শুক্রবার, ২৭ জুলাই, ২০১৮ ০০:০০ টা

মানবতাবাদী সাম্যবাদী অসাম্প্রদায়িক নজরুল

এ এইচ এম মোস্তাফিজুর রহমান

মানবতাবাদী সাম্যবাদী অসাম্প্রদায়িক নজরুল

আজকের পৃথিবীতে সবচেয়ে সংকটে যে চেতনা, তার নাম মানবতা। আজকের বিশ্বে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন যে চেতনার, তার নাম মানবতা। আজকের পৃথিবীর অন্যতম বড় সমস্যা দেশে দেশে বিরাজমান ধর্মীয় সংকীর্ণতা, ধর্ম নিয়ে জঙ্গিপনা। নিজ নিজ ধর্ম রক্ষার দোহায় দিয়ে অন্য ধর্মের অনুসারীদের প্রতি হিংসা-বিদ্বেষ ছড়ানো এক ধরনের অলিখিত প্রবণতা হয়ে দাঁড়াচ্ছে সারা বিশ্বে প্রায় প্রতিটি সমাজে। সব দেশেই এ কাজে বেশি ভূমিকা রাখতে দেখা যায় সমাজপতি বা ধর্মীয় মোড়লদের। এ থেকে উত্তরণের একমাত্র চেতনার নাম অসাম্প্রদায়িকতা। বর্তমান সময়ের আরেকটি বড় সমস্যা নারীর প্রতি অন্যায়-অবিচার-নিগৃহ এবং তাদের বিরুদ্ধে সংঘটিত যৌন সন্ত্রাস। এর থেকে উত্তরণের পথ রয়েছে লৈঙ্গিক ভারসাম্য রক্ষার মধ্য দিয়ে। অর্থাৎ শিল্প-কারখানা, শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা থেকে সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের ক্ষমতা ও সমতার যে ভারসাম্যহীনতা রয়েছে, তা থেকে মুক্তির উপায় হলো সবাইকে সমভাবে গুরুত্ব দেওয়া। আমরা জানি, দ্রোহ চেতনার পাশাপাশি আশাবাদ, দেশপ্রেম, সব ধরনের বঞ্চনা-শোষণের বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃণা ব্যক্ত। সাম্রাজ্যবাদী চিন্তা-চেতনার তীব্র বিরোধিতা করা, জনমানুষের ওপর সমাজের ওপরতলার মানুষের পরিচালিত সব অন্যায় থেকে মুক্তি কামনা প্রভৃতির জনহিতকর চেতনার জন্য কবি কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্যদর্শনকে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যে আসীন করেছে। মানবতাবাদ, অসাম্প্রদায়িকতা আর নারী-পুরুষ তথা সমাজের সাম্য রক্ষা—কাজী নজরুলের কবিতায় প্রতিফলিত এই তিনটি প্রবণতার বিষয়ে আলোচনা সীমাবদ্ধ থাকবে বর্তমান প্রবন্ধে।

উল্লিখিত সংকটগুলোর প্রতিটিই মানুষের সৃষ্ট অর্থাৎ কৃত্রিম। পৃথিবীতে কালে কালে সুযোগসন্ধানী, লোভী আর অমানবিক কিছু মানুষের আবির্ভাব ঘটে। তাদের কারণেই বারবার মানবতা সংকটের মুখে পড়ে। পৃথিবীর কোনো প্রান্তে যুদ্ধ সংঘটিত হলে তো কথাই নেই। সাধারণ মানুষের প্রতি রাষ্ট্র বা ক্ষমতাবানদের অবহেলা, নারী-শিশুর ওপর নেমে আসা অবর্ণনীয় কষ্টের কথা কেউ মনে রাখে না। ফলে ক্রূর হাসি হেসে পাশবিক ও নির্মম মরণখেলায় মেতে ওঠে যুদ্ধবাজরা। এমন অবস্থাকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১) বলেছেন ‘বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে’। আর কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬) বলেছেন, ‘চারদিকে এই গুণ্ডা এবং বদমায়েশির আখড়া দিয়ে/রে অগ্রদূত, চলতে কি তুই পারবি আপন প্রাণ বাঁচিয়ে?/পারবি যেতে ভেদ করে এই বক্রপথের চত্রুব্যূহ?/উঠবি কি তুই পাষাণ ফুঁড়ে বনস্পতি মহীরুহ?/আজকে প্রাণের গো-ভাগাড়ে উড়ছে শুধু চিল-শকুনি,/এর মাঝে তুই আলোক-শিশু কোন অভিযান করবি, শুনি?’ (‘পথের দিশা’, ফণি-মনসা)

সাধারণ মানুষ ধর্মের অজুহাতে, সামাজিক নিয়মের বেড়াজালের কারণে সমাজের ওপরতলার মানুষের দ্বারাই বঞ্চিত-নিগৃহীত। ধর্মের ধ্বজাধারীদের মধ্যে ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি এমন অবস্থায় গিয়ে পৌঁছেছে যে, ধর্মের চর্চাও যেন সাধারণের জন্য নয়। শুধু মোড়ল-মোল্লা আর ধর্মের ছদ্মবেশী যারা, ধর্ম যেন-বা তাদের থাকবে কুক্ষিগত। সমাজের সেই নীতি-নির্ধারকদের প্রতি ক্ষুব্ধ নজরুল বলেছেন, ‘শিহরি’ উঠো না, শাস্ত্রবিদেরে ক’রো না ক’বীর, ভয়,/তাহারা খোদার খোদ প্রাইভেট সেক্রেটারি ত নয়।/সকলের মাঝে প্রকাশ তাহার, সকলের মাঝে তিনি।/আমারে দেখিয়া আমার অদেখা জন্মদাতারে চিনি।’ (‘ঈশ্বর’, সাম্যবাদী)

সকল দেশের, সকল ভাষার, সকল জাতির কালজয়ী কবি-সাহিত্যিক-শিল্পীরাই ধর্মের চেয়ে মানবতা বড়—এ চেতনাকে সামনে নিয়ে তাঁরা নিজেদের মতো শিল্পসাধনা করে গেছেন। বাঙালি কবিদের মধ্যে মধ্যযুগে যেমন চণ্ডীদাস বলেছেন, ‘শুনহ মানুষ ভাই,/সবার ওপরে মানুষ সত্য/তাহার ওপরে নাই।’ এরও পরে লালন বলেছেন, ‘মানুষ ধরো, মানুষ ভজো, মানুষ খোঁজো, শোন বলিরে পাগল মন।’ আর নজরুল আরও স্পষ্ট করে মানবতাবাদকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছেন। পাশাপাশি ধর্মীয় সাম্য বজায় রেখে সব ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়েছেন অসাধারণ পঙিক্তমালায়। কারণ ১৯১৭ সালে সংঘটিত রুশ সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব তাকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছিল। গোটা পৃথিবীকে তিনি রূপকার্থে ‘রণ-ভূম’ আখ্যা দিয়েছেন। আর প্রতিটি ধর্মের অবতারদের প্রতি যথার্থ সম্মান দেখিয়ে বলেছেন, বিশ্বাসের যে জায়গা অর্থাৎ মানুষের হৃদয় হচ্ছে উত্তম জায়গা, যেখান থেকে ধর্মচর্চার বিষয়টি নির্ধারিত হয়। তাই বলেছেন :

গাহি সাম্যের গান—

যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান,

যেখানে মিশেছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলিম ক্রিশ্চান।

... .... ...

এই রণ-ভূমে বাঁশির কিশোর গাহিলেন মহা-গীতা,

এই মাঠে হ’ল মেষের রাখাল নবীরা খোদার মিতা।

এই হৃদয়ের ধ্যান-গুহা মাঝে বসিয়া শাক্যমুনি

ত্যাজিল রাজ্য মানবের মহা-বেদনার ডাক শুনি’

এই কন্দরে আরব-দুলাল শুনিতেন আহ্বান,

এইখান বসি’ গাহিলেন তিনি কোরানের সাম-গান!

মিথ্যা শুনিনি ভাই,

এই হৃদয়ের চেয়ে বড়ো কোনো মন্দির-কাবা নাই।

(‘সাম্যবাদী’, সাম্যবাদী)

ধর্মীয় বিশ্বাসের জন্ম মনের অভ্যন্তরে। মনের গহীনে জন্ম নেওয়া সেই বিশ্বাস প্রকাশ্যে কোনো বিরোধ বা দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করুক, সেটা কবি চাননি। এই উপমহাদেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী যে দুটি ধর্মের অনুসারী, তাদের তিনি একই বৃন্তে ফোটে দুটি ফুলের সঙ্গে তুলনা করেছেন। কবি শুধু প্রতীকী অর্থে নয়, বাস্তবতার নিরিখেই বলেছেন :

মোরা এক বৃন্তে দু’টি কুসুম হিন্দু-মুসলমান।

মুসলিম তার নয়ন-মণি, হিন্দু তাহার প্রাণ।

এক সে আকাশ মায়ের কোলে।

যেন রবি শশী দোলে,

এক রক্ত বুকের তলে, এক সে নাড়ির টান।

তিনি মনে-প্রাণে সেই উচ্চাশা করে গেছেন, নিজ নিজ ধর্ম বিনাদ্বন্দ্বে পালিত হবে। কিন্তু তার চেয়ে বড় কথা একজন মানব সন্তানের বড় পরিচয়, সে মানুষ। সেই বিষয়টি সবচেয়ে জোরালোভাবে উচ্চারণ করেছেন। ফলে এই উপমহাদেশে যখন রাজনীতির ক্ষেত্রে ধর্মীয় পরিচয়ই বড় হতে যাচ্ছিল, গোটা বিশ্বে যখন ধর্মীয় বিভেদের কারণে হানাহানি বেড়ে যাচ্ছিল, তখনই নির্দ্বিধায় বলেছেন :

গাহি সাম্যের গান—

মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান।

নাই দেশ-কাল-পাত্রের ভেদ, অভেদ ধর্ম জাতি,

সব দেশে, সব কালে ঘরে ঘরে তিনি মানুষের জ্ঞাতি।

(‘মানুষ’, সাম্যবাদী)

মনুষ্যসৃষ্ট নানা বিভেদরেখায় বিভক্ত এই সমাজকে দেখে যারপরনাই বিচলিত ছিলেন কবি নজরুল। এসব থেকে কায়মনোবাক্যে মুক্তি চান তিনি। সেই কারণেই তার রচিত সাহিত্যের প্রধান উপাদান হয়েছে মানবতাবাদ, সাম্যবাদ আর অসাম্প্রদায়িক চেতনা।

তার একটি কারণও রয়েছে। তাঁর লেখালেখির শুরুটা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অব্যবহিত পর; গোটা বিশ্ব যখন টালমাটাল; মানুষ যখন মানবতার চরম বিপর্যয় কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছে। কোথাও-বা সেই সুযোগে নতুন করে শুরু হয়েছে বিপর্যয়ের পুনরাবৃত্তি। বিশ্বযুদ্ধের সেই ডামাডোলে কবি নিজেও বেছে নিয়েছিলেন যুদ্ধজীবন। ভেবেছিলেন, যুদ্ধে অংশ নিয়ে মানুষের জন্য কিছু করবেন। মোহ ভাঙতে দেরি হয়নি তার। কারণ সেই যুদ্ধ ছিল যুদ্ধবাজদেরই পক্ষে আর সাধারণ মানবতার বিরুদ্ধে। ফিরেই তিনি শুরু করেন আরেক যুদ্ধ। কাব্যযুদ্ধ-জীবনযুদ্ধ বললেও অত্যুক্তি হবে না। প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থায় আস্থা রাখতে না পারা নজরুল নিজের জ্ঞান-দর্শন-অভিজ্ঞতা ব্যক্ত করতে লেখনী হাতে তুলে নিলেন; লিখলেন। যেখানে প্রতিজ্ঞা করলেন এই সমাজের খোলনলচে পাল্টে দেওয়ার। বাজালেন অগ্নি-বীণা। হয়ে উঠলেন আজন্ম ‘বিদ্রোহী’। বলে উঠলেন, পুরনোকে, জীর্ণকে, প্রচলিত সমাজের গণ্ডিকে ভেঙে নতুন করে গড়তে হবে। সেই আহ্বান জানিয়ে তিনি নতুনের জয়ধ্বনি করতে করতে বললেন, ‘ধ্বংস দেখে ভয় কেন তোর?—প্রলয় নূতন সৃজন-বেদন! আসছে নবীন-জীবন-হারা অসুন্দরে করতে ছেদন!/...কাল ভয়ঙ্করের বেশে এবার ঐ আসে সুন্দর!/ তোরা সব জয়ধ্বনি কর!’ (‘প্রলয়োল্লাস’, অগ্নি-বীণা)

সকল বর্ণ-ধর্মের অনুসারীদের মধ্যে ভেদাভেদহীন-জাতপাতহীন এক উন্নত সমাজ প্রত্যাশা করেছেন কবি। ফলে চোখের সামনে যা দেখেছেন, যা কিছু তার কাছে অন্যায় বলে প্রতীয়মান হয়েছে, তারই প্রতিবাদ করেছেন, প্রতীকার চেয়েছেন। সনাতন সবকিছুর বিরুদ্ধেই সোচ্চার ছিলেন। কোনো ধর্মের মধ্যে উঁচু জাত-নীচু জাত বলে এক ধরনের অলিখিত রীতি চালু ছিল তাঁর সময়ে (হয়তো এখনো আছে)। সেই জাতের ধুয়া তুলে যারা সমাজকে বিভক্ত করতে চান, তাঁদের প্রতি বিষোদগার করেছেন কবি। আর পৃথিবীর সকল ধর্মব্যবসায়ীর প্রতি ঘৃণা ছুড়ে বলেছেন, ‘জাতের নামে বজ্জাতি সব জাত-জালিয়াত খেলছে জুয়া/ছুঁলেই তোর জাত যাবে? জাত ছেলের হাতের নয় তো মোয়া।/...ভগবানের ফৌজদারি-কোর্ট নাই সেখানে জাত-বিচার,/(তোর) পৈতে টিকি-টুপি টোপর সব সেথা ভাই এক্কাকার।’ (‘জাতের বজ্জাতি’, বিষের বাঁশী)

ধর্মের নামে চলমান অসহিষ্ণুতার এই সব কিছুর বিরুদ্ধে তার আজন্ম বিদ্রোহ। সমাজের নিপীড়িত-নিগৃহীত মানুষের প্রতি অকৃত্রিম দরদ প্রতিফলিত হয়েছে বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ‘বিদ্রোহী’ কবিতায়, ‘আমি সেই দিন হব শান্ত,/ যবে উত্পীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে-বাতাসে ধ্বনিবে না,/অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না’ (‘বিদ্রোহী’, অগ্নি-বীণা)।

সেই কবিই আমাদের পুরুষশাসিত সমাজের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন মায়ের জাত মেয়েদের যে আমরা অবমূল্যায়ন করি, সমযোগ্যতা সত্ত্বেও তাদের আমরা সমভাবে দেখি না। কিন্তু তিনি সবক্ষেত্রে সাম্য চান। তাঁর মতো বাংলার আর কোনো কবি নারীদের প্রতি যুগ যুগ ধরে চলমান অসাম্যকে সামনে এভাবে আনেননি। ফলে তিনি বলতে পেরেছেন :

সাম্যের গান গাই—

আমার চক্ষে পুরুষ-রমণী কোনো ভেদাভেদ নাই।

বিশ্বের যা-কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যাণকর।

অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।

বিশ্বে যা-কিছু এল পাপ-তাপ বেদনা অশ্রুবারি

অর্ধেক তার আনিয়াছে নর, অর্ধেক তার নারী।

(‘নারী’, সাম্যবাদী)

শুধু তা-ই নয়, যেসব পুরুষ নিজেকে শ্রেষ্ঠ জ্ঞান করে নারীকে হেয়প্রতিপন্ন করে, তাদের প্রতি ক্ষোভ ব্যক্ত করে একই কবিতায় বলেছেন, ‘নরককু-বলিয়া কে তোমা করে নারী হেয়-জ্ঞান?/ তারে বল, আদি-পাপ নারী নহে, সে যে নর-শয়তান।’ বরং সকল সৌন্দর্যের, সকল সাফল্যের কৃতিত্ব দিতে তিনি বিন্দুমাত্র কার্পণ্য করেন না; ‘এ-বিশ্বে যত ফুটিয়াছে ফুল, ফলিয়াছে যত ফল,/নারী দিল তাহে রূপ-রস-মধু গন্ধ সুনির্মল।/তাজমহলের পাথর দেখেছ, দেখিয়াছ তার প্রাণ?/অন্তরে তার মোমতাজ নারী, বাহিরিতে শা-জাহান।’

বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্ম এমন এক সময়ে, যখন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রতিভা মধ্যগগনে। আর যখন নজরুল সাহিত্যস্রষ্টা হিসেবে আবির্ভূত হন, তখন অজস্র সাহিত্যস্রষ্টা রবিতাপে বিসর্জন দিচ্ছেন নিজেদের প্রতিভাকে। অবস্থা এমন বেগতিক, যিনি যা-ই লিখছেন, কোনো না কোনোভাবে তা রবিতাপে পুড়ে অঙ্গার হয়ে যাচ্ছে। কেবল দেশে নয়, বিদেশের সাহিত্যজগতেও উজ্জ্বল রবিরশ্মির আলোকশিখা ছড়িয়ে পড়েছে-রবিঠাকুরের নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির মধ্য দিয়ে। বলা যায়, রবীন্দ্রপ্রতিভা যখন দেশ-বিদেশে সুপ্রতিষ্ঠিত, দুর্দমনীয়, অপ্রতিরোধ্য, তখনই বাংলাসাহিত্যের আকাশে ‘বাউণ্ডুলে’ এক কবির সমহিমায় আত্মপ্রকাশ। জীবন ঘষে ঘষে আগুন জ্বালানো নজরুলের ব্যতিক্রম কাব্যভাষা বা নতুন কাব্য-উপাদান নিয়ে আবির্ভাব হওয়া গত্যন্তর ছিল না। বাংলা সাহিত্যস্রষ্টাদের মধ্যে তখন এমন কিছুই করতে হতো, যা নজরুল করে দেখিয়েছেন। তবে নজরুলের সৃষ্টিযাত্রা ও সৃষ্টিলয়ের সময়ের মধ্যে এক অদ্ভুত সাজুয্য বিরাজমান। কারণ প্রথম মহাসমরের পরপর তাঁর প্রতিভা বিকাশের শুরু, আর দ্বিতীয় মহাসমরের মাঝপথে তিনি বাকশক্তি লোপ পেয়ে যান। এখনো প্রসঙ্গ আসে, বিখ্যাত কবি-সাহিত্যিক-দার্শনিকের তো স্ব স্ব সমাজে এক ধরনের প্রভাব থাকে। তারা না থাকলেও তাদের বর্ণিত দর্শন মানুষ চর্চা করে থাকে। কিন্তু নজরুলে কাব্য-দর্শন আমাদের সমাজে বাংলাভাষী মানুষের কাছে কতটুকু ব্যাপৃত হতে পেরেছে! সেই বিষয়ের বিবেচনায় বলা চলে, বাংলাদেশ নামে বিশ্বমানচিত্রে জাতিরাষ্ট্রের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তার পেছনে ছিল নজরুলের বিদ্রোহী সত্তার অনুপ্রেরণা। বাংলাদেশের মানুষ যে পঞ্চাশের দশক থেকে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে আন্দোলন-সংগ্রাম করেছে, এ দেশের ছাত্রসমাজ যে ষাটের দশকের প্রগতিশীল ধারা আন্দোলন সংঘটিত করতে পেরেছিল, তাদেরই ক্রমাগত আন্দোলনের ফলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে যে একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে এ দেশের নারী-পুরুষ অংশ নিয়েছিলেন—দেশ স্বাধীন করতে পেরেছিলেন, এসবের পেছনে অবশ্যই নজরুলের বিদ্রোহী, অসাম্প্রদায়িক ও সাম্যবাদী চেতনার প্রতিফলন ঘটেছিল। আর বাংলাদেশ যে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় পরিচালিত হবে বলে বাহাত্তরে বিশ্বমানের একটি সংবিধান প্রণীত হয়েছে, সেখানেও নজরুল-সাহিত্যের বড় প্রভাব রয়েছে। সাহিত্য যে সমাজ দর্শনের সঙ্গে একাকার হয়ে যায়, তা নজরুলের কাব্যকবিতা বা তার সাহিত্যের অন্যান্য উপাদানের মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হয়েছে। মূলত পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে নজরুলের শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন, অসাম্প্রদায়িক চেতনার চোয়ালবদ্ধ সংকল্প আর বঙ্গবন্ধুর শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা একাকার হয়ে যায়। এরই ধারাবাহিকতায় নজরুলের শোষণহীন-অসাম্প্রদায়িক চেতনার কাব্যদর্শন, বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শনে উন্নীত হয়। আর বঙ্গবন্ধুর ভিতরে নজরুলের চেতনাগুলো অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে প্রোথিত ছিল বলেই বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই তাকে ভারত থেকে এনে তিনি নাগরিকত্ব প্রদান করেন। শেষ করছি নজরুল-গবেষক অধ্যাপক রফিকউল্লাহ খানের একটি বক্তব্যের সঙ্গে সহমত পোষণ করে। তিনি ‘নজরুলের শিল্পীমানস : সমকালে থেকে চিরকালের’ শীর্ষক প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘...নজরুলের আন্তর্জাতিক বোধের উৎস তার স্বভাবজাত সাম্যবাদী চিন্তাধারা, শ্রমজীবী মানুষের সংকট ও সংগ্রামের রক্তিম অনুভূতি। বিশ্ব মানবমুক্তির এই সত্য গণতন্ত্র ও সাম্যতন্ত্রের জন্য মানুষের দীর্ঘ সংগ্রামের ইতিহাস থেকে আহরণ করেছিলেন তিনি। সে কারণে তৎকালীন ভারতবর্ষের সর্বাপেক্ষা জটিল ক্ষত সাম্প্রদায়িক চিন্তাকে তিনি সর্বাংশে পরিহার করেছিলেন। কুলি-মজুর শ্রমিক-কৃষাণ-মানুষের এই শ্রেণি-পরিচয়ই তাঁর কাছে গুরুত্বপূর্ণ; হিন্দু কিংবা মুসলিম হিসেবে নয়। সাম্রাজ্যবাদ, জাতিশোষণ, শ্রেণিশোষণ-বিরোধী চিরকালীন প্রতিরোধ ও সংগ্রামের সঙ্গে নজরুলের শিল্পীসত্তা অবিচ্ছেদ্যসূত্রে জড়িত। আধুনিক বিশ্বের প্রতিটি প্রগতিশীল, গণতন্ত্রকামী সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক-অর্থনৈতিক আন্দোলনে নজরুলের প্রাসঙ্গিকতা এ সূত্রেই নিরূপিত। তবে বর্তমান বিশ্বে চলমান মানবতার সংকট, সাম্প্রদায়িক সহিংসতা, শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে নারীর ব্যাপক অংশগ্রহণ সত্ত্বেও নারী-পুরুষের মধ্যে বৈষম্য বৃদ্ধির এই প্রবণতা থেকে মুক্তি পেতে নজরুলের অমর বাণীসমৃদ্ধ কবিতা পাঠের বিকল্প নেই।

সর্বশেষ খবর