শেষ পর্ব
মশালের আলো জ্বালিয়ে সময়মতো গ্রিক সেনাবহরকে সংকেত দেওয়ার জন্য সাইনন নামে এক গ্রিক সৈন্যকে নির্দিষ্ট দায়িত্ব দেওয়া হয়। ওডিসিয়ুস সাইননকে ভালো করে শিখিয়ে পড়িয়ে রেখে গেছেন। সাইননকে ধরে নিয়ে যাওয়া হলো রাজা প্রিয়ামের কাছে। ওডিসিয়ুসের শেখানো গল্প সে গড়গড় করে বলতে শুরু করে। আরও বলল, ‘আমাকে বলি দেওয়ার সমস্ত ব্যবস্থাই পাকা হয়ে গেছিল, কিন্তু ওই রাতে আমি শিবির থেকে পালাতে সমর্থ হই এবং জঙ্গলের ভেতর পালিয়ে থাকি। গ্রিকরা চলে যাওয়ার পর আমি বেরিয়ে আসি।’ সাইননের বানানো কাহিনি সবাই সরলমনে বিশ্বাস করে। রাজা তাকে অভয় দেন। কৃতজ্ঞতার ভান করে সাইনন গল্পের দ্বিতীয় অংশটা জানায়। বলে, এই কাঠের ঘোড়াটিকে গ্রিকরা রেখে গেছে দেবী এথিনার প্রতি অর্ঘ্যস্বরূপ। তবে এর পেছনে তাদের অসৎ উদ্দেশ্য আছে। তারা চায়, ট্রয়বাসী এটিকে ধ্বংস করুক যাতে দেবী এথিনা ট্রয়ের ওপর ক্রুদ্ধ হন। আর তা ছাড়াও, নগরীর অভ্যন্তরে যে এথিনার মন্দির সেখানে ঘোড়াটি নিয়ে গেলে দেবী তো গ্রিকদের বদলে ট্রয়বাসীদের প্রতিই অনুগ্রহ দেখাবেন। সেই চতুর গল্পের ঈপ্সিত ফল মন্ত্রের মতো ফলল সঙ্গে সঙ্গে । আর এভাবেই সফল হলো ওডিসিয়ুসের ধূর্ত কৌশল। ১০ বছরের যুদ্ধে যা সম্ভব হয়নি, সেই অসাধ্য সাধন হলো একটি ধাপ্পাবাজির মাধ্যমে। এ যেন ইংরেজ কবি জন লিলির লেখা শিক্ষামূলক রোম্যান্স ‘ইউফুয়েস : দ্য এনাটমি অফ উইট’-এ উল্লেখিত সেই প্রবাদের প্রতিফলন- “All is fair in love and war.”-প্রেমে এবং যুদ্ধে সবই ন্যায্য।
রাজা প্রিয়াম শুরুতে এই উপহার নিতে অস্বীকৃতি জানালেন। রাজ জ্যোতিষী পরামর্শ দেন, উপহার গ্রহণ না করলে তা অমঙ্গল বয়ে আনবে ট্রয়ের। প্রিয়াম তখন মত পাল্টাতে বাধ্য হন। ট্রয়বাসী আনন্দ-উল্লাস করতে করতে ঘোড়াটিকে নগর-দেয়ালের ভেতরে নিয়ে আসে। সর্বনাশকে এমন উন্মত্ত অভ্যর্থনা জানানোর ঘটনা বোধ করি মানব ইতিহাসে দ্বিতীয়টি নেই। উৎফুল্ল ট্রয়বাসী কাঠের ঘোড়াটিকে টেনে নিয়ে গেল এথেনার মন্দির চত্বর পর্যন্ত। মধ্য রাতে অন্ধকার মন্দির চত্বরে দাঁড়িয়ে থাকা কাঠের ঘোড়ার পেটের দিকে খুলে গেল একটি দরজা। বেরিয়ে এলো দুর্ধর্ষ গ্রিকযোদ্ধারা। তাদের নেতা মহাবীর ওডিসিয়ুস। তারা পা টিপে টিপে নগরীর মূল ফটকের দ্বার খুলে দিলে বাইরে অপেক্ষমাণ গ্রিকবাহিনী ঢুকে পড়ল ঘুমন্ত নগরীতে। তারা বিভিন্ন ভবনে একসঙ্গে লাগিয়ে দিল দাউদাউ আগুন। হনুমানের লেজের আগুনে যেমন স্বর্ণলঙ্কা পুড়ে ছাই, ট্রয়ের অবস্থাও যেন ঠিক তাই। মুহূর্তেই ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয় এক সময়কার সমৃদ্ধ, সুসজ্জিত, সুন্দর, সুরম্য ট্রয়। আগুনে পুড়ে ছাই-ভস্ম হয়ে যায় হাজারো সৈন্য আর নিরীহ অধিবাসী। এদিকে অ্যাকিলিস ছুটে যান হেলেনকে বাঁচানোর আশায়; কিন্তু প্যারিসের ছোড়া তীর বিদ্ধ করে অ্যাকিলিসের গোড়ালি। মারা যান মহাবীর অ্যাকিলিস। কিন্তু জয়লাভ করে গ্রিকরা। পরাজিত হয় ট্রয়বাসী। ইউরোপ মহাদেশের এককালের সবচেয়ে সম্পদশালী নগরী ট্রয় এক রাতের মধ্যে পরিণত হলো ধ্বংসস্তূপে। অনাদিকাল ধরে মানুষ স্মরণ করবে ট্রয়ের সেই ভয়াল কালরাতের কথা। সেই রক্তস্নাত ট্রয়নগরী থেকে দেবী আফ্রোদিতির সহায়তায় পালিয়ে বেঁচেছিলেন আরেক বীর ইনিয়াস, যিনি পরে নতুন সভ্যতা গড়ে তুলেছিলেন।
‘অ্যাকিলিসের গোড়ালি’ (Achilles’heel) প্রতীকী অর্থে সামগ্রিক শক্তি থাকা সত্ত্বেও একটি দুর্বলতা, যা পতনের দিকে নিয়ে যেতে পারে। ন্ডে পেছনের কাহিনি খানিটা বলে রাখা দরকার। আগেই উল্লেখ করেছি, অ্যাকিলিসের জন্ম হলে সদ্যোজাত সন্তানকে অবিনশ্বর করার মানসে মা থেটিস তাকে স্টিক্স নদীতে একবার ডুবিয়েছিলেন। কিন্তু গোড়ালির যে অংশ ধরে থেটিস অ্যাকিলিসকে পানিতে ডুবিয়েছিলেন, সেই অংশটি শুকনো থেকে যায়। সেজন্য গোড়ালি ছাড়া অ্যাকিলিসের সমগ্র শরীর অপরাজেয় ছিল। ট্রয়যুদ্ধে এই গোপন রহস্য বিরোধী পক্ষের কানেও পৌঁছায়। বিষাক্ত তীর অ্যাকিলিসের গোড়ালিতে আঘাত করলে তাঁর মৃত্যু ঘটে। প্রসঙ্গত আমরা স্মরণ করতে পারি, মহাভারতে উল্লেখিত মাতা গান্ধারীর দৈবদৃষ্টি দ্বারা পুত্র দুর্যোধনের দেহকে অক্ষত রাখার, আঘাত থেকে সুরক্ষা দানের এবং অপরাজেয় করার ব্যর্থ চেষ্টার কাহিনি। বিষাদ সিন্ধুতে বিবৃত বিশ্বনবী কর্তৃক তাঁর আদরের দৌহিত্র পুণ্যাত্মা ইমাম হোসেনের গলায় মমতাময় পবিত্র চুম্বনের ঘটনা- যা কারবালা প্রান্তরে দুরাত্মা সীমারের ক্ষুরধার খঞ্জর থেকে মা ফাতিমার দুলালের গলদেশকে সুরক্ষা দিয়েছিল।
ইতিহাস মতে, হেলেনের বিয়ে হয়েছিল কমপক্ষে তিন বার। রাজা মেনেলায়েস, প্যারিস ও তার ভাই ডাইফোবাসের সঙ্গে। মেনেলায়েসকে সে একটি কন্যাসন্তানও উপহার দেয়। যার নাম ছিল হারমিয়ন। ট্রয় যুদ্ধে প্যারিস নিহত হওয়ার পর তার দুই ভাই হেলেনাস ও ডাইফোবাস ভ্রাতৃবধূকে পাওয়ার জন্য দ্বন্দ্বযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। হেলেনাসকে পরাজিত করে হেলেনকে লাভ করে ডাইফোবাস। যুদ্ধ শেষে মেনেলায়েসের হাতে নিহত হয় ডাইফোবাস।
হেলেনকেও মারতে উদ্যত হন মেনেলায়েস। কিন্তু তার নয়নাভিরাম রূপে আবারও প্রেমে পড়ে যান রাজা মেনেলায়েস। শেষ জীবন তারা মিসরে কাটান। ঐতিহাসিকের মতে, তাদের মৃত্যু হয় গ্রিসের থেরাপিয়নে। ইতিহাস বা পুরাণ- সবক্ষেত্রেই ট্রয়নগরী ধ্বংসের জন্য দায়ী করা হয় হেলেনকে। ইউরিপিডিসের বর্ণনায় হেলেনকে দেখানো হয়েছে তেড়ে আসা অভিশাপের সন্তান, ঈর্ষা ও খুনের সন্তান, পৃথিবীর লালিত প্লেগ, মৃত্যু ও বিভীষিকার প্রতীক হিসেবে।
এত কিছুর পরও প্রশ্ন কিন্তু থেকেই যায়। এ দায় কী কেবলই হেলেনের? হেলেনের দৈবিক জন্ম, মানবিক লাবণ্য, ভুবনমোহিনী রূপ- এগুলোর কোনোটার জন্য কি হেলেন দায়ী? নাকি কিছুটা দায় ছিল প্যারিসেরও? নিজ শ্বশুর রাজা প্রিয়ামকে উদ্দেশ করে হেলেন বলেছিল, ‘আমি আপনাকে গভীর শ্রদ্ধা, ভক্তি ও সম্মান করি, হে আমার প্রিয় পিতা, কিন্তু আমি যদি আমার দাম্পত্যশয্যা, আমার প্রিয় কন্যা, আমার প্রিয় বাল্যবন্ধু এবং আমার আত্মীয়দের ফেলে আপনার ছেলের সঙ্গে পালিয়ে না এসে বরং মৃত্যুকেই আলিঙ্গন করতাম- সেটাই হতো আমার জন্য শ্রেয়। কিন্তু আমি তা করিনি, এখন আমি দুঃখের অতলান্তিকে বিলীন হয়ে যাচ্ছি।’
হেলেনের ভুবনমোহিনী ধ্বংসাত্মক রূপ, নাকি প্যারিসের উন্মত্ত প্রেম এই অনিষ্টের জন্য দায়ী? নাকি হেলেন আর প্যারিসের অদূরদর্শিতাই ডুবিয়েছিল ট্রয়কে? তাহলে ‘Apple of Discord’ কী ভূমিকা রাখল? দেব-দেবীরা কেন উৎকোচ প্রথা চালু করল? মর্ত্যরে কায়-কারবারে স্বর্গবাসী দেবতাদের কেন এত নাক গলানো? রবীন্দ্রনাথের মিনতিও এখানে প্রাসঙ্গিকতা পায়, “থাকো স্বর্গ হাস্যমুখে, করো সুধাপান /দেবগণ। স্বর্গ তোমাদেরি সুখস্থান/ মোরা পরবাসী। মর্ত্যভূমি স্বর্গ নহে/ সে যে মাতৃভূমি- তাই তার চক্ষে বহে/ অশ্রুজলধারা...” উইলিয়াম শেকসপিয়র তাঁর ‘কিং লিয়ার’ নাটকে যেমনটা বলেছেন, ‘দুরন্ত ছেলেপেলেদের কাছে মাছি যেমন, দেবতার কাছে আমরাও তেমনি/তারা তাদের খেলাচ্ছলেই আমাদের প্রাণ কেড়ে নেয়।’
তাহলে ট্রয় যুদ্ধের আসল দায় কার? এর দায়ভার কি প্রেমের, নাকি প্রেম এখানে পূর্বনির্দিষ্ট ছকে আবদ্ধ ভিন্ন কোনো অমোঘ হাতের নিরুপায় পুতুল। নাকি এর পুরোটাই নিয়তির নির্মম পরিহাস? নাকি চিরায়ত অন্ধ প্রেম? এমন হাজারটা প্রশ্ন আছে, কিন্তু উত্তরে পাহাড়।
-সমাপ্ত