শুক্রবার, ১৯ মে, ২০১৭ ০০:০০ টা

বাবার কথা মনে পড়ে

নিবন্ধ ♦ ফারুক চৌধুরী

বাবার কথা মনে পড়ে

বাবার তিরোধান ছিল আকস্মিক। ১৯৭১-এর ২৪ জানুয়ারি, সাভার থেকে মোটরযাগে ঢাকা ফেরার পথে সড়ক দুর্ঘটনায় পতিত হন। মস্তিষ্কে গুরুতরভাবে আঘাতপ্রাপ্ত বাবা, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়লেন তিনটি দিন; প্রাণত্যাগ করলেন ২৭ জানুয়ারি ১৯৭১-এ। না, বাংলাদেশের অভ্যুদয় তিনি দেখে যাননি— জেনে যাননি যে, আমাদের মুক্তি আর স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রারম্ভেই যশোরে শহীদ হয়েছিল তাঁরই জ্যেষ্ঠ জামাতা কর্নেল সৈয়দ আবদুল হাই। মাত্র ৩২ বছর বয়সে তিনটি নাবালক সন্তান নিয়ে আমার বোন নাসিম বিধবা হলো। এতে অসহনীয় আঘাত বাবা নিশ্চয়ই পেতেন, তবে তাঁকে যদি জেনে থাকি, নির্দ্বিধায় বলতে পারি তার সেই গভীর বেদনায় মিশে থাকত অপরিসীম গর্ব। বাবা সাহসী মানুষকে ভালোবাসতেন আর শহীদ তার বীর জামাতার রক্ত তো মিশেই আছে আরও লক্ষ বীর শহীদের রক্তস্রোতে।

সেই সড়ক দুর্ঘটনায় গাড়িতে আমার ছোট ভাই ইনাম আর আমিও ছিলাম। অলৌকিকভাবে বেঁচে গিয়েছিলাম আমরা দুজন। বাবা যখন হাসপাতালে মৃত্যুশয্যায়, আহত ইনাম যখন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন তবে শঙ্কামুক্ত, তখন প্রতিটি মুহূর্ত কাটছিল গভীর উৎকণ্ঠায়। আশ্চর্য হলেও সত্য যে, বাবারই বহুবার বলা একটি কথায় কিছুটা হলেও সান্ত্বনা পেতাম। বাবা বলতেন, জীবনে যদি বিপদের মুখোমুখি হও, এটা মনে রেখো যে, যা ঘটেছে তার চেয়েও ভয়াবহ বিপদও তো ঘটতে পারত। হ্যাঁ, তাই ঘটত, যদি একটি সীমিত আয়ের মধ্যবিত্ত উঠন্ত পরিবার থেকে আমরা তিনজন একযোগে অন্তর্হিত হতাম। পরিবারটি অকূল সাগরেই ভাসত, বিশেষ করে সেই দুর্ঘটনায় দু’মাস পরেই যখন আমাদের ভগ্নিপতি শহীদ হলেন। মৃত্যুশয্যা থেকেও বাবার উচ্চারিত জীবনধর্মী নিগূঢ় একটি বচন; কিছুটা হলেও বাস্তবতাকে গ্রহণ করার শক্তি জুগিয়েছিল।

চা-বাগানে কর্মরত আমার ডাক্তার দাদার রক্তপাতজনিত অকালমৃত্যুর কারণে বাবার শিক্ষালাভের দায়িত্ব মূলত তার নিজের উপরই বর্তেছিল। সেই বিচারে বাবা ছিলেন আত্মপ্রতিষ্ঠিত একজন ব্যক্তি। শুনেছি, ভারতের আসামে একটি চা বাগানে চিরনিদ্রায় শায়িত আমার ডাক্তার দাদা নাকি জীবন বীমার মাত্র তিন হাজার টাকা রেখে গিয়েছিলেন, আর তাছাড়া ছিল ঘরবাড়ি আর কিছু জায়গাজমি। পরিবারও ছিল যথেষ্ট বড়। পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে বাবাই ছিলেন জ্যেষ্ঠ। জীবনসংগ্রামে কৈশোরেই বাবাকে অবতীর্ণ হতে হয়েছিল। ম্যাট্রিকে স্টার পাওয়া, অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিলেন বাবা। ইংরেজি সাহিত্যের স্নাতক ডিগ্রি লাভ করার পর তদানীন্তন আসাম সিভিল সার্ভিসে তিনি যোগ দেন ১৯৩০ সালে। তবে বিশের দশকের শেষ ভাগে আর চল্লিশের দশকের মাঝামাঝি, সম্ভবত ম্যানেনজাইটিসে আক্রান্ত হয়ে বাবার দুই ছোট ভাই, ফাইয়াজ আর মুহিবের যথাক্রমে অকাল মৃত্যু ছিল বাবার জীবনের বিরাট একটি ট্র্যাজেডি। ফাইয়াজ চাচাকে দেখিনি। কিন্তু ছয় ফুট উচ্চতার সুঠাম দেহী মুহিব চাচাকে আমার স্পষ্ট মনে আছে। তার মৃত্যুতেই প্রথম বাবাকে কাঁদতে দেখেছিলাম।

ব্রিটিশ ভারত আর পাকিস্তানি আমলে পদোন্নতির সোপান বেয়ে বাবা তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে মহকুমা হাকিম, জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, ডিভিশন কমিশনার, সচিব, রাজস্ব বোর্ডের সদস্য এবং প্রাদেশিক নির্বাচন অথরিটির চেয়ারম্যান পদে দায়িত্ব পালন করেন। প্রশাসনিক কর্মকর্তা হিসেবে বিবিধ ডিপার্টমেন্টে তাকে দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে, যার মাঝে কৈশোরের অনুভূতিতে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়ে আসামের রাজধানী শিলংয়ে সিভিল ডিফেন্সে তার দায়িত্বটি ছিল বিশেষ আগ্রহউদ্দীপক। বাবাকে তখন উর্দি পরে দায়িত্ব পালন করতে হতো। আর আমার মনে রোমাঞ্চ জাগত, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ যেন আমাদের দোরগোড়ায়।

খেলাধুলায় বাবার আগ্রহ ছিল অপরিসীম। বাবাকে ফুটবল খেলতে দেখিনি, তবে শুনেছি কলেজজীবনে তিনি ছিলেন সিলেট মুরারিচাঁদ কলেজ (এমসি কলেজ) দলের দক্ষ একজন গোলরক্ষক। ভালো টেনিস খেলতে তাকে দেখেছি এবং আমার টেনিস খেলার হাতেখড়ি তারই হাতে।

বাবার মৃত্যুর প্রায় চার দশক হতে চলল। বাবার কথা কি রোজ মনে পড়ে? জীবনের স্রোতে ভেসে পেছনে ফিরে তাকানোর অবকাশ কী সব সময় হয়? তা হয় না। তবে সত্তার গভীরে যে ভাবনাটি চিরতরে বিরাজ করেছে তা হলো বাবা ছাড়া আমাদের জীবন, আমাদের অস্তিত্ব, আমাদের অনুভূতি, রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, ‘রিক্ততার বক্ষভেদ’ করে উন্মোচিত হতো না। ‘জীবনের জয়’কে ব্যক্ত করার ক্ষমতা, বাবার কাছ থেকেই আমি পেয়েছিলাম। সন্তান হিসেবে বাবার কাছে আমি তাই চিরকৃতজ্ঞ। তবে বাবাকে যে বারবার মনে পড়ে না, তা তো নয়। জীবনের কোনো কোনো বিশেষ মুহূর্তে তাকে বিশেষভাবে মনে পড়ে। একটি মনে পড়াকে স্মরণ করি।

এক স্থান থেকে অন্য স্থানে; শুধু তাই নয়, এক দেশ থেকে নবগঠিত আরেকটি দেশ পাকিস্তানে, কর্মরত বাবার সঙ্গে বাস করতে হয়েছিল বলে স্থায়ী বাসস্থান বলে আমাদের কিছু ছিল না। বাবার জীবিতবস্থায় গ্রামের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থার দৈন্য আর সেই সময়ের বিজলি বাতির সংযোগহীনতার জন্য গ্রামের বাড়ি বাস-উপযোগী বলে আমাদের চিন্তায় ছিলই না। পঞ্চাশের দশকের শেষে এসে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে বাবা আমাদের জন্য ধানমন্ডির পাঁচ নম্বরে নির্মাণ করেছিলেন আমাদের পরিবারের প্রথম বাসস্থান, ধানমন্ডির পাঁচ নম্বর রাস্তায়, ‘সুরমা’। প্রায় অর্ধ শতাব্দী সেটাই ছিল আমাদের ঠিকানা। কত ‘আনন্দ, বেদনা, মিলন, বিরহ, সংকটে, এই সুরমা’ ছিল আমাদের বিশ্বময় ছড়িয়ে থাকা পরিবারের মিলনকুঞ্জ। বাড়িটির নির্মাণ সময়ে আমি বিদেশে ‘ফরেন সার্ভিসে’ কর্মরত ছিলাম। বাবার লেখা অনেক চিঠিই আমার কাছে আছে। বাবা ইংরেজিতে লিখতেন। একটি চিঠির ছোট একটি অংশ ভাষান্তরিত করছি। ১৯৫৭ সালের পয়লা নভেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রে আমাকে লিখেছেন— ‘আমি নিজ কাজে খুবই ব্যস্ত থাকি, কিন্তু যখনই সামান্য সময় পাই, বাড়ি নির্মাণের তদারকি করতে ছুটে যাই। আল্লাহর ইচ্ছায় ছাদ নির্মাণ প্রায় শেষ হওয়ার পথে। টাকা জোগাড় করা মুশকিল আর তার চাইতেও মুশকিল হচ্ছে নির্মাণ সামগ্রীর প্রাপ্তি আর ব্যবস্থাপনা’। সেই বছরের ২৬ ডিসেম্বরে আবার লিখলেন— ‘বাড়ি নির্মাণ (একতলা), শেষ হওয়ার পথে। আমি ৪০,০০০ (চল্লিশ হাজার) টাকা ইতিমধ্যে খরচ করেছি। কমপক্ষে আরও ১৫,০০০ (পনের হাজার) টাকা প্রয়োজন।’

সেই ‘সুরমা’ পরে তিনতলা হলো। বাবা তখন বেঁচে নেই। এই তো বছর চারেক হলো, অবশেষে কালের অনিবার্যতায় একদিন তিনতলা ‘সুরমা’র ছাদের কার্নিশে হাতুড়ির আঘাত পড়ল। সজোরে সশব্দে; কার্নিশের পলেস্তারার কিছু টুকরো ছিটকে পড়ল ‘সুরমা’র জলছাদের ওপর। তার ধুলো মিলিয়ে যেতে না যেতেই হাতুড়ি আবার নির্মম আঘাত হানল। তারপর আবার, আবার...। বৈশাখের এক সূর্যস্নাত প্রত্যুষে, সময়ের দাবির কাছে ‘সুরমা’ আত্মসমর্পণ করল। চলল ‘সুরমা’র ধ্বংসযজ্ঞ। টুকরো টুকরো হয়ে গেল, পঞ্চাশের দশকের শেষার্ধে নির্মিত আমাদের পারিবারিক ঠিকানা: সুরমা-বাড়ি ৮৭, ধানমন্ডি। (অবশ্য পরবর্তীকালে তা হয়েছে ৮৭ (পুরনো), ২৫ (নতুন)। চুন সুরকিতে ঢেকে গেল ‘সুরমা’র একদা অন্তরঙ্গ প্রাঙ্গণ। সময়ের গহ্বরে হারিয়ে গেল আমাদের সম্মিলিত পরিবারের একমাত্র ঠিকানাটি। কালের অতলে ডুবে যাওয়া ‘সুরমা’র বুদ্বুদটি চিরদিনের জন্য বিলীন হয়ে গেল। অথচ এই সুরমা ছিল আমাদের পারিবারিক কতনা ঘটনার সাক্ষী। এই সুরমায় অন্তিম শয্যায় শায়িত ছিলেন বাবা, আম্মা, শহীদ কর্নেল হাই, যুক্তরাষ্ট্রে বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত অবস্থায় একটি দুর্ঘটনায় নিহত আমার ছোট বোন নীনা ও তার স্বামী ড. ফখরুদ্দিন আহমদের পুত্র, আমাদের অতি আদরের উনিশ বছরের ভাগ্নে নাভিদ। এই সুরমাতেই কতবার বেজেছে আপনজনের বিয়ের সানাই, উত্থিত হয়েছে প্রিয়জনের চির বিদায়ের সুর। ইতিহাসের সাক্ষী ‘সুরমা’। শহীদ জামাতার মৃতদেহ দেখে কান্নায় ভেঙে পড়া আমার মায়ের মুখের ওপর পাকিস্তানি সেনা সেখানেই বলেছিল, ‘আপনি কোনো শব্দ করবেন না। এ ঘর থেকে যদি কোন আওয়াজ বেরোয়— আমরা এই লাশ নিয়ে যাব।’ সেদিন আর জানাজায় অংশ নেয়নি পাক সেনারা— কারণ তিনি ছিলেন গাদ্দার। ‘ইনি গাদ্দার নন, ইনি একজন সৈয়দ’ নিষ্ফলে প্রতিবাদ করেছিলেন আমাদের গাড়িচালক নির্ভীক আবুল কাসেম। এই সুরমায়ই সেদিন একজন বাঙালি সৈনিক আমার ভাইদের গোপনে চুপি চুপি বলেছিলেন, ‘ভয় করবেন না! আমরা আপনাদের সঙ্গে আছি’। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১-এর বিজয়ের মুহূর্তে এই সুরমাতেই আমাদের বাবুর্চি, কৃষ্ণাঙ্গ, মেদবহুল সোবহান একটি সুস্থ সবল খাসির গলায় দড়ি বেঁধে নিয়ে তার বত্রিশটি দন্ত বিকশিত করে আম্মাকে বলেছিল, ‘আম্মা, খাসিটি পাঁচ নম্বর রোডের কোনায় রাজাকার ক্যাম্প থেকে ধরে নিয়ে এসেছি। এটা দিয়ে আজ কাচ্চি বিরিয়ানি রাঁধব’?

ইতিহাসের সাক্ষী ‘সুরমা’। এখন ধূলিসাৎ সুরমা। কিন্তু স্মৃতি যে ধূলিসাৎ হয় না। মুছে যায় না সুরমার উদগ্রিব নির্মাতা বাবার মুখাবয়ব। স্মৃতির উন্মেষ থেকেই বাবাকে বন্ধু হিসেবে পেয়েছিলাম। বাবা আমাদের পড়াতেন কিন্তু কদাচিৎই পড়ার বই পড়াতেন। কবিতা পড়াতেন বাবা। নজরুলের ‘বিদ্রোহী’। আর তার সঙ্গে গল্প করতেন বিশের দশকে নজরুলের সিলেট সফরের। নজরুলের নীল শিরোধান, ডাগর ডাগর চোখ, বাবড়ি চুল, নজরুলের অট্টহাসি, সেই সফরের সঙ্গে একান্তভাবে সম্পৃক্ত বাবার মুখে গল্প শুনে যেন নজরুলকে দেখতে পেতাম। রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর মাশুল দিতে হয়েছিল ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’ আর ‘সাজাহান’ কবিতা কণ্ঠস্থ করে। ইংরেজির ছাত্র বাবার মুখে, ‘হ্যামলেট’ ‘ম্যাকবেথে’র গল্প শুনে বড় হয়েছি— ওয়ার্সওয়ার্থ, শেলি, কিটসয়ের নাম তাদের কবিতা পড়ার আগেই অজানা ছিল না। জ্যামিতির থিয়েরম না বুঝতে পারায় বাবার চপেটাঘাত এখনও মনে পড়ে। তবে আমাদের জন্য বই কিনতে বাবা ছিলেন ব্যগ্র। কলকাতায় প্রকাশিত পুজোর নতুন ‘শিশু সাথী’ যথাসময়ে সুদূর আসামে আমাদের হাতে পৌঁছে যেত। সেই সময় ওয়ার্ল্ড কাপ ফুটবলের নামও জানতাম না। বাবাও হয়তো জানতেন না। কিন্তু গল্প করতেন কলকাতার ফুটবল খেলার। মোহামেডান স্পোর্টিংয়ের ঘোর সমর্থক ছিলেন বাবা— ওসমান, জুমা খান, কালুখান, সামাদ এসব নাম আমার অপরিচিত ছিল না মোটেও। উইম্বলডন নয়, তবে শুনতাম গাওস মোহাম্মদ, ইফতেখার আহমদ, সুমন্ত মিশ্রের টেনিস খেলার নৈপুণ্যের গল্প। টেলিভিশনের সামনে আন্তর্জাতিক ফুটবল অথবা টেনিস খেলা দেখতে দেখতে বাবার কথা মনে পড়ে বৈকি।

প্রচুর হাস্যরস ছিল বাবার। ছেলেবেলায় একবার সাইকেলের নিচে পড়ে বেশ খারাপভাবেই আহত হয়েছিলাম। মোটর দুর্ঘটনা মেনে নেওয়া যায়, কিন্তু সাইকেলের নিচে পড়ে আহত হওয়াটা লজ্জাকরই বটে। মনে পড়ে, ছড়া বানিয়েছিলেন বাবা বলেছিলেন,

‘ফারুক মিয়া সাবধান না হওয়ার ফলেতে

পড়িয়া গেছিল বাইসাইকেল তলেতে’

আমার আলস্য আর কচুমুখি খাওয়ার মধ্যে সম্পৃক্ততা খুঁজে পেতেন বাবা। বলতেন, ‘ফারুক কচুমুখি পছন্দ করে, বেশি চিবোতে হয় না বলে!’ ১৯৬৪ সালে বাবা টোকিওতে গিয়েছিলেন পাকিস্তান অলিম্পিক দলের ‘চিফ অব মিশন’ হিসেবে। সেই অলিম্পিকে ভারত পাকিস্তানকে হকিতে হারিয়েছিল। আমি তখন বেইজিংয়ে কর্মরত। টোকিও থেকে ফেরার পথে বেইজিংয়ে, প্রথমবারের মতো আমার বাসায় বাবা এলেন। মনে পড়ে সেই সময়কার চীনের ক্রীড়া উপমন্ত্রী, বাবার সম্মানার্থে একটি ভোজের আয়োজন করেন। কাকতালীয়ভাবে সেই মন্ত্রীপ্রবরের সঙ্গে আমার ভালোই পরিচয় ছিল। খাবার টেবিলে বসে বাবার সামনে আমার পানীয় দ্রব্য গ্রহণে অনীহা দেখে, আমাদের সামাজিক প্রথা সম্বন্ধে অনভিজ্ঞ চীনা মন্ত্রী বাবাকে বলেছিলেন, ‘আজ না খেলেও, জানেন আপনার ছেলে কিন্তু আসলে পানাহারে এখানকার কূটনৈতিক মহলে চ্যাম্পিয়ন।’

বাড়ি ফিরে বাবা আম্মাকে ডেকে বলেছিলেন, ‘পাকিস্তান হকি চ্যাম্পিয়ন হলো না। কিন্তু তোমার ছেলে শুনে এলাম ‘চ্যাম্পিয়ন’ হয়েছে! কীসের— তা তাকে জিজ্ঞেস করো।’

বাবাকে যে খুব বেশি দিন পেয়েছি তা তো নয়। ষোল বছর বয়সে কলেজ হোস্টেলে চলে গেলাম। ২২ বছর বয়সে বিদেশে ফরেন সার্ভিসে। মাঝেমাঝে ফিরে এসেছি, পেয়েছি বাবার নিবিড় সান্নিধ্য। কিন্তু যখন যেখানেই ছিলাম না কেন, বাবার কাছ থেকে নিয়মিত চিঠি পেতাম। জীবনের সেই সময়ে নিয়মিত উত্তর দেওয়ার অবকাশ কী পেতাম? তবে বাবার একটি ধারণা সব সময়েই প্রেরণা জোগাত। তা হলো আমার ওপর তার গভীর বিশ্বাস। ‘তুই পারবি’— বাবার এ উৎসাহই ছিল জীবনের প্রধান চালিকাশক্তি।

হ্যাঁ—বাবাকে কিন্তু আমি বছরে অনন্ত একটি চিঠি লিখেছি— তার মৃত্যুর পর। এক পাতার ছোট সেই চিঠিগুলোতে সংক্ষেপে ব্যক্ত করেছি একটি সুবিশাল পরিবারের নানামুখী বিবর্তন। সেই চিঠিগুলোকে একটি সুতোয় গেঁথে— সম্প্রসারিত একটি উপাখ্যান যদি রচনা করার সময়, সুযোগ আর সামর্থ্য খুঁজে পাই— মূলত তা কী হবে? মনে হয় যে, তা হবে আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক আর সমকালীন নানা টানাপোড়নে অস্ট্রেলিয়া থেকে ইউরোপ হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে অপকেন্দ্রিক টানে ছড়িয়ে পড়া একটি পরিবারের নানা মনের মানুষগুলোর ক্রমে ক্রমে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার বিয়োগান্ত একটি কাহিনী; আমাদের স্থায়ী ঠিকানা ‘সুরমা’ কালের অমোঘ নিয়ম প্রবাহে যা প্রতিহত করতে পারল না। তবে আমার মনের আকাশে শুকতারার মতো যদি কেউ জেগে থাকে তিনি হবেন বাবাই— যার পার্থিব ঠিকানা আমার জীবনভরই বইবে— ‘সুরমা’-৮৭, ধানমন্ডি-সড়ক ৫-ঢাকা।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর