শুক্রবার, ৩ আগস্ট, ২০১৮ ০০:০০ টা
গল্প

জীবনের কঠিন সত্য

ইকবাল আজিজ

জীবনের কঠিন সত্য

মানুষের জীবনে সব কিছুই অস্থায়ী, কোনো কিছুই চিরকাল আড়ালে রাখা সম্ভব নয়। পরিত্যক্ত জিনিসপত্র, আলুর খোসা, পোটলের চোকলা, কাগজের ঠোঙা, পলিথিনে ভরা পচা খাবার, মাছের আঁশ, মুরগির নাড়িভুঁড়ি, ফলের অর্ধেক, ছেঁড়া জামা প্রভৃতি বর্জ্যে ভরে আছে আমাদের প্রতিদিনের ময়লা ফেলার বালতি। বাজার অর্থনীতির জয়-জয়কার এখন চারদিকে; সবকিছুতেই ব্যবসা। প্রতিটি বাড়ি থেকে প্রতিদিনের ময়লা ফেলার কাজ নিয়ে লাভজনক ব্যবসা গড়ে উঠেছে বাংলাদেশে। কিন্তু জিনিস ফেলতে ইচ্ছা করলেও ফেলে দেওয়া যায় না; কৌশলগত কিছু সমস্যা আছে। মানসম্মান বজায় রাখার বিষয়টিও অবহেলা করার মতো নয়। এ ছাড়া সত্য দুনিয়ায় সবার জন্য প্রতিদিনের ব্যক্তিত্বের মুখোশ পরে থাকাও একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। দেশের ভীষণ জনপ্রিয় কবি, লেখক ও নাট্যকার সোহেল রহমান এ সমস্যাটির সমাধান করেছেন নিজের উদ্ভাবনী বুদ্ধির জোরে; কায়দাটি নিঃসন্দেহে অভিনব। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন, খ্যাতি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এই অভিনব সমস্যাটিও তার জন্য দুঃসহ হয়ে উঠেছিল। এ শহরের নানা ধরনের সাংস্কৃতিক ও আর্থ-সামাজিক অনুষ্ঠানে তাকে নিয়মিত যেতে হয় প্রধান অতিথি বা সভাপতি হিসেবে। তাকে প্রায় সারাক্ষণ চারপাশ থেকে ঘিরে রেখেছে একদল ভক্ত। যেমন গত সন্ধ্যায় ‘সংস্কৃতি কেন্দ্রে’ সমকালীন সাহিত্যের বিষয়ে এক আলোচনা অনুষ্ঠানে জনপ্রিয় কথাশিল্পী শফিকুল হক পল্টু বলেই ফেললেন, সব্যসাচী লেখক সোহেল রহমান শুধু বাংলাদেশের গৌরব নন। তিনি সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ার গৌরব। নোবেল পুরস্কার নিয়ে তখন সারা দুনিয়ায় রাজনীতি চলছে।

তা না হলে আমাদের এ সব্যসাচী লেখক পাঁচ বছর আগেই নোবেল পুরস্কার পেয়ে যেতেন। কিন্তু সোহেল রহমান এখন সবকিছুর ঊর্ধ্বে অবস্থান করছেন। জনগণের ভালোবাসাই তার জীবনের শ্রেষ্ঠ উপহার। এখন সময় এসেছে, সোহেল রহমানের সাহিত্যকর্ম দুনিয়ার অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ভাষায় তরজমা করা। এই বক্তব্য প্রদানের সময় অনুষ্ঠানে অনেক হাততালি বেজেছিল; সাহিত্যিক সোহেল রহমান সে সময় মনের গভীরে এক ধরনের গভীর পুলক অনুভব করেছিলেন।

সেই বিশেষ সমস্যাটির কথা আবার ভাবলেন একালের বাংলা সাহিত্যের নতুন যুগের সব্যসাচী লেখক। তিনি খেয়াল করছিলেন, গত পনেরো-বিশ বছর ধরে তার জনপ্রিয়তা বিপজ্জনকভাবে বেড়ে গেছে। বাড়ি থেকে হেঁটে বাজারে কিংবা অন্য কোথাও যাওয়ার উপায় নেই। রাস্তার দুপাশ থেকে নানা বয়সের মানুষ তাকে সালাম দিতে থাকে। কেউবা এগিয়ে এসে সোহেল রহমানের নতুন প্রকাশিত সায়েন্স ফিকশনের গুণকীর্তন করে তাকে অভ্যর্থনা জানায়। কোনো স্মার্ট সাহসী তরুণী হয়তো আগামী শুক্রবার রাতে তার বাড়িতে সামান্য ‘ডাল ভাতের’ দাওয়াত জানায়। সোহেল জানেন, ‘বিদগ্ধ তরুণীর এই ‘ডালভাতের দাওয়াতের’ বিষয়টি নিতান্ত ভদ্রতা; আসলে সেদিন থাকবে নিদেনপক্ষে পনেরো ধরনের রাজকীয় খাবারের আয়োজন। সোহেল অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে এ বিষয়ে ইতিমধ্যে একটা সুস্পষ্ট ধারণা পেয়েছেন। সোহেল জানেন ভক্তের বাসায় শুধু এই রাজকীয় খাবার খাওয়াই সব নয়; ভোজন শেষে যখন সব্যসাচী লেখক হাতমুখ ধুয়ে তরুণীর বৈঠকখানায় একটু বিশ্রাম নেবে, তখন ‘খ্যাতি প্রকাশে’ অনিচ্ছুক তরুণীটি তার অতি চমৎকারভাবে মুদ্রিত সর্বশেষ কাব্যগ্রন্থটি এগিয়ে দেবে সম্মানিত অতিথির দিকে। তবে সালেহা মজহার নামের তরুণ কবিটি সে রাতে রীতিমতো সাহসের পরিচয় দিয়েছিলেন। সালেহা সে রাতের ভোজনের পর লেখক সোহেল রহমানের সম্মানে টেবিলে দামি ফরাসি রেড ওয়াইনের বোতল ও তিনটি গ্লাস সাজিয়ে রেখেছিলেন। সোহেল রহমানের কাছে বিষয়টি রীতিমতো অসহ্য মনে হয়েছিল। সেই সঙ্গে কিছুটা অপমানজনকও বটে। কিন্তু সালেহার সেদিকে খেয়াল ছিল না। সেদিন এই তরুণী কবিটির ব্যবসায়ী স্বামীও পাশে বসেবৌয়ের দিকে কেমন বিগলিত হেসে তাকিয়েছিলেন। এরপর সালেহা মজহার তার নতুন কাব্যগ্রন্থ ‘ডিজিটাল যুগের শেষ গৌধূলি’ এগিয়ে দিয়েছিলেন। কাব্যগ্রন্থটি শুধু এগিয়ে দেননি; বইটি সোহেলের হাতে পরম ভক্তি সহকারে দিয়ে বলেছিলেন, এবার ঈদেও নিউইয়র্ক বেড়াতে গিয়ে কবি অ্যালেন গিন্সবার্গের কয়েকটি কাব্যগ্রন্থ পড়ে রীতিমতো আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিলাম। তারপর এই ‘ডিজিটাল যুগের শেষ গোধূলি’ কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলো লিখেছি। স্যার, বইটা নিশ্চয়ই আপনার ভালো লাগবে। যদি অনুগ্রহ করে দৈনিক ইত্তেহাদের সাহিত্য পাতায় বইটি নিয়ে আলোচনা করেন, তবে খুব খুশি হব।’

দেশব্যাপী এই অতিরিক্ত খ্যাতির জ্বালা-যন্ত্রণা প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তে ভোগ করছেন সোহেল রহমান। একেবারে প্রথমদিকে তা ভালো লাগত; কিন্তু এখন রীতিমতো অসহ্য। তবে সোহেলের মূল সমস্যাটি কাটিয়ে আমরা কি অন্যদিকে চলে গেছি? না, ঘুরে-ফিরে আমাদের সেখানেই যেতে হবে সমস্যার কেন্দ্রমূলে। খ্যাতি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সোহেল তরুণ কবি সাহিত্যিক কিংবা অনুরাগীদের কাছ থেকে উপহার হিসেবে প্রচুর বই পাওয়া শুরু করেছিলেন। এসব বই তার ফ্ল্যাটের কিতাবখানায় সাজিয়ে রাখা নিয়ে রীতিমতো সমস্যার সৃষ্টি হয়েছিল। ফ্ল্যাটের একটি বড় ঘরে অনেক দুষ্প্রাপ্য ও প্রয়োজনীয় বই সাজিয়ে তিনি এই কিতাবখানার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ঘরোয়া পাঠাগার ও লাইব্রেরিকে ‘কিতাবখানা’ বলতেন সোহেলের দাদা। ‘কিতাবখানা নামটি তিনি সেখান থেকেই পেয়েছেন। সেখানে গত প্রায় পঞ্চাশ বছরের পারিবারিক বইয়ের সংগ্রহ। এখন উটকো ঝামেলার মতো শুরু হয়েছে, দেশের অসংখ্য ‘সাহিত্যিক’, ‘যশোপ্রার্থী’ তরুণ-তরুণীর দেওয়া উপহারের বই। এসব বই পড়াও যায় না; জায়গার অভাবে রাখাও একটা ঝামেলা। পাঠকক্ষে আর জায়গা নেই, ঠিক যেন, ‘ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই ছোট সে তরী; আমার সোনার ধানে গিয়েছে ভরি।’ প্রথমে উপহার হিসাবে পাওয়া এসব বই তিনি অন্যায়ের উপহার দিতে শুরু করেছিলেন; অর্থাৎ একজনের কাছ থেকে পাওয়া বই অন্যকে গছিয়ে দিতেন। কিন্তু দেখলেন। এতে নতুন করে আরও বড় সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। তরুণ সাহিত্যিকরা তার বদনাম করে বেড়াচ্ছে যে, তিনি তাদের লেখা বই পড়েন না। আর এক লেখকের বই তিনি অন্য লেখককে গড়িয়ে দিয়ে তিনি রীতিমতো তাদের অপমান করছেন। কোনো কোনো তরুণ লেখক ফোনে সোহেল রহমানকে রীতিমতো পেটানোর হুমকি দিয়েছিলেন। বেনামিতে ফোন করে। তাই অন্য পথ খুঁজছিলেন; এখন পর্যন্ত সেটাকেই সবচেয়ে নিরাপদ বলে মনে হয়েছে।

২.

সব্যসাচী লেখক সোহেল রহমানের সারা মুখ সব-সময় মিষ্টি হাসিতে ভরে থাকে। তিনি মুখের হাসি মনের মধ্যে লুকিয়ে রেখে একটি গোপন পদ্ধতি অনুসরণ করলেন। প্রতিদিন যে বইগুলো উপহার পেতেন, তার সবই তিনি হাসিমুখে গ্রহণ করতেন। এবং লেখকের সামনে পাতা উল্টে বইয়ের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করতেন। পরের দিন বইগুলোর প্রথম কয়েকটি পাতা ছিঁড়ে ফেলতেন; অর্থাৎ পরম ভক্তি সহকারে বইটি তাকে লিখে উপহারে দেওয়ার বিষয়টি বেমালুম গায়েব করে ফেলতেন। এরপর এসব বই তার গাড়ির পেছনের সিটের একপাশে লুকিয়ে রাখতেন। কেবল ড্রাইভার রহিম মিয়াই, জানত, এই গভীর গোপন মারেফতি ব্যাপারটি আর কেউ নয়।

সারা দিন কত জায়গায় ঘুরে বেড়াতেন সব্যসাচী লেখক সোহেল রহমান। এই বিশাল শহরে কোনো নির্জন এলাকায় পাঁচিলের ওপাশে, কোনো পার্কের ফুলের বাগানে, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান বা রমনা পার্কের বেঞ্চের নিচে এসব বই রেখে দেওয়া হতো। বহুদিনের অভ্যাসে ড্রাইভার রহিম মিয়া এই আজব কাজটি খুব দক্ষতার সঙ্গে সম্পাদন করত। এ সময় তার মনে হতো, দুনিয়ায় বাস্তবিকই মানুষ মানুষের জন্য। একে অপরকে অবলম্বন করেই মানব সভ্যতা এগিয়ে চলেছে বহুকাল ধরে।

৩.

কিন্তু ফুলে যেমন কাঁটা, তেমন সব সাফল্যের মধ্যেও যেন হঠাৎ করে বিপদের ঘণ্টাধ্বনি বেজে ওঠে। বহু বছর ধরে ড্রাইভার রহিম মিয়ার মাধ্যমে লেখক সোহেল রহমান তার ব্যক্তিত্বের মুখোশটি বজায় রেখেছিলেন। মানুষের সজীব শরীরজুড়ে কত রহস্যের হাতছানি, কত প্রেম-বিরহের ঝড়। সব্যসাচী লেখকের শরীর বয়সের পথ পরিক্রমায় দুর্বল ও ব্যাধিগ্রস্ত হলেও কখনো তার মনে প্রেমের রঙিন ফানুস ওড়ে। প্রেমের ফাঁদ পাতা ভুবনে কতবার তিনি ধরা পড়েছেন। খ্যাতিমান লেখক বৃদ্ধ হলেও অনেক বিদগ্ধ সুন্দরীর তিনি পরম কাঙ্ক্ষিত হিরো। মানবজীবনে এ  এক গভীর রহস্য। সোহেল রহমান  পঁচাত্তর বছর বয়সে সহসাই প্রেমে পড়েছেন ‘সক্রেটিস প্রাইভেট ভার্সিটির’ ইংরেজি বিভাগের ছাত্রী দিলশাদ খানমের।

ওদের পরিচয় মাত্র ছ’মাসের; কিন্তু দিলশাদ যখনই ডাক দেয় কবিতা বা সংস্কৃতির কথা বলে, তখনই তার কাছ হাজির হয়ে যায় সোহেল রহমান। সেদিন গুলশানে নিজ বাড়িতে ক্লাসের   সহপাঠীদের নিয়ে কবিতা পাঠের আসর বসিয়েছিলেন দিলশাদ। সবাই যার যার ইংরেজিতে কবিতা আবৃত্তি করছিল। দিলশাদ পড়ছিল তার প্রিয় কবিতা কোলরিজের ‘রাইম অফ অন্যাসিয়েন্ট মেরিনার’। দিলশাদ ঘরোয়া কবিতা আবৃত্তির অনুষ্ঠানে মধ্যমণি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল; সোহেল বার বার তার দিকে মুগ্ধ চোখে তাকাচ্ছিলেন।

অনুষ্ঠান শেষে সবাই যখন চা-নাশতায় ব্যস্ত; তখন দিলশাদ সহসাই সোহেলের ওপর বিনা কারণে কিছুটা অভিমান করল। হয়তো ওদের অসমান সম্পর্কের আড়ালে এও এক অন্য ধরনের সম্পর্কের জটিলতা। কিংবা কিছুই নয়, শুধু হেঁয়ালি, দিলশাদ সহসাই বলল, ‘আগামী সপ্তাহে আপনার বাসায় আমি যাব; সেদিন শুধু আমাকেই কবিতা শোনাবেন, অন্য কাউকে নয়’ সোহেল যেন এও অদ্ভুত মুগ্ধতায় নিমগ্ন;’ মনে হলো বহুদিন পর এক আশ্চর্য মমতাময়ী বিদগ্ধ নারীর আবির্ভাব ঘটেছে তার জীবনে। বাড়িতে প্রৌঢ়া স্ত্রীর সাম্প্রতিক খ্যাঁচ খ্যাঁচ করে সব সময় কথা বলা আর ভালো লাগছে না; মনে হচ্ছে এভাবে বেশি দিন চললে তার কবিতা ধূ-ধূ মরুতে মরীচিকার মতো বিলীন হয়ে যাবে। চিরতরে। এরপর গলায় অনেক মধু মিশিয়ে দিলশাদ বলল, ‘আপনার কবিতা, গল্প, নাটক সবই এখন মহাকালকে ছুঁয়ে গেছে। আপনি অমর হয়ে গেছেন।’

সোহেল রহমান ভিতরে ভিতরে খুব খুশি হলেন। বললেন, ‘তুমি আমাকে এত ‘স্যার স্যার’ কর কেন? ভাই বলতে পার না? গুলশান থেকে বিদায় নিয়ে আসার সময় দিলশাদ ইংরেজিতে লেখা তার একটি কবিতার বই সোহেলকে উপহার দিল এবং তা নিয়ে কোথাও একটু আলোচনা করার অনুরোধ জানাল। সোহেল যখন গাড়িতে উঠে বসল, দিলশাদ জানালা দিয়ে তার হাত দুটি অনেকক্ষণ ধরে রাখল। সোহেল রহমানের কাছে এই সামান্য মুহূর্তটিকে মনে হলো যেন হাজার বছরের।

পরের সপ্তাহে শুক্রবার সন্ধ্যায় সোহেলের ধানমন্ডির বাসায় ঠিকই  এসেছিল দিলশাদ। মেয়ের বয়সী দিলশাদকে সোহেলের প্রৌঢ়া স্ত্রী মাসুদা খুবই আন্তরিকতার সঙ্গে অভ্যর্থনা জানিয়েছে। রাতে ডিনারের পর সোহেল মন থেকে দিলশাদের লেখার প্রশংসা করল। দিলশাদের জন্যে একটু গভীর মায়া যেন জমে আছে সোহেলের মনের পশ্চিমাকাশে সূর্যাস্তের ম্লান আভায়। এ যেন বড় বেশি মৃত্যুময় আভা, বয়সের বাধা এখানে নেই। সোহেল রহমান অনেক কথা লিখে তার কাব্যসমগ্র উপহার দিল দিলশাদকে। পরে দিলশাদের গাড়ি যখন লেকের পাশে ১১ নম্বর রোড দিয়ে চলে গেল, তখন সোহেল অনেকক্ষণ সেই গাড়িটির দিকে তাকিয়ে থাকলেন।

৪.

দিনের বেলায় ইদানীং একটু দেরিতে ঘুম থেকে ওঠেন সোহেল। সেদিনও তেমনই। দিলশাদের পবিত্র সুন্দর মুখ স্মরণ করে তিনি যেন সেদিন একটু বেশি স্বপ্নময় ঘুমে আচ্ছন্ন। ঘুম থেকে উঠেই দেখলেন, বাড়ির পুরনো চাকর বাদশা মিয়া সামনে দাঁড়িয়ে। বাদশা মিয়ার হাতে তার কাব্যসমগ্র। বইটি কয়েক পাতা উল্টে সোহেল বুঝতে পারলেন; গত রাতে এ বইটিই তিনি দিলশাদকে উপহার দিয়েছিলেন, বইয়ের তৃতীয় পৃষ্ঠায় লিখে দিয়েছিলেন, ‘এ যুগের শুদ্ধতম কবি দিলশাদকে’ বইটি সম্পর্কে বাদশা মিয়ার কাছ থেকে যা জানা গেল, আজ সকালে বইটি ১১ নম্বর রোডের মোড়ে পাওয়া গেছে। কে বা কারা হয়তো বইটি ফেলে রেখে গেছে। সকালে কেউ লেকের ধারে হাঁটতে গিয়ে বইটি পড়ে থাকছে। সোহেল রহমানের নাম দেখে বইটি ফেরত দিয়ে গেছে। এ পাড়ায় বিখ্যাত সব্যসাচী লেখক হিসাবে সোহেল রহমান সবার পরিচিত। এবার তিনি বাদশা মিয়াকে বইটি গুছিয়ে রাখতে বললেন এবং চোখ বুঁজে গোটা ঘটনাটি বুঝতে চেষ্টা করলেন। বাদশা মিয়া বইটি আলমারিতে সাজিয়ে রেখে চলে গেল।

৫.

এরপর এক গভীর বিচিত্র অনুভূতিতে সোহেলের মনটা ভরে গেল। তিনি এ দেশের একজন বিখ্যাত ও জনপ্রিয় সব্যসাচী লেখক। এতদিন অনেকের বই তার কাছে জঞ্জাল মনে হয়েছে; তা তিনি সুকৌশলে ফেলে দিয়েছেন এ দেশের কত ময়লা, কত জায়গায় পথে-প্রান্তরে। গত রাতে তার নিজের বই এক অর্বাচীন ও সুন্দরী মেয়ে ফেলে রেখে গেছে তারই বাড়ির কাছে। হয়তো ছুঁড়ে  ফেলে দিয়েছে গাড়ির জানালা দিয়ে। সোহেল ভাবলেন। কখনো কখনো কিছু ঘটনার বাস্তবতা উপন্যাসকেও হার মানায়। এই দ্বন্দ্ব, এই দুঃখ এবং এই আলো অন্ধকারের জগৎ নিয়ে আমাদের  সবার বেঁচে থাকা—সোহেল রহমান ডাকলেন; এই আশ্চর্য প্রচারণার ঘটনাটি জীবনের অনেক কঠিন সত্যকে আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। এর চেয়ে বড় পাওয়া আজ সকালে আর কী হতে পারে?

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর