ইবিকাস, বহু বছর আগে দস্যুরা যাকে হত্যা করেছিল গ্রিসে, আপনারা হয়তো বলবেন মহুলসাধু হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে ইবিকাস হত্যাকাণ্ডের মিল রয়েছে। থাকতেই পারে। পারে বলেই তো মহুলসাধুকে ইবিকাসের বংশধর বলা হচ্ছে। ইবিকাস ছিলেন জনপ্রিয় কবি। আর মহুলসাধু? কবি কি তাকে বলা যায়? নিশ্চয়ই। যিনি গান রচেন, একতারা বাজিয়ে সুর তোলেন, সুরে সুরে পালাগানের আসর মাতান, কবি না বলে তাকে কী আর বলা যায়? আপনারাও নিশ্চয় তাকে কবি হিসেবে স্বীকৃতি দেবেন।
দুই হত্যাকাণ্ডের মধ্যে অমিল যে নেই, তা বলা যাবে না। আগেই বলেছি, ইবিকাসকে খুন করেছিল দস্যুরা। ইবিকাস যে কবি, তার কবিতা যে মানুষের মুখে মুখে ফেরে, জানত না তারা। জানলেই বা কী? দস্যুর কাজ তো দস্যুগিরি। কে কবি, কে লেখক, কে গায়ক, কে সাধক, কে বণিক, কে ফকির—তারা কি আর তদন্ত করে দেখে? যে-ই হোক, প্রথমে তার কাছ থেকে মালামাল ও টাকা-পয়সা কেড়ে নেবে। ইচ্ছে করলে বাঁচিয়ে রাখবে, না করলে মেরে ফেলবে। মহুলসাধু কোনো দস্যুর হাতে খুন হননি। এই কালে দস্যুরা জনপদে থাকে না, থাকে সুন্দরবনে অথবা গভীর সমুদ্রে। তবে কি ডাকাতরা? একজন সাধুকে, কাঁধে থলে আর হাতে একতারা ছাড়া যার পকেটে টাকা-পয়সা কিছু থাকত না, ডাকাতরা কেন হত্যা করবে?
তবে কে খুন করেছিল তাকে? কোন অপরাধে? ইবিকাসের খুনি শনাক্ত হতে বহু বছর লেগেছিল, তার বংশধর মহুলসাধুর খুনি শনাক্ত কি একদিনেই হয়ে যাবে? অন্তত এই বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে তো নয়ই। এ কালের মতো ইবিকাসের কালে খুনিকে শনাক্ত করার মতো এত এত প্রযুক্তি ছিল না। থাকা সত্ত্বেও এ দেশে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর চলে যায়, খুনিকে গ্রেফতার তো দুরস্ত, শনাক্তই করতে পারে না পুলিশ। মহুলসাধু খুনের কোনো সাক্ষী নেই, প্রমাণ নেই; খুন তাকে কোনো মানুষ করেছে, নাকি অন্ধকার রাতে তিনি যেসব জিন-পরীর সঙ্গে কথা বলতেন তারা করেছে, তা নিশ্চিত করে কে বলবে! খেয়াল-খুশি মতো যাকে ইচ্ছা তাকে খুনি হিসেবে সাব্যস্ত করে তো বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেওয়া যায় না। দেশটা তো আর মগের মুল্লুক নয়। আইনের শাসন বলে তো একটা কথা আছে।কী কারণে মহুলসাধু খুন হয়েছিলেন পুলিশের কাছে তা ছিল এক জটিল রহস্য। মহুলসাধু ছিলেন নির্ঝঞ্ঝাট মানুষ। জ্ঞানত কোনো দিন কারও অপকার করেননি, পারতপক্ষে উপকার করেছেন। মানুষ তো বটেই, মানবেতর কোনো প্রাণীও যাতে তার দ্বারা কষ্ট না পায়, সব সময় সতর্ক থাকতেন। তিনি ছিলেন সহজিয়া সাধক। যা সরল, যা শুভ, তাকে সাদরে গ্রহণ করতেন এবং যা জটিল, যা অশুভ, তাকে নির্দ্বিধায় প্রত্যাখ্যান করতেন। সব কট্টরপন্থা থেকে তার অবস্থান ছিল হাজার মাইল দূরে। কোনো রকমের সংকীর্ণতা তাকে স্পর্শ করতে পারেনি কোনো দিন। তিনি বিশ্বাস করতেন লালনের সেই বাণী : মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি। বাংলার হাজার হাজার লোকসাধকের মতো তিনিও বলতেন, সাত আসমানের উপর নয়, কাবায় নয়, গয়া-কাশী-বৃন্দাবনে নয়, মসজিদ আর মন্দিরেও নয়, ঈশ্বর থাকেন মানুষের অন্তরে। গভীর রাতে তার আখড়া থেকে ভেসে আসত এই গানের সুর—
আমি মন-মন্দিরে পূজা দেব
সত্যম শীবম অনন্তম
আমি দেল কাবাতে নামাজ পড়ব
আল্লাহ হু-আকবর।
তার আখড়াটি ছিল মেঘনা নদীর তীরে, বিআইডব্লিউটিএর একটি পরিত্যক্ত লঞ্চঘাটের কাছে। উত্তরে জনবসতি, পশ্চিমে জনবসতি, দক্ষিণে বিস্তীর্ণ চর এবং পুবে প্রমত্তা মেঘনা। তার ভক্ত-শিষ্যরা ছাড়া তেমন কেউ যেত না সেদিকে। বছরে একবার, মাঘী পূর্ণিমায়, ফকির-সন্ন্যাসীদের মজমা বসত আখড়ায়। রাতভর চলত গানের আসর। মহুলসাধু এক সময় পালাগান গাইতেন। মৌসুম এলে ব্যস্ততার সীমা থাকত না তার। কত জায়গা থেকে যে ডাক পড়ত! আজ এই গ্রামে তো কাল ওই গ্রামে, আজ এই জেলায় তো কাল ওই জেলায়। বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে গাইতেন ধর্মমঙ্গলের পালাগান, যে গানে ধর্মরাজ ও তার পূজার উৎপত্তিসহ নানা বিষয় বর্ণিত হতো। এই পালার কদর কমার পর ধরেছিলেন কৃষ্ণ ও গৌরাঙ্গ লীলার পালাকীর্তন। মহুয়া, মলুয়া, কমলা, দেওয়ান মদিনা, দস্যু কেনারাম ও ভেলুয়ার পালাতেও তার তুলনা ছিল না। হাস্যরস আর করুণরসে এমনভাবে তিনি আসর মাতিয়ে তুলতেন, পালা শেষ হওয়ার পর তাকে কদমবুচির জন্য দর্শক-শ্রোতার লাইন পড়ে যেত।
তার আখড়াটির পাশে ছিল কচুরিপানায় আকীর্ণ একটা খাল। দুপাশে ঘন বন। অন্ধকার কত গভীর হতে পারে, নিশিরাতে খালটির পারে দাঁড়ালে টের পাওয়া যায়। মহুলসাধু গভীর রাতে প্রায় সেই অন্ধকারের মুখোমুখি দাঁড়াতেন। দাঁড়িয়ে থাকতেন নিশ্চুপ। পায়ের উপর দিয়ে বিষধর সাপ হেঁটে গেলেও টের পেতেন না। হেঁটে কি যেত না? তার এক শিষ্য তো একদিন নিজচোখে দেখেছে মুখে জ্বলজ্বলে মাণিক নিয়ে একটা গোখরো সাধুর পা ডিঙিয়ে চলে যাচ্ছে, সাধু একঠায় দাঁড়িয়ে, একটা আঙ্গুলও নড়ল না।
কেন তিনি অন্ধকারের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকতেন? এমন ঘনঘোর অন্ধকারে কী দেখতেন তিনি? গ্রামের লোকেরা বলত, অন্ধকারে তিনি জিন-পরীদের সঙ্গে কথা বলতেন। জিন-পরীদের মধ্যে কি তার ভক্ত ছিল না? নিশ্চয়ই ছিল। নইলে তার মাথায় এমন লম্বা জটা ছিল কেন? চোখ দুটো সব সময় হলুদ থাকত কেন? গ্রামে এমন কথাও চালু আছে, মেঘনার ওপারে গিয়ে ফিরতে যদি কখনো রাত হয়ে যেত সাধুর, ভক্ত জিনেরা তাকে ডানায় বসিয়ে নদী পার করে দিত। মানুষ ভক্তদের সঙ্গে তো দিনের বেলায় কথাবার্তা হতো তার, ভক্ত জিনদের সঙ্গে মাঝেমধ্যে কি কথাবার্তা বলা লাগত না? দিনের বেলায় তো তাদের সঙ্গে কথা বলা যায় না, বলতে হয় নিশিরাতে, পৃথিবী যখন সুসুপ্তির আঁচলে ঢাকা পড়ে। এসব কথা শুনে মহুলসাধু হাসতেন। বলতেন, ‘নাদান মানুষ। তারা জানে না মানুষের কপালেও যে একটা চক্ষু আছে। তৃতীয় চক্ষু। অন্ধকারে সেই চক্ষু উন্মীলিত হয়।’
খালটির দক্ষিণে মেঘনার বিস্তৃত চরে অজ্ঞাত খুনির ছুরিকাঘাতে খুন হয়েছিলেন মহুলসাধু। সে দিন তিনি মেঘনার তীর ধরে দূরের গ্রাম থেকে ফিরছিলেন। কাঁধে ঝোলানো থলে, একহাতে একতারা, অন্যহাতে লাঠি। পশ্চিমের আকাশে তখন গোধূলির রং। নির্জন পথ। কোথাও জনমানুষের চিহ্ন নেই। মাঝচরে, যেখানে কাশবন, তার খানিকটা উত্তরে নিঃসঙ্গ বটগাছটার কাছে এলে পরে পেছন থেকে আচমটা ধাক্কা খেয়ে পড়ে গেলেন তিনি। দুহাতে ভর দিয়ে যেই না উঠতে যাবেন অমনি তার পিঠে ছুরির আঘাত করল ঘাতক। চিৎকার করে উঠলেন তিনি। দিগন্তে মিলিয়ে গেল তার চিৎকার। আবার যখন উঠে বসার চেষ্টা করলেন, ঘাতকের লাথি এসে পড়ল তার বুকে। এবার তিনি চিৎ হয়ে পড়ে গেলেন। ঘাতক এবার ছুরিটা বসিয়ে দিল তার পেটে। উঠে বসার মতো আর শক্তি ফেলেন না সাধু। একতারা আর চশমাটি সিথানে, থলেটা পিঠের নিচে এবং লাঠিটা পড়ে রইল পায়ের কাছে। রক্তে ভিজে যেতে লাগল চরের মাটি। ঝাপসা চোখে তিনি ঘাতকের মুখের দিকে তাকালেন। দাঁত বের করে হাসছে ঘাতক। সাধুর দৃষ্টি চলে গেল আকাশের দিকে। ডানায় সোনালি আবীরের রং মাখিয়ে একঝাঁক পায়রা উড়ছে আকাশে। ডান হাতটা ঊর্ধ্বে তুলে উড়ন্ত পায়রাদের উদ্দেশে তিনি বললেন, ‘দেখ কী নির্মমভাবে আমাকে খুন করল। একমাত্র তোমরাই এই খুনের সাক্ষী। আমার হত্যার প্রতিশোধ তোমরা নেবে। নিতেই হবে।’
অট্টহাসি দিল ঘাতক। হত্যার প্রতিশোধ নেবে পায়রা! গাঁজা খেতে খেতে বেটার মাথাটাই গেছে, মরার সময় তাই আবোল-তাবোল বকছে। ছুরিটা এবার সাধুর বুকে বসিয়ে দিল নিষ্ঠুর ঘাতক। টান মেরে ছুরিটা খুলে আবার। ছুরিটা বুকের ভিতর সেঁধিয়ে রেখে বলল, ‘প্রতিশোধ মারাচ্ছিস শালা? প্রতিশোধ? আজীবন গান-বাজনা করে মানুষের ইমান নষ্ট করেছিস, তোর লাশ এবার শেয়াল-কুকুরে খাবে মালাউনের বাচ্চা।’
মহুলসাধুর যদি তখন হুঁশ থাকত, গান-বাজনা করে মানুষের ইমান নষ্টের কথা শুনে তার মুখে ফুটে উঠত হাসির বাঁক রেখা। হয়তো বলতেন, ‘নাদান মানুষ বোঝে না সুর যে মানব-সভ্যতার সর্বশ্রেষ্ঠ আবিষ্কারের একটি।’
দুই.
যেদিন মহুলসাধু খুন হলেন তার পরদিনই এলাকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে না পারার ব্যর্থতার দায়ে স্ট্যান্ড রিলিজ হলেন থানার ওসি নববিক্রম খীসা। হতেন না, যদি না বিক্ষুব্ধ জনতা থানা ঘেরাও করত। করবে না? মহুলসাধুর মতো একজন মানুষ, দিকে দিকে যার নামডাক, নির্মমভাবে খুন হয়ে গেলেন, সারা রাত তার লাশ পড়ে থাকল মেঘনার চরে, শিয়ালেরা টানাহেঁচড়া করল তার লাশ অথচ ওসি কিনা থানায় বসে মদ খেয়ে চুর হয়ে থাকলেন! এমন ওসি থানায় থাকলে মানুষ তো আরও খুন হবে। সেদিন সকালেই ক্ষমতাসীন দলের থানা কমিটির সেক্রেটারি বখতিয়ার উদ্দিনের ডান হাত বেলাল হোসেন মন্টুর নেতৃত্বে দলের শত শত নেতা-কর্মী থানা ঘেরাও করল। তাদের সঙ্গে যোগ দিল বাজারের বণিক সমিতির সদস্যরা। ওসির ওপর বণিকরা তো আগে থেকেই খেপা। এ থানায় আসার ১০ দিনের মাথায় ভিত্তিহীন অভিযোগের ভিত্তিতে বাজারের তিন ব্যবসায়ীকে ধরে নিয়ে হেনস্তা করেছেন ওসি। দুজন হোটেল মালিক, একজন মুদি দোকানদার। হোটেল মালিকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তারা নাকি হোটেলে পচা-বাসি খাবার এবং মুদি দোকানদার নাকি সয়াবিনের সঙ্গে পামঅয়েল মিশিয়ে বিক্রি করে। কোনো সাক্ষী-প্রমাণ নেই। স্রেফ ডান্ডার জোরে ওসি নিরপরাধ তিন ব্যবসায়ীকে হেনস্তা করেন। সেই থেকে তাকে উচিত একটা শিক্ষা দেওয়ার মওকা খুঁজছিল ব্যবসায়ীরা। মহুলসাধু হত্যার ঘটনায় মওকাটা মিলে গেল। ওসিকে এবার তারা বুঝিয়ে দেবে জনতার শক্তি কাকে বলে। জনগণের সেবক হয়ে তুমি বেআইনিভাবে জনগণকে হেনস্তা করবে, এত বড় সাহস তুমি পেলে কোথা থেকে?
শুধু কি ব্যবসায়ীদের হেনস্তা? এক মাসের মাথায় গ্রেফতার করলেন ক্ষমতাসীন দলের ত্যাগী ছাত্রনেতা সোহেলকে। অভিযোগ, সোহেল নাকি অস্ত্র নিয়ে কলেজে আসে। সম্পূর্ণ কাল্পনিক অভিযোগ। ওসি কি নিজ চোখে তার হাতে কখনো অস্ত্র দেখেছেন? বিরোধীদলীয় নেতাদের কান কথায় বিশ্বাস করে তিনি রোলিং পার্টির ছাত্রনেতাকে কিনা গ্রেফতার করলেন! তার মুক্তির জন্য খোদ বখতিয়ার উদ্দিন ফোন করলেন ওসিকে। এমনই তেড়া তার ঘাড়, বখতিয়ার উদ্দিনের মতো নেতাকেও পাত্তা দিলেন না, মামলা দিয়ে সোহেলকে জেলে চালান করে দিলেন।
বিক্ষুব্ধ জনতাকে ওসি বোঝাতে চেষ্টা করলেন, মহুলসাধু খুন হওয়ার রাতে মদ খেয়ে চুর হয়ে থাকার যে অভিযোগ তার বিরুদ্ধে তা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। তার সুনাম ক্ষুণ্ন করার জন্য কুচক্রী মহল এসব বানোয়াট কথা প্রচার করছে। যে করেই হোক মহুলসাধুর খুনিকে তিনি দ্রুত গ্রেফতার করবেন। জনতা কি তার কথা বিশ্বাস করে! ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ওসির অপসারণের দাবিতে স্লোগান দিতে লাগল তারা। উসকানি দিতে থাকে বেলাল হোসেন। কতক্ষণ পরপরই সে জনতার মুখে স্লোগান তুলে দেয়, ‘ব্যর্থ ওসির বদলি চাই, করতে হবে করে দাও।’ স্লোগান চলতে থাকে। ‘মহুলসাধুর রক্ত বৃথা যেতে দেব না’, ‘হৈহৈ রৈরৈ খুনি তুই গেলি কই’ ইত্যাদি স্লোগানে কাঁপিয়ে দিতে লাগল থানা এলাকা।
বখতিয়ার উদ্দিন তখন জেলাশহরে। ওসির বিরুদ্ধে নালিশ করতে ভোরেই তিনি দলের জেলা কমিটির সভাপতির বাড়িতে হাজির হয়েছেন। সভাপতি কি আর চুপ করে বসে থাকতে পারেন? ছুটে গেলেন এসপি অফিসে। এসপিকে না পেয়ে ওসির বিরুদ্ধে নালিশ করলেন এএসপির কাছে। এএসপি কি আর ওসিকে প্রত্যাহার না করে পারেন? জনতার দাবি বলে কথা। দেশের মালিক জনগণ। জনতার সেবায় যে ওসি, সেই জনতাই যদি তার বদলি দাবি করে, এএসপির কী করার আছে। জননেতাদের নালিশ তো তিনি উপেক্ষা করতে পারেন না।
সেদিনই তল্পিতল্পা গুটিয়ে চলে গেলেন ওসি। গাড়িতে উঠার আগে একটি চিঠি লিখে খামে ভরে এক কনস্টেবলের মাধ্যমে পাঠিয়ে দিলেন বখতিয়ার উদ্দিনের কাছে। চিঠিতে তিনি লিখলেন— ‘আমাকে স্ট্যান্ড রিলিজ করা হয়েছে, সাসপেন্ড করা হয়নি। বেঁচে থাকলে আরও অনেক দিন চাকরি করব। একদিন না একদিন আমার প্রমোশন হবেই। যে করেই হোক, একদিন আমি এ জেলায় বদলি হয়ে আসব। মহুলসাধুর খুনিকে তখন খুঁজে বের করবই।’
তিন.
তের বছর গড়িয়ে গেল। মহুলসাধুর কথা প্রায় ভুলে গেছে সবাই। ততদিনে সাধুর আখড়াটিও বেদখল। বখতিয়ার উদ্দিন এখন দলের থানা কমিটির সভাপতি ও সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এবং তার ডান হাত বেলাল হোসেন মন্টু সাংগঠনিক সম্পাদক। এখনো সে বখতিয়ারের অনুগত। তার কথার বাইরে এক কদমও নড়ে না। ওসি নববিক্রম খীসা কোন থানায় চাকরি করছেন, প্রমোশন আদৌ পেলেন কিনা, বেঁচে আছেন না মরে গেছেন, তার খবর নেই। তার কথা এলাকার কারও মনেও পড়ে না। থানার ওসি এখন আবদুল মালেক। মন্টুর মতো তিনিও কখনো বখতিয়ারে কথার বাইরে যান না। এলাকার কাউকে গ্রেফতার করার আগে তার অনুমতি নেন। জেলে চালান করতে বললে চালান করেন, ছেড়ে দিতে বললে ছেড়ে দেন। ছাড়ার সময় যত পারেন টাকা খসিয়ে নেন। খসানো টাকার একটা অংশ দিয়ে দেন বখতিয়ারকে।
গ্রামবাসীর সুবিধার্থে অনেক চেষ্টা-তদবির করে পরিত্যাক্ত লঞ্চঘাটটি আবার চালুর উদ্যোগ নিয়েছেন বখতিয়ার। লঞ্চঘাট উদ্বোধন উপলক্ষে বিশাল জনসভার আয়োজন করা হলো। মাইকিং করা হলো দুদিন ধরে। প্রধান অতিথি বখতিয়ার উদ্দিন এবং বিশেষ অতিথি ওসি আবদুল মালেক এবং বেলাল হোসেন মন্টু। সেদিন সভা শুরু হওয়ার কথা ছিল বিকাল ৪টায়। জেলাশহরে বখতিয়ারের বিশেষ কাজ থাকায় তিনি সভামঞ্চে এসে পৌঁছলেন ৫টায়। জ্যৈষ্ঠ মাসের ৫টা মানে মাথার ওপর রোদের প্রখর তাপ। অপেক্ষা আর গরমে হয়রান উপস্থিত জনতা। ফিতা কেটে ঘাট উদ্বোধনের পর শুরু হলো বক্তৃতার পালা। প্রথমে বক্তৃতা দিলেন দলের ইউনিয়ন কমিটির দুজন নেতা, তারপর স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান ও থানা কমিটির একজন নেতা। তারপর শুরু হলো বিশেষ অতিথির বক্তৃতা। প্রথমে বক্তব্য রাখবেন বেলাল হোসেন মন্টু। সূর্য তখন ঘাপটি মেরে বসে মেঘনার জলে রং মেশাচ্ছে, পশ্চিমের আকাশে জেগেছে রঙিন আবির, পাখিরা উড়াল দিতে শুরু করেছে নীড়ের পানে। প্রধান অতিথি, বিশেষ অতিথি এবং উপস্থিত জনতাকে সালাম ও শুভেচ্ছা জানিয়ে বক্তৃতা শুরু করল মন্টু। গলাখাকারি দিয়ে যখন মূল বক্তৃতায় যাবে, মাথার উপর মুক্ত আকাশে তখন এক ঝাঁক উড়ন্ত পায়রা দেখে তর্জনীর ইশারা করে বক্তৃতার বদলে স্বতঃস্ফূর্তভাবে বলে উঠল, ‘ঐ যে মহুলসাধুর হত্যার প্রতিশোধকারীরা ওড়ে যায়।’
জনতার চোখ ফিরল আকাশের দিকে। বক্তৃতার মাঝখানে নেতা কেন পায়রার প্রসঙ্গ টানলেন কেউ কিছু বুঝে উঠতে পারে না। খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়লেন বখতিয়ার উদ্দিন। তার বিব্রত মুখখানা দেখে হেসে দিলেন ওসি আবদুল মালেক। পায়ের ওপর পা তুলে বসে খেঁক খেঁক করে হাসেন আর গোঁফে তা দেন।
সেদিন রাতেই গ্রেফতার হয় বেলাল হোসেন মন্টু এবং চার দিন পর বখতিয়ার উদ্দিন।