আমি ঘাড় ফেরাতেই আঙুল তুলে পশ্চিমের স্টার টাওয়ারের জানালার দিকে নির্দেশ করে। কিন্তু আমি সেদিকে তাকাতে না তাকাতেই আমার বাহু বেষ্টনী থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে ঘরের মধ্যে পালিয়ে যায়। আমি তখন হতভম্ব!
মাথার ওপরে বৃষ্টি ঝরছে তো ঝরছেই। ঝরছে তো ঝরছেই। আমার শরীর জুড়িয়ে হিম। বাথরুমের দরজায় খটখট করে বিরামহীন শব্দ করে চলেছে তরু, চিৎকার করে ডাকছে আমাকে- দরজা খোলো সোনামণি! তুমি কি পাগল হয়ে গেলে? দরজা খোলো! কটা বাজে, জানো?
দুম দুম করে দরজায় করাঘাত করে তরু। বুঝিবা কপালও ঠোকে নির্দয়ভাবে। বাথরুমের ভিতর থেকে আমার মনে হয় তরু হয়তো কাঁদছে আর বলছে-তোমার কী হয়েছে? সোনামণি? দরজা খোলো প্লিজ, সোনামণি, নটা বেজে গেছে। কই তুমি শুনছ! বেরিয়ে এসো।
তরুর কণ্ঠে কেন এত আর্তনাদ, কেন এত আহাজারি আমি তার কিছুই বুঝতে পারি না। অত্যন্ত স্বাভাবিক ভঙ্গিতে মাথায় তোয়ালে ঘষতে ঘষতে আমি বাথরুম থেকে বেরিয়ে আসি। খুব চমৎকার একটা গোসল হয়েছে। মনের ভিতরটাও যথেষ্ট ফুরফুরে। শিস দিয়ে গান গাইলেও অস্বাভাবিক ভঙ্গিতে তাকিয়ে থাকে চোখের দিকে। দ্রুত আমি চোখ সরিয়ে নিতে গিয়েও পারি না, থমকে দাঁড়িয়ে শুধাই,
কি হলো তরু?
এতক্ষণে তরুর দুই চোখে নামে বাঁধভাঙা প্লাবন। আমি বেশ অবাক হই,
কী ব্যাপার, সকালবেলায় মেঘবাদলা যে!
দুহাতে আমার গলা পেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করে,
তুমি আমার ওপর রাগ করেছ?
কেন, রাগ করব কেন?
ওই যে নাটসায়েব বলে ঠাট্টা করলাম!
কী যে বল না!
সত্যি বলছ, রাগ করনি?
নাহ! রাগ হচ্ছে এখন, দেরি হয়ে যাচ্ছে না! আহ আমার ইন্টারভিউ।
সত্যিই যে দেরি হয়ে যাচ্ছে, সে হিসাব তরুরও খুব আছে। তবু সে আলিঙ্গনের মধ্যে আমাকে বন্দি রেখেই দু’গালে দুটো চুম্বন এঁকে দেয়। তারপর ডান হাতের তালুতে আমার চোখ ঢেকে ঠোঁটে এঁকে দেয় দীর্ঘ চুম্বন। বড় অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে- এই প্রথম তরুর চুম্বন আমার কাছে পানসে মনে হয়। যে তরুর একটি মাত্র চুম্বনের জন্য ভিতরে ভিতরে ভীষণ রকমের লালায়িত হয়ে থেকেছি, অথচ কী অবাক কাণ্ড, সেই তরুর চুম্বন হঠাৎ এমন বিস্বাদ হয়ে গেল! শুধু এই এক বিস্ময়ে আলিঙ্গনমুক্ত হওয়ার পরও আমি তরুর চোখের দিকে তাকিয়ে থাকি। এতক্ষণে বুঝিবা তরু কিছুটা লজ্জা পায়। দৃষ্টি নামিয়ে নিয়ে বলে ওঠে,
কী দ্যাখো অমন করে!
আমি একবাক্যে ঘোষণা করি,
আমাকে দেখি।
তোমাকে?
হ্যাঁ, এ আর নতুন কী! আমি তো আমাকেই দেখি তোমার চোখের আয়নায়, কপালের টিপের আয়নায়। আমাকেই তো দেখি!
বেশ। নাও, রেডি হও দেখি। সত্যি সত্যি দেরি হয়ে গেল কিন্তু!
এই তাড়াহুড়োর মাঝেও আমি রসিকতা করি,
হলোই না হয় দেরি! কী হবে দেরি হলে?
ওমা! আমাকে অফিসে যেতে হবে না টাইমলি?
ও হ্যাঁ, তোমার তো অফিস আছে। এই দ্যাখো আমি...
হয়েছে। আর আদিখ্যেতা করতে হবে না। নাও, চলো!
আচ্ছা, তুমি তোমার অফিসে রওনা হলেই তো পার। আমি আমার মতো বেরোচ্ছি।
আহা! মতিঝিল পর্যন্ত আমরা তো একসঙ্গেই যেতে পারি, নাকি!
তা পারি। চলো।
ছয়
বাস থেকে মতিঝিলে নামার পর আমরা দুজনে দু’দিকে চলে যাই।
তরুর অফিস মতিঝিলেই, শাপলা চত্বর পেরিয়ে আরও একটু সামনে। আমি কখনো যাইনি ওর অফিসে। যাইনি মানে যাওয়া হয়ে ওঠেনি। তরু বেশ কয়েকবার আহ্বান জানিয়েছে। এ নিয়ে সামান্য খুনসুটিও হয়েছে কখনো সখনো। তরুর অনুযোগ মতিঝিলের দিকে তুমি যাও না, এমন তো নয়! ঘুরতে ঘুরতে এক-আধবার গেলে কী হয় আমার অফিসে!
গেলে যে কী হয়, সে কথা আমি কেমন করে বুঝাই? ব্যাখ্যা আমি যেভাবেই দিই, সেটাই তরুর কাছে জোড়াতালি মনে হবে। অবশ্য আমার নিজের কাছেও খুব পরিষ্কার ব্যাখ্যা আছে বলে মনে হয় না। তরুর আহ্বান ঠিকই আছে, যাওয়া হয়নি আমার দোষেই। একাধিকবার অনুযোগও করেছে তরু- আমার কলিগরা অনেকেই তোমার সঙ্গে পরিচিত হতে চান, তোমার সংকোচ কোথায় বল তো!
আমি উত্তর না দিয়ে হা হা করে হাসি। হাসি দিয়েই আড়াল করতে চাই এ প্রসঙ্গ। কিন্তু তরুর তো উৎসাহের শেষ নেই। এর সঙ্গে এবার পরামর্শের ছবকও যোগ করে, নানান রকম মানুষের সঙ্গে পরিচয় থাকা ভালো, বুঝেছ? কে কখন কোন কাজে লেগে যায়, সে কথা কে বলবে!
আমি ঘাড় ঝাঁকিয়ে সমর্থন জানাই, তা ঠিক।
এতগুলো লোককে তো আমি বাসায় ডাকতেও পারি না।
তা ঠিক।
আর তোমাদের দেশের ছেলে সালাম ভাই তো যে কোনো দিন বাসায় চলে এলো বলে! তাকে আর ঠেকানো বোধহয় যাবে না।
কেন, কেন?
তোমাকে বলিনি আগে-বরিশালে আমার শ্বশুরবাড়ি, এ কথা জানার পর থেকে সে আমাকে ভাবি বলে ডাকে। সারা অফিসে এই এক সালাম ভাই-ই ভাবি ডাকে। তার সোজাসাপটা যুক্তি-দেশের বউ, ভাবি ডাকব না?
কোথায় তোমার সালাম ভাইয়ের বাড়ি? বরিশালের কোথায়?
বরিশাল কীসের? তার বাড়ি হচ্ছে পটুয়াখালীর বাউফল না লাউফল উপজেলায়।
লাউফল!
আমি হা হা করে হেসে উঠি। হাসতে হাসতে বলি-বেশ বলেছ যা হোক! আবার হাসি।
এত হাসির কী হলো!
হাসছি মানে আমরাও এক সময় ওই শব্দটিই বলতাম।
তরু যেন নিজের ভুলটা ধরতেই পারে না-লাউফল একটা জায়গার নাম হলো?
না না, জায়গার নাম বাউফল। ভুলটা আমি শুধরে দিই, ওটা একটা উপজেলার নাম। কিন্তু আমরা ক’জন... বাক্যটি শেষ হয় না। আবারও প্রবল হাসি পায়। হেসে উঠি পাগলের মতো। তরু অবাক হয়,
কী ব্যাপার! তোমরা ক’জন কী করেছ?
আমার হাসি কিছুতেই থামতে চায় না। তরু আমার মুখে হাত দিয়ে হাসি থামায়। আমাকে আঁকড়ে ধরে-এত হাসির কী আছে বল তো!
এতক্ষণে আমি হাসির লাগাম টেনে রহস্যটা ভেঙে বলি,
বরিশাল বিএম কলেজে আমাদের সঙ্গে বাউফলের এক মেয়ে পড়ত। দেখতে নাদুসনুদুস। ব্রিলিয়ান্ট। এই পর্যন্ত বলে আমার আবার হাসি পায়। তরু এবার ধমক লাগায়, তো হাসির কী হলো?
বোমা ফাটানোর মতো করে আমি জানাই,
বাউফলের সেই মেয়েটিকে আমরা বলতাম লাউফল।
এবার আমার সঙ্গে সঙ্গে তরুও হেসে ওঠে। কিন্তু হাসির ফাঁকে বলে,
তোমরা তাহলে সেই বয়সেই এতটা ইচড়েপাকা ছিলে!
