বলুন কী সমস্যা?
ডাক্তার ব্যানার্জি জানতে চাইলেন রোগীর সঙ্গে আসা দম্পতিটির কাছে। সাগর দত্ত হাসপাতালের আউট ডোরে তখন রোগীর ভিড়ে পা ফেলাই দায়।
ডাক্তার বাবু, জুড়ান মণ্ডল মুখ দিয়ে কথা বলার আগেই তার দুচোখ দিয়ে ধারা নামে। তার দেখাদেখি লক্ষ্মীও হাপুস নয়নে কাঁদতে শুরু করে দেয়। কান্না যে এক সংক্রামক ব্যাধি!ডাক্তার গৌতম ব্যানার্জি স্বাভাবতই অস্বস্তি বোধ করেন।
আরে এত কান্নাকাটি কেন, এত ভেঙে পড়লে চলবে? কী সমস্যা বলতে হবে তো? তা না হলে সমাধান মিলবে কীভাবে?
আজ্ঞে ডাক্তার বাবু, আমাদের এই একটা মেয়ে। গত প্রায় এক মাস ধরে ও একদম বোবা বনে গেছে। মুখ দিয়ে রাটি কাড়ে না। খায় না তেমন করে ঘুমের ঘোরেও চমকে চমকে ওঠে। সদা সর্বদা একটা যেন আতঙ্কের মধ্যে থাকে। কী হবে ডাক্তার বাবু, আয়লায় আমার যথাসর্বস্ব গেছে, মেয়েটাকে যা রক্ষা করতে পেরেছি কোনোমতে। এখন ভাবি সপরিবারে আমাদের যদি আয়লা খেত, বরং ভালো ছিল। এ রকম যন্ত্রণা ভোগ করতে হতো না। এক রত্তি মেয়েটার এমন তিলে তিলে শুকিয়ে যাওয়া দেখতে হতো না। হঠাৎ করে বলা নেই কওয়া নেই, জুড়ান গৌতম ডাক্তারের পায়ের ওপর শুয়ে পড়ে।
আরে করেন কী! পা ছাড়ুন। উঠুন। মনে জোর আনুন। আপনারাই যদি এমনভাবে ভেঙে পড়েন, তবে আপনাদের বাচ্চাটার কী হবে?
বাদলি নির্বিকার দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। ভাবলেশহীন মুখমণ্ডল তার। মা-বাবার কাণ্ড-কারখানাতেও সে হতবাক হয় না তেমন। হাসপাতালের নতুন পরিবেশেও তার মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে না। চোখ দুটো যেন তার পাথরের। রক্তমাংসের মানুষের মতো নয়।
কি গো, তোমার নাম কি সোনামণি?
স্নেহভরে জিজ্ঞাসা করেন গৌতম। বাদলির চিবুকে তার ডান হাত।
বাদলি কোনো জবাব দেয় না। আগের মতোই যে চুপ করে থাকে। নির্বিকার। তুমি আমার সঙ্গে কথা বলবে না?
কণ্ঠে শুধু মমত্ববোধই নয়, এক ধরনের আর্তিও যোগ হয় গৌতমের। হঠাৎ করে গৌতম জিজ্ঞাসা করেন,
বল তো আমি কে?
না কোনো জবাব নেই।
গৌতম তার কাঁধ থেকে স্টেথোটা নিয়ে বাদলির গলায় ঝুলিয়ে দেন। হাসি-হাসি মুখে বলেন, আমাদের হাসপাতালের নতুন ডাক্তার বাবু, লেডি ডাক্তার। কী সোনামণি তাই তো? নির্বিকার বাদলি। যথাপূর্বম তথা পরম।
গৌতম এবারে মুখ ফেরান জুড়ানের দিকে। আপনারা আয়লার শিকার? তা আসা হচ্ছে কোথা থেকে?
গৌতমের এই এক অভ্যাস। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলে মানুষের সঙ্গে ভাববাচ্যে কথা বলা। আজ্ঞে আমরা সুন্দরবনের বাসিন্দা।
সুন্দরবনের কোথায়?
আজ্ঞে গাঁড়াল নদীর নাম শুনেছেন? সেই নদীর লাগোয়া সাতজেলিয়া গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার সুকুমারী গ্রামে।
বেশ কিছুকাল আগে গৌতম ডাক্তার বন্ধুদের সঙ্গে লঞ্চে সুন্দরবন বেড়াতে গিয়েছিলেন। তবে গাঁড়াল নদীর নাম শোনেননি। শোনেননি সুকুমারী গ্রামের নাম কিংবা সাতজেলিয়া গ্রাম পঞ্চায়েতের নামও। যাই হোক কাগজে আয়লার কারণে হওয়া ক্ষয়ক্ষতির বিবরণ পড়েছেন, টিভিতেও এর ভয়ঙ্কর ভূমিকা দেখেছেন। তবু আয়লার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতালব্ধ মানুষকে পেয়ে গৌতম কৌতূহল সংবরণ করে উঠতে পারেন না। জুড়ানের কাছে আয়লার বীভৎসতা সম্পর্কে জানতে চান। সেই সঙ্গে তার উদ্দেশ্য বাদলির ট্রমার কারণ ও গভীরতা সম্পর্কেও অবহিত হওয়া।
আয়লা হয়েছিল বাবু ২৫শে মে। আমাদের গাঁড়াল নদী যেমন খরস্রোতা তেমনি চওড়া। নিয়ম অনুযায়ী শেষ ভাটায় যত জল নামার কথা, ওই দিন নদীতে তা নামতে দেখা গেল না। আরও প্রায় ফুট আটেক নীচেয় জল নেমে গেল। ফলে নদীর মাছটাছ সব লাফালাফি শুরু করে দিল। এমনটা চলল তা ধরুন না কেন মিনিট কুড়ির মতো। তারপরেই জোয়ারের জল মুহূর্তে ফুঁসে উঠল। নদীর জলে রাস্তার কানা পর্যন্ত ছাপাল। ইতিমধ্যে ঘূর্ণিঝড় ভয়ঙ্কর রূপ নিয়ে নিয়েছে। সে রূপ এখনো আমাদের চোখের সামনে ভাসছে। মুহূর্তের মধ্যে রাস্তার গা ঘেঁষা চরের যে জঙ্গল তা ডুবে গেল জলে। রাস্তা ভেঙে উড়িয়ে তৈরি হলো খাদ। বেলা একটু বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে জলের স্রোত ধেয়ে চলল হিংস্র জন্তুর মতো গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে। ঢেউয়ের প্রচণ্ড ধাক্কায় গঞ্জামের কাঁচা-পাকা বাড়িগুলো সব জলে মিশে যেতে লাগল। কত না ঘরের চাল ভেসে যেতে দেখা গেল। ভেসে গেল দূর থেকে দূরান্তে।
প্রাণ বাঁচাতে মানুষ সাঁতার দিয়ে আশ্রয় নিতে লাগল উঁচু জায়গায়। বাঁচার তাগিদে বিপন্ন মানুষ আঁকড়ে ধরল ঘরের চাল কিংবা গাছের ডাল। মানুষজন আঁকড়ে ধরল খড়ের গাদা। মানুষসহ সেই খড়ের গাদা ঝড়ের তাড়নায় পাগলের মতো ছুটে চলল। জুড়ানকে পেয়ে বসেছে আয়লার বর্ণনা। এখন আর তার মেয়ের কথা মনে নেই।
তা আপনারা রক্ষা পেলেন কেমনভাবে?
আমাদের গ্রামের ইস্কুলটা অনেক উঁচুতে। সেখানেই সপরিবারে আমরা আশ্রয় নিয়েছিলাম। তাই এ যাত্রায় বেঁচে গিয়েছি। জবাব জুড়ান মণ্ডলের।
বাদলি কি এসব নিজের চোখে দেখেছে? গৌতমের কৌতূহলী প্রশ্ন। তা দেখবে না কেন, এসব তো আর রাতের অন্ধকারে লোকচক্ষুর আড়ালে ঘটেনি। সবই তো দিনের বেলাকার ঘটনা। ওই এক রত্তি মেয়েটার চোখের সামনেই সব ঘটেছে। ও সব দেখেছে। মানুষ, জীবজন্তু এসব মরে ভেসে যাচ্ছে। ওরই চোখের সামনে দিয়ে। গৌতম এসব বিবরণ শুনে শিউরে, শিউরে, উঠছেন। ভাবছেন সাধে মেয়েটা আর বোবা বনে গেছে। শুনেই যদি তার এই ভাবান্তর হয়।
জানেন ডাক্তার বাবু অসংখ্য গরু, বাছুর, ছাগল, মুরগি মরে ভেসে গেছে। কেবল উঁচু জায়গায় থাকা গরুগুলো দলবদ্ধ হয়ে প্রাণ বাঁচিয়েছে কোনোক্রমে। প্রাণে বাঁচলে কি হবে, ওদের দেহগুলো সব ছিল জলের তলায়। বাছুরগুলো প্রাণ বাঁচাতে তাদের মুখগুলো উঁচু করে তুলে ধরে রেখেছিল। মায়েদের ডুবন্ত শরীরে চেপে থেকে। বন্যার জল পুকুর ও খালে ঢোকায় মিষ্টি জলের মাছগুলো কয়েক মুহূর্ত লাফালাফি করে শেষে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে। যতদূর চোখ যায়, শুধু জলে আর জলে আর মৃত প্রাণী দেহের শোভাযাত্রা। কত যে গাছ মুখ থুবড়ে পড়েছে তার আর ইয়ত্তা নেই। এত সব সত্ত্বেও যে গাছগুলো পড়ে যায়নি, সেগুলোতে পাতার চিহ্ন মাত্র ছিল না। নিষ্পত্র হয়ে দাঁড়িয়েছিল। প্রধানমন্ত্রীর সড়ক যোজনার চওড়া রাস্তায় প্রায় আড়াইশ ফুটের মতো গভীর খাল তৈরি হয়েছে। রাস্তার ইটগুলোর তো কোনো অস্তিত্বই নেই, সব ভেসে গেছে। ধানের গোলা জলের স্রোতে কাত হয়ে পড়ে। চব্বিশ ঘণ্টা আগেও যে বাড়িগুলোতে ছিল শোবার ঘর, রান্নাঘর, বৈঠকখানা, গোয়াল, গোলা, খড়ের গাদা, সেসবের কিছুর আর অবশিষ্ট নেই। সাত পুরুষের সাজানো সংসার সব ছারখার হয়ে গেছে। একটু আশ্রয়ের জন্য, একটু মিষ্টিজলের জন্য, একটু খাবারের জন্য মানুষের কি আকুলি-বিকুলি। পাগলের মতো মানুষজনে জলে-কাদায় খুঁজছে যদি ঘর-গৃহস্থালির হারানো সম্পদের ছিঁটেফোঁটাও মেলে।
গৌতমের চেতনা থেকে বাদলির প্রসঙ্গটিই উধাও হয়ে গেছে। আয়লার ভয়ঙ্করতার বিবরণে তিনি শিহরিত। আতঙ্কিতও বটে। ক্রমে হুঁশ ফেরে। অ্যাটেনডেন্টকে দিয়ে গৌতম একটা ক্যাডবেরি সেলিব্রেশন আনান। পরম স্নেহে তিনি সেটি তুলে দেন বাদলির হতে। জানতে চান, সোনামণি তুমি ক্যাডবেরি ভালোবাস না? আমি তো খুব ভালোবাসি। সময়-সুযোগ পেলেই খাই।
আচ্ছা তুমি কী খেতে ভালোবাস মাছ না মাংস?
বাদলি নিরুত্তর। সে কিছু শুনেছে বলেই মনে হচ্ছে না। ভাবলেশহীন মুখ তার। আচ্ছা, তোমাকে কে বেশি ভালোবাসেন বাবা না মা?
নিরুত্তর বাদলি।
আচ্ছা সোনামণি, তোমার কতজন বন্ধু?
নিরুত্তর।
তোমাদের বাড়িতে গরু ছিল? ছাগল, মুরগি?
বাদলির যেন কোনো কথাই কানে যায়নি। একেবারে স্ট্যাচুবৎ বসে বেঞ্চিতে।
তুমি পুতুল ভালোবাস? ক’টা পুতুল তোমার?
প্রশ্নটি যেন অন্য কারুর উদ্দেশে করা হয়েছে, বাদলিকে নয়।
অনেক চেষ্টা করেও গৌতম বাদলির মুখ থেকে একটা কথাও বের করতে পারেন না। হতাশায় লক্ষ্মী এবং জুড়ান দুজনেই প্রায় কঁকিয়ে ওঠে। তারাও চেষ্টা করে আপ্রাণ মূক মেয়েটাকে দিয়ে কথা বলাতে।
গৌতম প্যাডের কাগজ টেনে খসখস করে ওষুধ লিখে দেন। বুঝিয়ে দেন কেমন করে কবার খেতে হবে।
আশ্বস্ত করেন, ভেঙে পড়বেন না। বাচ্চা মেয়ে তো, সাংঘাতিক একটা ট্রমার মধ্যে রয়েছে। কিছুতেই এর থেকে বের হতে পারছে না বেচারি।
তাহলে কী হবে ডাক্তার বাবু? আকুল প্রশ্ন মা-বাপের।
আমরা তো তাই বলে হাল ছেড়ে দিতে পারি না। অত বড় আয়লার মোকাবিলা করে এসেছেন আপনারা, আর এই একটি সমস্যাকে এত বড় করে দেখছেন।
আমরা তো আছি না কী? ভরসা রাখুন। সব ঠিক হয়ে যাবে।
ডাক্তার ব্যানার্জি পরামর্শ দেন ‘ডানা’য় গিয়ে কাউন্সেলিং করাতে। বলে দেন যাতে ডানায় কাউন্সেলিংয়ের জন্য কোনো খরচ না লাগে তিনি সেটা দেখবেন। ওষুধটা চালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন।
গৌতম বাদলির ব্যাপারে একটু বেশি অনুসন্ধিত্সু হয়ে পড়েন। ‘ডানা’র কাউন্সেলর লোপা মুদ্রাকে বাদলির ব্যাপারটি জানিয়ে ভালো করে কাউন্সেলিংয়ের জন্য বলে দেন।
প্রথম দুটি সিটিংয়ে কোনো কাজ হয় না। তৃতীয় সিটিংয়ে আশার আলো দেখা দেয়। লক্ষ্মী এবং জুড়ান বাদলিকে নিয়ে চলে যেতেই লোপা চিৎকার করে ওঠে, ইউরেকা পেয়ে গেছি, পেয়ে গেছি অবশেষে।
সেদিন গৌতমেরও চেম্বার ছিল ‘ডানা’তে। লোপার চিৎকার তার কানেও যায়। বেরিয়ে আসেন ঘর থেকে।
কী লোপা কী পেয়েছ। এতে আনন্দ ধ্বনি কেন?
টুকুন।
টুকুন, সেটা কি? অবাক হয়ে গৌতম জানতে চান।
আপনার পেসেন্ট বাদলিরানী মৌনতা ভেঙেছে গৌতম দা।
ভেঙেছে? তা কি বলছে?
ওই যে টুকুন।
আরে হেঁয়ালি ছাড় তো, খুলে বল টুকুনটা কী?
আরে টুকুন হলো বাদলির প্রিয় পুতুল। ওর চোখের সামনে দিয়ে সেই টুকুন ভেসে গেছে।
কিছুতেই ও সেটা ভুলতে পারছে না।
যাক বাবা, এবারে তাহলে একটা ক্লু পাওয়া গেল।
আশ্বস্ত গৌতম নিজের মনেই বিড়বিড় করে ওঠেন, মেয়েটাকে সুস্থ করে তোলা যাবে। টুকুন রহস্য ভেদের জন্য লোপা তোমাকে অজস্র ধন্যবাদ। কি জান তো, হতভাগিনী মেয়েটার জন্য আমার একটা যেন আলাদা মায়া পড়ে গেছে। আয়লায় ওদের সর্বস্ব গেছে সেসব তো আমি ফিরিয়ে দিতে পারব না, তবু মেয়েটাকে সুস্থ করে তোলার চ্যালেঞ্জ নিয়েছি, এটুকু সাহায্য ওদের করতে পারলে অন্তত ওদের ক্ষতে কিছুটা প্রলেপ পড়বে।
লোপা বলে ওঠে, কি হলো গৌতম দা, তখন থেকে নিজের মনে কি বিড়বিড় করে চলেছেন?
চল আজ তোমাকে খাওয়াব।
কী খাওয়াবেন গৌতম দা?
তুমি যা খেতে চাইবে, তা-ই।