শুক্রবার, ৭ ডিসেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা
গল্প

মহানায়কের প্রত্যাবর্তন

মোস্তফা কামাল

মহানায়কের প্রত্যাবর্তন

অলংকরণ : শাকীর

ডিসেম্বর, ১৯৭১।

পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো হোটেল কক্ষে বসে খবর পান, পাকিস্তান ইস্টার্ন কমান্ডের সর্বাধিনায়ক জেনারেল এ এ কে নিয়াজি যৌথবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন। তিনি যখন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে পাকিস্তানের ঐক্যের পক্ষে ব্যাপক তোড়জোড় চালাচ্ছেন, সেই মুহূর্তে আত্মসমর্পণের খবরটা তাকে স্তম্ভিত করে। তিনি কিছুতেই এটা মেনে নিতে পারেন না। এ পরিস্থিতিতে তিনি কী করবেন তা নিয়ে ভাবেন। অনেক চিন্তাভাবনার পর তিনি সিদ্ধান্ত নেন, নিরাপত্তা পরিষদে বক্তৃতা দেবেন। সেখানে তিনি তার অবস্থান তুলে ধরবেন।  

যথাসময়ে নিরাপত্তা পরিষদের অধিবেশন শুরু হলো। জুলফিকার আলী ভুট্টো সভাপতির অনুমতিক্রমে বললেন, সম্ভবত নিরাপত্তা পরিষদে এটাই আমার শেষ বক্তৃতা। যদি নিরাপত্তা পরিষদ মনে করে থাকে যে, আমি আত্মসমর্পণ সংক্রান্ত ব্যাপারটা বৈধ করার জন্য এতে অংশগ্রহণ করব তাহলে এটুকু বলতে পারি যে, কোনো অবস্থাতেই আমি তা করব না। আমি নিরাপত্তা পরিষদ থেকে আত্মসমর্পণের দলিল গ্রহণ করব না। আমি একটা সামরিক আগ্রাসনকে বৈধ করার অংশীদার হব না। কেন গত তিন-চার দিন ধরে নিরাপত্তা পরিষদ বিধি মোতাবেক সিদ্ধান্ত গ্রহণে বিলম্ব করল? এর অর্থ কি এই নয় যে, ঢাকার পতনের জন্য অপেক্ষা করা হচ্ছিল? কেন আমি নিরাপত্তা পরিষদে সময় নষ্ট করব? ...আমি এই মুহূর্তে নিরাপত্তা পরিষদ থেকে ওয়াক আউট করলাম।

জুলফিকার আলী ভুট্টো জাতিসংঘ ভবন থেকে হোটেলে ফিরে এলেন। হোটেলে এসেই তিনি জানতে পারেন, ইয়াহিয়া খান তাকে হন্যে হয়ে খুঁজছেন। তিনি ইয়াহিয়া খানের কাছে ফোন করলেন। ইয়াহিয়া খানও ভুট্টো সাহেবের ফোনের অপেক্ষায়ই ছিলেন। ফোনে ভুট্টো সাহেবের কণ্ঠস্বর টের পেয়ে তাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ইয়াহিয়া বললেন, এখন আর নিউইয়র্কে বসে বসে কী করছেন? যা হওয়ার তা তো হয়েই গেছে!

স্যার, আমি তো চেষ্টা করছিলামই। নিয়াজি এত তাড়াহুড়া কেন করল?

ওকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। ইন্ডিয়া ব্যাপকভাবে যুদ্ধে নেমে যাওয়ার কারণে আমাদের সেনারা পেরে উঠছিল না। অবস্থা বেগতিক দেখে আমাকে বলল, যুদ্ধবিরতি ঘোষণা ছাড়া বিকল্প নেই। আমি বললাম, ঠিক আছে তাই কর।

তাহলে শুধু যুদ্ধবিরতিই করত! সারেন্ডার কেন?

সারেন্ডার না করলে নাকি আমাদের বিপুলসংখ্যক সৈন্য মারা পড়ত। তাদের বাঁচাতেই নাকি সে সারেন্ডার করেছে। যাকগে, এসব নিয়ে আর কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। আপনি চলে আসেন। আমি প্রেসিডেন্টের পদ ছেড়ে দেব।

কী বলেন!

হ্যাঁ, আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমি আর থাকব না। আর, আপনার মনে নেই! আপনাকে আমি কথা দিয়েছিলাম, ক্ষমতা ছাড়লে আপনার হাতেই ছাড়ব। আমি আমার সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করব।

ভুট্টো সাহেব মনে মনে ভীষণ খুশি। তিনি আনন্দে উদ্বেলিত। কিন্তু তা প্রকাশ করতে পারছেন না। তিনি নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, জী আমি দু’একদিনের মধ্যেই চলে আসছি।

প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ফোন রাখলেন। ভুট্টো সাহেবও ফোনের রিসিভার রেখে চিৎকার দিয়ে বললেন, ওয়াও! আই অ্যাম গোয়িং টু বি এ প্রেসিডেন্ট অব পাকিস্তান! ও গড! আই অ্যাম গ্রেটফুল টু ইউ! তুমি আমাকে এত বড় পুরস্কার দিয়েছ!

ভুট্টো সাহেব আবার ফোনের রিসিভার তুললেন। রাষ্ট্রদূতকে টেলিফোনে বললেন, আমার আজই পাকিস্তানে ফিরে যেতে হবে। আপনি দ্রুত টিকিট পরিবর্তনের ব্যবস্থা করেন।

রাষ্ট্রদূতের আশ্বাস পেয়ে ভুট্টো সাহেব লাগেজ গোছাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন।

২.

পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে দ্বন্দ্ব-সংঘাত ব্যাপকভাবে শুরু হয়েছে। কে প্রেসিডেন্টের পদ দখল করবে তা নিয়ে নানা কূটকৌশল করছেন শীর্ষ সেনা কর্মকর্তারা। এরমধ্যে বিদ্রোহী গ্রুপের নেতা জেনারেল গুল হাসান প্রেসিডেন্ট হওয়ার স্বপ্নে বিভোর!

ইয়াহিয়া খান সেনা কর্মকর্তাদের মতলব বুঝতে পেরে মনে মনে বলেন, যে পরিস্থিতি শুরু হয়েছে তাতে ভুট্টোর হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে চলে যাওয়াই ভালো। তা না হলে কেলেঙ্কারির মাত্রা আরও বাড়বে। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, ক্ষমতা ছাড়ার আগে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেবেন। পরে জেনারেল গুল হাসানের পরামর্শে তিনি ভাষণ দেওয়া থেকে বিরত থাকেন। ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তাদের পরামর্শেই তিনি ১৯ ডিসেম্বর রাতে পদত্যাগ করেন।

২০ ডিসেম্বর জুলফিকার আলী ভুট্টো দেশে ফিরে আসেন। ওইদিনই পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে নিযুক্ত হন। এর পরপরই ভুট্টো সাহেব পিপলস পার্টির নেতাদের নিয়ে মন্ত্রিসভা গঠন করেন।

শপথ নিয়ে প্রেসিডেন্টের চেয়ারে বসে তৃপ্তির হাসি হেসে ভুট্টো বলেন, পূর্ব পাকিস্তান আলাদা হয়ে তো ভালোই হয়েছে! আমার ভাগ্য খুলে দিয়েছে। আমি প্রেসিডেন্ট হয়েছি! এর চেয়ে আনন্দের খবর আর কী আছে!

৩.

কলকাতা থেকে স্বদেশে ফিরে আসেন বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, স্বরাষ্ট্র ও পুনর্বাসনবিষয়ক মন্ত্রী এএইচএম কামরুজ্জামান, অর্থমন্ত্রী ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী। তারা গভর্নর হাউসে অবস্থান নেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমদ ওঠেন আগামসী লেনে নিজের বাড়িতে।

ঢাকায় ফেরার কয়েক দিনের মধ্যেই প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ তার মন্ত্রিসভার রদবদল ও সম্প্রসারণ করেন। খন্দকার মোশতাককে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পদ থেকে সরিয়ে তার স্থলে আবদুস সামাদ আজাদকে নিয়োগ দেন। এর নেপথ্যে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন তার নেতিবাচক ভূমিকা রয়েছে। তিনি মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত লঙ্ঘন করে কলকাতায় স্বাধীনতাবিরোধী চক্রান্তে লিপ্ত হন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের পরামর্শে পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে আপসের ফর্মুলা নিয়ে অগ্রসর হয়েছিলেন। এ নিয়ে বেশ কয়েকবার মার্কিন প্রতিনিধির সঙ্গে আলোচনাও করেন তিনি। দেশে ফিরেই প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের মুক্তির দাবিতে সোচ্চার হন। তিনি জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে লিখিত আবেদন জানান। পরে তিনি ধানমন্ডির ১৮ নম্বর বাড়িতে ফজিলাতুন্নেছার সঙ্গে দেখা করতে যান। পারস্পরিক কুশল বিনিময়ের পর তাজউদ্দীন বলেন, ভাবি আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত। নয় মাস আপনাদের সঙ্গে কোনো যোগাযোগই করতে পারিনি। আপনারা কেমন ছিলেন; কী অবস্থায় ছিলেন?

সে কথা আর জেনে কী হবে! আমরা এই বাড়িতে একরকম অবরুদ্ধ অবস্থায় ছিলাম। দম ফেলারও কোনো অবস্থা ছিল না। একটা ছেলে আমাদের বাজারটাজার করে দিত। তাকেও মারধর করে বাড়িছাড়া করেছে। হাসিনা, রেহানা, রাসেল কেউ বাড়ির বাইরে যেতে পারত না। ওয়াজেদ কেবল যেতে পারত। তাও নানারকম জেরার মুখে পড়তে হতো তাকে। তারপর, আপনার খবর বলেন। পত্রিকায় দেখলাম, খন্দকার মোশতাককে বাদ দিয়েছেন!

জী ভাবী। তাকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে সরিয়ে দেওয়ার পর নিজেই পদত্যাগ করেছে। অসুস্থতার কথা বলে ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি হয়েছে। আসলে আরও আগেই তাকে বাদ দেওয়া উচিত ছিল। সে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে গোপন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিল। ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে আপস করতে চেয়েছিল।

ফজিলাতুন্নেছা তার কথা শুনলেন। কোনো মন্তব্য করলেন না। কিছুক্ষণ পর তাজউদ্দীন আহমদ বললেন, ভাবী, আমরা বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবিতে কাজ করছি। জাতিসংঘকে জানিয়েছি। বিভিন্ন দেশের কাছে অনুরোধ করেছি, তারা যেন পাকিস্তানকে চাপ দেয়। আমরা বলেছি, দেশের মানুষ এখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। ভাবী, আমি এখন আসি। পরে আবার কথা হবে।

আচ্ছা ভাই। আসবেন আবার।

তাজউদ্দীন আহমদ চলে যাওয়ার পর ফজিলাতুন্নেছা ওয়াজেদ মিয়াকে কাছে ডাকলেন। তাকে বললেন, তুমি তো বাইরে যাও। তোমার শ্বশুরের মুক্তির ব্যাপারে তুমিও খোঁজখবর নাও।

ওয়াজেদ মিয়া বললেন, জী আম্মা। আপনি চিন্তা করবেন না। আব্বা খুব দ্রুতই মুক্তি পাবেন।

ফজিলাতুন্নেছা কোনো মন্তব্য করলেন না। তিনি দীর্ঘনিশ্বাস ছাড়লেন।

শেখ মুজিবের মুক্তির দাবি ওঠে সারাবিশ্ব থেকে। জাতিসংঘ মহাসচিব ও সোভিয়েত ইউনিয়নের পক্ষ থেকে লিখিতভাবে শেখ মুজিবের মুক্তির দাবি জানায় পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ভুট্টোর কাছে। লিখিত পত্রে বলা হয়েছে— শেখ মুজিবের কিছু হলে সব দায়-দায়িত্ব পাকিস্তানকে বহন করতে হবে। ইউরোপের অধিকাংশ দেশের রাষ্ট্রপ্রধানগণ আনুষ্ঠানিকভাবে শেখ মুজিবের মুক্তির দাবি জানান।

ঢাকায় আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগসহ অঙ্গসংগঠনগুলো ৭ জানুয়ারি রেসকোর্স ময়দানে সমাবেশ করে। সমাবেশ থেকে শেখ মুজিবের মুক্তির দাবি জানানো হয়। কিন্তু একটি বিশেষ মহল থেকে গুজব ছড়ানো হয় যে, তাজউদ্দীন সাহেব শেখ মুজিবের মুক্তির ব্যাপারে আন্তরিক নন।

ওয়াজেদ মিয়া এ খবর জানার পর সোজা গভর্নর হাউসে গিয়ে হাজির হন। ততদিনে গভর্নর হাউসের নাম পরিবর্তন করে বঙ্গভবন রাখা হয়। তিনি প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে দেখা করে গুজবের বিষয়টি অবহিত করেন।

তাজউদ্দীন বলেন, মুজিব ভাইর মুক্তির বিষয় নিয়ে ভাবীর সঙ্গে কথা বলব। আমি আজই তার কাছে যাব।

পরে তাজউদ্দীন আহমদ ধানমন্ডির সেই ১৮ নম্বর রোডের বাড়িতে ফজিলাতুন্নেছার সঙ্গে দেখা করেন এবং শেখ মুজিবের মুক্তির বিষয়ে যে যে অগ্রগতি হয়েছে তা অবহিত করেন। তাজউদ্দীন বলেন, আপনি চিন্তা করবেন না। অচিরেই মুজিব ভাই মুক্তি পাবেন।

এর পরপরই জুলফিকার আলী ভুট্টো শেখ মুজিবকে মুক্তিদানের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। এই ঘোষণার পর সারাদেশে আনন্দের বন্যা বইতে শুরু করে।

৪.

‘শোন একটি মুজিবরের থেকে

লক্ষ মুজিবরের কণ্ঠস্বরের ধ্বনি

প্রতিধ্বনি আকাশে বাতাসে ওঠে রঙিন।

বাংলাদেশ আমার বাংলাদেশ।’

গানটি তাজউদ্দীন আহমদের মনের মধ্যে আকুলি বিকুলি দিয়ে ওঠে। তিনি বাংলার অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে চোখে চোখে দেখেন। দৃপ্ত পদক্ষেপে মহানেতা আসছেন। বিমান বন্দরের সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসছেন বাংলার মাটিতে। স্বপ্নের স্বাধীন বাংলায় পা রাখছেন তিনি।

এরমধ্যেই বিবিসি বাংলা সার্ভিসের খবর শুরু হয়। শুরুতেই শেখ মুজিবের দেশে ফেরার খবর। খবরে বলা হয়, পাকিস্তানের কোনো বিমান ভারতের আকাশসীমায় প্রবেশ নিষিদ্ধ। সঙ্গত কারণেই শেখ মুজিবকে ঢাকায় পাঠাতে হলে লন্ডন অথবা মধ্যপ্রাচ্যে যাত্রাবিরতি করতে হবে। সেখান থেকে ঢাকায় আসতে হবে তাঁকে। শেখ মুজিবের কাছে জানতে চাওয়া হলো, তিনি লন্ডন নাকি মধ্যপ্রাচ্য হয়ে ঢাকায় যাবেন!

শেখ মুজিব লন্ডন হয়ে ঢাকায় আসার বিষয়ে মতামত দিলেন। ওইদিন রাতেই তাঁকে চার্টার্ড বিমানে করে লন্ডনে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তার সঙ্গে ড. কামাল হোসেনও আছেন। তিনি সকাল সাড়ে ৬টার দিকে লন্ডনের হিথরো বিমান বন্দরে পৌঁছেন। সেখানে ব্রিটিশ পররাষ্ট্র ও কমনওয়েলথ দফতরের কর্মকর্তারা তাকে অভ্যর্থনা জানান। লন্ডনে হোটেল ক্লারিজে তার থাকার ব্যবস্থা করা হয়। সন্ধ্যায় তিনি ১০ ডাউনিং স্ট্রিটে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী অ্যাডওয়ার্ড হিথের সঙ্গে দেখা করেন। প্রধানমন্ত্রী হিথ শেখ মুজিবকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানান। তিনি তাঁর স্বাস্থ্যের খোঁজখবর নেন।

৯ জানুয়ারি ব্রিটিশ রাজকীয় বিমানে তাকে ঢাকায় পাঠানো হবে। নয়াদিল্লিতে তিনি যাত্রাবিরতি করবেন। পালাম বিমান বন্দরে তাঁকে অভ্যর্থনা জানাবেন ভারতের রাষ্ট্রপতি পিভি গিরি ও প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীসহ তার মন্ত্রিসভার সদস্যরা।

খবর শেষ হওয়ার পর স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লেন তাজউদ্দীন আহমদ। তিনি গভর্নর হাউস থেকে তখনই ফজিলাতুন্নেছার সঙ্গে দেখা করার জন্য ছুটে যান ধানমন্ডিতে। তিনি শেখ মুজিবের ঢাকায় ফেরার বিস্তারিত কর্মসূচি সম্পর্কে অবহিত করেন। তিনি এও বলেন, ব্রিটিশ বিমানটি ১০ জানুয়ারি দিল্লি হয়ে ঢাকায় পৌঁছবে। এতে ফজিলাতুন্নেছার দুশ্চিন্তা অনেকটাই কেটে যায়। পরিবারের অন্য সদস্যরাও স্বস্তিবোধ করেন।

৫.

স্বাধীনতার মহান নেতা শেখ মুজিবের শুভাগমনের খবর শুনে সকাল থেকে হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। কিশোর যুবক ও বৃদ্ধরা দলে দলে আনন্দ মিছিল করে। রেসকোর্স ময়দান থেকে বিমান বন্দর-সর্বত্র মানুষ আর মানুষ। রাজপথে যেন তিল ধারণের ঠাঁই নেই। ক্ষণে ক্ষণে হাজার কণ্ঠে স্লোগান উঠছে— বঙ্গবন্ধুর আগমন, শুভেচ্ছা স্বাগতম। শেখ মুজিব শেখ মুজিব, জিন্দাবাদ! জিন্দাবাদ! কেউ কেউ গলা ছেড়ে গান গায়।

লাখো মানুষের পদভারে মুখরিত ঢাকা শহর আজ যেন নতুন সাজে সেজেছে। চারদিকে আনন্দের ঢেউ। সবাই স্বাধীনতার অবিসংবাদিত নেতাকে অভ্যর্থনা জানাতে উন্মুখ হয়ে আছেন। হঠাৎ আকাশ কাঁপানো শব্দে থমকে দাঁড়ায় মানুষ। আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখে, বহুল প্রতীক্ষিত সেই বিমান ঢাকার আকাশে। মুহূর্তের মধ্যেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে বহনকারী সেই বিমান ঢাকা বিমান বন্দরে অবতরণ করে। সবার চোখ ছুটে যায় ওই বিমানের দিকে।

ধীরে ধীরে বিমানের দরজা খোলে। এক পা দুই পা করে সিঁড়ি বেয়ে নামলেন নেতা। নেতাকে দেখে বাংলার আকাশ বাতাসও যেন নেচে ওঠে। ফুলে ফুলে সুশোভিত বিমান বন্দর। নানা রঙের ফুল দিয়ে নেতাকে বরণ করা হয়। সাত কোটি বাঙালি আনন্দে প্রকৃতিও যেন যোগ দেয়। আকাশে বাতাসে ধ্বনিত হয় স্বাধীনতার সেই গান,

স্বাধীনতা এক গোলাপ ফোটানো দিন।

স্বাধীনতা এক সূর্য জাগানো দিন।

প্রতিপ্রাণে তাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা অমলিন।

কাঁটার আঘাত পায়ে পায়ে ছিল কত

তবু শঙ্কা ছিল না হৃদয়ে নত

ফুটিবে কুঁড়ি ভেবে ভেবে ছিল

জোয়ারে দোলানো দিন

স্বাধীনতা এক...

সর্বশেষ খবর