শুক্রবার, ৫ অক্টোবর, ২০১৮ ০০:০০ টা

প্রবাসে মোহনীয় রাজনীতি

জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত

প্রবাসে মোহনীয় রাজনীতি

প্রবাসে বাংলাদেশীয় রাজনীতির প্রাণকেন্দ্র সম্ভবত আমাদের এই শহর। তাই বাইরের ঘরে টেবিলের উপরেই সাজিয়ে রেখেছিলাম—এই শহর থেকে প্রকাশিত আমাদের নিজেদের কিছু পত্রপত্রিকা। দেশীয় রাজনীতির খবরে পরিপূর্ণ। বারোটি বাংলা সাপ্তাহিক, দুটি বাংলা পাক্ষিক, দুটি বাংলা মাসিক, একটি ইংরেজি মাসিক। বিজ্ঞাপনে দেখলাম, আরও দুটি বাংলা সাপ্তাহিক ও একটি বাংলা মাসিক বেরুবে শিগগিরই। লোকমুখে শুনি একটি ইংরেজি পাক্ষিকও নাকি বেরুবে। এছাড়া মাসিক সাহিত্য ও বিনোদন পত্রিকাটি এবং সদ্য প্রকাশিত ত্রৈমাসিক কবিতা পত্রিকার দ্বিতীয় সংখ্যাটিও ছিল। দেখে দেখে গর্বে বুক ভরে ওঠে। ভাবাই যায় না, চল্লিশ বছর আগে এখানে একটি বাংলা কাগজও ছিল না। তারপর মাঝে মাঝে চালু হওয়া স্থানীয় নানারকম বাংলা রেডিও অনুষ্ঠানসহ দেশের বাংলা টেলিভিশন চ্যানেলসমূহ তো আছেই। আছে সরাসরি এখান থেকেই সম্প্রচারিত কয়েকটি টিভি চ্যানেলও।

সামনে কেউ থাকলে কথাগুলো সম্ভবত বেশ আনন্দের সঙ্গেই বলতাম; কিন্তু দরজা খোলার শব্দে ঘাড় ফিরিয়ে আমার যে বন্ধুটিকে ঢুকতে দেখলাম, তাঁর সামনে নয়। তাঁকে আশা করিনি। অবশ্য খবর দিয়ে আসা আমার এই উন্মাদ বন্ধুটির ধাতে নেই। যখন খুশি উদয় হবেন, যখন খুশি চলে যাবেন, এই তাঁর রেওয়াজ। সেটিও বড় কথা নয়, আসলে এই ছুটির দিনে দু-একটি সভা-সমিতির শেষে ঘরে ফেরার পথে ইলিশ কি পুঁইশাকের নতুন চালান, চাই কি সঙ্গে নতুন দু-একটি ভিডিও ঘরে নিয়ে আসা কাম্য। তাই এ মুহূর্তে পাগল বন্ধুটির সঙ্গে বৃথা বাক্যব্যয়ে সময় কাটাতে ইচ্ছুক ছিলাম না। তবুও বলতেই হয়, ‘এই যে, অনেকদিন দেখা নেই।’

বন্ধুবর আমার কথা শুনেছেন বলে মনে হলো না। টেবিলে সাজানো কাগজগুলোর দিকে তাঁর দৃষ্টি। ভালো করে দেখে বললেন, ‘সবগুলোই আছে তো?’

‘নিশ্চয়ই’, মুহূর্তে যেন মনে খুশির জোয়ার আসে আমার। ‘সবকটি’। এমন কি অন্যান্য শহর থেকে বেরোয় যেসব পত্রিকা তাও আমার কাছে আছে, তাঁকে জানাই।

তাঁর মুখে যেন খুশির আভাস। সোফায় বসে সামনে রাখা সাপ্তাহিকটি হাতে তুলে নেন। অগত্যা আমাকেও বসতে হয়।

‘দেখেছো হে, আজকাল ইলেকশনে জিতে ভোটারদের ধন্যবাদ জানানোর ব্যাপারটা? ভালো নয়?’

‘নিশ্চয়ই’, আমি বলি। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে বড় বড় কয়েকটি অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাচনসংক্রান্ত বিজ্ঞাপন, খবরাখবর ছাপা হচ্ছিল কাগজগুলোতে। নির্বাচনের খবর, নির্বাচনের বিজ্ঞাপন, ভোটপ্রার্থীদের আবেদন, ভোটবিজয়ীদের ধন্যবাদ জানানোর বিজ্ঞাপন ইত্যাদিসহ গত কয়েক সপ্তাহ ধরেই কাগজে কাগজে রীতিমতো উত্তেজনা। তার ওপর এতদ্দেশীয় আবাহনী-মোহামেডান ফুটবল ম্যাচের ফাইনাল, পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা সচিত্র সংবাদ ইত্যাদি। এসবই যে খুব ভালো, কাগজগুলো যে কী পরিমাণ কম্যুনিটি সার্ভিস দিচ্ছে তা বলে শেষ করা যায় না, বেশ আগ্রহের সঙ্গে তাঁকে বলতে আমার উৎসাহেই সম্ভবত, তাঁরও গলায় জোর আসে, ‘শুধু কি তাই? আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর কথাই ধরা যাক। তাদের সব শাখাও তো সমানে নানা সভা-সমিতি করছে— কাগজগুলোতে তাদের খবরও ছাপে।’

‘শুধু কি সভার খবরই? বক্তব্য, বিবৃতি, দেশ থেকে নেতাদের আসা-যাওয়া, তাঁদের প্রেস কনফারেন্স, সংবর্ধনা, এ সবই তো ছাপা হয়—।’ আমি তাঁর কথার সঙ্গে জুড়ে দিই, ‘তাছাড়া এই যে এত রকমের অনুষ্ঠান, নাটক, এই যে দলে দলে শিল্পী আসছেন দেশ থেকে— তাঁদের অনুষ্ঠানের খবর, বিজ্ঞাপন, সাক্ষাৎকার... কিছু কম সার্ভিস কাগজগুলো দিচ্ছে না?’ প্রশংসাসূচক কথাগুলো প্রায় এক নিঃশ্বাসে বলে যাই আমি।

‘ঠিকই বলেছ হে,’ বন্ধুবর ঘাড় নাড়িয়ে আমায় সমর্থন করেন। এতক্ষণ উৎসাহের ফলে খেয়ালই করিনি যে এমনি করে আমার সব কথায় সায় দিয়ে আমাকে ফাঁদে ফেলার মতলব তাঁর সব সময়। ফলে একটু সাবধান হয়ে বলি, ‘কিন্তু এসব তো ওঁদের কাজের মধ্যেই পড়ে!’

‘তা ঠিক।’ তিনি ঘাড় নাড়ান, ‘আর কিছু কিছু পয়সাও তারা এজন্য পায়।’ হালকাভাবে কথাগুলো বলে তিনি যেন বিষয়টির আলোচনা শেষ করে দিতে চাইলেন।’

তারপর বেশ কিছুক্ষণ তিনি কাগজকটি উল্টে-পাল্টে দেখেন চুপচাপ। তাঁর এই চুপ করে থাকাটাই বেশি ভালো লাগে না আমার। বলি, ‘তা ছাড়া আমাদের লোকও তো এখন অনেক বেড়েছে। দোকানপাটও বেড়েছে কত। আজকাল তো সবই পাওয়া যায়।’

হঠাৎ করেই যেন বন্ধুর উৎসাহ বেড়ে যায় আবার, ‘সব পাওয়া যায়’, তাই না? পোলাও চাল থেকে কচুর লতি, শুঁটকি থেকে পান, সাতকরা, ধারাপাত, টেংরা মাছ...সব। ‘সালোয়ার-কামিজ, শাড়ি, হাওয়াই শার্ট, তহবন্দ, চুড়ি, নাকের নোলক’, বলতে বলতে আবেশে যেন তাঁর চোখ বন্ধ হয়ে আসে, আমারও বন্ধ হয়।

‘তারপরে দেখ, দেশীয় রাজনীতির দলগুলো সব আছে আমাদের—আওয়ামী লীগ, বিএনপি, গণতন্ত্রী পার্টি, জাতীয় পার্টি, জাসদ, বাসদ—সব। খেলার দলও আছে, মোহামেডান, আবাহনী, ব্রাদার্স ইউনিয়ন। সব রকমের সমিতি সব জেলার, শহরের, উপজেলার, চাই কি গ্রামেরও আছে, তাই না’, বলে আমার মুখের দিকে তাকান তিনি। আমি আত্মতৃপ্তির সঙ্গে সায় দিই, ‘সে তো বটেই’। তারপর আমার মনের গোপন বাসনা আর চেপে রাখতে পারি না, ‘ভাবছি, আমাদের জেলার যারা আছে তাদের নিয়েও একটা অ্যাসোসিয়েশন করব।’ বলেই একটু সাবধান হই। এ ব্যাপারে যে প্রাথমিক কিছু আলাপ হয়েছে কয়েকজনের সঙ্গে এবং আমাকে প্রেসিডেন্ট করা হবে এমন সম্ভাবনাও যে আছে, এ কথা যেন মুখ ফসকে বেরিয়ে না যায়।

আমার দিকে উৎসাহের চোখ তখন তাঁর। এসব সামান্য কথা গ্রাহ্য করেন না বলেন, ‘তবে কি জানো, একটা জিনিস নেই।’ বলেই একটু দমে যান যেন।

যা নেই তা আমিও জানি। কয়েক বছর এ নিয়ে কথাবার্তাও বলেছি আমরা। তাই বলি, ‘ওই জাতীয় সংসদে আসন সংরক্ষণের ব্যাপারটা বলছ তো?’ জাতীয় সংসদে প্রবাসীদের জন্য আসন সংরক্ষণের একটা প্রস্তাব করেছিলাম আমরা কয়েক বছর আগে, পত্রিকার পাতায়। প্রবাসী সম্প্রদায় প্রস্তাবটি গ্রহণও করেছিলেন। আমার মনে হলো সেই অভাবের কথাই বলবেন তিনি। একটু চুপ করে, বেশ ভেবে তিনি বলেন, ‘না, ঠিক তা নয়। আমি পুরো জাতীয় সংসদের কথাই ভাবছি।’

‘মানে?’ আমি বিস্ময়ের সঙ্গে বলি।

‘এই, মানে, আমাদের এখানে সম্পূর্ণ একটা জাতীয় পরিষদ করলে কেমন হয়? সদস্য, প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার ইত্যাদিসহ?’

‘কী সব বাজে বকছ?’ আমাকে নিয়ে তামাশা করার মতলব এতক্ষণে টের পাই।

‘বাজে কথা মানে, কী বলছ তুমি?’ তিনি একটু রেগে যান। ‘সবই তো আছে আমাদের, সমস্ত সমিতি, অ্যাসোসিয়েশন, রাজনৈতিক দল, সাংস্কৃতিক দল, স্পোর্টিং ক্লাব, দাবা অ্যাসোসিয়েশন, নাট্যগোষ্ঠী, স্কুল, মসজিদ, মন্দির, গির্জা—জাতীয় পরিষদ কি চাই তো দেশটিকেও আমরা বানিয়ে নিতে পারি এখানে।’

‘সে কি সম্ভব নাকি! এক দেশের মধ্যে আর এক দেশ। এ কী কথা?’ আমিও রেগে যাই।

আমার রাগ দেখে তিনি একটু খুশি হলেন যেন মনে হয়। এই তাঁর স্বভাব। আর খুশি হলে যেমন সবাই সব মেনে নেয়, তিনিও তাই বললেন, ‘আরে আমি কি আর সত্যিকার জাতীয় সংসদ বা বাংলাদেশের কথা বলছি নাকি? এই যেমন আবাহনী, মোহামেডান, বিএনপি, আওয়ামী লীগ- আসল দলগুলো তো আর এখানে নয়, সবই দেশে। এখানকার জাতীয় সংসদ, স্পিকার, প্রধানমন্ত্রী, প্রেসিডেন্টও হবে তেমনি—আসল নয়। কিন্তু তাতে কী? কার কী আসে যায়? নির্বাচন করাটাই বড় কথা। তাই ভেবে দেখ তো কী অবস্থা দাঁড়াবে তাতে! কী উত্তেজনা—যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের নির্বাচন, নেতা-নেত্রীর অনবরত আসা-যাওয়া। কী বিশাল কর্মকাণ্ড!’

এভাবে অবশ্য ব্যাপারটা ভাবিনি আমি। তা সেরকম করে দেখলে একটা কথার কথা বটে। আমি জানাই, ‘তখন আমাদের খবরের কাগজগুলো একশো পৃষ্ঠা ছাপিয়ে কূল পাবে না। বারোটি সাপ্তাহিক কি, তখন হয়তো বারোটি দৈনিক পত্রিকারই দরকার হবে।’ আমি খুশির সঙ্গে বলি।

‘তবে একটু অসুবিধেও আছে।’ আমার খুশির বেলুন চুপসে দেওয়ার ইচ্ছে নিয়ে যেন বলেন তিনি, ‘এখানেই যদি বাংলাদেশ হয়ে যায়, তাহলে কেউ সেখানে যেতে চাইবে না।’

সে একটা সমস্যা বটে, তবে আমি তাতে দমি না মোটে। কোনো জবাব দিই না। প্রতি বছর সপরিবারে দেশে গিয়ে গিয়ে আমার ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে কয়েকটা শূন্য আছে কেবল। আমাকে নিরুত্তর দেখে তিনি বলেন, ‘আর তাই আর একটা ভাবনার কথাও আছে। বাংলাদেশ বিমান আবার যে নিউইয়র্ক ফ্লাইট চালু করবে তার যাত্রী হবে কোথা থেকে?’

হঠাৎ করে আমার মুখে কোনো কথা জোগায় না। তবুও একটু ভেবে বলি, ‘তা এখান থেকে লোক বেশি না গেলেও এই বিশাল কর্মকাণ্ড চোখে দেখতে দেশ থেকেও তো কিছু কম লোক আসবে না। না, বিমানের যাত্রীর অভাব হবে না।’

তিনি যেন সান্ত্বনা পান, ‘তাহলেই ভালো।’

রবিবারের সকালটা এমন কাটবে বুঝিনি। সাধারণত এরকম উল্টোপাল্টা কথাবার্তা বলে আমাকে খেপিয়ে দিয়ে বাতুল বন্ধু ঘর থেকে বেরিয়ে যান। আজ তেমন কিছুই ঘটল না দেখে আমি আনন্দে আগের রাতেই দেশ থেকে আসা পোড়াবাড়ির চমচম প্লেটে করে এনে দিই তাঁর সামনে।

যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ স্থাপনের প্রস্তাব করে মহাবিপদে পড়া গেছে। অতি উৎসাহের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কাগজে লেখার পরে পরিচিত অনেকেই আমাকে ব্যাপারটা বিশেষভাবে ব্যাখ্যা করে বোঝানোর অনুরোধ করছেন এবং বোঝাতে না পারলে গালাগালি দিচ্ছেন। কিন্তু প্রস্তাবটি যে আমার নয়, সেই উন্মাদ বন্ধুটির এ কথা বোঝাই কী করে! গত এক সপ্তাহ ধরে অনেক চেষ্টাতেও তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারিনি। টেলিফোনেও নয়।

সেদিন তাঁর বাসায় টেলিফোন করে যাকে পেলাম তার কথা শুনে একবারের জন্যও মনে হয়নি যে তিনি আমার আধপাগল বন্ধুটি নন। অথচ গলার স্বর একটুও না বদলে অবলীলাক্রমে তিনি বলে দিলেন, ‘তিনি বাসায় নেই।’

আমি হাসতে হাসতে বললাম, ‘তামাশা রেখে দাও। তোমার সেই প্রস্তাব কাগজে তুলে দিয়ে মুশকিলে পড়ে গেছি।’

অবিচলিত কণ্ঠে উত্তর আসে, ‘কিসের প্রস্তাব?’ আমার রাগ হয় এবারে, ‘তুমি কি মনে কর তোমার গলার স্বর চিনি না আমি? এটা কী ধরনের ব্যবহার?’ ক্ষোভের সঙ্গে বলি।

‘গলার স্বর আমার মতো হলেই যে সেটি আমি, এমন উদ্ভট চিন্তা তোমার মাথায় এলো কী করে?’

আমি হতভম্ব হয়ে যাই। তাঁর বাসার টেলিফোন, তাঁরই গলার স্বর। এ কেমন পাগল! নিজ পরিচয়কে স্বীকার করে নিয়ে আবার নিজেই সেটি অস্বীকার করছে। আমি সে কথা বলি। তাঁর বক্তব্যের পরস্পরবিরোধিতা এবং অসংগত যুক্তিরও উল্লেখ করি।

‘আলফ্রেড করজিবস্কির কথা মনে আছে?’ তাঁর প্রত্যুত্তর।

এটি উেকন্দ্রিক বন্ধুটির প্রিয় প্রসঙ্গ। প্রায়ই করজিবস্কির বুলি কপচান। করজিবস্কি ভাষার যথার্থ ব্যবহারের মধ্য দিয়ে, পারস্পরিক ভুল বোঝাবুঝির অবসানের মধ্য দিয়ে, পৃথিবীজোড়া শান্তি ও সহাবস্থানের স্বপ্ন দেখতেন। তাঁর কাছে চিন্তা ও বস্তুর সাধারণীকরণই মানুষের সমস্ত ভুলের মূল। তিনি বলতেন, এক নদীতে দুবার স্নান করা যায় না। তেমনি এই মুহূর্তের আমি, আর পর মুহূর্তের আমি এক মানুষ নই। সেই যুক্তির বলেই টেলিফোনে বাতুল বন্ধুর অমন উত্তর।

আমি বিরক্ত হয়ে বলি, ‘তার মানে এখন তুমি সেদিনের সব কথা অস্বীকার করছ তো?’

‘কথাগুলো মিথ্যা নয়,’ তিনি বলেন, ‘তবে সেদিন যে আমি ওইসব কথা বলেছিলাম আর আজ যে আমি, তারা এক লোক নয়।’

বুঝলাম এই জেনারেল সেম্যান্টিসিস্টের সঙ্গে পেরে ওঠা সম্ভব নয়। (করজিবস্কি চিন্তাক্ষেত্রে জ্ঞানার্জনের যে বিষয়টি নিয়ে এসেছিলেন, তার নাম দিয়েছিলেন ‘জেনারেল সেম্যান্টিস’)। ফলে নরম হয়ে বলি, ‘সবাই বলছে রাজনৈতিক দল নিজেদের স্বার্থ দেখাশোনা করার জন্য, পুরনো কর্মীদের মধ্যে সমর্থন বজায় রাখার জন্য বিদেশে দলের শাখা করতেই পারে। খেলাধুলায় উৎসাহীরা বাংলাদেশের প্রিয় খেলার দলের নাম অমর করে রাখার জন্য ওই দলের নাম নিয়ে জার্সি পরে, প্যাড লাগিয়ে, মাঠে নামতেই পারে কিন্তু সেজন্য এখানে জাতীয় সংসদ স্থাপন করা যায় না। সেটা নেহাতই তামাশার ব্যাপার।’

‘তোমাদের মতো অজ্ঞানের সঙ্গে বাক্য ব্যয় করার মতো সময় আমার নেই।’ বলে তিনি টেলিফোন রেখে দিতে চান।

আমি, ‘না, রেখো না, রেখো না’ বলে মিনতি করি, ‘অন্তত জবাবটা দাও।’

আমার বিপদে তাঁর বোধহয় করুণা হয়। বলেন, ‘আচ্ছা বাংলাদেশ সরকারের শাখা নেই বিদেশে?’

একটু ভেবে বলি, ‘তা অ্যাম্বাসি বা কনস্যুলেটকে যদি সরকারের শাখা বলা যায়, তাহলে তো নিশ্চয়ই আছে।’

তিনি খুশি হয়ে বলেন, ‘ঠিক জবাব দিয়েছ। তা অ্যাম্বাসেডর কী করেন?’

আমি বলি, ‘সরকারের প্রতিনিধিত্ব করেন। সরকারের স্বার্থ রক্ষা করেন। যে দেশে আছেন সেই দেশের প্রতি সরকারের নীতি কী হবে সে ব্যাপারে সাহায্য করেন। যে দেশে আছেন, সেই দেশের প্রতি সরকারের যা নীতি তা নিজ কাজের মধ্যে স্পষ্ট করেন।’

‘ঠিক কথা। তা সরকারের তো শাখা তিনটি—প্রশাসন, আইন প্রণয়ন আর বিচার বিভাগ। অ্যাম্বাসি-কনস্যুলেট হচ্ছে প্রশাসনের শাখা। এখন প্রশাসনের শাখা যদি বিদেশে করা যায়, তাহলে অন্য বিভাগের কেন করা যাবে না?’

আমি মহাফাঁপড়ে পড়ে যাই, ‘সে কী কথা! অ্যাম্বাসি-কনস্যুলেট হলো আমলাদের ব্যাপার।’ আমার মুখ থেকে কথা লুফে নিয়ে তিনি বলেন, ‘আর সংসদ হচ্ছে নন-আমলাদের ব্যাপার। এজন্য যুক্তরাষ্ট্রে প্রবাসী সম্প্রদায়ের মধ্যে জাতীয় সংসদ করার প্রস্তাব। তাঁরা নির্বাচিত হয়ে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদকে আইন প্রণয়নে পরামর্শ দেবে। অসম্ভবটা কোথায়?’

এরকম এঁড়ে তর্কের কোনো জবাব হয় না। তাই বলি, ‘তাহলে বলো বিচার বিভাগেরও এ দেশে শাখা করা যায়।’ বিদ্রূপের মতোই শোনায় আমার কথা।

‘একশোবার যায়।’ উত্তেজনার সঙ্গে বলেন তিনি, ‘কেন যাবে না? সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে পরোটা না হয় মুড়ি খেয়ে নাশতা করো, দুপুরে খাও ভাত বা রুটি, রাতে খাও ভাত। মেহমানকে খাওয়াও বিরিয়ানি, ঘরে পরো লুঙ্গি, কেবল কাজে যাওয়ার সময়ে নেহায়েৎই পরা যায় না তাই—আর যায় না-ই বা কেন, অনেককে তো আজকাল পাজামা-পাঞ্জাবিও পরতে দেখি সাবওয়েতে। লাউশাক, পুঁইশাক, কচুরলতি ছাড়া মুখে রোচে না, বাংলা গান ছাড়া কানে ওঠে না, বাংলা কাগজ ছাড়া পড়ে না, বাংলা টেলিভিশনের চ্যানেল ছাড়া অন্য কিছু দেখে না—তো সবই যখন এরকম তখন মামলা-সালিশেই বা কেন অমন হবে না?’

আমি খুবই বিরক্ত হয়ে বলি, ‘পাগল আর কাকে বলে। তোমার মতো উন্মাদের সঙ্গে কথা বলাই মূর্খতা।’ বলে ফোন রেখে দিই।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর