শুক্রবার, ২০ অক্টোবর, ২০১৭ ০০:০০ টা

আমাদের কিশোরী কন্যারা কুরূপা হয়ে যাক রাতারাতি

পূরবী বসু

আমাদের কিশোরী কন্যারা কুরূপা হয়ে যাক রাতারাতি

আমি যদি অলৌকিকতায় বিশ্বাস করতে পারতাম, যদি জানতাম বা দেখতাম অন্যায় কাজের, বিশেষ করে অকারণে মানসিক/শারীরিক চাপ সৃষ্টি করে অসহায় নারী-শিশুকে দলিত-মথিত, বিব্রত, মৃত করার অপরাধে কঠোর শাস্তি কার্যকর করা সম্ভব, তাহলে বলতাম এ মুহূর্তে সামাজিকভাবে আমাদের দেশে অন্যতম জরুরি কাজ হলো, আমাদের অবুঝ, নিষ্পাপ কিশোরীদের আত্মহত্যার প্ররোচনা থেকে বাঁচানো— অশুভ শক্তির হাত থেকে তাদের রক্ষা করা। আসল দোষীদের খুঁজে বের করে যথোপযুক্ত শাস্তি দেওয়া। আর তা শুধু অফিসের টেবিলের ওপর আইনের বই বা খাতা কিংবা পিন দিয়ে আটকানো ছাপানো প্রজ্ঞাপনের পৃষ্ঠাসমূহের উপস্থিতি নয়। সত্যিকার জীবনে আইন অনুযায়ী কঠিন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা সরকার। আর সেটা তাত্ক্ষণিকভাবে কার্যকর করতে হবে। অনেকটা জরুরি অবস্থার মতো। পশ্চিম বাংলায় যৌতুকের জন্য বধূ যাতনা বা হত্যা/আত্মহত্যা নিবারণ এরকম কঠিন নিয়ম করে কার্যকর করা হয়েছে। সেখানে পুনঃ পুনঃ গণমাধ্যমে তা প্রচারিত হতে হতে, বিভিন্ন টার্গেট গ্রুপে প্রশিক্ষণ দিতে দিতে সমাজের মানুষের ‘মাইন্ডসেট’ বা মানসিক প্রক্রিয়া আজ এমন হয়েছে যে, নববধূকে কোনোরকম অত্যাচার বা গালাগালের আগে শ্বশুরবাড়ির লোক তিনবার ভাবে যাতে জেলের ভাত খেতে না হয়। এ ব্যাপারে পাড়াপ্রতিবেশী, আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা, উকিল, এনজিও কর্মী সবারই সচেতনতা, সততা ও শুভবুদ্ধির প্রয়োজন। প্রয়োজন ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের বড় বা মাঝারি কিংবা ছোট ক্ষমতাধরদের নাক গলাতে না দেওয়া। অপরাধী, সে যে-ই হোক না কেন? সামাজিক অন্যায় ও অবিচারে দিশাহারা হয়ে কিশোরী-আত্মহত্যা যেন মহামারী আকার ধারণ করেছে আজ, আমাদের দেশে। গতির ও ক্ষতির দিক দিয়েও একমাত্র মহামারীর সঙ্গেই তুলনীয় এই ঘটনা—এই সামাজিক সমস্যা।

কাহিনী সর্বত্র-ই এক। কিশোরী বা সদ্য যৌবনে পা দেওয়া মেয়েটি দেখতে-শুনতে ভালো। স্বাস্থ্য সুন্দর। বয়স, সৌন্দর্য ও স্বাস্থ্য মিলে মেয়েটি লোকের দৃষ্টি কাড়ে। সব সুন্দর, নান্দনিক বস্তুই আশপাশের লোকের চোখে পড়ে। দৃষ্টিতে প্রশান্তি আসে। আমাদের ভালো লাগে সে দিকে তাকাতে। যেমন লাগে ফুলগাছে গুচ্ছ গুচ্ছ ফুলের সম্ভার দেখতে। মুগ্ধ হতে। চোখের সামনে কিছু দেখে মনে মনে প্রশ্বস্তি করা, ভালো লাগা, এটা স্বাভাবিক ব্যাপার। মানবিক দোষের কিছু নেই। সীমানাটা এ পর্যন্ত টানলে, এখানেই ভদ্রতার রাশ ধরতে পারলে কারওই অসুবিধা হয় না। কারও কোনো ক্ষতিও হয় না। সেরকম কোনো কথাই ওঠে না। বরং সুন্দর কোনো জিনিসকে দেখে দূর থেকে প্রশংসা করলে, দৃশ্যটি দেখে মুগ্ধ হলে জীবনটা বরং আরও পরিপূর্ণ ও সুন্দর মনে হতে পারে। আরও মোহনীয় হয়ে উঠতে পারে বেঁচে থাকা। কিন্তু সমস্যা হলো আমাদের বখাটে ছেলেরা সেখানেই থেমে থাকে না। তারা জানে না তাদের চলাচলের সীমারেখা স্থির করতে। কোথায় কতদূরে, তাদের থামতে হবে। আর তাই স্কুলে, মাস্টারের কাছে পড়তে যাওয়ার সময় পথের মাঝখানে পদে পদে হতে হয় মেয়েদের লাঞ্ছিত। নানা কু-প্রস্তাব, যৌনভাবভঙ্গি, অশ্লীল মন্তব্য ছুড়ে মারে কুলাঙ্গার তরুণগুলো রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে মেয়েটির উদ্দেশে। প্রথমে মেয়েটি বিব্রত হয়। তাড়াতাড়ি সরে পড়ে ঘটনাস্থল থেকে। দিন গেলে মাস্তানদের সাহস বেড়ে যায়, রাস্তার ধার থেকে নয়, সরাসরি রাস্তায় মেয়েটির সামনে নেমে আসে। বখাটের দলকে এত কাছে দেখে মেয়েটি ভয় পায়। কিন্তু প্রতিবাদের ভাষা কড়া হলে হয়তো গায়ে হাত দিয়ে অপমান করে বসে ওরা। উপায় না পেয়ে বড় ভাই, পিতা বা অন্য অভিভাবকদের জানাতে হয়। কিন্তু তারা এই গুণ্ডাদের চ্যালেঞ্জ করলে কন্যা এবং অন্য লোকজনের সামনেই হয়তো তাদের মৌখিক বা দৈহিক নির্যাতন সইতে হয় খোলা রাস্তার ওপর অথবা নিজ বাড়িতেই ওইসব বখাটে দ্বারা। সব দেখে দুঃখে, অভিমানে, অপমানে মেয়েটি গলায় ওড়না পেঁচিয়ে বা বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করে পরিবারকে মুক্তি দিতে চায়। এটা এত বেশি পরিচিত ঘটনা হয়ে গেছে যে, কাগজে এ ধরনের দুঃসংবাদ পড়ে আমরা আর চমকে উঠি না। এটা যেন এক অতি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া বা ঘটনায় পরিণত হয়ে গেছে। কচিকচি সম্ভাবনাময় সতেজ প্রাণের সাধারণ ঘরের অল্প বয়সী মেয়েরা শিকার হয় যৌন হয়রানির। প্রধানত সেসব মাস্তান ছেলেদের দ্বারা যাদের ক্ষমতা প্রদর্শনের অভ্যাস আছে, আছে ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক যোগাযোগ। প্রায় সময়েই নিরঙ্কুশ বলি মেয়েরা এ ধরনের নিরন্তর অত্যাচার মুখ বুজে সহ্য করে যায়। কেননা এসব কথা অভিভাবক বা ভাইবোন-বন্ধুদের বললে তারা তার নিরাপত্তা ও সম্মানের জন্য এগিয়ে এসে ওদের বাধা দেবে। আর বাধা দিলে ওরা ভয়ঙ্কর রূপ নেবে। এসব দেখে-শুনে মেয়েটি কষ্টে-অপমানে শিউরে ওঠে। আত্মহত্যাই এ সমস্যার একমাত্র সমাধান মনে হয় তার। ধারণা হয় সে নিজেই একটা আপদ সংসারে এবং কেবল তার জন্যই পরিবারে অশান্তি হচ্ছে। ফলে তার এই পৃথিবী থেকে বিদায় সব অশান্তি নির্মূল করবে।

কখনো আবার দেখা যায় শুধু মৌখিক হেনস্থা নয়, জোর করে পছন্দের মেয়েকে রাস্তা থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করে এসব নিষ্ঠুর বখাটে ছেলে বা ছেলেরা। আবার কখনো কখনো সেই ধর্ষণের দৃশ্য ধারণ করে রাখে ভিডিওতে। পরবর্তীকালে ওই ভিডিও জনসম্মুখে বা ফেসবুক জাতীয় সামাজিক মিডিয়াতে প্রকাশ করার ভয় দেখিয়ে তখন যত্রতত্র যে কেউ তার দেহ ভোগ করতে শুরু করে। পরিণতিতে মৃত্যুকে আমন্ত্রণ করা ছাড়া মুক্তির আর কোনো উপায় খুঁজে পায় না অসহায় কিশোরী। থানায় গিয়ে সব বললেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে মামলা গ্রহণ করা হয় না। কেননা বেশির ভাগ সময়ই এই যৌন সন্ত্রাসীরা হয়ে থাকে রাজনৈতিক আশীর্বাদপুষ্ট নির্ভীক অপরাধী তরুণ। কখনো ঘটনাটি অতি জানাজানি হয়ে গেলে বা গণমাধ্যমে বেশি কথা উঠলে মামলা গ্রহণ করতে বাধ্য হয় থানা। আসামিকে গ্রেফতারও করা হয় কখনো কখনো, কিন্তু তারপর নানা অজুহাতে কয়েক দিন পরই তাকে আবার নিশ্চুপে ছেড়ে দেওয়া হয়।

স্বেচ্ছামৃত্যুর শিকার অল্পবয়সী নিষ্পাপ মৃত মেয়েগুলোর মুখের দিকে তাকিয়ে বুকের ভিতরে হু হু করে ওঠে। বিনা দোষে ওদের এই মর্মান্তিক পরিণতি মানা যায় না। আমি ওদের ছবির দিকে তাকাই আর ভাবি। এ ধরনের ঘটনায় মৃত সব কিশোরীর ভিতর কিছু সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়। তারা প্রায় সবাই দেখতে সুন্দর, স্বাস্থ্যবতী, সদ্য উন্মেষিত যৌবনের উপকরণে সমৃদ্ধ। এই মেয়েদের উদ্দেশ করে তাই আগেও বহুবার বলেছি, এখনো বলি, (আশা করি ভবিষ্যতে বলতে হবে না) মানুষের জীবন, মেয়েদের শরীর মাটির কলসির মতো এমন ভঙ্গুর বা সস্তা নয়, যে একটু আঘাত লাগলেই তা ভেঙে যাবে বা তাকে... ফেলে দিতে হবে। ধর্ষণের মতো বড় অপরাধ, একজন নারীর শরীর-মনের ওপর দিয়ে যে ঝড়, যে নির্যাতন ঘটায়, তা তুলনাবিহীন। তা সত্ত্বেও ধর্ষণ বা টিপ্পনি/অশ্লীল বাক্য বা প্রস্তাব ছুড়ে ফেলার উত্তরে নিজেকে হত্যা করার মতো বোকামি, নিজেকে এই পৃথিবীর রূপ, রস, গন্ধ, স্পর্শ থেকে চিরতরে বঞ্চিত করার কোনো যুক্তি বা বৈধতা নেই। মূল সমস্যারও কোনো সমাধান হয় না তাতে। কখনো হতে পারে না। বেয়াদবদের শাসানিমতো অবাঞ্ছিত যদি কিছু ঘটেও যায় তবু তাকে বাধা দিয়ে তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে অপরাধীর শাস্তির জন্য যা কিছু করণীয় করে যেতে হবে। সংঘবদ্ধভাবে বর্তমান বা ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে বর্তমান সংকটের মোকাবিলা করতে হবে। নিজের পরিবারকে ছারখার করে দেওয়া ছাড়া আত্মহত্যা কোনো রকম সমাধান আনে না। কারও মঙ্গল বয়ে আনে না এ ঘটনা। অপরাধের শিকার মেয়েটির মরে যাওয়া মানে তার ওপর সংঘটিত সর্বোচ্চ অপরাধের সব আলামত, সব অভিযোগ নস্যাৎ করে দিয়ে অপরাধীকে মুক্ত করে দেওয়া। আর তাই ধর্ষণের শিকার মেয়েটির উদ্দেশে আমি বার বার বলেছি, তোমার আক্রমণকারীরা ওদের নোংরা কাজ, ওদের কলুষিত শরীর দিয়ে নিজেরাই পতিত হয়েছে মানুষ হিসেবে। তুমি তো নষ্ট হওনি। কোন অপরাধে কোন শক্তিতে সমাজ তোমাকে ছোট করে দেখবে? বরং ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্র যে তোমাকে নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হলো—এজন্য লজ্জা হবে তাদের। শতবার তোমার কাছে ক্ষমা চাইবে তারা, কারণ এটা তাদের দায়িত্ব ছিল। তুমি গা ঝেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে পদ্মপুকুর বা বড় দিঘি কি কলের জলে, সাবান মেখে নিজেকে ভালো করে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে বহুক্ষণ ধরে অবগাহন করবে। হয় বিশাল জলাশয়ে কিংবা শরীরে অনবরত পানি ঢেলে কলের নিচে। গোসলের আগে অপরাধীকে শনাক্ত করার জন্য যা যা আলামত দেওয়া দরকার ডাক্তারকে, পুলিশকে তা আগে দিয়ে আসবে। তক্ষুনি জরুরি চিকিৎসার দরকার হলে নিয়ে নেবে। তারপরই তুমি অনেকক্ষণ ধরে একটানা স্নান করবে। পরিচ্ছন্ন হয়ে গা, চুল মুছে ভালো করে ধোয়া শুকনো কাপড় পরবে। আয়নার সামনে গিয়ে নিজেকে দেখবে। ভালো করে তাকালে দেখবে, ঠিক আগের সেই সুন্দর মানুষটিই তুমি রয়েছ। কেবল কতগুলো হায়েনার উপস্থিতি টের পেয়েছ ইতিমধ্যে, কিন্তু তোমাকে পরাস্ত করতে পারেনি তারা। নিজেকে বোঝাও অন্য একজনের অপরাধের বোঝা তুমি তোমার কাঁধে নেবে না। তুমি নিরপরাধ। তুমি চাও তোমার ওপর এই অন্যায় অযাচিত হামলার প্রতিশোধ নিতে—দোষী ব্যক্তিকে শাস্তি দিতে। আর এই গুরুতর অপরাধের শাস্তি নিশ্চিত করতেও তোমাকে বেঁচে থাকতে হবে, তুমি মরে গেলে কে তোমার হয়ে যুদ্ধ করবে? বল!

আমাদের এত লেখালেখি, সমাজকর্মীদের এত বক্তৃতা, মনোবিজ্ঞানীদের নানা প্রশ্ন ও থেরাপি (যেখানে প্রযোজ্য), অভিভাবকদের চব্বিশ ঘণ্টার এত পাহারার পরেও যখন একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখি, ফুটফুটে কিশোরীদের অনবরত আত্মহত্যা করতে শুনি, বিশেষত মফস্বল শহর বা গ্রামাঞ্চলে, তখন মনে হয় সোনার কাঠি রুপোর কাঠির স্পর্শ ও তাদের স্থান পরিবর্তন করিয়ে কিংবা কোনো ফুস মন্তরের মাধ্যমে অলৌকিকভাবে ও সাময়িকভাব যদি আমাদের সব কিশোরীকে রাতারাতি কুরূপা ও অনাকর্ষণীয়া করে দেওয়া যেত! যদি কয়েক বছরের জন্য তাদের ভরন্ত পেলব শরীর হতো হাড় গিলগিলে লিকলিকে অথচ সুস্থ। প্রারম্ভিক যৌবন তাদের গায়ে ছোঁয়া দিতে যদি দেরি করত কয়েকটা বছর! কিন্তু তাদের বৌদ্ধিক ও জাগতিক জ্ঞান ও উপলব্ধি এবং জীবন-সঞ্চিত অভিজ্ঞতা যদি প্রকৃত বয়স অনুযায়ী অগ্রসর হতো! এভাবে যদি চার থেকে পাঁচটা বছর একরকম মেটামরফোসিস (রূপান্তর) বা হাইবারনেশনে (লোকালয় থেকে অদৃশ্য জীবনাংশ) চলে গিয়ে এই মানুষখেকো দস্যুদের কাছ থেকে বাঁচতে পারত আমাদের কিশোরীরা! অর্থাৎ সতর্কতার সঙ্গে বিশেষ লক্ষ্য রেখে ২০ বছর বয়স না হওয়া পর্যন্ত এভাবে যদি ওদের বাঁচিয়ে রাখা যেত! যেমন করে উজ্জ্বল রঙের বর্ণিল প্রজাপতি কদাকার শুয়োপোকার শুককীট ও মূককীটের জীবনচক্রের ভিতর দিয়ে গিয়ে কোনোমতে জীবনধারণ করে অবশেষে আকর্ষণীয় উজ্জ্বল রঙের প্রজাপতিতে রূপান্তরিত হয়ে রঙিন ডানা মেলে আকাশে উড়ে বেড়ায়। আমি এতক্ষণ যে পরাবাস্তবতার কথা বললাম, তা নেহাতই হতাশা থেকে। আগেই বলেছি, অলৌকিকতায় বিশ্বাস নেই আমার। তবু আমরা আজ এমন করে কোণঠাসা হয়ে পড়েছি যে মনে হয় কিশোরী আত্মহত্যা এ মুহূর্তে এমন ব্যাপক আকারে দেখা দিয়েছে যে, অলৌকিকভাবে কিছু ঘটলেই বুঝি কেবল এ সমস্যার সমাধান হতে পারে। কিন্তু তা তো দিবাস্বপ্ন। পৌরাণিক কাহিনীতে এসব ঘটলেও আমাদের বেলায় তার কোনো সম্ভাবনা নেই। ফলে সব মানুষের, বিশেষ করে এনজিও কর্মী, গণমাধ্যমের লোকজন ও পাড়া-প্রতিবেশীদের সচেতনতা বৃদ্ধি ও সজাগ থাকা এবং আইনজ্ঞ ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার জোরালো ভূমিকা গ্রহণ, সেই সঙ্গে অপরাধী মুক্তিতে রাজনৈতিক নেতাদের হস্তক্ষেপ রহিত করা, একমাত্র পথ এ সমস্যা সমাধানের।

একবার কুড়ি-একুশ বছরের বয়োচিত পরিণতমনস্ক নারীতে রূপান্তরিত হলে নিজের শরীর-মনের ওপর শুধু নয়, পারিপার্শ্বিকতার ওপরও যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা অর্জন করতে সক্ষম হবে মেয়েটি। অনেকটাই আয়ত্তে থাকবে তার নিজস্বভাব, অনুভূতি, আবেগ, তাত্ক্ষণিক কাজের উন্মাদনার ওপর। এ ধরনের করুণ, মর্মান্তিক মৃত্যু, জাতীয় সম্পদের বিনাশ, সম্ভাবনার অপচয়, পারিবারিক বিপর্যয় এড়ানোও হয়তো সম্ভব হবে তখন। আমরা সব শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ একত্রিত হয়ে দলবদ্ধভাবে কি পারি না এই অসহায় কিশোরী/প্রাক-কিশোরীদের কয়েকটি বছর আগলে রাখতে, যতদিন পর্যন্ত ওরা পরিণতমনস্ক হয়ে না উঠছে, অথবা আরও উত্কৃষ্ট হতো, যতদিন না রাষ্ট্রের সর্বত্র ন্যায়ের শাসন প্রবর্তিত হতো!

আমি ব্যক্তিগতভাবে নিজের লেখা একটা কবিতা এই কচি অবুঝ মেয়েদের জন্য উৎসর্গ করেছি। যারা দুর্বৃত্ত দ্বারা নিষ্ঠুরভাবে ধর্ষিত হয়েছে, কিন্তু সুবিচার পায়নি। অপরাধীর কোনো শাস্তিও হয়নি। এসব হতাশ ও নির্যাতিত মেয়েদের স্বেচ্ছা মৃত্যু গ্রহণ না করে বেঁচে থাকার জন্য আকুতি জানিয়ে আমার এই কবিতা : (পুনঃমুদ্রিত)।

ওঠ ছেমরি, ওঠ এবারে, দূর করে দে ভয়,

জানিস না কি এমনি করেই আমাদের বেঁচে থাকতে হয়।

যা ছেমরি, পুকুর ঘাটে, গোসল সেরে আয়

ঘষে মেজে নাইবি যাতে নোংরা মুছে যায়।

 

কান্না কীসের? বলি মেয়ে, চোখে কেন জল?

এমন কী আর হয়নি আগে নিজের মুখেই বল!

গেল বছর চৈত্র মাসের কাল বোশেখীতে,

জয়া গেল ঝড়-তুফানে আম কুড়াইতে।

 

কোথায় জয়া! কোথায় আম! সন্ধ্যা নামে ঘাটে

বেহুঁশ মেয়ে খুঁজে পেতে সারাটা রাত কাটে।

ভাগ্য তবু ভালো জয়ার, বেঁচে তো সে আছে!

মুখে রা’ নেই, যদি আরও ক্ষতি হয় তার পাছে।

 

আরও ক্ষতি? সে কী জিনিস জানতে আমি চাই,

ওরা বলে, ‘হতেই পারতো জীবনটাই আর নাই’।

তাই তো বলি, কান্না ভুলে ওঠ এবারে, স্নানটা সেরে আয়

জানিস না কি পদ্মপুকুর জলে সব ময়লা ধুয়ে যায়!

 

পুনশ্চঃ আমাদের দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে তিরিশ লাখ নারী নির্বিচারে ধর্ষিত হয়েছিল মাত্র দশ মাস সময় সীমার মধ্যে। যে দেশ স্বাধীনতার পঁয়তাল্লিশ বছর পরেও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করে তাদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করে, সে দেশের পথে-ঘাটে ধর্ষণের মতো অপরাধ আজো সংঘটিত হওয়ার কথা নয়। সেই সঙ্গে এটাও স্বীকার্য ধর্ষণ খুন-জখমের মতোই একটি মারাত্মক এবং ভয়ঙ্কর অপরাধ। তা সত্ত্বেও মুক্তিযুদ্ধের সময়কার সর্বব্যাপী অভিজ্ঞতার পর ধর্ষণ সম্পর্কে মাত্রাতিরিক্ত স্পর্শকাতরতা থাকা উচিত ছিল না আমাদের মূল্যবোধে। এটি নিঃসন্দেহে একটি মারাত্মক লঙ্ঘন। অপরাধীকে অবশ্যই শাস্তি দেব আমরা। কিন্তু সেই সঙ্গে অপরাধের শিকারকে দুহাতে বুকে তুলে নেব। সামাজিকভাবে পুনর্বাসিত করব তাকে। বাঁকা চোখে তার দিকে তাকাবার স্পর্ধা যেন কারও না হয়।

এই লেখাটা শেষ করে কাগজে পাঠাবার মুহূর্তে একটি সুসংবাদ চোখে পড়ল আজকের (১৭ অক্টোবর, ২০১৭) আমাদের সময় কাগজে। সংবাদটির একাংশ হুবহু তুলে দিলাম “... এ অবস্থা থেকে উত্তরণে ‘জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০’ এর আলোকে নারীদের শিক্ষা ও জ্ঞানের সমৃদ্ধির জন্য নতুন প্রকল্প হাতে নিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। ছয় মহীয়সী নারী প্রকল্পের আওতায় বেগম রোকেয়া, শেখ ফজিলাতুন নেছা, সুফিয়া কামাল, প্রীতিলতা, নবাব ফয়জুন্নেছা চৌধুরাণী এবং সারদা সুন্দরী—এই ছয় মহীয়সী নারীর নামে গড়ে ওঠা শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানগুলোয় একাডেমিক ও আবাসিক ভবন নির্মাণ করে ছাত্রীদের শারীরিক ও মানসিক দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য নানা রকম প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের সাধারণ কর্মকাণ্ডের বাইরে ষষ্ঠ থেকে দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রীকে আলাদা করে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই প্রশিক্ষণের মাধ্যমে নারী শিক্ষার যুগান্তকারী পরিবর্তন হবে।”

এই শুভ উদ্যোগের জন্য সরকারকে অভিনন্দন জানাই। মনে পড়ে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ছাত্রী লীলা নাগ তার দীপালী সংঘের মাধ্যমে নারীদের পড়াশোনার পাঠ্যক্রমের সঙ্গে শারীরিক শক্তি অর্জন ও নিজেদের রক্ষা করার কলাকৌশল আয়ত্ত করার জন্য প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন বিভিন্ন বাস্তব সূচি গ্রহণ করে। আমি আশা করব, এই মহীয়সী নারীর স্থাপিত ঢাকার বিখ্যাত স্কুলগুলোর হোস্টেলও যেন এ প্রকল্পের আওতায় আনা হয়। নারী শিক্ষায় লীলা নাগের বহুবিধ অবদান বিশেষ করে নারীর শরীর ও মনের সুস্থ বিকাশ ও নিরাপত্তার ব্যাপারে প্রশিক্ষণ দানের কথা ভোলার নয়। বিভিন্ন ধরনের ব্যায়াম, লাঠিখেলা থেকে শুরু করে বহু ধরনের প্রশিক্ষণ অন্তর্ভুক্ত ছিল সেখানে। আশা করি সরকারের এই শুভ উদ্যোগ আস্তে আস্তে সারা দেশময় ছড়িয়ে পড়বে।

সর্বশেষ খবর