শুক্রবার, ৭ এপ্রিল, ২০১৭ ০০:০০ টা

যুধিষ্ঠিরের কুকুর

গল্প ♦ স্বকৃত নোমান

যুধিষ্ঠিরের কুকুর

যুধিষ্ঠির বললেন, এই কুকুর আমার ভক্ত, একেও আমার সঙ্গে নিতে ইচ্ছা করি। ইন্দ্র বললেন, যার কুকুর থাকে সে স্বর্গে যেতে পারে না। যুধিষ্ঠির বললেন, নিজের সুখের জন্য আমি এই কুকুরকে ত্যাগ করতে পারি না।

—মহাভারত; মহাপ্রস্থানিকপর্ব

খামারবাড়ি মোড়ে নেমে ইন্দিরা রোড ধরে ফার্মগেটের দিকে হাঁটা ধরলে দেখা যাবে একটা কাঁচাবাজার। বাজারের ঠিক মাঝখানে ফুটপাতের ছোট্ট ঐ বটগাছটার নিচে রাস্তার ওপর সিটি করপোরেশনের ডাস্টবিনের কাছে দেখা যাবে মোটাসোটা একটা কুকুর শুয়ে। এমন স্বাস্থ্যবান কুকুর শহরে খুব কমই দেখা যায়। ডাস্টবিনের উচ্ছিষ্ট খেয়ে খেয়ে হয়ত শরীরটার এই কন্ডিশন করেছে। হয়ত সে অলস। খাবারের জন্য সারাক্ষণ ছুটে বেড়ানো পোষায় না তার। কিংবা এমনও হতে পারে, তার শরীরে দুরারোগ্য কোনো ব্যাধি বাসা বেঁধেছে। নইলে এমন বেখাপ্পা টাইপের মোটা হবে কেন। খেলে কি এত মোটা হয়? বাজারে আরও যেসব কুকুর আছে তারা কি কম খায়? তারা তো তার মতো এত মোটা নয়।

ঠিক ঐ জায়গাটায় সারাক্ষণ শুয়ে থাকে। হয়ত ঘুমায়। কিংবা চোখ বুজে ঝিমায়। হয়ত উঠে দাঁড়ানোর শক্তি পায় না বলে মাথাটা বুকে গুঁজে সারাক্ষণ ওভাবে পড়ে থাকে। গায়ে মশা-মাছি বসলেও নড়েচড়ে না। গাড়ির তীক্ষ্ন হর্নেও সচকিত হয় না। এসব নাগরিক কোলাহলে সে অভ্যস্ত। মাঝেমধ্যে ডাস্টবিনের উচ্ছিষ্ট নিয়ে কুকুরের দলের কামড়াকামড়ি লেগে গেলে মাথাটা তুলে এক পলক দেখে নেয়, তারপর যথারীতি বুকের কাছে মাথাটা গুঁজে নেয়। ভাবে, এ আর এমন কি। এমন কামড়াকামড়ি তো প্রায়ই লাগে। বাজারের অন্য কুকুরগুলো তার ধারেকাছে ঘেঁষে না খুব একটা। তার সঙ্গে মেশে না। কেউ তাকে ঘাঁটায়ও না। মাঝেমধ্যে কেউ কেউ এসে তার গা শোঁকে। মরে গেছে না বেঁচে আছে হয়ত বোঝার চেষ্টা করে। খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে লেজ নাড়ে, হাই তোলে, গা চুলকায়। তারপর ধীরপায়ে চলে যায়।

কুকুরটি খায় কখন কেউ দেখে না। সারা দিনে আদৌ কিছু খায় কিনা কেউ জানে না। সে তো মানুষ নয়। ফুটপাতে আর পার্কে যেসব মানুষ থাকে তাদের খাওয়া না-খাওয়া নিয়েই তো কারও মাথাব্যথা নেই। সে তো তুচ্ছ একটা কুকুর, তার খাওয়া না-খাওয়া কেউ কি আর খেয়ালে রাখে? হয়ত সে খায়। রাতে বাজারের উল্টোদিকের সানমুন রেস্টুরেন্টের যে উচ্ছিষ্ট ডাস্টবিনে জমা হয়, শেষ রাতে, অন্য কুকুরেরা যখন ঘুমিয়ে পড়ে, তখন সে ধীরেসুস্থে উঠে পেট ভরে খেয়ে নেয়। সারাদিন আর কিছু খায় না। প্রয়োজন পড়ে না। কোনো কোনো রাত আবার না খেয়েই কাটিয়ে দেয়। বিশেষত বৃষ্টির রাতগুলোতে। বেদখল যাত্রীছাউনির বেঞ্চিটার নিচে সারা রাত বেঘোরে ঘুমায়। বৃষ্টি থামলে আবার আগের জায়গায় এসে শুয়ে পড়ে। এক শোয়াতেই দিন কাবার।

