একেবারে অচেনা মানুষ। মাত্র এক সন্ধ্যার আলাপেই কেমন অবলীলায় তার বুকের কপাট হাট করে খুলে ধরে, ব্যক্তিগত দীর্ঘশ্বাসের প্যাচালি মেলে ধরে; আমি কিন্তু কিছুতেই ওই রকম সহজ হতে পারি না। আমাকে নানাভাবে সে খুঁচিয়ে দেখেছে। আমি বলেছি, আমার স্ত্রী ঢাকায় চাকরি করে, আমাদের দাম্পত্য জীবনের বয়স এখনো এক বছর পেরোয়নি, ব্যস। এই পর্যন্তই। এর বেশি আর কিছুই বলতে পারিনি। আরও কী যে বলার ছিল, তাও গুছিয়ে উঠতে পারিনি। অথচ না বলা সেই সব কথাই সারা রাত আমাকে দগ্ধায়। দুই চোখের পাতা এক করতে পারি না। কী আলোয়, কী আঁধারে তরুমণির চোখ ছলছলে মুখচ্ছবি ভেসে ওঠে চোখের পাতায়। আমি তখন কী করি! কী করে সরাই ওই ছবি! আমি তো চোখ বন্ধ করেও দিব্যি দেখতে পাই-পাপড়ি প্রতিরোধ ভেঙে অশ্রুদানা গড়িয়ে পড়ে তরুর চোখ থেকে। অভিমানে ওর কণ্ঠরুদ্ধ। এই চাকরিতে যোগ না দেওয়ার জন্য আর মোটেই পীড়াপীড়ি করবে না আমাকে। কিন্তু আমি কী করব এই হাওয়াশূন্য স্তব্ধ রাতে। ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না একলা জেগে রই। কোথায় আমার তরুমণি সন্ধ্যামণি কই।
মাত্র এক রাতের পীড়নেই আমার চেতনা জাগ্রত হয়।
তরুর সঙ্গে একত্রে জীবনযাপন শুরু করার পর এই প্রথম একটি রাত আমরা বিচ্ছিন্ন হয়ে কাটালাম। তরুবিহীন আমার সে রাত এতই দীর্ঘ। এতই ভারী যে সূর্য ওঠা ভোর পর্যন্ত পাড়ি দেওয়াও আমার কাছে ভয়ানক দুর্বহ হয়ে ওঠে। আমার চোখে লেশমাত্র ঘুম নেই, অথচ একই ঘরে পাশের বিছানায় একজন কন্যাহারা দুঃখী পিতা দিব্যি নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছে-এ আর কতক্ষণ সহ্য হয়! তাকিয়ে দেখি-ওই লোকটিরও কষ্ট কম নয়, নাক দিয়ে সে শ্বাস-প্রশ্বাসের কাজ করতেই পারছে না। মুখগহ্বর হাঁ করে ওই ক্রিয়াটি সম্পাদন করতে গিয়ে তারও নাভিশ্বাস ওঠার দশা। তবু আমার মস্তিষ্কের একটি বদরাগী কোষ উত্তেজিত হয়ে ওঠে, বিদঘুটে এক বদবুদ্ধি আমাকে প্ররোচিত করে-ঘুমন্ত এই লোকটির হাঁ হয়ে যাওয়া মুখের ওপরে বালিশ চাপিয়ে দিয়ে পালিয়ে গেলে কেমন হয়!
না, শেষ পর্যন্ত অতটা খামখেয়ালি কাণ্ড ঘটানো আমার পক্ষে সম্ভব হয় না। তাই বলে সুস্থ স্বাভাবিক ভদ্রলোকের মতো সকালে ঘুম থেকে উঠে আড়মোড়া ভেঙে স্নানাহার সম্পন্ন করার পর ঠিক অফিস আওয়ারে যথানিয়মে জয়েনিং লেটার জমা দিয়ে শান্তশিষ্ট ভঙ্গিতে নিজের চেয়ারে বসার মতো মানসিকতাও আমার অবশিষ্ট ছিল না। অতি প্রত্যুষে আমার স্বল্পচেনা সহকর্মীর ঘুম ভাঙিয়ে তাকে স্তম্ভিত করে দিয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হই।
আমি যখন বাসায় এসে পৌঁছাই তখন বেলা আড়াইটে। আমার অতি চেনা বাসা। চারতলা পর্যন্ত উঠতে বাহাত্তরটি সিঁড়ির প্রতিটি সিঁড়ি আমার চেনা। গত এপ্রিলে দোতলার মেয়ে বকুলের বিয়ে উপলক্ষে তিনতলার সিঁড়ি পর্যন্ত আল্পনা আঁকা হয়েছিল, সেই আল্পনার লতাপাতার ডিজাইন পর্যন্ত আমার মুখস্থ, প্রত্যেক সিঁড়িতে বকুলের পায়ের পাতার ছাপও আমার চেনা। তবু আমার ভয় করে। সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠতে আমার পা কাঁপে, বুক ধড়ফড় করে। নিজেকে কেমন অচেনা আগন্তুক মনে হয়। এই তো মোটে গতকাল সকাল থেকে আজ দুপুর পর্যন্ত কতটুকুই বা সময়! ঘড়ি ঘণ্টা ধরে হিসাব করলে বড়জোর ঘণ্টা তিরিশেকের ব্যবধান। এতেই আমার মনে হয় আমি আসছি বহু যুগের ওপার হতে, মনে হয় হাজার বছর ধরে পৃথিবীর পথ আমি হাঁটিতেছি। তিনতলা থেকে চারতলা পর্যন্ত পা আর উঠতে চায় না, আমি ক্লান্তপ্রাণ এক, চারদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন।
চারতলা পেরিয়ে আসার পর এতক্ষণে আমার সম্বিত ফেরে-আমার কাছে তো ঘরে ঢোকার চাবিই নেই। আমাদের বাসার প্রতিটি তালার না হোক, অন্তত ঘরে ঢোকার জন্য যে দুটি তালা খুলতে হয়, সেই চাবি আমরা দু’ভাগে ভাগ করে রেখেছি। তা থাকেও আমাদের দুজনের কাছে পৃথকভাবে। কিন্তু এখন তো আমার কাছে কোনো চাবিই নেই। ঘরে ঢুকব কী করে! অফিস থেকে তরুর ফিরতে ফিরতে সেই বিকাল চারটে কি পাঁচটা। তাহলে উপায়!
দরজার সামনে এসে আমি অবাক হয়ে যাই-দরজা ঠিকই বন্ধ, কিন্তু তালা নেই একটাও। তার মানে ঘরের মধ্যে মানুষ আছে এবং দরজা ভিতর থেকেই লাগানো। তরু কি তবে অফিসে যায়নি! কই, এমন পরিকল্পনার কথা তো আগে শুনিনি। বন্ধ দরজায় কান লাগিয়ে সিলিং ফ্যানের বোঁ বোঁ শব্দ ছাড়া কিছুই শুনতে পাই না। কেন জানি না এই দিনে দুপুরেও আমার গা ছম ছম করে। আমি দরজায় হাত রেখে ব্যাকুল কণ্ঠে ডেকে উঠি- তরু!
সহসা দরজা খুলে যায়।
সামনে দাঁড়িয়ে তরু, আমার তরুমণি, তরুলতা। কিন্তু এ কী চেহারা হয়েছে ওর! গত তিরিশ ঘণ্টা কে যেন ওর শরীর থেকে সমস্ত রক্ত নিংড়ে নিয়েছে। সারা মুখ পাংশু পাণ্ডুর। মনে হয় যেন বিরাট ঝড়ের সঙ্গে যুদ্ধ করে বিধ্বস্ত দেহ নিয়ে কোনো রকমে টিকে আছে মাত্র। সাহস সঞ্চয় করে আমি ওর চোখে চোখ রাখতেই সব বাঁধ ভেঙে যায়, তরুলতা দুবাহু মেলে জড়িয়ে ধরে আমাকে, বুকের মধ্যে মুখ লুকিয়ে হু হু করে কান্নায় ভেঙে পড়ে। অবলম্বন পেয়ে ওর অবসন্ন দেহ এলিয়ে পড়তে চায় যেনবা। আমি ওকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে বলে উঠি,
তোমাকে ছেড়ে আমি থাকতে পারব না তরু।
এতক্ষণে তরু সশব্দে কেঁদে ফ্যালে। কেঁপে ওঠে ওর সারা শরীর। আমি ভয়ানক বিব্রতবোধ করি। কী বলে যে ওকে সান্ত্বনা দেব, সেই ভাষা খুঁজে পাই না। ধীরে ধীরে দুহাতের অঞ্জলিতে আমি ওর পাণ্ডুর মুখটা তুলে ধরি। দু’চোখে শ্রাবণধারা। কপাল টিপশূন্য। সূর্যহীন দিনের আকাশ কিংবা চন্দ্রহীন রাতের আকাশ কি কল্পনা করা যায়! তরুর কপালের টিপ যে আমার জগৎ দেখার আয়না! আজ সেই আয়না নেই। আমার বুকের মধ্যে হাহাকার করে ওঠে। বেদনাসিক্ত আমার দু’ঠোঁট নেমে আসে তরুর কপালের আয়নায়। তখন আমি ভেতরে ভেতরে প্রবল নাড়া খাই, চমকে উঠি-এই আমি কোন আমি!
পাঁচ
চাকরিভাগ্য আমার প্রসন্ন নয়, বহুবারের পরীক্ষায় বহুভাবে প্রমাণিত হয়ে গেছে। তবু মন মানে না। নিজের চাকরিহীনতাকে একেবারে নিঃশর্তে মেনে নিতে পারি না। নিজের যোগ্যতাহীনতার প্রতি কুণ্ঠাহীন সমর্থন জানাতে পারি না, তাই এখনো এখানে সেখানে দরখাস্ত করি, ইন্টারভিউ কার্ড এলে এখনো রক্ত চনমন করে ওঠে, অতঃপর ইন্টারভিউয়ের দিন আমার ঘটে বিদ্যাবুদ্ধি যা আছে, তাই নিয়ে রণক্ষেত্রে ঝাঁপিয়ে পড়ি। কোথাও রিটেন ভাইভা দুই-ই হয়, কোথাও বা ভাইভা নামের মুখ ভ্যাংচানিতেই দায় সারে। কম তো দেখলাম না! দিন যত গড়াচ্ছে, বুঝতে পারি ভিতরে ভিতরে ক্রমাগত অসহিষ্ণু হয়ে উঠছি, ফলে সবই এখন অসভ্যতা মনে হয়, মাঝেমধ্যে অশ্রাব্য নোংরা ভাষা এসে যায় মুখে, তখন মনে মনে বলে ফেলি এসবই পাতানো খেলা, এসবই ছেনালিপনা!
শৈশবে আমার দাদি বলতেন-আমার মণি জজ-ব্যালেস্টার হবে। জজ কিংবা ব্যারিস্টার কিছুই আমি হইনি, সে সম্ভাবনাও মোটেই নেই; আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হিস্ট্রিতে অনার্স মাস্টার্স করেছি মাত্র। আমাকে দিয়ে কী আর হবে! এত সব হিসেব-নিকেশ তো গ্রাম্যবৃদ্ধার মাথায় ছিল না। মাতৃহীন নাতিকে আদর করতে গিয়ে কত যে বেসামাল ভুলভাল কথাবার্তা বেরিয়ে পড়ত তার মুখ দিয়ে, এখন তার অর্থ ভেবে কখনো কখনো আমি লজ্জা পাই। গ্রাম্য মানুষের আঞ্চলিক উচ্চারণে আমার দাদি বলতেন- আমার মণি নাটসায়েব হবে।
নাটসায়েব মানে হচ্ছে লাটসাহেব।
হায় আমার দাদির প্রত্যাশা! বড় লাট কিংবা ছোট লাটের শাসনামল দাদি দেখেছেন কিনা আমি জানি না, তবে ‘নাটসাহেব’ ব্যাপারটা যে তাঁর কাছে বিরাট বড় ছিল তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু দাদির সেই স্বপ্ন পূরণের উপায় কী! আর আমার সাধ্যই বা কী!
একদিন এক ছুটির দিনের অলস দুপুরে তরুকে শোনাচ্ছিলাম আমাদের বাড়ির গল্প; আমার বাবা এবং সৎমায়ের গল্প, বৈমাত্রেয় ভাইবোনের গল্প এবং আমার দাদির গল্প। খুব শৈশবে মাকে হারিয়ে তার বদলে যাকে পেয়েছি তাকে কখনো আমার মা বলে মনে হয়নি, বরং স্নেহের আধিক্য কিংবা অন্য কোনো কারণেই হোক দাদিকেই আমার মা মনে হয়েছে। শৈশবে সেই দাদিই আমাকে নিজে হাতে গোসল করিয়ে দিতেন, মাথার চুলে চিরুনি বুলিয়ে দিতেন, লালচে রঙের মোটা চালের গরম ভাত খাইয়ে স্কুলে পাঠাতেন। আদর করে বলতেন, মণি আমার নাটসায়েব হবে। ভাগ্যিস, সাধের নাতির ‘নাটসায়েব’ হওয়ার দৃশ্য উপভোগের জন্য যমের মুখে কাঁটা দিয়ে আমার দাড়ি বুড়ি এ পর্যন্ত বেঁচে নেই। থাকলে তাঁর নাটসায়েবের এই দুর্দশা দেখে খুবই কষ্ট পেতেন। স্বপ্ন ভঙ্গের এতটা বেদনা তিনি সইতে পারতেন কিনা, আমার সন্দেহ আছে। দাদি গত হয়েছেন বছর তিনেক হয়ে গেল। দাদির মৃত্যু সংবাদ পেয়ে সেই আমার শেষবারের মতো বাড়ি যাওয়া। তারপর থেকে বাড়ির সঙ্গে আমার সম্পর্কটা মরা নদীর মতো এক প্রকার শুকিয়েই গেছে। গত বছর ছোট ভাই শরিফুল এসেছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিতে। উঠেছিল আমার কাছেই। ভর্তি পরীক্ষায় টেকেনি বলে বাড়ি ফিরে গিয়ে সে ডিগ্রিতে ভর্তি হয় স্থানীয় কলেজে। সেই শরিফুল হঠাৎ আমাকে চমকে দেয়। একদিন সে বাড়ি যাওয়ার আগে আমাকে জানায়, মা তোমাকে বাড়িতে ডেকেছে ভাইয়া।
মা ডেকেছে?
অবাক না হয়ে আমি পারি না। শরিফুলকেই জিজ্ঞেস করি, কেন বল তো? শরিফুল এড়িয়ে যায়, বলে-আমি কী করে বলব?
সভয়ে জানতে চাই, বাবা কিছু বলেনি?
না তো!
আমাদের বাবাটা বরাবর এই রকমই। চিরদিন তাকে দূরের মানুষ মনে হয়েছে। শুধু আমার বলে তো নয়, অন্য ভাইবোনদেরও এই একই মূল্যায়ন বলে আমার ধারণা। সে যাই হোক, প্রকৃতপক্ষে নানাবিধ কারণে আমার আর বাড়ি যাওয়া হয়ে ওঠেনি। মাস্টার্স পরীক্ষা শেষে একবার গিয়ে ঘুরে আসার কথা ভেবে রেখেছিলাম। তবু হয়নি। হবে কী করে! পরীক্ষার পরই তো পুরো অন্ধকারে ঝাঁপ দিয়েছি। জীবিকার ধান্ধায় সেই থেকে এ নাগাদ তো প্রগাঢ় অন্ধকারের মধ্যে কালো বেড়াল খুঁজে বেড়াচ্ছি। নাগাল পেলাম কই!
কখনো কখনো মনে হয় পেয়েছি নাগালে, বেড়ালটা বুঝিবা এবার ধরেই ফেলেছি। এই তো এখনই অন্ধকার সরে যাবে, ধীরে ধীরে আলো ফুটবে, স্পষ্ট চেনা যাবে কালো বেড়ালটা। নাহ্! সে বুঝি হওয়ার নয়। ফসকে যায়। বারবার হাতের ফাঁক গলিয়ে বেরিয়ে যায়। আমার করতলে পড়ে থাকে চাপ চাপ অন্ধকার।
আমার এই ‘অন্ধকারের কালো বেড়াল’ উপমাটি তরুও বেশ ভালোভাবে গ্রহণ করেছে। তবে ও প্রচণ্ড আশাবাদী-বেড়াল একদিন ধরা পড়বেই আমার হাতে। যেন আমি অধৈর্য না হই। তরু আমাকে সাহস দেয়, আশাবাদী করে রাখে এবং পুরো ব্যাপারটা হাসি-তামাশায় হালকা করে নেয়। প্রায়ই জোর দিয়ে বলে- দুজনের না হোক, আমাদের মধ্যে একজনের তো চাকরি আছে! ভয় কীসের বল তো! অন্ধকার যতই হোক, ওই কালো বেড়াল তুমি নিশ্চয়ই ধরবে।
ইন্টারভিউয়ের ডেট এলে আমরা এখন ব্যাপারটা রসিয়ে রসিয়ে উপভোগ করি, দিনটাকে বলি-বেড়াল ধরার দিন। শুরুটা আমিই করি, পরে দেখি কথাটা তরুরও খুব মনে ধরেছে। এই তো মাস দুয়েক আগের এক সকালে আমি বেঘোরে ঘুমুচ্ছি। বহুদিন আগের এক অসমাপ্ত কবিতা কী মনে করে যেন আমার চৈতন্যের দরজায় এসে করাঘাত করেছে রাতের বেলা। তখন লোডশেডিং। ঘুম কি হয়! ঘুম এলো ভোর রাতের দিকে। এর মাঝে তরু উঠে কখন প্রস্তুত হচ্ছে, আমি কিছুই টের পাইনি। টের পেলাম তার ডাকেই,
এই যে নাটসায়েব! ওঠো। আজ না তোমার বেড়াল ধরার দিন! চোখ মেলতেই এই ‘নাটসায়েব’ সম্বোধন শুনে অন্তরটা জুড়িয়ে যায়। কবে কবে যে এই সম্বোধনের জন্যও ভিতরে এমন তৃষ্ণা জমেছিল, আগে কখনো টের পাইনি। বহুদিন পর আমার দাদির মুখ মনে পড়ে। বার্ধক্যেও সৌন্দর্য থাকে তা জেনেছিলাম দাদিকে দেখে। আমার বাবা কিংবা ফুপুরা কেউ তাদের মায়ের চেহারা-লাবণ্য পাননি। কেবল ছোট ফুপুর চেহারায় দাদির আদলের ছাপ পড়েছে খানিকটা। অথচ সেই ছোট ফুপুই উল্টো দাবি করেন আমি নাকি দাদির চেহারা পেয়েছি। কই, আর কেউ এ কথা বলে না। সবার চেয়ে আমি যে দাদির আদর বেশি পেয়েছি, এতে কারও ভিন্নমত নেই। আমারও নেই। কিন্তু সেই সৌন্দর্য কোথায় পাব? বিছানা ছেড়ে উঠে তরুর চোখে চোখ পড়তেই তামাশা করি,
আজ থেকে আমার দাদি হবে নাকি?
তরু কটাক্ষ করে-দাদি হব!
না না, হতে চাইলেও তুমি পারবে না। সেই রূপ লাবণ্য পাবে কোথায়!
বাব্বা! এখনো সেই বুড়ির পিরিতেই মজে আছ?
হ্যাঁ, সে পিরিত কোনো দিন শেষ হবে না তরু। কিন্তু হঠাৎ দাদির মতো করে ডাকলে যে!
আটটা পর্যন্ত ঘুমুলে তাকে নাটসায়েব বলব না?
অ্যাঁ! আটটা বেজে গেছে?
জ্বি, জনাব!
সর্বনাশ! দশটায় আমার ইন্টারভিউ।
আমি তাড়াহুড়ো করে লুঙ্গি তোয়ালে কাঁধে নিয়ে বাথরুমে ঢুকি। দরজার সিটকিনি লাগাতে লাগাতে শুনতে পাই, তরু বলছে,
আজ কিন্তু কালো বেড়ালটা ধরতেই হবে।
টুথব্রাশে পেস্ট লাগাতে লাগাতে চমকে উঠি-‘কালো বেড়ালটা’ আজ ধরতেই হবে? দ্রুত হাতে ব্রাশ চালাই মুখের মধ্যে। আচমকা ধাক্কা খেয়ে ডান দিকের মাড়ি ফুলে ওঠে, আমি ব্যথায় কাতরে উঠি। দাঁত মাজার অধ্যায় শেষ হলে দু’গালে ক্রিম লাগিয়ে অবিরাম ব্রাশ ঘষি। ধীরে ধীরে সাদা ফেনায় ভরে ওঠে মুখমণ্ডল। আয়নায় নিজের ফেনালিপ্ত কিম্ভূতকিমাকার ছবি দেখে ভারি মজা পাই। এ দৃশ্য নতুন কিছু নয়। প্রতিদিনই সকালে উঠে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে প্রত্যক্ষ করি-ওই সাদাসঙ ভেসে এসে জিভ ভেংচি কাটে। রোজ সেটা ধরতে পারিনি। আজ আমার মগজের কোষে কোষে চিন চিন করে। আমি ঠিক বুঝতে পারি না-কার উপরে যেন রাগ হয়, সেই রাগ একটু একটু করে চড়তে থাকে। আমি দ্রুত ব্রাশ চালিয়ে সারা মুখ ফেনায় ডুবিয়ে দিই। ঠোঁট জোড়া জেগে আছে দেখে সেখানেও ব্রাশ চালাই। তারপর আয়নায় উদ্ভাসিত সাদা সঙকে শুধাই-পারবি কালো বেড়াল ধরতে?
আয়নার ওপার থেকে কোনো জবাব আসে না।
তখন আমার আরও রাগ চড়ে যায়। আবার ব্রাশ ঘষি। আবারও নিজ হাতে ফেনালিপ্ত করে নিজেকে ঢেকে দিই। কিন্তু রেজার চালাতেই বেরিয়ে পড়ে চিরকালের সেই আমি। কী আশ্চর্য! আয়নার ভেতরে ওই আমিটা নির্লজ্জের মতো দাঁত কেলিয়ে হাসছে! আমি একটু বিস্মিত হই-এখানে হাসির মতো কী হলো!
দ্রুত হাতে কোনো রকমে শেভ সেরে নিয়ে শাওয়ারের নিচে গিয়ে দাঁড়াই। আহ্! কী যে শান্তি! চাবি ঘুরিয়ে শাওয়ার খুলে দিই ফুল স্পিডে। ঝরনা ধারার মতো অবিরল ধারায় ঝরে পড়ে জলধারা। কখনো কখনো মাথার ওপরে সেই রকম আকাশভাঙা বৃষ্টিধারা আমি প্রত্যাশা করি। বৃষ্টি আমার ভালো লাগে। একদিন তরুকে সঙ্গে নিয়ে বৃষ্টির মধ্যে খুব পাগলামি করেছিলাম। দূরে কোথাও বনবনানীর কোলঘেঁষে মাঠে প্রান্তরে নয়। এই ঢাকা নগরীতে তেমন অবারিত সবুজ কোথায়! আমাদের বাসার সুপরিসর ছাদের ওপরেই সেদিন আমরা বৃষ্টিবরণ করি। প্রথমে তরু তো রাজি হতেই চায় না। আমার প্রস্তাবকে পাগলামি বলে উড়িয়ে দিতে চায়। কিন্তু আমি তা শুনব কেন! ছুটির দুপুর। দুজনেই ঘরে বসে আছি। চলছে নানা রকম খুনসুটি। এরই মাঝে মেঘকালো করে এলো বৃষ্টি! সে কী প্রবল বর্ষণ! সকাল থেকেই প্রকৃতি মুখ গোমরা করেছিল। কেমন যেন গুমোট ভাব। গোমরামুখো মেঘের সেই রাগ ভাঙল শেষে দুপুর বেলায় ঝনঝনিয়ে বৃষ্টি নিয়ে। ছুটির দুপুরের এমন বাদলাবেলা কি চাইলেই পাওয়া যায়। তরুর হাত ধরে এক টানে ঘর থেকে বের করে আনি ছাদে। থই থই বৃষ্টিতে এই নিষ্প্রাণ ছাদ তখন হয়ে যায় উত্তাল সমুদ্দুর। দৃশ্যাতীত কোনো টেউয়ের আঘাত প্রতিরোধের অজুহাতে আমরা একে অপরকে জড়িয়ে ধরি। ঢেউয়ের সাধ্য কী আমাদের বিচ্ছিন্ন করে! আমরা যে তখন নিবিড় আলিঙ্গনে চুম্বনাবদ্ধ। আমরা মোটেই খেয়াল করিনি, খেয়াল করতে চাইনি আদৌ-আশপাশের আকাশমুখী বাড়িগুলোর পাঁচতলা-ছয়তলার জানালা দিয়ে যে কেউ আমাদের বৃষ্টিস্নানের দৃশ্য দেখতে পারে। বেশ কিছুক্ষণ পর তরু আমার গায়ে চিমটি দিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
[চলবে]