শুক্রবার, ১৮ জানুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা

সত্যজিৎ রায় এবং মাদাম কাওয়াকিতা

প্রবীর বিকাশ সরকার

সত্যজিৎ রায় এবং মাদাম কাওয়াকিতা

মাদাম কাওয়াকিতা, ইন্দিরা গান্ধী ও সত্যজিৎ রায় (বাম থেকে)

বিশ্বনন্দিত চলচ্চিত্র নির্মাতা সত্যজিৎ রায়ের (১৯২১-৯২) সঙ্গে জাপানের সম্পর্ক খুব গভীর কিন্তু আমাদের অজানাই বলা চলে। তাঁর আপনসৃষ্ট ভুবনের আলো সাত হাজার মাইল দূর প্রাচ্যের প্রাচীন সভ্যতা জাপানেও এসে আলোড়ন তুলেছিল। যে-সব খ্যাতিমান বাঙালির সঙ্গে জাপানের গুণীজনের মধ্যে গভীর সখ্য গড়ে উঠেছিল সত্যজিৎ রায় ছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম। তাঁর নির্মিত অসামান্য দিক-নির্দেশক একাধিক চলচ্চিত্র জাপানে প্রদর্শিত হয়েছে এবং প্রভাবশালী একটি প্রতিষ্ঠানে সংরক্ষিত আছে। বিশেষ করে, বিশ্ব চলচ্চিত্র জগতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ ‘পথের পাঁচালী’ ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছিল এই দেশের সিনেমাবোদ্ধা দর্শক এবং বুদ্ধিজীবী মহলে। এখনো প্রবীণদের স্মরণ থেকে মুছে যায়নি অপু ও দুর্গার সতেজ রূপটি।

‘পথের পাঁচালী’ বাঙালির একটি সময়ের মানবিক ও প্রাকৃতিক জনজীবনের বাস্তবিক এক জীবন্ত দলিল। যা জাপানিদের মনকে নাড়া না দিয়ে পারেনি এই কারণে যে, জাপানিরা অত্যন্ত সূক্ষ্ম অনুভূতিশীল খুঁতখুঁতে স্বভাবজাত সৌন্দর্যপ্রিয় মানবগোষ্ঠী। কাজেই সত্যজিতের সুনিপুণ কলাকৌশল, শিল্পভাবনা জাপানি ভক্তদের আন্দোলিত করেছিল এবং তারা সেসব গভীর আগ্রহসহকারে উপভোগ করেছিলেন। চলচ্চিত্রটি জাপানি ভাষায় রূপান্তরিত হওয়ায় দর্শক ছবিটিকে বুঝতে সক্ষম হয়েছিলেন ভালো করেই। কয়েকজন উঁচুমাপের চলচ্চিত্রবোদ্ধা এবং সমালোচকের দৃষ্টিতে সত্যজিৎ রায়ের ‘পথের পাঁচালী’ সম্পর্কে মন্তব্য জানা যাক। দেশ-বিদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাস-গবেষণাবিষয়ক অনেক গ্রন্থের লেখক ও সমালোচক ইয়ামাদা কাজুও (১৯২৮-২০১২) তাঁর ‘এইগা হিয়াকু নেন’ বা ‘শত বছরের চলচ্চিত্র’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘রায়ের এই ছবিটি নির্মাণের অছিলা ছিল কলকাতায় বিজ্ঞাপনী সংস্থায় চাকরিধীন বিভূতিভূষণ নামক একজনের আত্মজৈবনিক উপন্যাস ‘পথের পাঁচালী’র (নাতিদীর্ঘ পথ) চিত্রাঙ্কনের কাজ। পান্ডুলিপিটি পড়ার সময়ই যে-করে হোক এটাকে চলচ্চিত্রে রূপ দেওয়ার চিন্তায় উপনীত হন।’

লেখক ও চলচ্চিত্র সমালোচক কিকুগাওয়া তোঅরু তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘ওয়াসুরে এনু শোত্তো’ বা ‘অবিস্মরণীয় শর্ট’-এ লিখেছেন, ‘দিদি এবং ছোটভাই কাশবন পেরিয়ে দূরের রেলগাড়ি দেখতে যাওয়ার সিকোয়েন্স, বিদ্যুতের থামে কান লাগিয়ে রেলের কম্পন ও শব্দ শোনার দৃশ্য প্রভৃতি শৈশবে অভিজ্ঞতাপ্রাপ্ত মানুষ জাপানেও ছিলেন কোনো ভুল নেই। আবার, পদ্মপুকুরে পদ্মপাতায় ফড়িংয়ের পাখা স্থির করে বিশ্রাম নেওয়া, এরই মধ্যে জলের ওপর জলের ফোঁটাপড়ার শব্দ এবং মৃদু ঢেউ ওঠার দৃশ্য থেকে বর্ষার শাব্দিক সূচনার সিকোয়েন্সও চমৎকার! জাপানে হলে গ্রীষ্মের শেষ নাকি! কিন্তু ভারতে একটি বছর ছ’টি ঋতুতে ভাগকরা। বসন্ত, গ্রীষ্ম, বর্ষা, হেমন্ত, শীত এবং শুষ্ককাল। এগুলো জানা থাকায়, হঠাৎ সন্ধেবেলায় জোরালো বৃষ্টি এলে ভিজে জুবুথুবু দিদি দুর্গা গাছের পাতার নিচে আশ্রয় নেওয়ার দৃশ্যটাও খুব ভালো করেই বুঝতে পারি। সম্ভবত বর্ষার সূচনা, হরিহর পরিবারের জন্যও জীবনযাপনের দীনতার মধ্যে ক্রমবর্ধমান কঠোরতার লক্ষণ বলেই মনে হয়।’ 

জাপানের প্রথিতযশা চলচ্চিত্র সমালোচক, চলচ্চিত্রের ইতিহাসলেখক এবং সর্বজন শ্রদ্ধেয় কিংবদন্তিতুল্য টিভি ব্যক্তিত্ব য়োদোগাওয়া নাগাহারু (১৯০৯-৯৮), ‘অপরাজিত’ ছবি যেটা জাপানি ভাষায় রূপান্তরিত নাম ‘তাইগা নো উতা’ (মহানদীর গান) এবং ‘অপুর সংসার’ বা ‘তাইজু নো উতা’ (মহাবৃক্ষের গান) এবং সত্যজিৎ রায় সম্পর্কে যা বলেছেন এককথায় অসামান্য ইতিহাস! জাপানি থেকে বাংলায় ভাষান্তর করলে এরকম দাঁড়ায় : ‘তাইগা নো উতা’ ছবিটির মাধ্যমে গঙ্গানদীর কাছে যাই এবং ভারতীয় প্রকৃতির ভয়ঙ্কর রূপ প্রত্যক্ষ করি। সবাই গঙ্গাজলে গা ছেড়ে স্নান করে। সেই দৃশ্যে ভারতীয় বিশ্বাস ফুটে ওঠে তাই ভালো লাগে। এরপর ‘তাইজুউ নো উতা’ ছবিতে বৃক্ষ ক্রমে ক্রমে বড় হতে থাকে তার সঙ্গে অপুর প্রবৃদ্ধির তুলনা পরিস্ফুট হয়। ‘অপরাজিত’ ও ‘অপুর সংসারে’র পরিবর্ধনের সূত্র ধরে অপুর একসময় বউবরণ পর্যন্ত দৃশ্য অভূতপূর্ব, অসাধারণ চলচ্চিত্র বলে প্রতিভাত হয়েছে!

পরিচালক সত্যজিৎ রায় যখন জাপানে আগমন করেন, আমি তাঁকে বলি, ‘আপনি একজন অসামান্য মানুষ!’ কিন্তু তিনি সঙ্গে সঙ্গে বলে ওঠেন, ‘য়োদোগাওয়াসান, আমার চেয়েও বড় অসামান্য মানুষ আছেন।’

আমি যখন জিজ্ঞেস করি, ‘সে কে?’

সত্যজিৎ রায় উত্তর দেন, ‘মিস্টার কুরোসাওয়া।’

কুরোসাওয়াকে তিনি খুব শ্রদ্ধা করতেন। তাঁর জন্ম কলকাতায় বলে, আমি যেহেতু ভারতকে খুব পছন্দ করি, ভারতের নাচও আমার খুব পছন্দের, তাই কলকাতার নাচ নেচে দেখালে তিনি বললেন, ‘য়োদোগাওয়াসান আপনি তো ভালো নাচ জানেন! ভারতে আসুন।’ কিন্তু মানুষটা ৭১ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেছেন। এই সত্যজিৎ রায় ভারতীয় চলচ্চিত্র জগতে সবচেয়ে উঁচুশ্রেণির এবং শীর্ষতম। বিশ্বমাপেও শীর্ষ। সুতরাং এই অর্থে সত্যজিৎ রায় অসামান্য একজন চিত্রপরিচালক।

আমি ‘অপরাজিত’র আবির্ভাবে এবং সত্যজিৎ রায়ের ব্যক্তিত্বে মাতাল হয়েছি। ভালো চিত্রপরিচালক বলে মনে হয়েছে। ভারতে এরকম একজন পরিচালক জন্ম নিয়েছেন, এর মানে চলচ্চিত্রের ইতিহাসে তাঁর সত্যিই বিপুল-বিপুলভাবে অবস্থান করা আবশ্যক। এই মানুষটি কুরোসাওয়া আকিরাকে খুব পছন্দ করার কথা, কলকাতায় জন্ম বলে কলকাতার নানা কিছু শিক্ষালাভ করার কথাও আমাকে জানিয়েছেন। জাপানে যখন ছিলেন তাঁকে খুবই শান্ত দেখেছি। দীর্ঘদেহী ছিলেন, কুরোসাওয়ার প্রায় সমান। নীরব-নিশ্চুপ দেখেছি তাঁকে। বলেছেন, ‘য়োদোগাওয়াসান, কাবুকি দারুণ ভালোবাসি!’ একেবারেই অনুচ্চকণ্ঠ, নিরহঙ্কার একটা মানুষ। আসলেই শান্তশিষ্ট। তাঁর মর্যাদার পাশাপাশি তাঁর নির্মিত চলচ্চিত্রের ঐশ্বর্য, ঐশ্বর্যগত সম্মানও অনুভব করেছি।

সত্যজিৎ রায় ১৯৬৬ সালে জাপানে এসেছিলেন, যখন তাঁর চলচ্চিত্র ‘পথের পাঁচালী’ প্রথম প্রদর্শিত হচ্ছিল। বলা প্রয়োজন, পঞ্চাশের দশকে দু-তিনটি ভারতীয় ছবি জাপানে প্রদর্শিত হলেও আদৌ আলোড়ন সৃষ্টি করতে পারেনি। ১৯৫৬ সালে কান চলচ্চিত্র উৎসবে মানবিক দলিল পুরস্কারে ভূষিত প্রথম ভারতীয় চলচ্চিত্র ‘পথের পাঁচালী’ জাপানে ১৯৬৬ সালে প্রদর্শনের মধ্য দিয়ে সূচনা ঘটে নবদিগন্তের। এরপর আশি সালের প্রথম ভাগ পর্যন্ত সত্যজিৎ রায়ের একাধিক চলচ্চিত্র প্রদর্শনের ফলে এই দেশে ‘ভারতীয় চলচ্চিত্র মানেই সত্যজিৎ রায়ের ছবি’ এরকম একটি পরিচিতি বা ভাবমূর্তি গড়ে ওঠে। আশি সালের মাঝামাঝি থেকে ভারতীয় চলচ্চিত্র জগতের অন্যান্য পরিচালকদের ছবি প্রদর্শনের চিন্তাভাবনা করেন শ্রীমতী মাৎসুওকা তামাকি নামে একজন ভারতীয় চলচ্চিত্রের মহাভক্ত, আয়োজক, গবেষক এবং গ্রন্থকার। ১৯৮৮ সালে এই দেশে প্রথম ‘ভারতীয় চলচ্চিত্র মহোউৎসব’ অনুষ্ঠিত হয় তাঁরই উদ্যোগে। এরপর একাধিক উৎসব অনুষ্ঠিত হয়েছে, হচ্ছে।

১৯৬৬ সালে সত্যজিৎ রায় প্রথম বিশ্ববিখ্যাত জাপানি চিত্রপরিচালক কুরোসাওয়া আকিরার (১৯১০-৯৮) সঙ্গে পরিচিত হন জাপানেই। তাঁকে কুরোসাওয়ার সঙ্গে পরিচিত করিয়ে দেন মাদাম কাওয়াকিতা কাশিকো (১৯০৮-৯৩), সত্যজিৎ রায়ের চলচ্চিত্র ‘পথের পাঁচালী’র প্রদর্শক। সেই থেকে কুরোসাওয়া ও সত্যজিতের মধ্যে বন্ধুত্ব। অবশ্য মাদাম কাওয়াকিতার সঙ্গে সত্যজিতের পরিচয় ও বন্ধুত্ব আরও আগে। ১৯৫৬ সালে কান উৎসবেই হবে বলে ধারণা করা যায়। ‘পথের পাঁচালী’ পুরস্কৃত হলে পরে সেই ছবি জাপানে প্রদর্শনের ইচ্ছে ছিল মাদাম কাওয়াকিতার তা আর না বললেও চলে। সম্ভবত তিনি নিজেই সোহৎসাহে সত্যজিতের সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে চিঠিও বিনিময় হয়েছে একাধিক। একই সঙ্গে সত্যজিতের স্ত্রী বিজয়া রায়ের (১৯১৭-২০১৫) সঙ্গেও মধুর সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল মাদাম কাওয়াকিতা কাশিকোর। তাঁদের মধ্যেও অনেকগুলো চিঠি বিনিময় হয়েছিল। তিনজনেরই সাক্ষাৎ হয়েছে কলকাতা, দিল্লি, ম্যানিলা, জার্মানি, আমেরিকা, ইতালি, ফ্রান্সে একাধিকবার।

১৯৬৩ সালে মাদাম কাওয়াকিতার সঙ্গে বিজয়া রায়ের প্রথম সাক্ষাৎ ঘটে বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসবে। বিজয়া রায় তাঁর আত্মজীবনী ‘আমাদের কথা’য় বেশ কয়েকবার মাদাম কাওয়াকিতা এবং কুরোসাওয়ার কথা উল্লেখ করেছেন। মাদাম কাওয়াকিতার সঙ্গে প্রথম আলাপের বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে : ‘মানিকের বিদেশি বন্ধুদের সঙ্গে এখানেই আমার প্রথম আলাপ হলো। প্রথমেই নাম করতে হয় ম্যাডাম কাওয়াকিতার। জাপানি মহিলা। ওঁকে কখনো আমি কিমোনো ছাড়া অন্য পোশাকে দেখিনি। জাপানের সবচেয়ে বড় ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির মালিক। অঢেল টাকা। কিন্তু কোনো চাল নেই। এত সহজ, সরল, সুন্দর স্বভাবের মহিলা আমি সত্যি বড় একটা দেখিনি। সেই যে আলাপ হলো, আমৃত্যু সেই ভালোবাসা অটুট ছিল। আমাকে যে কত দামি-দামি উপহার দিয়েছেন তার শেষ নেই। আমিও আমার সাধ্যমতো চেষ্টা করেছি ওঁকে তার রিটার্ন দিতে। কিন্তু ওঁর সঙ্গে পেরে উঠব কী করে? উনি বয়সে আমার চেয়ে বেশ খানিকটা বড় ছিলেন। কিস্তু চেহারায় কোনো দিন বয়সের ছাপ পড়তে দেখিনি।

মানিকের ছবির ওঁর চেয়ে বড় ভক্ত আর কেউ ছিল না। মানিক যেদিন সেলজনিক অ্যওয়ার্ড নিলেন, সেদিন কাওয়াকিতা আমার পাশে বসেছিলেন, সঙ্গে ছিলেন মানিকের আমেরিকান ও ইংরেজ ক্রিটিক বন্ধুরাও। সবাই হইহই করে হাত তালি দিয়ে হল ফাটাবার জোগাড়। কাওয়াকিতা আমার কানে ফিসফিস করে বললেন, ‘‘ইউ মাস্ট বি ফিলিং ভেরি প্রাউড মঙ্কু’। ততদিনে আমরা দুজনে ডাকনাম ধরে ডাকতে শুরু করে দিয়েছিলাম। ওঁকে সবাই ‘কে’ বলে ডাকত। কাজেই আমিও ওঁকে ওই নাম ধরেই ডাকতাম। আমার চোখে সহজেই জল এসে যায়। কাজেই চোখটা চিকচিক করছিল। উনি আমার হাত চেপে বললেন, ‘আই ফিল লাইক ক্রায়িং অলসো, হি ইজ সাচ আ গ্রেট ম্যান’।

এ ঘটনার তিন বছর পরই সত্যজিতের আগমন ঘটে জাপানে অবশ্য একাই। মাদাম কাওয়াকিতার স্বামী জাপানের প্রভাবশালী এবং প্রথম দিককার চলচ্চিত্র ব্যবসায়ী কাওয়াকিতা নাগামাসার (১৯০৩-৮১) সঙ্গে পরিচিত হন। মেইজি যুগের (১৮৬৮-১৯১২) রাজকীয় সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার সন্তান নাগামাসা ১৯২৮ সালে তোওয়া ট্রেডিং কোম্পানি প্রতিষ্ঠাতা করেন। তরুণকালে চীনে ও জার্মানিতে উচ্চশিক্ষা নেন। জার্মানির বিখ্যাত মুভি কোম্পানি ইউনির্ভাসাম ফিল্ম অ্যাজেন্সি (ইউএফএ) তাঁকে চাকরিতে নিযুক্ত করে জাপানে প্রতিনিধি করে পাঠায়। ১৯২৯ সালে সহধর্মিণী কাশিকোর সঙ্গে সাক্ষাৎ ঘটে। কাশিকো সেক্রেটারি হিসেবে কোম্পানিতে যোগদান করার পর দুজনে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। কাশিকো ওসাকার এক বিশিষ্ট ব্যবসায়ীর কন্যা ছিলেন। য়োকোহামায় অবস্থিত ১৮৭০ সালে প্রতিষ্ঠিত অভিজাত ফেরিস গার্লস স্কুলে শিক্ষা লাভ করেন ইংরেজিতে। ফলে তিনি ইংরেজিতে ছিলেন সুদক্ষ।

বিয়ের পর ১৯৩২ সালে কাওয়াকিতা দম্পতি মধুচন্দ্রিমা উদযাপনের জন্য য়োরোপ ভ্রমণ করেন মূলত ভালো ভালো চলচ্চিত্র সংগ্রহের উদ্দেশ্যে। স্বামীর অনিচ্ছাসত্ত্বেও মাদাম কাশিকো ১৯৩১ সালে নির্মিত জার্মানির একটি ফিচার মুভি ‘মেডচেন ইন ইউনিফর্ম’ বা ‘গার্লস ইন ইউনিফর্ম’ ক্রয় করেন জাপানে প্রদর্শনের জন্য। ছবিটি জাপানে বক্স অফিস হিট হয়। তাঁদের সৌভাগ্যের দরজাও খুলে যায়। তাঁরা নিয়মিত য়োরোপ যান এবং দর্শকনন্দিত ব্যয়বহুল চলচ্চিত্রের স্বত্ব ক্রয় করে জাপানে প্রদর্শনের আয়োজন করেন নিজেদের প্রোডাকশন কোম্পানির ব্যানারে। বিশ্বখ্যাত চলচ্চিত্রকার ফ্রান্সের জিন রেনোয়ার (১৮৯৪-১৯৭৯), রেনে ক্লেয়ার (১৮৯৮-১৯৮১), ফ্রান্স-বেলজিয়ান জেকুয়েস ফেয়দার (১৮৮৫-১৯৪৮), ফ্রান্সের জুলিয়েন ডুবিয়ার (১৮৯৬-১৯৬৭) প্রমুখের চলচ্চিত্র ক্রয় করে জাপানে প্রদর্শনের পর ব্যাপক সাড়া পড়ে যায় সাধারণ নাগরিক এবং সিনেমাবোদ্ধা মহলে। জাপানের ভালো চলচ্চিত্রও য়োরোপে প্রদর্শনের ব্যবস্থা করেন তাঁরা। উল্লেখ্য, তাঁরাই প্রথম কুরাসাওয়া আকিরার ‘রাশোমোন’ চলচ্চিত্রটি ভেনিস ফিল্ম ফেস্টিভালে প্রদর্শনের জন্য নিয়ে যান ১৯৫১ সালে। ‘রাশোমোন’ সেখানে ইতিহাস সৃষ্টি করে ‘গোল্ডেন লায়ন’ পদকে ভূষিত হয়ে। পরের বছর অর্জন করে আমেরিকার অ্যাকাডেমি অনারারি অ্যাওয়ার্ড বা ‘অস্কার’ পুরস্কার যা চলচ্চিত্রের ‘নোবেল’ বলে খ্যাত। একাধিক পুরস্কারে ভূষিত ‘রাশোমোন’ই বিশ্বচলচ্চিত্রমঞ্চে জাপানি তথা এশিয়ার চলচ্চিত্রকে মর্যাদাসম্পন্ন আসনে আসীন করে যা সম্ভব হয়েছিল কাওয়াকিতা দম্পতির কল্যাণে। ফলে কুরোসাওয়া আকিরা রাতারাতি খ্যাতিমান চলচ্চিত্র নির্মাতারূপে আবির্ভূত হন। তাঁর নির্মিত ‘রাশোমোন’ এবং ‘সেভেন সামুরাই’ বিশ্বের মহান চলচ্চিত্রের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত। তাঁর সঙ্গে গভীর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে কুরোসাওয়ার।

চলচ্চিত্র বিষয়ে ব্যাপক শিক্ষা ও অভিজ্ঞতা অর্জন করেন মাদাম কাশিকো এবং চলচ্চিত্র জগতে জনপ্রিয়তার কারণে ‘মাদাম কাওয়াকিতা’ নামে দেশ-বিদেশে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেন। আমেরিকা, য়োরোপ এবং ভারতে তিনি পরবর্তীকালে ‘কে’ নামেই সমধিক খ্যাত ছিলেন। সত্যজিৎ রায় এবং বিজয়া রায়ও তাঁকে ‘কে’ বলেই সম্বোধন করতেন। চলচ্চিত্রে অসামান্য অবদানস্বরূপ কাওয়াকিতা নাগামাসা ১৯৭৩ সালে জাপানের রাষ্ট্রীয় সম্মান ক্কোকা কুনশো ‘জুইহোও-শোও’ পদকে ভূষিত হন। কাওয়কিতা দম্পতি কানাগাওয়া-প্রিফেকচারের ইতিহাসখ্যাত কামাকুরা শহরে যে বাড়িতে বসবাস করতেন সেটি এখন কামাকুরা সিটি কাওয়াকিতা ফিল্ম মিউজিয়াম ২০১০ সালে উদ্বোধন হয়েছে। দৃষ্টিনন্দন এই প্রতিষ্ঠানে দেশ-বিদেশের চলচ্চিত্রবিষয়ক বহু তথ্য-উপাত্ত-দলিলপত্র, আলোকচিত্র, পোস্টার, প্রকাশনা, স্মারকবস্তু এবং চলচ্চিত্র সংরক্ষিত আছে। আছে সত্যজিৎ রায়েরও সৃষ্টিকর্ম।

এ ছাড়াও টোকিওর চিয়োদা-ওয়ার্ডে রয়েছে কাওয়াকিতা মেমোরিয়াল ফিল্ম ইনস্টিটিউট নামে একটি ফাউন্ডেশন, যার মাধ্যমে কাওয়াকিতা পুরস্কার প্রদান করা হয়। মাদাম কাওয়াকিতা কাশিকো যে সত্যজিৎ রায় এবং বিজয়া রায়কে সত্যিই অন্তর দিয়ে ভালোবেসেছিলেন।

সর্বশেষ খবর