একটা কুকুর দিনের পর দিন একই জায়গায় শুয়ে থাকার ব্যাপারটা কেউ ঠিক খেয়াল করেনি। হয়ত করেছে। কিন্তু এ নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না। এটা কি মাথা ঘামানোর মতো ব্যাপার? মানুষের কত কাজ, কত ব্যস্ততা। দিন-রাত মানুষ ছুটছে... ছুটছে। একটা কুকুরের ভালো-মন্দ নিয়ে মাথা ঘামানোর মতো সময় কোথায়।

ঘামায় শুধু একজন, বটগাছের নিচে ফুটপাতের এক পাশে বসা কাশিরাম মুচি। রোজ ভোরে বাক্স-পেটারা ঝাড়মোছ দিতে দিতে কুকুরটির দিকে তাকিয়ে সে বলে, কী খবর মোটকু? আছিস কেমন? কুকুরটি তখন কান দুটো নাড়া দেয়। মাথাটা তুলে একবার ঘেউ করে ওঠে। ওটাই তার সাড়া। তারপর আবার মাথাটা গুঁজে নেয়। কেউ সারা দিন মোটকু মোটকু বলে মুখে ফেনা তুলে ফেললেও মাথাটি আর তুলবে না। বহুদিন ধরে কাশিরামের ঐ জিজ্ঞাসাটা শুনতে শুনতে সে অভ্যস্ত। কথাটা তার কানে গেলেই বুঝতে পারে গলাটা কার। সাড়া দেওয়াটা তখন তার কর্তব্য হয়ে পড়ে। আর রোজ রোজ ঐ কথা দুটি বলাটা কাশিরামের অভ্যাসে দাঁড়িয়েছে। একদিন জিজ্ঞেস না করলে তার মনে হয় দিনটা আজ ভালো যাবে না। কাস্টমার জুটবে না। পুলিশের ঠ্যাঙানি খাবে।

দিনের বেশিরভাগ সময় কাশিরামের চোখ দুটো বলতে গেলে কুকুরটার ওপরই থাকে। শহরের ব্যস্ততম এলাকা ইন্দিরা রোড। কাস্টমার লেগেই থাকে, নাক চুলকানোরও ফুরসত নেই। বেশিরভাগই স্যু। স্যান্ডেল খুব কমই আসে। এলেও সেই পালিশের কাজ। সেলাই-টেলাই দিতে হয় না তেমন। ঢাকা শহরে বড় লোকদের কারবার, কে আসে ছেঁড়া জুতো নিয়ে। জুতোয় ব্রাশ করতে করতে কাশিরামের হাত আর মাথা সমানতালে দোলে, আর চোখ দুটো স্থির হয়ে থাকে কুকুরটার দিকে। ব্রাশ করার সময় কুকুরটার দিকে তাকিয়ে থাকাটাও তার অভ্যাস হয়ে গেছে। নিজের অজান্তেই চোখ দুটো ওদিকে চলে যায়। অন্যদিকে ফেরালেও মুহূর্তে আবার আগের জায়গায় এসে স্থির হয়। তাকিয়ে থাকতে থাকতে প্রায়ই যুধিষ্ঠিরের কুকুরের কথা মনে পড়ে তার। ছোটবেলায় মাস্টারের মুখে শুনেছিল যুধিষ্ঠিরের কুকুরের কথা। এখনো স্পষ্ট মনে আছে।

রাতে বাসায় ফেরার জন্য যখন বাক্স-পেটরা গোছায়, শেষবারের মতো কুকুরটার দিকে তাকায় কাশিরাম। তখন বলতে ইচ্ছা করে, কীরে মোটকু, খাবি না? মাঝেমধ্যে বলেও। কুকুরটা তখন সাড়া দেয় না। কেন দেয় না? কাশিরামের চলে যাওয়াটা হয়ত সে মেনে নিতে পারে না। তাই অভিমান করে থাকে।

কুকুরটার প্রতি কাশিরামের মনে আসলে এক ধরনের মায়া জন্মে গেছে। জন্মানোটাই স্বাভাবিক। কতদিন ধরে দেখছে। কতদিন একসঙ্গে আছে। একসঙ্গেই তো। ফুটপাতের বটতলা থেকে ডাস্টবিনের কতটুকুই বা দূরত্ব। বছর তিন আগে সে যখন এই বটতলায় বাক্স-পেটরা নিয়ে বসে, তখন থেকেই কুকুরটাকে দেখছে। তখন বয়স কম ছিল কুকুরটার। স্বাস্থ্যও এমন ছিল না। তেলতেলে টানটান শরীর। সারা বাজার দাপিয়ে বেড়াত। কামড়াকামড়িতে বাজারের অন্য কুকুরগুলো তার সঙ্গে পেরে উঠত না। সারাক্ষণ কেবল খাই খাই করত। জিবটা বের করে রাখত হরদম। খাবারের বাছবিচার ছিল না। খাওয়ার উপযোগী সামনে যা পেত তা-ই মুখে তুলে নিত। আর কতক্ষণ পর পর ডাস্টবিনটার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে এক ঠ্যাং তুলে মূত্রথলিটা খালি করত। হেগেও দিত মাঝেমধ্যে। কাশিরামের তখন রাগ উঠত খুব। মনে পড়ে যেত শৈশবে স্কুলমাস্টারের মুখে শোনা ইন্দ্রের সেই বাণী— যার কুকুর থাকে সে স্বর্গে যেতে পারে না। ঘৃণায় তখন তার নাক-চোখ-মুখ কুঁচকে যেত। সামনে পুরনো স্যান্ডেল-জুতো যা পেত কুকুরটার উদ্দেশে ছুড়ে মারত। শালা বেজন্মা! হাগার আর জায়গা পেলি না! একদিন তো আস্ত হাতুড়িটা ছুড়ে মারল মাথা বরাবর। কুকুরটা কুঁইকুঁই করে ছুট দিল রাস্তার উল্টোদিকে। অল্পের জন্য বাসের চাকার নিচে পড়ল না। স্পিডব্রেকারটা না থাকলে চ্যাপ্টা হয়ে যেত নিমিষে। তারপর বেশ কদিন কুকুরটাকে আর দেখা গেল না। কাশিরাম ভাবল, মরেটরে গেল নাকি! না মনে হয়। কুকুরের প্রাণ, এত সহজে কি মরবে! ভয়ে হয়ত এলাকা ছেড়েছে। কিংবা বাজারেই আছে, ভয়ে কাশিরামের আশপাশ ঘেঁষছে না।

কদিন পর সানমুন রেস্টুরেন্ট থেকে নাস্তা করে ফেরার পথে কাশিরাম দেখল, রাস্তার উল্টোদিকের ফুটপাতে দুটো কুকুর পাছার সঙ্গে পাছা লাগিয়ে দাঁড়িয়ে। জিব বের করে দিয়ে হাঁপাচ্ছে। চোখে ভীতির ছাপ। ভালো করে ঠাওর করে দেখল কাশিরাম, দুটোর একটি ঐ কুকুরটা, যার মাথায় সে হাতুড়ি ছুড়ে মেরেছিল। দ্রুত সে চোখ সরিয়ে নিল। চারদিকে তাকিয়ে দেখল তাকে কেউ দেখছে কিনা। ভারি লজ্জার ব্যাপার। কুকুর হলে কী হবে, ব্যাপারটা তো মানুষের মতোই। এমন একটা ন্যাকেড দৃশ্যের দিকে সে তাকিয়ে, লোকে দেখলে কী ভাববে তাকে। মুখে হাসির একটা রেখা ফুটিয়ে দ্রুত সে নিজের জায়গায় এসে বসে পড়ল। কিন্তু চাইলেই কি চোখ ফিরিয়ে রাখা যায়? রাস্তার লোকজন ঐ দৃশ্যের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে। প্যান্ট-স্যুট আর টাই পরা এক ভদ্রলোক তো ওদিকে তাকিয়ে হাঁটতে গিয়ে এক বাদামঅলার সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে পড়ে যেতে লেগেছিল। অল্পের জন্য পড়েনি। তাছাড়া স্কুল ছুটি হয়েছে। ছাত্রছাত্রীরা বাড়ি ফিরছে। তাদেরও চোখও এড়াচ্ছে না দৃশ্যটি। লেগুনার পুচকে কন্ডাক্টররা হুই-হাই করে মজা লুটছে।

কাশিরামের মাথায় তখন রাগ ওঠে। শালা কুত্তার বাচ্চা কুত্তারা লাগানোর আর জায়গা পেল না। পেছন থেকে এক সবজিঅলা বলে উঠল, সিটি করপোরেশন কী করতাছে বইসা বইসা। কুত্তাগুলো মারার ব্যবস্থা করে না ক্যান? কথাটা শুনে কাশিরামের রাগ গেল আরও চড়ে। কোত্থেকে একটা বাঁশের টুকরো কুড়িয়ে এনে এক ছুটে রাস্তা পার হয়ে কুকুরটার মাথায় মারল জোরসে বাড়ি। কিন্তু বাড়িটা মাথায় লাগল না, লাগল জায়গামতো, দুই পাছার ঠিক মাঝ বরাবর। দীর্ঘ সময়ের গিট্টু এক বাড়িতেই গেল ছুটে। মুক্তি পেয়ে সুখক্লান্ত প্রাণী দুটো দুইদিকে ছুটে গেল।

ডাস্টবিনটার কাছে কুকুরটা আসন নেওয়ার বছরখানেক পরের কথা। দেশজুড়ে তখন টার্গেট কিলিং চলছে। আজ এখানে তো কাল ওখানে। দেশের উত্তর-দক্ষিণ, পূর্ব-পশ্চিম রঞ্জিত হতে লাগল রক্তে। লেখক, প্রকাশক, শিক্ষক, ইমাম, বিদেশি, পুরোহিত, যাজক চাপাতির বলি হতে লাগল। জনসমাগমে মানুষের কল্লা ফেলে দিচ্ছে ঘাতক, কেউ এগিয়ে আসছে না আক্রান্তকে বাঁচাতে। কে চায় চাপাতির বলি হতে। কে চায় ঘাতকদের টার্গেট হতে। পুলিশের সামনে লাশ ফেলে দিচ্ছে, হামলা হচ্ছে খোদ পুলিশের উপরও, আর পাবলিক তো পাবলিক।

সেদিন সকালে কুকুরটা ছিল সানমুন রেস্টুরেন্টের সামনে। মানুষের গাদাগাদি রেস্টুরেন্টের ভিতরে। ম্যাসিয়ার নাস্তা দিয়ে কুলিয়ে উঠছে না। সকাল আটটা। অফিসের সময় হয়ে আসছে। সবাই ব্যস্ত। নাস্তার জন্য ম্যাসিয়ারকে তাড়ার পর তাড়া দিচ্ছে কাস্টমাররা। গ্যাসের চুলার নিচে বসে নেহারির হাড্ডি চিবুচ্ছিল কুকুরটা। রেস্টুরেন্টে হন্তদন্ত হয়ে ঢুকতে গিয়ে এক কাস্টমারের চোখ আটকে গেল সেদিকে। নাক-মুখ কুঁচকে স্বগতোক্তি করল, বিচ্ছিরি পরিবেশ। ম্যানেজারের কান এড়াল না কথাটা। কুকুরটা দেখে তার মেজাজও গেল চড়ে। চেয়ার থেকে ওঠে সিঙ্গারা ভাজার লম্বা ডাঁটঅলা চাকনিটা হাতে নিয়ে কুকুরটাকে দিল ধাওয়া। হাড্ডিটা ফেলে এক ছুটে রাস্তায় ওঠে এলো কুকুরটা। তখন, ফুটপাতে যে লোকটা চিতই পিঠা বেচে, চুলা থেকে একটা জ্বলন্ত লাকড়ি বের করে ছুড়ে মারল তার দিকে। লক্ষচ্যুত হলো। হবে না? কুকুর বড় সেয়ানা প্রাণী। পিঠাঅলার হাতটা উপরে উঠতে দেখেই সে দিল ছুট। লাকড়িটা পড়ল গিয়ে এক পথচারীর পায়ের কাছে।

আর ওদিকে তখন হুলুস্থূল। খামারবাড়ি মোড়ের দিক থেকে একটা লোক ছুটছে ফার্মগেটের দিকে। পরনে প্যান্ট, গায়ে সাদা গেঞ্জি, পায়ে চামড়ার স্যান্ডেল। তাকে ধাওয়া করছে দুই তরুণ। একজনের মুখে চাপদাড়ি, পরনে পাজামা-পাঞ্জাবি। আরেকজনের ক্লিনশেভ মুখ, পরনে প্যান্ট-শার্ট। দুজনের পিঠে দুটো কালো ব্যাগ। দুজনের হাতেই ধারালো চাপাতি। বাক্স-পেটরা ঝাড়মোছ দিচ্ছিল কাশিরাম। তরুণ সূর্যের আলোয় চাপাতিটা চিকিয়ে উঠতে দেখে বুকটা ধপ করে উঠল তার। কদিন আগেও পাবনায় এক পুরোহিতকে গলা কেটে মেরেছে। রামকৃষ্ণ মিশনের প্রধান পুরোহিতকেও হুমকি পাঠিয়েছে। বাক্স-পেটরা ফেলে সেও দিল ছুট। পথচারীরা যে যেদিকে পারছে ছুটে পালাচ্ছে। রাস্তার মোড়ে ডিউটিরত কনস্টেবলটা রেস্টুরেন্টে ঢুকে পড়েছে। সবজিঅলা, মুরগিঅলা, মুদিঅলা, পানঅলা, সিগারেটঅলা, পিঠাঅলা, বাদামঅলা আর চানাচুরঅলারাও পালাচ্ছে।

ছুটতে ছুটতে লোকটা যখন ডাস্টবিনটার সামনে এলো, পেছন থেকে দুই চাপাতিঅলার একজন তার ঘাড়ে মারল এক কোপ। ঘাড়ে না লেগে কোপটা লাগল পিঠে। কুকুরটা তখন বটগাছের অদূরে যাত্রীছাউনির বেঞ্চিটার তলায়। সহসা তুমুল শব্দে ঘেউ ঘেউ করতে করতে বিজলির গতিতে ছুটে এলো অকুস্থলে। তাকে ছুটে আসতে দেখে দুই চাপাতিধারীর একজন ছুট লাগাল রাস্তার উল্টাদিকে। আক্রান্তের ঘাড় লক্ষ্য করে ততক্ষণে দ্বিতীয় কোপটা চালিয়ে দিল আরেকজন। ধড়-মুণ্ডু আলাদা হয়ে যেত, যদি না চাপাতিধারীর পা-টা কামড়ে ধরত কুকুরটা। আক্রান্ত লোকটি মুখ থুবড়ে পড়ে গেল রাস্তায়। রক্তে ভিজে যেতে লাগল তার সাদা গেঞ্জি। কুকুরের কবল থেকে ছাড়া পেতে চাপাতিটা ঘাতক চালিয়ে দিল কুকুরটার পিঠে। কিন্তু কোপটা পড়ল গিয়ে মাটিতে। পা ফসকে উপুড় হয়ে পড়ে গেল সে। চাপাতিটা ছিটকে পড়ল হাত থেকে। কুকুরটা তখন তার বুকে চড়ে বসে কামড়ে ধরল তার থুতনিটা। কুকুরটাকে এক ঝটকায় বুক থেকে সরিয়ে দ্রুত ওঠে বসল ঘাতক। এবার কুকুরটা কামড়ে ধরল তার পা। দুই হাতে ভর দিয়ে দাঁড়াল ঘাতক। তারপর দিল ছুট। কুকুরটা গলাফাটানো শব্দে ঘেউ ঘেউ করতে করতে তার পেছনে ছুটতে লাগল।

ফার্মগেট ওভারব্রিজের কাছে গিয়ে কুকুরটা থামে। ঘাতককে খোঁজে। পায় না। ওদিকে তো মানুষ আর মানুষ। ঘাতক মিশে গেছে মানুষের ভিড়ে। কুকুরটা এক ছুটে আবার আহত রক্তাক্ত লোকটার কাছে ফিরে এলো। লোকটা তখনো মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। মরেনি। পলায়নরত পথচারীরা এবার থামে। এগিয়ে আসতে থাকে অকুস্থলের দিকে। বটগাছের আড়াল থেকে কাশিরামও বেরোয়। সবজিঅলা, মুরগিঅলা, মুদিঅলা, পানঅলা, সিগারেটঅলা, পিঠাঅলা, বাদামঅলা আর চানাচুরঅলারাও এগিয়ে আসতে থাকে।

খানিকের মধ্যে আহত লোকটার চারদিকে লেগে গেল মানুষের ভিড়। এক পথচারী পকেট থেকে মোবাইল বের করে আহতের ছবি তুলে নিল ঝটপট। রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে ছুটে এলো কনস্টেবলও। তার আনকোরা পোশাক অথবা হাতের জালিবেতটা দেখে কিনা কে জানে, হঠাৎ ঘেউ ঘেউ করে উঠল কুকুরটা। কনস্টেবল বেতটা উঁচিয়ে তাকে শাসাল। তাতে আরও জোরে ঘেউ ঘেউ করতে লাগল কুকুরটা।

মানুষের ভিড় বাড়তে থাকে ক্রমে। কুকুরটা তখন ডাস্টবিনের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে, পুবদিকে ফিরে, জনতার দিকে বাঁ ঠ্যাংটি উঁচু করে পেশাব করতে লাগল। ছরছর শব্দে সে মূত্রথলি খালি করতে থাকে। তার পেশাবের বেগ পেয়েছে খুব।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর