শুক্রবার, ৩১ মার্চ, ২০১৭ ০০:০০ টা

মুখপোড়া পরী

গল্প ♦ ইমদাদুল হক মিলন

মুখপোড়া পরী

ও বাবা, পরীরা দেখতে কেমুন হয়?

পার্কের এদিকটায় বেশ কয়েকটি বকুল গাছ। এখন বকুল ফোটার সময়। ফলে গাছতলার সবুজ ঘাস, ফুল পাতাবাহারের ঝোপঝাড় আর হাঁটাচলার পথে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে বকুল ফুল। হাওয়ায় সারাক্ষণই ভাসে বকুলের তীব্র গন্ধ।

দুপুরের দিকে গন্ধটা একটু কম। কারণ রাতভর ঝরে পড়া ফুল সকালের আলো ফুটে উঠবার আগেই ফুলের কারবার করা টোকাইরা এসে কুড়িয়ে নিয়ে যায়। বেশ একটা চক্র আছে তাদের। সেই চক্রে শিশু-কিশোর-টোকাইদের সঙ্গে বয়স্ক নারী-পুরুষও আছে। কুড়ানো ফুল একত্র করে মালা গাঁথে তারা, ট্রাফিক সিগন্যালের আশপাশে ছুটে ছুটে বিক্রি করে। একেকটা দুটাকা, পাঁচ টাকা। বিদেশি খদ্দের পেলে দশ-বিশ টাকায়ও বিক্রি করে একেকটা মালা। এক-দুই ডলারও দিয়ে ফেলে কোনো কোনো বোকা বিদেশি। কেউ কেউ হয়তোবা দয়া করেও দেয়। এই বয়সী ছেলেমেয়েরা পেটের দায়ে কাজ করছে ভেবে মন হয়তো দ্রবীভূত হয় তাদের।

শুধু যে বকুলের কারবারটাই চলে এভাবে তা না, অন্যান্য ফুলও বিক্রি করে এই শ্রেণি। গোলাপ, রজনীগন্ধা, স্বর্ণচাঁপা। সিগন্যালে গাড়ি থামবার সঙ্গে সঙ্গে চারদিক থেকে টকটকে লাল গোলাপের থোকা, সবুজ ডাঁটির রজনীগন্ধা, স্বর্ণচাঁপা আর বকুলের মালা হাতে ছুটে আসে। নানা প্রকার অনুনয় বিনয়ে, করুণ মুখের অনুরোধে মানুষের মন গলিয়ে গছিয়ে দেয় হাতের জিনিস। সকাল-বিকেলের দিকে তাই পার্ক ও ট্রাফিক সিগন্যালে এই শ্রেণির খুব ভিড়। শুধু দুপুরের সময়টায় কম। সকালের রোজগার হাতে নিয়ে যে যার ডেরায় ফেরে এই সময়। দুপুরের ভাত খেয়ে বিকেলের মুখে মুখে আবার ফিরে আসে। নতুন করে শুরু করে কারবার। ফলে দুপুরটা ফাঁকা ফাঁকা, নির্জন। ট্রাফিক সিগন্যালের এলাকাগুলো, পার্কটাও। পথে-পার্কেই যাদের জীবন, সেই সব কাঙাল ভিখিরি ছাড়া আর কেউ তেমন থাকে না।

আজ আছে ফকু ও পরী। তারাও ভিখিরি। বাপ ও মেয়ে। তবে চাল চুলাহীন, সংসার জীবনহীন ভিখিরি ফকু না। পরীকে নিয়ে ভিক্ষা সে করে ঠিকই কিন্তু বেশ ভালো একখানা সংসার তার আছে। মাদারটেকের ওদিককার এক বস্তিবাড়িতে আট শ টাকা ভাড়ার ঘর আছে। সেই ঘরে বউ ও পরীকে নিয়ে চার মেয়ে। রমনা পার্কের এই এলাকা থেকে মাদারটেক অনেকটা দূরের পথ বলে সকালবেলা বস্তি থেকে বেরিয়ে দুপুরে আর সেখানে ফেরে না ফকু। একবারে রাতে ফেরে।

দশ-এগারো বছরের পরীর মুখের একটা দিক বীভৎস পোড়া। মেয়ের এই পোড়া মুখ সম্বল করেই ভিক্ষাটা ফকু করে। সাত-দশ দিন এক এলাকায় করেই জায়গা বদলায়। কারণ নিয়মিত চলাচল করা লোকেরা একজনকেই কাঁহাতক ভিক্ষা দেবে!

কিছুদিন ধরে ফকুর ভিক্ষার জায়গা শেরাটন এলাকার রাস্তা। পরীকে নিয়ে রাস্তার এদিক-ওদিক হেঁটে বেড়ায় সে, ফুটপাথে দাঁড়িয়ে থাকে। সিগন্যালে গাড়ি দাঁড়াবার পর মেয়ের হাত ধরে ছুটে যায়। মেয়ের পোড়া মুখ দেখিয়ে হাত পাতে। মাইয়াডার মুক অপরেশন করামু। যা পারেন সাহাইয্য করেন।

সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত চলে এই কাজ। তারপর রাস্তা যখন ফাঁকা হয়ে আসে, লোকজন, গাড়িঘোড়া যখন কমে আসে তখন ঘণ্টা-দেড় ঘণ্টা ভিক্ষা বন্ধ রাখে ফকু। মেয়ে নিয়ে পার্কের ছায়ায় এসে বসে। দুপুরের খাবার খায়।

খাবার বস্তি থেকেই নিয়ে আসে ফকু। মোটা মোটা পাঁচ-ছখানা লাল আটার রুটি। সঙ্গে একটুখানি চিনি কিংবা একদলা গুড়। রুটির সঙ্গে ভাজিভুজি, সবজি এসবও আনে কোনো কোনো দিন। ফুটপাথ থেকে প্লাস্টিকের সস্তা বক্স কিনে এনেছে। ওতে করেই আনে খাবার। কোনো কোনো দিন ভাত-তরকারিও নিয়ে আসে। ফকুর কাঁধে মোটা কাপড়ের যে থলেটা সব সময় আছে, খাবারের বাক্স আর একটা পুরানা গামছা থাকে সেই থলেতে। ফকুর সিগ্রেটের প্যাকেট, ম্যাচ এসবও থাকে।

খাবার ছিল আজ ভাত আর টাকি মাছের সঙ্গে মিষ্টি কুমড়ার তরকারি। বাপ-মেয়ে সেই খাবার খেয়েছে খানিক আগে। পার্কের কল থেকে পানি খেয়েছে। পানি খাওয়ার ফাঁকে ফকু নিজ হাতে ধুয়েছে দুজনের প্লাস্টিকের বক্স দুটো। ওই বক্সই তাদের থালা। তারপর মোটা একখানা বকুল গাছের গায়ে শরীর এলিয়ে, পা দুটো লম্বা করে খুবই আয়েশি ভঙ্গিতে বসেছে ফকু আর তার কোলের কাছে ঘাসে কাত হয়ে শুয়ে পড়েছে পরী।

ব্যাগ থেকে প্রায় বিড়ির মতোন দামের একটা সিগ্রেট বের করে যখন ধরিয়েছে ফকু, পরী তখন বাপের মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্নটা করল। ও বাবা, পরীরা দেখতে কেমুন হয়?

ফকু একটু তিরিক্ষি মেজাজের লোক। কথায় কথায় খেকিয়ে ওঠার স্বভাব। তার ওপর পেটের খিদা যত বাড়তে থাকে মেজাজও ততই খচতে থাকে তার। কিন্তু ভরপেট খাওয়ার পর সে একেবারেই অন্য মানুষ। ধীরস্থির, শান্ত, নম্র। সিগ্রেট টানতে টানতে গল্প করতে ভালোবাসে। যে কারও যে কোনো কথার জবাব দেয় হাসিমুখে।

দিনভর বাবার সঙ্গে থাকতে থাকতে তার এই স্বভাব জেনে গেছে পরী। সুতরাং তার যত কথা সব সে বলে বাবার খাওয়া শেষ হলে।

আজও বলল।

মেয়ের কথা শুনে সিগ্রেটে বড় করে একটা টান দিল ফকু। নাক-মুখ দিয়ে গলগল করে ধোঁয়া ছেড়ে মেয়ের মুখের দিকে তাকাল। পরীরা দেখতে বহুত সোন্দর হয় গো মা। শইল্লের রং হয় দুধের লাহান। মাথার চুল পাও পইরযন্ত লাম্বা। গরুর চোক্ষের লাহান বড় বড় চোখ। গোলাপ ফুলের পাপড়ির লাহান পাতলা পাতলা ঠোঁট। নাক হইল জোড়া দেওয়া তিলফুলের লাহান, গলা হইল সারস পাখির গলা। শইল আর হাত-পাও হইল দুনিয়ার সবথিকা সুন্দরী মাইয়াছেইলার থিকাও সোন্দর। খালি পিঠে পোরজাপতির পাখনার লাহান দুইখান পাখনা। পরীগো শইল্লে সব সমায় বকুল ফুলের গন্ধ।

তুমি পরী দেখছ, বাবা?

না গো মা। আমগো লাহান পোড়া কপাইল্লা মাইনষে পরী দেখব কই থিকা! যাগো কপাল ভালো তারা কেঐ কেঐ দেখছে। দ্যাশগেরামের নিরালা ফুলের বাগানে, টাউনের এই হগল পার্কে নিঝুম জোছনা রাইতে দুই-চাইর বচ্ছরে এক-দুইবার পরীরা আহে। তারা ফুল ভালোবাসে। এই লেইগা ফুলের বাগানে আহে। তাও দিনদোফরে কোনোদিন আহে না। আহে নিঝুম রাইতে। আন্ধার রাইতে আহে না। আহে জোছনা রাইতে। আইয়া ফুলের লগে খেলা করে। পরীরা ফুলের কথা বোঝে। ফুলেরাও বোঝে পরীগো কথা। যেই হগল ফুল নিঝুম রাইতে ফোটে, ওই হগল ফুল বলে পরীরাঐ ফোটায়।

পরীরা থাকে কই?

পরীস্থানে।

পরীস্থান জাগাডা কোনখানে?

আসমানে। আমগো মাথার উপরে যেই আসমান, হেই আসমান কইলাম একখান না। আসমান হইল সাতখান। পরীরা থাকে পয়লা আসমানে। পয়লা আসমানেঐ পরীস্থান জাগাডা।

ফুক ফুক করে দুবার সিগ্রেটে টান দিল ফকু। পরীস্থান পয়লা আসমানে ক্যান জানচ?

না। ক্যান?

পয়লা আসমান থিকা দুনিয়াডা হইল কাছে। ইচ্ছা হইলে নিঝুম রাইতে পরীরা যাতে উড়াল দিয়া ঐ দুনিয়াতে আইতে পারে, এর লেইগা। তয় এই সবঐ হইল আল্লার কুদরত। আল্লার কুদরত ছাড়া কিচ্ছু হয় না। গাছের পাতাও নড়ে না তার কথা ছাড়া।

হাতের সিগ্রেট একেবারে গোড়ার দিকে চলে এসেছে। আঙ্গুলে ছ্যাঁকা লাগছে ফকুর। তবু সিগ্রেটটা সে ফেলতে চায় না। গভীর মায়ায় তিন আঙ্গুলের মাথায় ঘুরিয়ে ধরে সিগ্রেটটুকু। ফলে আগুনের দিকটা চলে যায় হাতের তালুর দিকে। এই অবস্থায় বড় বড় করে দুটো টান দিয়ে তারপর ছুড়ে ফেলে।

বাবার এই কাণ্ডটা অপলক চোখে তাকিয়ে দেখছিল পরী। আচমকা বলল, আমার নামডা কে রাখছিল, বাবা?

ফকু হাসল। আমিঐ রাখছিলাম।

এমুন নাম ক্যান রাখছিলা? পরী?

তুই তো পরীর লাহান সোন্দরঐ হইছিলি। শইল হইছিল দুধের বরণ, চক্ষু হইছিল গরুর বাছুরের লাহান, ঠোঁট দুইখান গোলাপ ফুলের পাপড়ি, জোড় লাগাইন্না ছোট্ট তিলফুলের লাহান নাক। তর শইল্লেও বকুল ফুলের ঘেরান আছিল।

বাবার কথা শুনে পরী কেমন লজ্জা পেল। যাহ্!

হ। হাচা কথা। আমি তর লগে মিছা কথা কইতাছি না। জন্মের পর তর মুখখান দেইখা আমার মনে হইল তুই মানুষ না। আমগো বস্তির ঘরে তুই জন্মাছ নাই। তুই একখান পরীর বাচ্চা। জন্মাইছচ পরীস্থানে। পরীস্থান থিকা কে জানি তরে চুরি কইরা লইয়াছে। আইন্না আমগো বস্তির ঘরে, তর মার কুলের কাছে শোয়াইয়া দিয়া গেছে।

মায় তো আমারে কয় অন্য কথা।

কী কয়?

কয়, হওনের পর আমারে তুমি দুই চোক্ষে দেখতে পার নাই। মাইয়া তুমি পছন্দ করো না। সব সমায় চাইছ পোলা হউক তোমার। হইছে খালি মাইয়া। চাইরখান মাইয়া। এর লেইগা আমারে বলে তুমি মুখে নুন দিয়া মাইরা হালাইতে চাইছিলা। মাইয়া হইছে ক্যান, এর লেইগা মারে বলে তুমি একদিন লাকড়ি দিয়া বহুত পিডাইছ।

মেয়ের কথা শুনে ফকু একটু লজ্জা পেল। অন্যদিকে তাকিয়ে লাজুক হেসে বলল, হ, কথা সত্য। তয় কী করুম ক! তহন মনমিজাজ বহুত খারাপ আছিল। ঠেলাগাড়ির কাম করি। হারা দিন গাড়ি ঠেইল্লা পোনরো-ষোল্ল টেকার বেশি পাই না। তর মায় দুইবেলা বুয়ার কাম করে দুই বাসায়। আগের তিনডা মাইয়া তার মইদ্যে আবার তুই হইলি। এতডি মাইনষের সংসার কেমতে চালামু আমি! পোলা হইলে সুবিধা অনেক। ছোড ছোড পোলারাও কামকাইজ করে। সংসারের আয়-রোজগার বাড়ায়। মাইয়া থাকনের আর একখান অসুবিধা হইল, মাইয়া বড় হইলে পাহারা দিয়া রাখন লাগে। আপন বাপ-ভাই ছাড়া দুনিয়ার বেবাক বেডারাঐ তক্কে তক্কে থাকে কুন সমায় কোন মাইয়াডার ওপরে চানস লইব। তার বাদে আবার বিয়াশাদি দেওনের কাম থাকে। আইজকাইল একহান মাইয়া বিয়া দিতে ম্যালা খরচা। বাপ-মার জান বাইর হইয়া যায়। জামাইরে এইডা দেও, ওইডা দেও। নগদ টেকা দিয়াও মাইয়া বিয়া দেওন লাগে। যৌতুক দিতে না পারলে মাইয়াডিরে মাইরাও হালায় জামাইরা। কত পদের ঝামেলা মাইয়াগো লইয়া। পোলা থাকলে এই হগল ঝামেলা থাকে না। পোলারা তো রুজি-রোজগার কইরা খাওয়ায়, পোলা বিয়া করাইয়া উল্টা যৌতুকও পাওয়া যায়। খাটপালং, সোনাদানা, নগদ টেকা।

বাপের সঙ্গে রাস্তাঘাটে চলেফিরে এই বয়সেই দুনিয়া অনেকখানি বুঝে গেছে পরী। ফকুর কথা সবই বুঝল সে। এতক্ষণ চিৎ হয়ে শুয়ে বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল। এবার উঠে বসল। তয় মাইয়ারাও আইজকাইল রুজি-রোজগার করে। আমার বড় তিনডা বইনরে গারমেনটে কামে লাগাইয়া দিছ তুমি। সাত-আট শ কইরা মাসে রুজি করে এহেকজনে। আমার থিকা বেশি বড় না, তাও তো রুজি করতাছে। আরও বড় হইলে আরও বেশি রুজি করব।

হ, হেইডা করব।

তয়? তয় পোলা আর মাইয়াতে তাফাত কী? মাইয়া হইয়া আমিও তো রুজি করতাছি। করতাছি না বাবা?

পরীর শেষ কথাটা যেন শুনতে পেল না ফকু। বলল অন্য কথা। তর বড় তিন বইনে তো রুজি কইরা জানডা বাঁচাইছে আমার। তরা চাইর বইন আর আমি এই পাঁচজনে মিল্লা রুজি করি। খালি তর মায়ঐ করে না।

করতে তো চায়। আগে বুয়ার কাম করছে না! হেই কাম দুইবেলা করলেও তো পাঁচ-ছয় শ টেকা রুজি হয়। তুমি করতে দেও না।

দেই না নিজেগো সুবিধার লেইগা। বিয়ানে উইট্টা আমরা পাঁচজন মানুষ কামে যাই। আমগো খাওনদাওনডা রাইন্দা দিব কেডা? বেবাক ঠিকঠাক কইরা দিব কেডা? বাজারঘাট করব কেডা? ক?

পরী কথা বলল না।

ফকু বলল, তর বড় তিন বইনে কাম করে ঠিকঐ, অগো তিনজনের রুজি দিয়াঐ সংসার চইল্লা যায়। তর-আমার রুজিতে হাত দেওন লাগে না। তয় এই দিন তো থাকব না।

ক্যা?

মাইয়ারা ডাঙ্গর হইলে তাগো বিয়া দেওন লাগব না?

হ, তা তো লাগবই।

বিয়ার পর তারা চইলা যাইব জামাইবাড়ি। তহন তো আর রুজি কইরা খাওয়াইতে পারব না আমারে।

ক্যান পারব না! বিয়াতো মাইয়ারাও তো গারমেনটে কাম করে?

কথাটা পরী শিশুর ভঙ্গিতে বলল। শুনে হাসল ফকু। হ, করে। তয় বেতনের টেকা তো আর মা-বাপরে দেয় না। দেয় জামাইরে।

এবার ব্যাপারটা বুঝল পরী। হ, বুজছি।

তার বাদে তিনহান মাইয়া বিয়া দেওনের খরচা আছে না! হেই টেকাডি আমার লাগব না! তর-আমার কামাই-রুজির যেই টেকা অহন জমাইতাছি, এই টেকার বেবাকঐ যাইব গা তিন মাইয়ার বিয়ায়। অহন মাইয়ারা রুজি কইরা আমারে খাওয়াইতাছে ঠিকঐ, এর থিকা দুই-তিন ডবল যে আমার যাইব গা তাগো বিয়ায়! তয় পুরাডাঐ আমার লছ না? এর লেইগাঐ কই, মাইয়া থাকনের কোনো লাভ নাই। তুই হওনের পর এর লেইগাঐ আমি চেইত্তা গেছিলাম।

পরী কথা বলল না। আনমনা হয়ে রইল।

ফকু আবার একটা সিগ্রেট ধরাল। টান দিয়ে বলল, এই হগল ছাড়াও আর একহান বিরাট খরচা আছে আমার। ডাঙ্গর হইলে তরেও তো বিয়া দেওন লাগব। মুখপোড়া মাইয়া কেঐ বিয়া করব না। এর লেইগা তর অপরেশনডা করান লাগব।

তারপর যেন নিজের কাছে বলছে এমন গলায় বলল, কপালডাঐ খারাপ আমার। এমুন পরীর লাহান সোন্দর মাইয়া হইলি তুই, ডাঙ্গর হইলে তরে বিয়া দেওনের লেইগা কোনো চিন্তাঐ করন লাগত না। তরে উল্টা যৌতুক দিয়া বিয়া কইরা নিত জামাইয়ে। হেই মাইয়া তুই, তর গেল মুখহান পুইড়া। কামের থিকা আইয়া বস্তির ঘরে রান্দন চড়াইছে তর মায়, মার বুকের দুধ খাইতে গিয়া তর মুখহান পুইড়া গেল চুলায়। মুখের একদিক পুইড়া ছেড়াভেড়া হইয়া গেল।

সিগ্রেট টানার ফাঁকে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল ফকু। দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গেও নাক-মুখ দিয়ে ধোঁয়া বেরোল তার। তারপর যেন সান্ত্বনা দিচ্ছে পরীকে এমন গলায় বলল, তয় তুমি চিন্তা কইরো না গো মা। আমি হুনছি অপরেশন করলে তোমার মুখের পোড়া দাগ আর থাকব না। আগের লাহান সোন্দর হইয়া যাইব তোমার মুখ। তোমারে বিয়া দিতে কোনো অসুবিধা হইব না। টেকাটা ইট্টু বেশি লাগব আর কী! লাগুক। তুমি আর আমি মিল্লা দুই-তিন শ কইরা টেকা রুজি করি এহেকদিন। এইডারে তুমি ভিক্কা কইতে পার না। আমরা চাই সাহাইয্য। তোমার পোড়া মুখ অপরেশনের লাইগা সাহাইয্য। ভিতরে ভিতরে যে অন্য চিন্তা আমগো হেইডা তো আর মাইনষে জানে না! জানি খালি আমরা কয়জনে। তোমার তিন বইনের বিয়া হইয়া গেলে তোমার অপরেশনটা আমি করামু। তার বাদে তোমারে বিয়া দিমু।

মেয়ের ব্যাপারে মায়াটা ফকুর একটু বেশি চাগা দিলে তাকে সে তুমি তুমি করে বলে। এখন সেই অবস্থা চলছে।

কিন্তু পরী আছে চুপচাপ হয়ে, উদাস হয়ে। অনেকক্ষণ কোনো কথা বলছে না।

ব্যাপারটা খেয়াল করল ফকু। বলল, কী গো মা, কী হইছে তোমার? এমুন চুপ কইরা আছ ক্যান?

বাপের মুখের দিকে তাকিয়ে পরী বলল, অপরেশনের পর আমারে যহন তুমি বিয়া দিবা, হেই বিয়ার খরচা তুমি পাইবা কই?

সিগ্রেটে টান দিয়ে হাসল ফকু। ডাক্তর সাহেবগো হাতে-পায়ে ধইরা অপরেশনের খরচা অনেক কমাইয়া ফালামু মা। যেই টেকা বাঁচব হেই টেকা দিয়া তোমার বিয়া দিমু।

কত দিন বাদে?

এই ধরো সাত-আষ্ট বচ্ছর।

তহন তো তুমি আর মায় বুড়া হইয়া যাইবা!

হ, বুড়া তো হমুঐ।

বুড়া হইলে তো রুজি-রোজগারও করতে পারবা না।

হু, কেমতে পারুম! শইল্লে জোরবল না থাকলে কাম করুম কেমতে! তর মায় আর আমি তহন ভিক্কা কইরা খামু। ভিক্কা করতে করতে রাস্তাঘাডে পইড়া মইরা থাকুম।

একটু থামল ফকু। তারপর বলল, এর লেইগাঐ পোলা চায় মাইনষে, বোজছস? মা-বাপ বুড়া হইয়া যায়, পোলারা তাগো রোজগার কইরা খাওয়ায়। এইডাঐ দুনিয়ার নিয়ম। তুই হওনের পর এই হগল চিন্তা কইরাঐ চেইত্তা গেছিলাম আমি।

বাপের মুখের দিকে তাকিয়ে উদাস গলায় পরী বলল, বুজছি। তোমার বেবাক কথাই আমি বুজছি বাবা। তয় আমারে লইয়া তুমি চিন্তা কইরো না। যেমতে যেমতে চিন্তা করছ ঠিক অমতে কইরা তিন মাইয়ারে বিয়া দিয়ো। আমার পোড়া মুখের অপরেশন তোমার করন লাগব না। আমার বিয়াও দেওন লাগব না। তিন মাইয়ার বিয়া দেওনের পর তুমি আর মায় যহন বুড়া হইবা, তহন আমি তোমগো দুইজনরে রুজি কইরা খাওয়ামু। এই পোড়া মুখ দেহাইয়া আমি একলা একলা ভিক্কা করুম। হারা দিন ভিক্কা কইরা তোমগো দুইজনের লেইগা চাইল মাছ তরকারি কিন্না লইয়া যামু। তোমরা মনে কইরো আমি তোমগো মাইয়া না, আমি তোমগো পোলা। মা-বাপ বুড়া হইলে পোলারা তাগো রুজি কইরা খাওয়ায়, আমি তোমগো খাওয়ামু।

ততক্ষণে দুপুর ফুরিয়ে এসেছে। পার্কের গাছপালায় ধীরে এগোচ্ছে বিকালের ছায়া। দেখে ছটফটে ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়াল পরী। ওডো বাবা। বিকাল হইয়া গেছে। দেরি করলে ভিক্কা কম পামু।

ফকু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠল।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর