আবার সাহস কত- চেয়ারম্যানের মেয়ের সঙ্গে প্রেম!
এই তো, চিনেছ তাহলে! সেই দেবুদা কিন্তু নীরুকে, মানে চেয়ারম্যানের মেয়েকেই বিয়ে করেছে। তবে চাপ ছিল নীরুর দিক থেকেই।
তা হঠাৎ ওদের খবর পেলে কোথায়? নীরুর সঙ্গে দেখা হয়েছিল? আরে নাহ! দেখা হলো দেবুদার সঙ্গে।
আমার বুকের মধ্যে গোপন বীণার সূক্ষ্ম কোনো তারে যেন টুং করে একটুখানি আওয়াজ হয়। আমি ওসব টুংটাং উপেক্ষা করে চোখ গোল করে তাকিয়ে থাকি তরুর মুখের দিকে। তরুদের ডিপার্টমেন্টের এক বছরের সিনিয়র বড় ভাই হচ্ছে দেবাশীষ রায়, আর তরুর চেয়ে এক বছরের জুনিয়র ছোট বোন নীরু, চেয়ারম্যান স্যারের একমাত্র মেয়ে। বাপের মুখের দিকে না তাকিয়ে সে ঝুলে পড়ল দেবুদার গলায়। তরু বেশ গর্বের সঙ্গে দেবাশীষ রায়ের গল্প শোনায়, দেবুদার কি চাকরির অভাব? অ্যাদ্দিন পর জানা গেল আমাদের কোম্পানিতে তিনি আমার বস হয়ে বসে আছেন।
তাই নাকি!
তবে আর বলছি কী! আজ অফিসে গিয়ে দেখি হেড অফিস থেকে টিম এসেছে ইন্সপেকশনে। ও বাবা, সে টিম না ঘোড়ার ডিম, হেডেড বাই দেবাশীষ রয়। দেবুদাও আমাকে দেখে অবাক- তুমি এখানে! আমারও খুব আশ্চর্য মনে হয়- ‘নানান কাজে আমিও তো অনেক দিন হেড অফিসে গেছি, কই, দেবুদার কথা তো শুনিনি! এ দিকে ইন্সপেকশন মাথায় উঠল, দেবুদার গল্পের শেষ হয় না। তার বউ নীরুকে সে ডাকে ভীরু বলে। তরু আবার হাসিতে গড়িয়ে পড়ে। আমি কমপ্লিমেন্ট দিই, বাহ! মুসলমানের মেয়ে হয়েও গণ্ডি ভেঙে বেরিয়ে এলো, মা-বাবার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করল, তবু সেই নীরুই হলো ভীরু!
সত্যি যা বলেছ। নীরুকে দেখে কে বলবে-এই মেয়ে এত কাণ্ড ঘটাতে পারে! দেবুদাকে আমিও বলেছি-তাই বলে ওকে ভীরু বলাটা আপনার ঠিক নয়। শুনে দেবুদা কী বলে জানো?
আমি ঘাড় তুলে তাকাই।
বলে কিনা-তুমি জানো না তরু, নীরু সত্যিই ভয়ানক ভীরু। খরগোশের মতো কোমল তুলতুলে শরীরটুকু নিয়ে তার ভয়ের অন্ত নেই। সব কিছুতেই গা বাঁচানো স্বভাব। তো সে যা-ই হোক, দেবুদা এবং তার স্ত্রীর দাম্পত্য জীবনের খুঁটিনাটি খবরাদি পরিবেশন শেষ হলে তরু জানায়, দেবুদা অবশ্য তোমার কথাও খুব বলেছিলেন। নাটক দেখার প্রস্তাব তারই। শান্তিনগরে বাসা। শুক্রবার বিকালে আমাদের যেতে বলেছেন। তারপর সন্ধ্যায় চারজন মিলে যাব নাটকে। সম্ভাব্য সেই নাট্যসন্ধ্যা নিয়ে আরও কত রকম পরিকল্পনা ফাঁদা হয়েছে, তরু একে একে সবই বলতে থাকে, আমিও শুনতে থাকি, কিন্তু কেন যেন আমারই মনে হয় আমি কিছুই শুনছি না।
আমাদের সেই নাটক দেখার সন্ধ্যা।
দিনে দিনে দিন ঘনিয়ে আসে ঠিকই, অথচ আমি তরুর উচ্ছ্বাসের সামনে কিছুতেই বলতে পারি না-নাটকে যেতে আমার আর ইচ্ছে করছে না। অফিস থেকে ফিরে তরু খলবলিয়ে জানায়-দেবুদার সঙ্গে আজ ফোনে অনেক কথা হয়েছে। আমরা যাব শুনে নীরু নাকি খুব খুশি। আমাদের সবার টিকিটও কনফার্ম হয়ে গেছে। এখন শুধু গেলেই হলো।
আমার সেই যাওয়ার ইচ্ছেটাই ধীরে ধীরে লুকিয়ে যায়, গুটিয়ে যায়। কেন আমার নাটকপ্রিয় স্বভাবটা গেল কোথায়? কত দিন নাটক দেখতে যাইনি! তরুর মুখে নাটকে যাওয়ার প্রস্তাব শুনে তো প্রথমে সারা অন্তর চনমন করে লাফিয়েই উঠেছিল। অথচ মাত্র এই দুই-তিনটি দিন যেতে না যেতে সেই ইচ্ছে-জোয়ার নেমে গেল। বেলাভূমিতে তাহলে কী পড়ে আছে! ভয়ে ভয়ে গোপনে গোপনে তাকিয়ে দেখি-বেলাভূমিজুড়ে ঈর্ষার নুড়ি চকচক করছে। নিজের কাছেই নিজেকে ভীষণ ছোট মনে হয়, গোপনে তরুর চোখ-মুখ জরিপ করি-এই ঈর্ষা নুড়িগুলো ওর নজরে পড়েনি তো!
সেই শুক্রবারের দিনটা আমার ছিল উৎকণ্ঠার দিন।
কিন্তু বিকাল গড়িয়ে আসতে আসতে আমার উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা, দ্বিধা-সংকোচ, লজ্জা-ঈর্ষা-সব কিছুর অবসান হয়ে যায়, সর্বংসহা প্রকৃতি পরম ঔদার্যে সব কিছু ঢেকে দেয়। প্রথমে আকাশজুড়ে ঘনকালো মেঘের দাপাদাপি। গুমোট আবহাওয়া। খানিক পরে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি। আমার মনে তখন ময়ূরের পেখম মেলার আনন্দ, তবু চোখে-মুখে দুঃখ এবং দুশ্চিন্তার রেখা ফুটিয়ে তুলে বলি,
এখন কী হবে তরু?
তরুর তো বেজায় মন খারাপ। দৌড়ে বারান্দায় গিয়ে একবার আকাশ দেখে এসে আমার গায়ে একটা আদুরে ধাক্কা দিয়ে বলে,
সত্যি কী হবে বল তো! দেবুদারা কিন্তু খুব অপেক্ষা করবে।
আমি তখন পালে হাওয়া দিই,
দাঁড়াও, দাঁড়াও! এই বৃষ্টি ছেড়েও যেতে পারে!
সত্যি বলছ?
আচ্ছা মুশকিল! আমি কি গনক ঠাকুর নাকি? তবে এক-আধ ঘণ্টার মধ্যে বৃষ্টি ছেড়ে যেতেও পারে। এমন তো হয়ই।
হ্যাঁ, তা হয়। তাহলে ওদের বাসায় বিশেষ একটা সময় দেওয়া হবে না হয়তো।
তবু তুমি রেডি হয়ে থাকো, বৃষ্টি একটু ধরে এলেই...
আর তুমি রেডি হবে না?
আমার আবার সময় লাগে নাকি?
তার মানে সময় লাগে আমার?
মোটেই না। তোমার তো পরনে ঢাকাই শাড়ি কপালে সিঁদুর, তোমার আবার দেরি হয়! তবু মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকা, এই আর কী?
এদিকে দিনের আলো ফুরিয়ে আসছে। কিন্তু বৃষ্টি ছাড়ার কোনো লক্ষণ নেই। তরু একবার ঘর একবার বারান্দা দাপাদাপি করে, আমার কাছে এসে আস্ফালন করে, আবার এক সময় আমার কাঁধে দু’হাতের ভর দিয়ে রবীন্দ্রনাথকে স্মরণ করে- যদিও সন্ধ্যা আসিছে মন্দ মন্তরে... কী যেন আবৃত্তি করতে তুমি...
এর মধ্যে আবার কবিতা আসে কোত্থেকে? আমি কৃত্রিম ক্ষোভ প্রকাশ করি।
কী করব বল! বাইরে বেরোনোর উপায় আছে?
তবুও অন্ধ, বন্ধ করো না পাখা!
তরু হেসে ওঠে ফিক করে,
সেই তো তোমার কবিতা আবৃত্তিই হলো!
না না, কবিতা হবে কেন, এই বর্ষণমুখর সন্ধ্যায় আমরা তো নাটক করব।
নাটক দেখার বদলে নাটক করতে হবে!
অগত্যা কী আর করা! নাটকই জমবে ভালো। আমরাই অভিনেতা, আমরাই দর্শক। আবার আমরা দুজনই হব নাট্য সমালোচক, মন্দ কী।
কী যা-তা বলছ।
যা-তা নয় যা-তা নয়, নাটকের কথা হচ্ছে। তুমি হবে রানি, আমি হব রাজা।
তরু আবার অর্গলভাঙা হাসি ছড়িয়ে দেয়, আমি বলি...
তুমি হবে লাইলী, আমি মজনু। তুমি হবে শিরি...
হাসির গমকে তরুর সারা শরীর উথলে ওঠে।
তুমি হবে মমতাজ, আমি শাজাহান, তুমি হবে মধুবালা, আমি...
তরুর মুখ থেকে হাসির মুক্তো গড়িয়ে পড়ে মেঝেয়। সেই মুক্তো কুড়ানোর ছলে আমরা দুজনে সারা মেঝে জুড়ে লুটোপুটি খাই। আমি ওকে দুই হাতের বাঁধনে বন্দি করে শুধাই আলোমতির নাম শুনেছ?
ঢাকা নগরীতে যে মেয়ের জন্ম-বেড়ে ওঠা, সে কী করে আলোমতির নাম জানবে? সেই শৈশবে প্রাণের গভীর থেকে আলোমতিকে চিনেছি, আমরা গ্রামের ছেলেরা, প্রেমকুমারকে দেখে সম্ভ্রমে মাথা নুইয়েছি। এখন এই বাদল সন্ধ্যায় আমি তরুকে প্রস্তাব দিই-তুমি হও আলোমতি, আমি প্রেমকুমার...।
বাইরে তখন ঝাঁপিয়ে বৃষ্টি নেমেছে। সন্ধ্যা নেমেছে বৃষ্টির ডানায় চেপে, অন্ধকার অবগুণ্ঠনে তার মুখ ঢাকা। এরই মাঝে বৃষ্টি বন্দি আমরা দুজন মেতে আছি নাটক নিয়ে। নাটক দেখতে যাওয়া তো হলো না, একে বলে আটকপড়া নাটক করা। এখানে অভিনয় নেই। যা আছে জীবন্ত। অভিনয়ের কিছুই জানে না তরু, তবুও কী অসাধারণ ভঙ্গিমায় আমার কাঁধে হাত রেখে বলে ওঠে,
তা জনাব প্রেমকুমার। বিবাহের পর কি আপনার প্রেমনদীর জোয়ার স্তিমিত হইয়া গিয়াছে?
সহসা আমি চমকে উঠি। দৃশ্যমান হোক বা না হোক, পিঠে আমার চাবুকের ঘা অনুভব করি। ভেবে পাই না, এ কেমন অভিযোগ! তরুর মনে এমন প্রশ্নের উদয় হলো কবে, কীভাবে! ভাবি, কিন্তু এক নিমিষে আবার নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে পরিহাসে মেতে উঠি,
প্রাণেশ্বরী আলোমতি, তুমি কি ওই নদীতে নেমে হাবুডুবু খেয়ে তারপর জোয়ার-ভাটা পরখ করেছ?
হাবুডুবু কী বলছেন জনাব! আপনার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার পর থেকেই তো আমি ওই নদীতে ডুবে আছি প্রেমকুমার।
তাই নাকি! তা হলে তো বলতে হয়- আমিও ওখানেই আছি, ওই নদীতেই; আরও একটু গভীরে, আরও একটু অতলে ডুব দিলেই আমার দেখা পাবে প্রাণেশ্বরী।
আমায় তাহলে মার্জনা কর প্রাণনাথ। আজ থেকে সেই অতল গভীরেই আমি...
বাক্য শেষ হওয়ার আগেই তরু এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে আমার বুকে, নিবিড় এবং গভীর আলিঙ্গনে আমাকে আঁকড়ে ধরে; ঠোঁট শুধু নয়, আমার সারা মুখ চুমোয় চুমোয় ভরিয়ে দেয়। আমাদের এই সান্ধ্য নাটকের এভাবে যবনিকা পড়বে, সে কথা কে জানত! বাব্বা! অসময়ে সাগরে জলোচ্ছ্বাস কিংবা টর্নেডো হলে যে দশা হয়, আমাদের তখন সেই অবস্থা। দুজনেরই দেহনদীতে কুলউপচানো ঢেউ। সত্যিকারের কথায়, শারীরিক এই শিল্পকলায় তরুকে আমি কখনো এতটা আগ্রাসী, উদ্যোগী এবং সক্রিয় হতে দেখিনি। অবগুণ্ঠন থেকে বেরিয়ে আসা এ যেন অন্য এক তরুমণির উন্মোচন। কামনাপাত্র কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে গেলে কত অবলীলায় আবার বলতে পারে,
আজ আমাদের এই শুভ্র সফেদ বিছানাটা যেন জোয়ার উথলানো নদী হয়ে গিয়েছিল, তাই না সোনামণি!
নদী বলে শুধু নদী। নদীর কূল নাই, কিনার নাই রে...।
আমাকে অবাক করে দিয়ে তরু হঠাৎ গেয়ে ওঠে-
ওপারে মেঘের ঘটা, কনক বিজলিছটা, মাঝে নদী বহে সাই সাই রে। আমি তো আনন্দে আটখানা।
বিছানা ছেড়ে লাফিয়ে উঠি। তরুকে দুই হাতে জাপটে কাঁধে তুলে ধেই ধেই নাচতে থাকি। আমিও গলা ছেড়ে গাই- আমি এই দেখিলাম সোনার ছবি, আবার দেখি নাই রে। বাইরে ঝুম বৃষ্টি, ঘরে অনবদ্য সৃষ্টি, এরই মধ্যে কখন হারিয়ে যায় বেইলি রোডের নাটক, দেবুদা এবং নীরুর আমন্ত্রণ সব কিছু অতলে হারিয়ে যায়। আমাদের এই অল্পদিনের সংসার জীবনে এই রকম মধুর সন্ধ্যা আর কখনো আসেনি, অথবা বলা যায় আমরাই পারিনি সে দিনের মতো আরেকটি সন্ধ্যা রচনা করতে।
অথচ একদিন শুধু সেই একটি সন্ধ্যায় তরুকে আমি সন্ধ্যামণি বলে ডেকেছিলাম।
চার
রাতভর আমাদের কথা যাই হোক, সকালবেলা ঘুম থেকে উঠেই আমার সিদ্ধান্ত পাল্টে যায়। শুধু চাকরির মোহে আমার সন্ধ্যামণিকে ঢাকায় ফেলে রেখে আমি যশোরগামী কোচ ধরে চলে যাই অভয়নগরে। নতুন জায়গা। আগে কখনো আসিনি। খুঁজে পেতে আমাদের এনজিওর অফিসটা আবিষ্কারের পরে অবাক হয়ে যাই চারপাশের পরিবেশ দেখে। যেদিকে তাকাই, কেবলই ফুলের চাষ। মাঠের পর মাঠ-হরেক রকমের ফুল আর ফুল। একত্রে এত ফুলের সমারোহ আমি আগে কখনো দেখিনি।
পথিমধ্যে ঝিনাইদহের সহকর্মীর আমন্ত্রণের কথাও মনে হয়েছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত মনের সমর্থন পাইনি, ফলে ঝিনাইদহে নামিনি। সোজা চলে এসেছি কর্মস্থল অভয়নগরে। কিন্তু এখানে উঠব কোথায়? থাকব কোথায়? এই অফিসেরই দুজন সহকর্মী মেস করে থাকে অফিসের বর্ধিত অংশের একটি রুমে। তাদের মধ্যে একজন সাপ্তাহিক ছুটির সঙ্গে আরও দুদিনের ছুটি নিয়ে বাড়ি গেছে, অপরজন অত্যন্ত আন্তরিকভাবেই আমন্ত্রণ জানায়- আপাতত এখানেই থাকতে পারেন, তারপর কালপরশু দেখেশুনে একটা ব্যবস্থা করা যাবে। তাদের ঘরের মধ্যে ঢুকে দেখি দুই পাশের দুই চৌকিতে বিছানা পাতা। আপাতশূন্য বিছানাটি দেখিয়ে আমাকে বসতে বলে। আমি ধপাস করে বসেও পড়ি। কিন্তু ভেতরে ভেতরে খুব খচখচ করে-এই অচেনা ঘরদোর অচেনা বিছানায় শুয়ে কি আমার রাত কাটবে?
রাতের কথা ভাবতেই আমার তরুর কথা মনে পড়ে যায়।
তরু। আমার তরুলতা। তরুমণি। আমার সন্ধ্যামণি। সারা পথ ওকে মনে পড়েনি, তা তো নয়। খুবই মনে পড়েছে। মনে মনে খুব ঝগড়া করেছি, আবার মীমাংসাও করে নিয়েছি দুই হাত ধরে। ঝগড়ার বিষয় তো অন্য কিছু নয়, এই একটাই-অভয়নগরে আসা না-আসা নিয়ে। সকালে উঠেই আমি তরুকে তাঁতিয়ে তুলি, স্পষ্ট ঘোষণা করি-ছোট বড় যা-ই হোক, জীবনের প্রথম চাকরিপ্রাপ্তি, আমি এই চাকরিতেই জয়েন করব।
সদ্য ঘুমভাঙা চোখের তরু কুঁচকে আমার দিকে তাকায় তরু, যেন অবিশ্বাস্য কোনো কেচ্ছা শুনে সে হতবাক হয়ে গেছে; পায়ে পায়ে আমার খুব কাছে এগিয়ে এসে ধীরে কিন্তু তীক্ষèস্বরে জিজ্ঞেস করে- মানে?
মানে আবার কী!
না না, যা বলছ তুমি ভেবে বলছ তো?
বেকারের অত ভাবাভাবি কীসের বল তো! চাকরি পেয়েছি, সেটা করব না? বাহ! বেশ সিদ্ধান্ত নিয়েছ, যা হোক। তা এই মূল্যবান সিদ্ধান্তটি নিলে কখন?
এই তো! সারা রাত ঘুম আসছিল না এই চিন্তায়। সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেললাম। তরু হঠাৎ ভেঙেচুরে নিজেকে বদলে নেয়, খুব চটুল ভঙ্গিতে জানায়,
তোমার এখন ঘুমানো উচিত বন্ধু। প্রয়োজন সাউন্ড স্লিপ।
না না, আমি এক্ষুনি বেরিয়ে পড়ব।
তরু তখনো যথেষ্ট ধৈর্যশীল, যথেষ্ট কৌতুকপ্রবণ,
শোনো প্রাণনাথ, ঘুম না আসা রাতে অনেক ভুল সিদ্ধান্ত আসে। ভুল পথে নিয়ে যায়। অনেকের পক্ষে আর ফেরাই হয় না।
তরু আমি সিরিয়াসলি বলছি- আমি আজই অভয়নগরে যেতে চাই। আগামীকাল সকালে চাকরিতে জয়েন করতে চাই। এই আমার শেষ কথা।
এবার তরুও ফণা ধরে দাঁড়িয়ে যায়,
বেশ। আমার বিষয়ে কী সিদ্ধান্ত নিয়েছ?
আমার সিদ্ধান্ত, আমার পরামর্শ -সবই তো তোমার কাছে অর্থহীন। তোমার সিদ্ধান্ত এবার তুমিই নাও।
আচ্ছা।
তরু আর কথা বাড়ায় না। কেবল ওর মেঘ থমথমে মুখটা আমার সম্মুখ থেকে সরিয়ে নেয়। আমিও যেন তাতেই স্বস্তি খুঁজে পাই। কিন্তু এখন আমার ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না।
অফিস সংলগ্ন মেসঘরের বিছানায় আমার সহকর্মী সেই কখন থেকে ঘুমে অচেতন। তার প্রবল নাসিকা গর্জনে রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে খানখান, থেকে থেকে কেঁপে উঠছে পলকা কাঠের চৌকি। ঘরের আলো নেভানোর পর অন্ধকার কিছুটা চোখ সওয়া হয়ে এলে সদ্য পরিচিত লোকটির মুখের দিকে তাকিয়ে ভাবি-কী জানি সে সত্যিই কতটা অসুখী মানুষ! কিছুক্ষণ আগেও আমার সঙ্গে আলাপ জমানোর উদ্যোগ নেয়। বয়সে আমার চেয়ে ঢের বড়। বলা যায় মধ্য বয়স পেরিয়ে গেছে। খুলনার ডুমুরিয়ায় তার স্ত্রী-পুত্র-কন্যা সবই আছে। কন্যাটি ছিল এবারের এসএসসি পরীক্ষার্থী। শেষ পরীক্ষার দিন সেই মেয়ে পরীক্ষার পর আর বাড়ি ফেরেনি। সম্ভাব্য নানান জায়গায় খোঁজখবর নিয়েও তার হদিস মেলেনি। তার ধারণা মেয়ের মা সবই জানে। মায়ের আশকারা পেয়েই মেয়ের এমন বাড় বেড়েছে, পাখা গজিয়েছে। এই দুঃখে স্ত্রীর উপরে রাগ করেই বাড়ি যেতে আর ইচ্ছে হয় না তার।
[চলবে]