শুক্রবার, ৩০ জুন, ২০১৭ ০০:০০ টা

যিনি সবার স্যার

মযহারুল ইসলাম বাবলা

যিনি সবার স্যার

অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, সবারই তিনি স্যার। তাকে সবাই স্যার বলেই সম্বোধন করেন। স্যারের সঙ্গে আমার পরিচয়-সংশ্লিষ্টতা প্রায় ৪০ বছরের। ১৯৭৭ সালে স্যারের স্ত্রী প্রয়াত ড. নাজমা জেসমিন চৌধুরী রচিত নাটক ‘আলোটা জ্বালো’ ঢাকা শিশু নাট্যম প্রযোজনা করেছিল। শিশু নাট্যমের সংগঠকরূপে সেই থেকে পরিচয়-আলাপচারিতা এবং ক্রমেই ঘনিষ্ঠ সাহচর্য লাভ। তবে স্যারের লেখার সঙ্গে পরিচয় ঘটেছিল আরও আগে। স্যার এবং নাজমা আপার সক্রিয় সহযোগিতা ও সমর্থনে ১৯৭৮ সালে গঠিত হয়েছিল ঢাকা লিটল থিয়েটার। নাজমা আপা এবং স্যারকে কেন্দ্র করেই বলা যায় সংগঠনটির সার্থক পথচলা সম্ভব হয়েছিল। নাটকের মহড়া, দলের কার্যালয় তাদের বাসাটিতেই কেন্দ্রীভূত ছিল। অসংখ্য শিশু-কিশোর, অভিভাবক এবং সংগঠকদের সরব উপস্থিতিতে তাদের আবাসটি পরিণত হয়েছিল সাংস্কৃতিক চর্চার কেন্দ্র রূপে। ১৯৮৯-এর ১২ সেপ্টেম্বর দুরারোগ্য ক্যান্সারে আক্রান্ত নাজমা আপা অসময়ে চলে গেলেন। আমরা বঞ্চিত হলাম তার মাতৃস্নেহ থেকে। সেই অপূরণীয় ক্ষতি আর পূরণ হলো না।

নাজমা আপা সংসার-সামাজিকতা একাই সামাল দিতেন। হাট-বাজার থেকে সমস্তই। আমাকে একদিন বলেছিলেন, ‘তোমাদের স্যারের পড়াশোনা, গবেষণা, সভা-সমাবেশ, লেখালেখি এবং পেশার ক্ষেত্রে যেন সামান্য বিঘ্ন না ঘটে সে জন্য শুরু থেকে আমি সমস্ত দায়িত্ব একাই পালন করে এসেছি।’ আমরা যে অসামান্য প্রজ্ঞাবান বটবৃক্ষের ছায়াতলের আশ্রয়ে রয়েছি; সর্বজন শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীকে অনুসরণীয় আদর্শরূপে পেয়েছি, তার পেছনে নাজমা আপার অসামান্য অবদান উপেক্ষা করা যাবে না। নাজমা আপাকে এড়িয়ে সঙ্গতকারণেই স্যারকে নিয়ে লেখা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। স্যারকে নিয়ে লিখতে বসে প্রাসঙ্গিকভাবেই নাজমা আপা চলে আসেন। নাজমা আপার অবর্তমানে তাদের দুই মেয়ে রওনক আরা চৌধুরী খুকু এবং শারমীন চৌধুরী শিউলী স্যারকে অদ্যাবধি আগলে রেখেছেন। স্যারের পারিবারিক বৃত্তটি এ দুই মেয়েকে নিয়েই।

পেশায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি সাহিত্যের জনপ্রিয় শিক্ষক। সত্য এই যে, স্যারের শিক্ষার্থী কেবল ইংরেজি বিভাগে সীমাবদ্ধ কখনো ছিল না। স্যারের সীমা দেশ-বিদেশ জুড়ে বিস্তৃত। তাকে আড়ালে সবাই ঝরপ ঝরৎ বলে সম্বোধন করেন। ২০০২ সালে অবসর গ্রহণের পর বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের অধ্যাপক এবং পরবর্তীতে ইমেরিটাস অধ্যাপক। স্যারের প্রখর চিন্তাশীল লেখার মাধ্যমে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে যাচ্ছেন প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে। প্রবন্ধ সাহিত্যের ন্যায় বিরস সাহিত্যও যে জনপ্রিয় সুখপাঠ্য হতে পারে, তার দৃষ্টান্ত স্যারের অসামান্য রচনাসমূহ। এ পর্যন্ত তার প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা প্রায় একশত। তার বিশ্লেষণ-গবেষণা সমৃদ্ধ প্রবন্ধে যুক্ত সাহিত্যের উপাদান প্রবন্ধ সাহিত্যকে নতুন মাত্রা দিয়েছে। তার গ্রন্থ পাঠে পাঠক কেবল জ্ঞানে ঋদ্ধ নয়, অসাম্য-অনাচারের বিদ্যমান ব্যবস্থা ভাঙার অনুপ্রেরণাও লাভ করে। তার প্রতিটি রচনায় পাওয়া যায় ব্যবস্থা বদলের পথের দিশা। ইতিহাস, সমাজ, আন্তর্জাতিক, অর্থনীতি, রাজনীতি, দর্শন, দেশি-বিদেশি সাহিত্য, ভাষা, সংস্কৃতি কোনোটির অনুপস্থিতি নেই। সাম্রাজ্যবাদী শোষণের যন্ত্র পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে তিনি চিহ্নিত করে ঘৃণিত ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনের পথও অকপটে প্রকাশ করে থাকেন। তার বক্তৃতা, বক্তব্য, লেখনীতে সমাজ বিপ্লবের আকাঙ্ক্ষা এবং পথটির নির্দেশনা দিতে কখনো ভুল করেন না। আমাদের সমাজে জ্ঞানী-পণ্ডিতের অভাব নেই। পণ্ডিত ব্যক্তি নিশ্চয় আছেন। তবে মতাদর্শে অবিচল দ্বিতীয়জনকে খুঁজে পেতে কষ্টই হবে। তার রচিত প্রবন্ধে নিখুঁত চুলচেরা বিশ্লেষণে পাঠকের মনোজগেক কেবল বিকশিত নয়, শাণিতও করে। সে কারণে স্যারের পাঠকের সংখ্যা ঈর্ষণীয়। তার রচনা পাঠে পাঠকমাত্রই শিক্ষার্থী হয়ে পড়ে। পাঠককে পাঠে উদ্বুদ্ধ-আগ্রহী করে তোলার ক্ষেত্রে স্যারের লেখনীয় মুনশিয়ানাকেও অস্বীকার করা যাবে না। প্রবন্ধ সাহিত্যকে হৃদয়গ্রাহী করার অভিনব সৃষ্টিশীল মাত্রা তিনি যুক্ত করেছেন, তার প্রবন্ধসমূহে। তিনি যে সবার স্যার, তার প্রধানতম কারণটি নীতিতে অবিচল তার এই সুদীর্ঘ পথযাত্রা। যেখানে আত্মসমর্পণের একটি দৃষ্টান্তও নেই। নেই নত স্বীকারের একটি ঘটনাও। সঙ্গত কারণেই তার পরিধি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ অতীতেও ছিল না। আজও নেই। কোনো ব্যক্তির পক্ষে সুদীর্ঘকাল আদর্শে অবিচল থাকার নজির আমাদের সমাজে খুব বেশি নেই। আদর্শে অবিচল ব্যক্তির আকাল চলছে দেশজুড়ে। স্যারের ন্যায় মতাদর্শে অবিচল ব্যক্তি আমাদের সমাজে বড়ই দুর্লভ। পার্থিব প্রলোভন, লোভ-লালসা এড়িয়ে চলা এক অনন্য দৃষ্টান্ত অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। ১৯৮১-তে ক’বছরের জন্য আমি বিদেশে ছিলাম। তবে নাজমা আপার সঙ্গে নিয়মিত পত্র যোগাযোগ ছিল। স্যারের এবং নিজের বই প্রকাশিত হলে আমাকে পাঠাতেন। এক চিঠিতে নাজমা আপা জানিয়েছিলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি প্যানেল নির্বাচনে সর্বাধিক ভোটে বিজয়ী স্যারকে উপাচার্য পদে নিয়োগের জেনারেল এরশাদের প্রস্তাব তারই সম্মুখে স্যারের প্রত্যাখ্যান করার সংবাদ। চিঠিতে আরও লিখেছিলেন, ‘তোমাদের স্যার ভাগ্যিস ভিসি হতে অপারগতা প্রকাশ করেছেন, বড্ড বাঁচা বেঁচে গেছি। ভিসি হবে হবে ওই সময়ে আমাদের চারপাশে সুযোগ সন্ধানী-সুবিধাবাদী অসংখ্য মানুষের ভিড়ে আমরা আমাদের প্রকৃত বন্ধুদের হারাতে বসেছিলাম। এ যাত্রায় বেঁচে গেলাম।’ ব্যক্তিগতভাবে জানি দ্বিতীয়বার তাকে উপাচার্যের পদ গ্রহণের প্রস্তাবও তিনি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের ভিসি পদটি শতভাগ রাজনৈতিক। আত্মসমর্পণে পারদর্শীদের জন্যই ওই পদ মানায়, নীতিনিষ্ঠদের জন্য নয়। ওই পদ দলীয় আনুগত্যের প্রতীকে পরিণত। আমাদের ক্ষমতাসীন শাসকদলের লেজুড়বৃত্তিতে পারদর্শীদেরই আনুগত্যের পুরস্কার স্বরূপ ওই পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। এই ঘৃণিত বিরাজমান সংস্কৃতির বিরুদ্ধে স্যারের প্রত্যাখ্যান ছিল অনন্য দৃষ্টান্ত।

মনে পড়ে, আমার উপস্থিতিতে জেনারেল জিয়ার মন্ত্রিসভায় যোগদানের আমন্ত্রণ নিয়ে স্যারের বাসায় সস্ত্রীক এসেছিলেন মুক্তিযোদ্ধা সংসদের চেয়ারম্যান প্রয়াত মাহফুজুর রহমান। মন্ত্রিত্ব গ্রহণের প্রস্তাব শোনামাত্র স্যারের মুখ শুকিয়ে গিয়েছিল। চোখের সমস্যার অজুহাত দেখিয়ে মন্ত্রিত্বের সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। বুকের ওপর হঠাৎ চেপে বসা পাথরটি অপসারণে যেন মুক্তিলাভ করলেন।

স্যারের পিতা চেয়েছিলেন মেধাবী বড় ছেলেটি সিএসপি হোক। ব্রিটিশ এবং পাকিস্তানি আমলে অভিভাবক এবং মেধাবী ছাত্রদের প্রধান লক্ষ্যই ছিল শাসক সহযোগী আমলা হওয়া। সিভিল সার্ভিসের পরীক্ষা দিতে মেধাবীদের মধ্যে চলত প্রতিযোগিতা। সেই অভিলাষে স্যারের পিতা স্যারের হাতে সিএসপি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের ফরম তুলে দিয়েছিলেন। কিন্তু স্যার সেই ফরমটি ছিঁড়ে শাসক সহযোগী আমলা হওয়ার সনাতনী প্রতিষ্ঠার বিপরীতে শিক্ষকতার পেশাকেই বেছে নিয়েছিলেন। যাতে মেরুদণ্ড সোজা রেখে জীবনভর চলতে পারেন। পিতার সম্মুখে যে অসম দৃঢ়তা প্রদর্শন করেছিলেন, সেই সুকঠিন দৃঢ়তায় এখনো পর্যন্ত মেরুদণ্ড সোজা রেখেই চলছেন। আত্মসমপর্ণের একটি অপবাদ তার চরম শত্রুও দিতে পারবে না। আর্থিকভাবে অসচ্ছল হলেও শিক্ষকতা পেশায় নিজেকে নিয়োজিত করেছেন একজন সফল, দক্ষ, জনপ্রিয় শিক্ষক রূপে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর গ্রহণের পর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ পদের নানা লোভনীয় প্রস্তাব সযত্নে ফিরিয়ে দিয়েছেন। শিক্ষাকে বাণিজ্যকরণের বিরুদ্ধে তার নীতিগত দৃঢ় অবস্থান এসব অসংখ্য প্রলোভনেও টলানো সম্ভব হয়নি।

গত পনেরো বছর যাবৎ স্যারের সম্পাদনায় সাহিত্য-সংস্কৃতির ত্রৈমাসিক নতুন দিগন্ত পত্রিকাটি নিয়মিত প্রকাশিত হয়ে আসছে। ব্যক্তিগতভাবে আমি পত্রিকার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। অতিমাত্রায় পরিশ্রমী, দায়িত্বশীল, সচেতন সম্পাদকরূপে তাকে দেখে আসছি। পত্রিকায় একটি শব্দও তার চোখ এড়িয়ে প্রকাশের উপায় নেই। পত্রিকাজুড়ে তার পরিশ্রমী নিপুণ সম্পাদনায় পত্রিকার এই দীর্ঘ পথচলা সম্ভব হয়েছে। নতুন দিগন্তে প্রকাশিতব্য আমার লেখা একটি প্রবন্ধে দুটি ঘটনার উল্লেখ থাকলেও তথ্যসূত্র না থাকায় আমাকে ঘটনা দুটির তথ্য-প্রমাণ দেখাতে বলেন। তথ্য-প্রমাণ দেখার পরই আমার লেখাটি নতুন দিগন্তে প্রকাশের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। সম্পাদকের অমন দায়িত্বশীলতার নজির দেশে খুব একটা দেখা যাবে বলে মনে হয় না।

১৯৯২-তে মৃত্যুপথযাত্রী আমার বাবার সংবাদ জেনে তিনি ডাকযোগে চিঠি লিখে আমাকে সাহস ও সান্ত্বনা দিয়েছেন। বাবার মৃত্যু-পরবর্তী সামাজিক অনুষ্ঠানে সশরীরে উপস্থিত থেকেছেন। আমার বিয়েতে, আমার সন্তানের সামাজিক অনুষ্ঠানসমূহে শত ব্যস্ততায়ও উপস্থিত থেকেছেন। যেটি অনেক নিকটাত্মীয়দের ক্ষেত্রেও আমি দেখিনি। বেশ ক’বছর আগে তার রচিত গ্রন্থ ‘গণতন্ত্রের অমসৃণ পথ’ বইটি আমাকে উৎসর্গ করে কৃতজ্ঞতার ঋণে আবদ্ধ করেছেন। জীবনে প্রকৃত শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ স্যারের সান্নিধ্যে পেয়েছি। সেটা পরম পাথেয় বলেই বিবেচনা করি। দেশের স্বার্থান্বেষী রাজনৈতিক ব্যবস্থার বিকট চেহারা আমরা নিত্য দেখে থাকি। সব পেশাজীবীর ক্ষেত্রে তো বটেই—এমন কি আমাদের বুদ্ধিজীবীরা পর্যন্ত দলীয় শৃঙ্খলে নিজেদের আবদ্ধ-সমর্পণ করেছেন, পার্থিব স্বার্থের টানে। শাসক শ্রেণির প্রধান দলে সব পেশাজীবীর মতো বুদ্ধিজীবীরা নিজেদের বিবেক, বুদ্ধি, নীতি-নৈতিকতাকে বন্ধক দিয়ে ফেলেছেন। সব বিবেচনায় তিনি দৃষ্টান্তে অনন্য। সারাটি জীবন রেললাইনের পথের মতো একই ছন্দে লাইন ধরে চলেছেন। কখনো লাইনচ্যুত হননি। গত ২৩ জুন ছিল মতাদর্শে অবিচল সবার পরম শ্রদ্ধা-ভালোবাসার প্রিয় মানুষ ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী স্যারের ৮১তম জন্মদিন। তাকে জানাই অভিনন্দন, বিনম্র শ্রদ্ধা, ভালোবাসা।

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর