তরুর নিমীলিত দু’চোখ থেকে আমি কিছুতেই চোখ সরাতে পারি না। মানুষের চোখের সঙ্গে উপমিত হওয়ার মতো কী যে বিশেষ যোগ্যতা আছে পাখির নীড়ের, সে কথা বুঝে উঠতে আমার ঢের সময় লেগে যায়। এতদিন পর সত্য স্বীকারে আজ আর আমার কোনো দ্বিধা নেই- প্রকৃতপক্ষে, তরুকে নিয়ে ঘর বাঁধার পরই জীবনানন্দীয় ওই উপমার অন্তর্নিহিত তাৎপর্য উপলব্ধি করেছি দিনে দিনে একটু একটু করে। আহা, এত দিনে জেনেছি, মানব-মানবীর যৌথ জীবনে সামান্য খড়কুটোরও এমন অসামান্য ভূমিকা থাকতে পারে। এখন আমি একান্তে নিভৃতে নিজের সঙ্গে নিজে নিজে তামাশা করি- কাকে তুমি খড়কুটো বলে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করো হে অর্বাচীন! ঠাকুরের বাণী কি তোমার কানের ভেতর দিয়ে মরমে প্রবেশ করেনি- ধরণীর ধন কিছুই যাবে না ফেলা!
কখনোবা নিজের সঙ্গে তর্ক করেছি, তাই বলে খড়কুটোরও এমন অমূল্য সম্মান!
পাখির নীড় মানে তখনো আমার কাছে তুচ্ছ তৃণলতা কিংবা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে কুড়িয়ে আনা খড়কুটোর অধিক কিছু হয়ে ওঠেনি। চারপাশের নানা রকম মানুষের চোখের মধ্যে খুঁজে ফিরেছি জীবনানন্দের পাখির নীড়। কোথায় সাদৃশ্য! কোথায় সাধারণ ধর্মের ঐক্য! মনে মনে ভাবি- এ এক সৃষ্টি ছাড়া উপমা বটে!
সেই তুলনায় কতই না সহজ এবং সাবলীল উপমা-পটোলচেরা চোখ। পটোল চিরে অর্ধেক করলেও তো চোখের আকৃতিই লাভ করে। আকৃতিগত এই সাদৃশ্য কার না চোখে পড়বে! চোখে পড়ার জন্য তো এ রকম আকৃতিগত সাদৃশ্য জরুরি। কিন্তু এই ‘চোখে পড়া’ শব্দবন্ধের কাছে এসে চেতনা থমকে দাঁড়ায়, ভেতরে ভেতরে প্রশ্ন জাগে- মানুষ কি তবে চোখেই দ্যাখে সব কিছু? চোখের আড়ালে আর কোনো রহস্য নেই তো! এই চোখ তাহলে মনের আয়না হয় কখন, কেমন করে হয়!
ভাবনার এই স্তরে এসে আমি কবে যেন আবিষ্কার করে বসি- চারপাশের নানারকম মানুষের মধ্যে আবার নারীর চোখে আছে আলাদা গভীরতা। আছে অন্যরকম মেঘছায়া। আছে রোদের সঙ্গে ছায়ার লুকোচুরি। একাকী নিভৃতে কাটাছেঁড়া করি, আবার একাকী চমকে উঠি, সাদৃশ্য কেবল আকৃতি নয় প্রকৃতিতেও প্রতিফলিত হতে পারে! সেই তখন থেকে উন্মোচিত হয় অবগুণ্ঠন; ফলে তরুর দু’চোখে মুগ্ধ চোখ ফেলে কত সহজেই খুঁজে পাই নাটোরের বনলতা সেনকে। আমি তখন দিব্যি দেখতে পাই- মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য; আমার বুকের ভেতরে উদ্ঘাটিত হয়। চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা। দারুচিনি দ্বীপের ভেতরে আমি কেমন অনায়াসে আবিষ্কার করি সবুজ ঘাসের দেশ।
আর সেই সবুজ ঘাসের দেশের রানি হচ্ছে আমার তরু।
এমনিতে ভারি সাদামাটা মানুষ। সাদা কথার সরল মানেটুকু সহজে বুঝতে পারে কি না, ওকে দেখে সেটুকু নিঃসংশয়ে বলা মুশকিল। কিন্তু বাইরের এই দেখাই তরু সম্পর্কে শেষ কথা নয়। ওর ভেতরে ভারি এক দার্শনিক দার্শনিক ভাব আছে। কিন্তু সেটা আবার কাউকে ধরতে দেয় না। অথচ আমি ওই তরুর কাছ থেকেই শিখেছি বস্তুর শরীর থেকে কীভাবে রূপ-রস-গন্ধ-ঐশ্বর্য-অলংকার সবকিছু সরিয়ে নিয়ে বস্তুনিরপেক্ষ করে তোলা যায়, ব্যক্তি কীভাবে নৈর্ব্যক্তিক হয়ে ওঠে, সেইসব তত্ত্ব। তরু যখন বুঝিয়ে বলে তখন মোটেই তত্ত্বভারাক্রান্ত মনে হয় না। কেমন অবলীলায় পাখির মতো ডানা মেলে গাইতে পারে- কেউ নয়ন মুদে দেখে আলো, কেউ দেখে আঁধার...।
মোটেই সন্তর্পণে নয়, তরুর চোখে আমি নির্ভয়ে চোখ রাখতেই দেখতে পাই দিগন্তছোঁয়া নীল আকাশ নুয়ে আছে তার চোখের তটিনিজুড়ে। তখন প্রকৃতিনিমগ্ন কবি জীবনানন্দ দাশ হাত বাড়িয়ে দেন, অবাক বিস্ময়ে আমি আবিষ্কার করি- কবির হাতে সেই রৌদ্রের গন্ধ, আমি টের পাই- সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতোন সন্ধ্যা আসে; ‘সব পাখি ঘরে আসে’- কেবল এইটুকু বাক্যাংশ আমার চৈতন্যের ক্যানভাসে এঁকে দেয় মহামূল্য পাখির নীড়। কই, খড়কুটো কিংবা তৃণগুল্ম কিছুই আমার চোখে পড়ে না। ঘরে ফেরা পাখির কাছে নীড় মানে আরও অনেক কিছু। আমি উল্টেপাল্টে নানাভাবে প্রশ্ন তুলেছি- কেন ওরা নীড়ে ফেরে? আকাশজোড়া কোথায়ও কোনো সীমারেখা নেই, আকাশের ওপারে কেবলই আকাশ, ডানা মেলবার এমন অফুরন্ত সুযোগ ছেড়ে পাখিরা কেন ফিরে আসে নীড়ে, কোন ভরসায়! তরুকে শুধিয়েও জবাব পাইনি। অথচ তার চোখের পাতায় মুদ্রিত জলছাপ থেকে পেয়ে যাই যথাউত্তর।
তরু ঘুমিয়ে।
বলক ওঠা দুধের ওপরে যেমন পাতলা সর পড়ে, সেই রকমই স্নিগ্ধ এবং কমনীয় আলোর প্রলেপ পড়েছে ওর চোখে-মুখে। ঘরের সব বাতি নেভানো। তবু ঘরের ভেতরে অসহনীয় অন্ধকার নয় মোটেই। বিছানার ডানদিকে প্রশস্ত জানালা। এই জানালা কিছুতেই বন্ধ করতে রাজি নয় তরু। এ ঘরে জানালা আরও দুটো আছে। সে দুটো বন্ধ অথবা খোলা রাখা নিয়ে ওর বিশেষ কোনো বক্তব্য নেই। খোলা রাখা চাই বিছানার পাশের এই ঢাউস জানালাটি। এটা বন্ধ করলে নাকি ঘুমই আসবে না, দম আটকে যাবে ওর! কী সাংঘাতিক কথা। মাথার ওপরে সিলিং ফ্যান ঘুরছে বোঁ বোঁ করে। তাতে আশ মেটে না, শ্বাস ভরে না, জানালা খোলা রাখতেই হবে।
সত্যি বলতে কী, বিশালায়তনের এই জানালা এবং আড়াই হাজার স্কয়ার ফিটের খোলা ছাদের জন্যই চারতলার ওপরে চিলেকোঠা মার্কা এই সামান্য বাসাটি তরুর পছন্দ। এই নাকি তার কাছে অসামান্য। আমি তো ভেবে অবাক হই- শহুরে এই মেয়েটির বুকের জমিনে এত সবুজের সমারোহ কখন কীভাবে ঘটল! আমাদের এই নতুন বাসার প্রশস্ত খোলা ছাদকে নাকি তার সবুজ ধানক্ষেত ভাবতে ভালো লাগে। রীতিমতো ইট-সিমেন্ট-লোহার তৈরি কংক্রিটের ছাদ, সেখানে ধানক্ষেত আসবে কোত্থেকে? বললেই হলো! তরু কেমন মনের জোরে দাবি করে, হয়, হয়। চোখ বন্ধ করে ভাবলেই হয়। ধানক্ষেত হয়। ফুলবাগান হয়। ওর কথা শুনে আমার হাসি পায়। কী অদ্ভুত যুক্তির ধারা! চোখ বন্ধ করে ভাবলে তো অনেক অসম্ভবকেই সম্ভব ভাবা যায়। কিন্তু চোখ মেললে? আমি জিজ্ঞেস করি,
চোখ মেলে ভাবলে কী হয়?
দূর! চোখ মেলে কিছু ভাবা যায় নাকি! শুধু দেখা যায়। যা তুমি দেখতে চাও না তাও দেখতে হয়। ঠা ঠা রোদ্দুর, চোখ খোলা থাকলে না দেখে উপায় আছে! ওর চেয়ে চাঁদের আলোয় দেখা ব্যাপারটা বেশ। খানিক দেখা যায়, বাকিটা পুষিয়ে নিতে হয় কল্পনাতে। বেশ ভালো-নিজের মতো ভাবা যায়।
তরু! চিরদিনই তুমি ভয়ানক কল্পনাপ্রবণ রয়ে গেলে!
মানুষ মাত্রই কল্পনাপ্রবণ। হাতি-ঘোড়া, গরু-ছাগল কোথায় পাবে এই হিরণ¥য় হাতিয়ার! কোথায় পাবে এই অমূল্য সম্পদ!
আমি অপলকে তাকিয়ে থাকি ওর মুখের দিকে। একটুখানি দম নিয়ে তরু এবার সোজাসুজি আমাকে আক্রমণ করে,
কেন, তুমি কল্পনাপ্রবণ নও?
একদা ছিলাম! এখন নই। এখন আমি বাস্তবতার পাথরে আঘাত খেয়ে খেয়ে জীবনের নতুন পাঠ নিই। সেই কবেই তো আমি কবিতাকে বিদায় দিয়েছি, তোমার মনে নেই।
উহ! কী যে সব খটমটে কথা বল না!
হ্যাঁ, জীবনটা এমনই খটমটে, এমনই নির্মেদ গদ্যময়।
এভাবে যে বলতে পারে, সে কল্পনাপ্রবণ না হয়ে পারে!
বললাম তো তরু- একদা ছিলাম!
তার মানে একদা তুমি মানুষ ছিলে। আর এখন...
এখন অমানুষ হয়ে গেছি, এই তো বলতে চাও?
তরুর মুখে আষাঢ়ের কালো মেঘ থমকে দাঁড়ায়। কী কথায় কী কথা এসে কথা বলার আনন্দটুকুই ম্লান করে দেয়। ও চুপ করে থাকে। কিন্তু আমার কিছুতেই চুপ করতে ইচ্ছে হয় না। তরুর ডান হাতে ঝাঁকুনি দিয়ে বলি, থামলে কেন! বল, অমানুষ হয়ে গেছি।
সহসা তরু আমার মুখে হাত দিয়ে থামায়।
প্লিজ তুমি শান্ত হও।
আমি শান্ত থাকি, আর তুমি একতরফা বলে যাও- বেশ আবদার বটে!
এতক্ষণে তরু আমার গলা জড়িয়ে ধরে। বুকের সঙ্গে জাপটে ধরে রাখে। আমি আর কথা বলতে পারি না। ভেতরে ভেতরে কে যেন দুর্বিনীত ফণা নামিয়ে নেয়। বলা নেই কওয়া নেই টকাটক আমার দুই গালে চুম্বন এঁকে দেয় তরু। তারপর কণ্ঠলগ্ন হয়েই বলে, আজ তোমার কী হয়েছে সোনামণি?
এবার আমি শান্ত।
বল কী হয়েছে?
তবু নীরব।
সোনামণি!
এতক্ষণে আমার বুকের ভেতরে কেঁপে ওঠে। দৃশ্যমান না-ই হোক, তবু আমার বুকের ভেতরে যে নিজস্ব বাগান আছে, সেই বাগানের সব কটা গাছগাছালি ডালপালাসমেত নুয়ে পড়ে ওই সোনামণি ডাকে। পাহাড়চূড়ার বরফ গলে যায়। ঠিকরে পড়ে সকালবেলার সোনাঝরা রোদ্দুর। আমি তখন কী করি? কী যে করি আমি নিজেই জানি না। আমার ডান হাতের পাঁচ আঙুল তরুর খোলা পিঠের প্রশস্ত উঠোনে মমতার বিলি কেটে দেয়, ঘুম ভাঙানোর খেলা করে। প্রথমে খুব নিরাসক্ত ভঙ্গিতে এই খেলা শুরু হলেও কিছুক্ষণের মধ্যে দেখা যায় পাঁচ আঙুলের সে কী দাপাদাপি! সে কী অস্থিরতা! আমি তো ভীষণ অবাক-কী চায় আঙুলেরা, কী তৃষ্ণায় এমন দাপিয়ে বেড়ায়! এদিকে কখন কীভাবে যেন আমার চোখে অশ্রু আবিষ্কার করেছে তরু, ওর তপ্ত ঠোঁটেই শুষে নেয় আমার অশ্রুরেখা, তবু কানের কাছে মুখ এনে অস্ফুটে শুধায়-কী হয়েছে সোনামণি?
আমি একটা কিছু বলতেই চাই তরুকে। ঠিক কোন কথাটা যে বলতে চাই, সেটা গুছিয়ে উঠতে পারি না। কণ্ঠ ভার হয়ে আসে। বাগ্যন্ত্রের দুয়ার আগলে দাঁড়ায় অচেনা কাঁটা। ঢোক গিলতে গিয়ে টের পাই, সে কাঁটা আবার বাষ্পীয় পি- হয়ে জমাট বেঁধে আছে। কিছুতেই গিলতেও পারছি না, গলায় কথাও ফুটছে না। কিন্তু তরু সেটা জানবে কী করে! অবোধ বালিকার মতো আদুরে গলায় ডাকে, সোনামণি!
সোনামণি আমার নাম নয়। আমার পিতৃদত্ত নাম মনিরুল ইসলাম। বন্ধুদের অনেককেই সংক্ষেপিত উচ্চারণে ‘মণি’ বলে ডাকে। দু-চারজন মনিরুলও বলে। কী ভেবে জানি না আমাদের ডিপার্টমেন্টের নাজমা আপা ডাকতেন মনির বলে।
[চলবে]