শুক্রবার, ২৮ জুলাই, ২০১৭ ০০:০০ টা
আহসান হাবীব

দুঃখবোধ ও স্থান-কাল নিরপেক্ষতার প্রতিভাস

তুহিন ওয়াদুদ

দুঃখবোধ ও স্থান-কাল নিরপেক্ষতার প্রতিভাস

কবি আহসান হাবীব [১৯১৭-১৯৮৫] ছবি : নাসির আলী মামুন/ফটোজিয়াম

ব্রিটিশ অধ্যায়, পাকিস্তান অধ্যায় এবং বাংলাদেশ তিন পর্বের লেখক আহসান হাবীব (১৯১৭-১৯৮৫)। ব্রিটিশ শাসনামলে লিখিত কাব্যগ্রন্থ ‘রাত্রিশেষ’ (১৯৪৭)। ‘রাত্রিশেষ’ আহসান হাবীব-এর প্রথম কাব্যগ্রন্থ। এ কাব্যগ্রন্থই কবির কাব্যশিল্পে দীর্ঘপথ চলার প্রেরণাশক্তি। পাকিস্তান শাসনামলে লিখিত ‘ছায়াহরিণ’ (১৯৬২), ‘সারা দুপুর’ (১৯৬৪)। বাংলাদেশ পর্বে লিখিত কাব্যগ্রন্থ ‘আশায় বসতি’ (১৯৭৪), ‘মেঘ বলে চৈত্রে যাবো’ (১৯৭৬), ‘দু’হাতে দুই আদিম পাথর’(১৯৮০), ‘প্রেমের কবিতা’ (১৯৮১), ‘বিদীর্ণ দর্পণে মুখ’ (১৯৮৫)।

আহসান হাবীব সমাজঘনিষ্ঠ লেখক। কাব্যগ্রন্থগুলোর নামকরণের মধ্যে জীবনবোধের গভীর ব্যঞ্জনা পরস্ফুিট। তিনি সমাজের সুখ-দুঃখ নিয়ে লিখেছেন। রূপক-প্রতীক-ইঙ্গিতে তা পরিদৃশ্যমান। লেখায় কখনো কখনো ইতিহাস-ঐতিহ্যকে অনেক গুরুত্ব দিয়েছেন। স্থান নিরপেক্ষ হয়ে নিজেকে বৈশ্বিক মানদণ্ডে উন্নীত করেছেন অনেক সময়। নিজের পরিচয় সম্পর্কে, এ মাটির সঙ্গে সম্পর্কের দৃঢ়তা বোঝাতে তিনি ‘আমি কোন আগন্তুক নই’ কবিতাটি লিখেছেন।

১৯৮৫ সালে প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ‘বিদীর্ণ দর্পণে মুখ’। এ কাব্যগ্রন্থের প্রথম কবিতা ‘পরিক্রম এবং অবস্থান প্রসঙ্গ’। এ কবিতায় তার কবিতার প্রকরণ-বিষয়সহ কবিতার নানামুখী সমালোচনার মূল্যায়ন লিপিবদ্ধ হয়েছে। প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘রাত্রিশেষ’ এর বিষয় কী তা নির্দেশ করেছেন এ কবিতায়। বণ্টনবৈষম্য, সামাজিক অসাম্য, পরাধীনতা, স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং মহাযুদ্ধের দায় নিয়ে প্রথম কাব্যের বিষয়গত পরিধি রচিত হয়েছে। অন্যান্য কাব্যগ্রন্থের বিষয় সম্পর্কে বলেছেন—‘তারপর ক্রমান্বয়ে ছায়া হরিণ, সারা দুপুর, আশায় বসতি/ মেঘ বলে চৈত্রে যাবো, দু’হাতে দুই আদিম পাথর এবং প্রেমের কবিতা। শ্রেণিবৈষম্যের অভিশাপ, মধ্যবিত্ত জীবনের কৃত্রিমতা/ এবং উদ্ভ্রান্ত উদ্বাস্তু যৌবনের যন্ত্রণা এই সবি আজো পর্যন্ত আমার কবিতার বিষয়বস্তু।’ এসব বিষয়ের উপস্থাপনকৌশলে তিনি আশ্রয় নিয়েছেন ইতিহাসের, অখণ্ড পৃথিবীর। দুঃখবোধের শিখাটিও সেখান থেকেই উৎসারিত। কবি আহসান হাবীবের আত্মজৈবনিক ভাষ্য এ কবিতাটি।

আহসান হাবীব দীর্ঘ সময় ধরে কবিতা লিখলেও সে তুলনায় কবিতার সংখ্যা কম। যদিও তিনি সারা জীবন কবিতা চর্চার মধ্যেই ছিলেন। ‘রাত্রিশেষ’ তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ। প্রথম কাব্যে কবি আহসান হাবীব এর দুঃখবাদী অন্তর্গঠন ধরা পড়ে। প্রথম কাব্য তিনি লিখেছেন ব্রিটিশ-ভারত পর্বে। এ কাব্যগ্রন্থে কবিচিত্তের এক অফুরান কষ্টের মানচিত্র উঠে এসেছে।

এককভাবে ব্রিটিশ শোষণ-পীড়ন এখানে বিষয় নয়। তবে ‘রাত্রিশেষ’ নামকরণের মধ্যে ব্রিটিশ বিদায়ের সুর উপ্ত আছে। তার ‘সেতু-শতক’ কবিতায় ব্রিটিশ পর্বের উল্লেখ আছে। ‘দ্বারপ্রান্তে তোমাদের বন্দী আমি দুই শতকের,/ আমার আত্মার তলে অগ্নিশিখা সাতান্ন সনের/ আজো অনির্বাণ,/ তবু কি পাহারা দেবে হাসিমুখে আমার জিন্দান?’ ‘রেড্ রোডে রাত্রিশেষ’ কবিতায় ব্রিটিশপর্বের সমাপ্তির প্রসঙ্গ প্রাণিত হয়েছে। কবি এখানে স্বপ্নাতুর। ব্রিটিশ পর্বকে বলেছেন অন্ধকার পর্ব। দীর্ঘকায় সাপের মতো সে অন্ধকার। অন্ধকার শয়তানের পাহারার উল্লেখ করে তাদের ‘মুমূর্ষু’ বলে উল্লেখ করেছেন। ‘রাত্রিশেষ’ কাব্যগ্রন্থের শেষ এ কবিতায় কবি লিখেছেন— ‘নদীর জলে ঝলকে উঠবে মুক্তি,/ বন্যা আসবে রেড্ রোডের প্রান্তে/ কেন না/ এদিকে আবার জাগবে নতুন সূর্য!’

আহসান হাবীব-এর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘রাত্রিশেষ’-এ দুঃখবোধ অতলান্তিক। এ দুঃখবোধ হতাশায় নিমজ্জিত নয়। আশাবাদে শেষ পরিণতি। জীবনানন্দ দাশ লিখেছেন ‘ঝরা পালক’। নৈরাশ্যের আঁধারে ডুবে ছিলেন তিনি। আহসান হাবীব কবিতায় লিখেছেন— ‘ঝরা পালকের ভস্মস্তূপে তবু বাঁধলাম নীড়।’ জীবনের প্রতিকূল প্রতিভাস আছে, কিন্তু প্রতিকূলতা ঠেলে আশার আলোয় জেগে ওঠার চেষ্টা ছিল তার।

‘রাত্রিশেষ’ কাব্যের প্রথম কবিতা ‘দিনগুলি মোর’ ঘনীভূত কষ্টের রেখাপাত। চরণে চরণে সেই কষ্ট ছড়িয়ে আছে। কবি যেন বেদনাহত। প্রথম কবিতায় তিনি লিখেছেন— ‘দিনগুলি আজ জরতী রাতের দুঃস্বপন,/ চির দহনের তিক্ত শপথ করে বহন/ দিনগুলি মোর শ্বাপদ বিজয়ী অরণ্যেতে/ শর খাওয়া এক হরিণ শিশুর আর্তনাদ।’

‘আজকের কবিতা’ শীর্ষক কবিতায় দগদগ করে দুঃখবোধের লেলিহান শিখা। কবি যেন এক অগাধ কষ্টসমুদ্রের নিবাসী। এ কষ্ট যেন শুধু ব্যক্তিক পর্যায়ের নয়। জীবনের নেতিবাচকতা যেন সর্বত্রই ছড়িয়ে আছে। বিপন্ন জীবনের চিত্র এখানে অঙ্কিত হয়েছে। কবি অন্য যে কাউকেই এখানে ‘বিরাম ঘর’ বাঁধতে নিষেধ করেছেন। কেন বিরাম ঘর বাঁধা যাবে না সেই বর্ণনায় উঠে এসেছে— ‘এ জনপদ একটি চরতুল্য। যার আকাশে ম্লান মেঘ, নিচে বন্যা, পায়ের তলায় ‘হিংস্র কুটিল সরীসৃপ।’ গৃহে আলো জ্বলবে না। জন্ম যেন অকাল জন্ম, ‘অথর্ব মৃত্তিকায়’ সুরের ব্যঞ্জনা। ‘রমণীয় চাঁদ’-এর বর্ণনাও ক্লেদাক্ত জীবনের পক্ষে। কবি লিখেছেন— ‘তোমার আমার দিন ফুরায়েছে, যুগটাই নাকি বৈপ্লবিক—/ গানের পাখিরা নাম সই করে নীচে লিখে দেয় রাজনীতিক/ থাকতে কি চাও নির্বিরোধ?/ রক্তেই হবে সে ঋণ শোধ!/ নীড় প্রলোভন নিরাপদ নয় বোমারু বিমান আকস্মিক/ আরদ্ধ গান এইখানে শেষ আজকে আহত সুরের পিক।’ আহসান হাবীব ‘আজকের কবিতা’ শীর্ষক কবিতায় সমকাল সম্পর্কে প্রতিকূল জীবনের যেসব অনুষঙ্গের অবতারণা করেছেন তা কেবল একটি বিশেষ সময়ে অনভূত হওয়া নয়। প্রথম কাব্যগ্রন্থ রচনার প্রায় সমস্ত সময়ই তিনি এ চিন্তাবিন্দুর চারদিকেই তার কাব্যবৃত্ত গড়ে তুলেছেন।

আহসান হাবীবের দুঃখ ভারাক্রান্ত চিত্তের প্রতিচ্ছবি শুধু ‘রাত্রিশেষ’ কাব্যের সীমায় নিবদ্ধ ছিল না। এ কাব্যগ্রন্থে দুঃখবোধ যত বিপুল প্রবাহ নিয়ে একচ্ছত্র প্রভাব ফেলেছে, অন্য কোনো কাব্যগ্রন্থে প্রধান উপজীব্য হিসেবে উপস্থাপিত নয়। তবে অনেক ক্ষেত্রেই স্বল্প মাত্রার শাণিত বেদনার্ত উচ্চারণ বোধের গভীরে রেখাপাত করে। ‘ছায়াহরিণ’ কাব্যের ‘তামসিক একটি মুহূর্ত’ কবিতায় কবির মৃত্যুজনিত হতাশা কাজ করেছে। পৃথিবী বেঁচে থাকবে বেঁচে থাকবেন না কবি। এই ভাবনায় কবি হতাশায় আচ্ছন্ন হয়েছেন। একই কাব্যের ‘ক্রান্তিকাল’ কবিতায় ঐতিহাসিকভাবে নারীর করুণ পরিণতি পাঠকবোধে বেদনার রং ছড়ায়। ‘সারা দুপুর’ কাব্যগ্রন্থের ‘উত্তীর্ণ প্রহরের গান’ কবিতায় কবি নিজের একাকিত্বের কথা লিখেছেন। এখানে তিনি সামষ্টিক বেদনাহত চিত্তের প্রতি আলোকপাত করেননি। নিজের নিঃসঙ্গতা এভাবে উঠে এসেছে— ‘কটাক্ষের ঝোড়ো হাওয়া/ কখন তুলেছে ঝড় এখানে। ঘাটের/ নিবেছে সমস্ত আলো/ মরা নদী/ নির্জনতা। আজ/ বিষণ্ন সন্ধ্যায় একা আমি।’

আহসান হাবীবের প্রায় সব কাব্যেই স্বল্পায়তনে হলেও দুঃখবোধের স্পর্শ আছে। ‘আশায় বসতি’ কাব্যের ‘অসুখ’ কবিতাটি সেই দুঃখবোধের রূপায়ণ। কবি যেন দুঃখবোধকেই চূড়ান্ত সত্য বলে জ্ঞান করেছেন। তিনি লিখেছেন— ‘শূন্যতাকে একমাত্র সত্য বলে রেখে যাবো দুয়ারে সবার।’ ‘আমাকে দাও’ কবিতার মধ্যেও কবির কষ্টেরই উন্মীলন। ‘মেঘ বলে চৈত্রে যাবো’ কাব্যগ্রন্থের ‘নির্ভুল সংলাপ’ কবিতার মধ্যেও এই স্রোতই বহমান। ‘দু’হাতে দুই আদিম পাথর’ কাব্যগ্রন্থেও কষ্টের ধারাপাত বিধৃত। ‘এবং তখনই’ কবিতায় কবি যেন একাকিত্বের বেদানায় মূর্ছিত। যখন তিনি অন্যদের সঙ্গে থাকেন তখন নিঃসঙ্গতার বেদনা তাকে স্পর্শ করতে পারে না। একলা হলেই যেন কষ্ট ঘিরে ধরে— ‘নিঃসঙ্গতা আমার একার। এই/ মরা পুল বিধ্বস্ত খামার/ আমার একার। আমি তোমাদের সঙ্গী হয়ে এলে/ ভোরের পরাগে দিখ হিরন্ময় রেখা/ দেখি সূর্যোদয়। সূর্যাস্ত আমার/ একা হলে বিষণ্নতা নৈরাশ্য এবং এই ব্যর্থতার ভার/ আমাকে জড়ায়।’

 

‘রাত্রিশেষ’ কাব্যগ্রন্থ বিদীর্ণ সমাজের আলেখ্য। নেতিবাচকতার গাঢ় স্বরলিপি। সময়ের দীর্ঘশ্বাস একেকটি কবিতা। কোথাও যেন প্রাণের উচ্ছ্বসিত কলরব নেই। কাব্যগ্রন্থের নাম ‘রাত্রিশেষ’ হলেও কাব্যজুড়ে প্রতীকী রাতেরই বিবিধ প্রকাশ। তবে কাব্যের নামকরণ কবির আশাবাদের পরিচায়ক। ‘কয়েদী’ কবিতায় আশাবাদ উঠে এসেছে— ‘আছে সেই অনাগত দিন/ হাতে আছে সেই সূর্য-পরিক্রমা স্বপ্ন রঙিন।’ কবি এ কাব্যগ্রন্থের অধিকাংশে প্রয়োগ করেছেন ভাববাচ্য। ‘স্বাক্ষর’ কবিতায় ব্যক্তিক পর্যায় উঠে এসেছে। সমাজবাস্তবতা পরিবর্তনে কবি নিজেও অঙ্গীকারাদ্ধ। কবিমনের তেজোদীপ্ত এক দৃঢ়চেতা কবির পরিচয় এখানে লিপিবদ্ধ— ‘প্রতিজ্ঞা আমার—/ মুমূর্ষু মানুষে ডেকে জীবনের নতুন আহ্বান জানাবার।/ আমার কণ্ঠস্বর সেথা নিত্য উচ্চতর হবে,/ আমৃত্যু এ হাতখানি তোমাদের হাতে হাতে রবে।’

কবি ভাবনা অনেক সময়ে আঞ্চলিক-দৈশিক রেখায় পরিব্যাপ্ত নয়। তিনি অনেক সময়ে হয়ে উঠেছেন জগত্ময়। ‘ছায়াহরিণ’ আহসান হাবীবের দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ। প্রথম কাব্য প্রকাশের ১৫ বছর পর এ কাব্যটি প্রকাশিত হয়। এ কাব্যগ্রন্থে আমরা স্থান-কাল নিরপেক্ষ এক কবিকে পাই। প্রথম কবিতা ‘তোমাতে অমর আমি’ কবিতায় দেশবোধের কথা উচ্চারিত হয়েছে। মা-প্রেমিকা-দেশ এ তিনের প্রতি কবির অগাধ ভালোবাসা। কবির স্বগোতক্তিতে এ সত্য উৎসারিত। ‘ছায়াহরিণ’ কাব্যগ্রন্থে ‘তোমাতে অমর আমি’ কবিতাটিতে শুধু কবির দেশপ্রেম ভৌগোলিক সীমা দ্বারা নির্দেশিত। অন্যান্য কবিতায় কবি বৈশ্বিক পরিপার্শ্ব দ্বারা প্রভাবিত। ‘ইতিহাস’ শব্দটি বারবার এসেছে। এ শব্দের ভিতরে তিনি দীর্ঘ সময় প্রবিষ্ট করান। এ শব্দের চেয়েও অনেক বেশি বার এসেছে ‘পৃথিবী’ শব্দটি। আহসান হাবীব ব্যক্তির পর্যায় অতিক্রম করে আঞ্চলিক-দৈশিক পরিমণ্ডলের সীমানা ছাড়িয়ে তিনি সমস্ত ভাবনার জাল বিস্তার করেছেন পৃথিবীব্যাপী। কবিতার চরণে ‘পৃথিবী’ শব্দটি ব্যবহার করে অনায়াসে আন্তর্জাতিকতায় পৌঁছেছেন। মূলত কবিভাবনার বিশালায়তন হচ্ছে এ কাব্যগ্রন্থটির কবিতাগুলো। ‘জীবন’ কবিতাটিতে ইতিহাস-ঐতিহ্য-পৃথিবী সবকিছু একাকার হয়ে আছে। এ কবিতায় জীবন ধ্বনিত হয়েছে— ‘লিখি ইতিহাস/ আগামী দিনের এক পৃথিবীর প্রাচুর্যের গান। অনাগত মানুষের প্রাণ/ পৃথিবীর পথে পথে দিয়ে যাই সহজে জাগিয়ে/ মনের মাধুর্য আর হাতের সবল মুঠি দিয়ে।’

আহসান হাবীব যে কালখণ্ডে ‘ছায়াহরিণ’ কাব্যটি লিখেছেন সে সময়টি ছিল পাকিস্তানি শাসনামল। এ সময়ে তিনি আলাদা করে খণ্ডিত পাকিস্তান প্রীতি প্রকাশ করেননি। তবে তার পৃথিবীবিষয়ক কবিতা প্রথম কাব্যেও প্রতিফলিত। ‘রাত্রিশেষ’ কাব্যের পদক্ষেপ অংশের দ্বিতীয় কবিতায় দেখি— ‘এই মৃত স্তূপের উপর/ তারা যদি ঘর বাঁধে;/ ভাঙা-চোরা দিনের ফাটলে/ তারা যদি ভালোবেসে দিনের সূর্যের মতো জ্বলে,/ তাদের কি দেবো না হৃদয়?/ সূর্য থেকে এ পৃথিবী/ আরেক সূর্যের পানে বিস্তৃত কি নয়?’ ‘সারা দুপুর’ কাব্যেও কবির অনুভূতি ব্যাপ্ত পৃথিবীময়। ‘প্রাজ্ঞ বণিকের প্রার্থনা’ কবিতায় কবির চেতনা পৃথিবী প্রসারিত। সমগ্র পৃথিবীর নির্যাস তিনি খুঁজেছেন— ‘তৃষার পীড়নমুক্ত প্রাজ্ঞ মুহূর্তের সূর্যোদয়ে/ পৃথিবী উজ্জ্বল হবে জানি না কখন।’ ‘তারা দু’জন’ কবিতায় কবি লিখেছেন— ‘মনে হয় সব ঈর্ষা ভালোবাসা হবে/ হৃদয় সম্রাট হবে পৃথিবী।’ ‘ মেঘ বলে চৈত্রে যাবো’ কাব্যগ্রন্থেও কবিপ্রজ্ঞা দেশনিরপেক্ষ অখণ্ড পৃথিবী। মানুষ বলতেও তার কাছে স্থাননিরপেক্ষ মানুষ। ‘মানুষ পশু ইত্যাদি’ কবিতায় ইতি-নেতির পর্যালোচনাও তাই সামগ্রিকতার নিরিখে— ‘এবং এ পৃথিবীতে কে না জানে/ আজন্ম ফুলের শত্রু জান্তব জগৎ’। আহসান হাবীব-এর কবিতার ক্যানভাস সমগ্র পৃথিবী। বিষয়-উপমা-উপাত্ত কবিতায় গেঁথে দিয়েছেন বারংবার। ‘দু’হাতে দুই আদিম পাথর’ কাব্যগ্রন্থ কবির সেই চরিত্রের অনুগামী। ‘যতবার ভোর হলো’ কবিতায় দেখি— ‘এইভাবে নীলাঞ্চলে/ খু-ফুর সাম্রাজ্যের আর/ বেবিলনে জ্বেলে দিয়ে উৎসব-নগরী, আমি/ ক্ষুধা তৃষ্ণা অন্ধকার নগ্নতা এবং ঘৃণা/ এইসব নিয়ে/ অবিশ্রান্ত হেঁটেছি/এবং/ হেল্লাস পেরিয়ে এসে এখানে বসতি চেয়ে/ তিন হাজার বৎসর কেটেছে তবু/ বসতির বাইরে বসবাস।’ এ কবিতার অনুষঙ্গ কেবল বৈশ্বিক নয়। কাল পরিসীমাও তিন হাজার বছরের।

কবি আহসান হাবীব তার কবিতায় দুঃখবোধের ধারাবাহিক ধারাপাত রচনা না করলেও তার সমস্ত কাব্যেই এর ব্যাপ্তি রয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে কবি ব্যক্তিগত দুঃখের বিমূর্ত ছবি এঁকেছেন। জাতিক ভাষ্যের সঙ্গে তার আন্তর্জাতিক ভাষ্যের প্রাচুর্য জাতিগত বৈশ্বিক ভাবনার প্রতিফলন। আমাদের ভূখণ্ডে শিল্প-সাহিত্য-দর্শন সবকিছুই যখন বিশ্বায়নের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছিল এ রকম সময়ে আহসান হাবীবের বোধের পৃথিবীময় ভাবনা যেন কালের দাবি ছিল।

১০ জুলাই ছিল বাংলা কাব্যের অন্যতম পুরোধা কবি আহসান হাবীব এর প্রয়াণদিবস। এ বছর কবির জন্ম শতবর্ষ পালিত হচ্ছে। কবি-স্মরণে বিনম্র প্রণতি।

সর্বশেষ খবর