তা তুমি বলতে পার।
অ। সে জন্যই আজ এই দশা।
এই দশা বলতে তরু যে কী বুঝাতে চায়, আমি জানি না। আবার এ নিয়ে প্রশ্নও করি না। কোনো এক প্রকারে ওদের অফিসের প্রসঙ্গটা অতিক্রম করতে পারলেই যেন বাঁচি। ওদের অফিসে আমি আদৌ কখনো যাব না, এমন সোজাসাপটা কথা আমি কোনো দিন বলিনি। এটা-সেটা বলে কেবল এড়িয়ে যেতেই চেষ্টা করি।
আমি যাব দিলকুশা। সেখানেই আমার ইন্টারভিউ। লিখিত পরীক্ষা অনেক আগেই হয়েছে। বরাবরের মতোই ভালো পরীক্ষা দিয়েছি। রেজাল্ট দিতে বিলম্ব হওয়ায় ধরেই নিয়েছিলাম, ওপর মহলে কলকাঠি নাড়াচাড়া চলছে, এবারও আমার কপাল ভাঙল। কিন্তু না, পাঁচ মাস পরে হলেও ওই লিখিত পরীক্ষার রেজাল্ট ঠিকই বেরিয়েছে, আমার ফলাফল ভালো। ডেকেছে মৌখিক পরীক্ষায়। দিলকুশা বাণিজ্যিক এলাকায়, ওদের হেড অফিসে এই ইন্টারভিউ।
তরুকে মতিঝিলে ছেড়ে দিয়ে আমি দিলকুশার দিকে পা বাড়াতেই শুনি পিছু ডাক। তরুর কণ্ঠই তো! আমি ঘুরে তাকিয়ে অবাক হই। মাত্র কয়েক গজের দূরত্ব। তবু সে দৌড়ে আসে। খপ করে আমার হাত চেপে ধরে। জানতে চায়,
তোমার ইন্টারভিউ শেষ হতে হতে কতক্ষণ হবে বলতো!
প্রশ্ন শুনে মেজাজ খিঁচড়ে যায়। তবু ঢের সংযত হয়েই বলি,
সেটা আমি কেমন করে বলব!
তা ঠিক। তুমি একটা কথা রাখবে?
কী মুশকিল। রাস্তার মাঝে সিনক্রিয়েট না করে যা বলার বলে ফেল।
ইন্টারভিউ শেষ হলেই আমার অফিসে চলে এসো। একসঙ্গে বাসায় ফিরব।
না না, আমার জন্য অপেক্ষা করার দরকার নেই। তুমি চলে যেও তোমার মতো।
আমি অপেক্ষা করব, ৫টা পর্যন্ত।
তরুর চোখের দিকে তাকিয়ে সহসা আমার ভিতরটা নুয়ে পড়ে, পরিহাস তরল হয়ে ওঠে, ফিক করে হেসে বলি,
আমার বেড়াল ধরার কাজ, কতক্ষণে হয় তার ঠিক আছে? তাও অন্ধকার ঘরে কালো বেড়াল, খুঁজে পাব কখন কে জানে!
তবু এসো।
আচ্ছা দেখছি। তুমি যাও।
সাত
দিলকুশা বাণিজ্যিক এলাকায় এসে খুঁজে পেতে আমাদের জন্য নির্ধারিত অন্ধকার ঘরটিতে আমি যখন পৌঁছুই, তখন ঘড়ির কাঁটা ১০টার ঘর পেরিয়ে গেছে। এখানেই আমাদের কালো বেড়াল খোঁজার পালা। হন্তদন্ত হয়ে পৌঁছানোর পর জানা গেল- অনিবার্য কারণে ১০টার পরিবর্তে ইন্টারভিউ শুরু হবে দুটুর ১২টা থেকে। আমার শরীর তখন ঘ্যামে জ্যাবজ্যাবে, ভেজা শার্ট সেঁটে লেগে আছে পিঠের সঙ্গে। সময় পরিবর্তনের খবর শুনে মেজাজ হয়ে যায় তিরিক্ষি। এখন এই দেড় ঘণ্টা, দুই ঘণ্টা কোথায় কাটাই, কী করি!
বাইরে খাঁ খাঁ রোদ্দুর। প্রচণ্ড দাবদাহ। ভ্যাপসা গরম। সেই তুলনায় এদের ওয়েটিং রুমটা যথেষ্ট ভালো। সেন্ট্রাল এসি চলছে। কিন্তু আমার মতো চাকরিপ্রার্থীর সংখ্যা এত বেশি যে ওয়েটিং রুমে সবার বসার সংকুলান হয়নি। ইতস্তত বিক্ষিপ্তভাবে অনেকে কেঁচোকুণ্ডলী পাকিয়ে ঘোরাঘুরি করছে। এসব সহযোদ্ধার মধ্যে থেকে একজন হঠাৎ প্রস্তাব দিয়ে বসেন, চলুন, চা খেয়ে আসি।
আমি তার দিকে তাকিয়ে চিনতে চেষ্টা করি। বেশ চেনা চেনা মনে হয়, তবু ঠিক চিনতে পারি না। আমি একটু দ্বিধান্বিত গলায় বলি,
আমাকে বলছেন?
হ্যাঁ হ্যাঁ। চলুন, ঘুরে আসি।
সত্যি বলতে কী চায়ের তেষ্টা যে আমার মোটেই পায়নি, তা নয়। তবু এভাবে প্রায় অচেনা একজনের আহ্বানে চা খেতে যাওয়ার বিষয়ে নিঃসংশয় হতে পারি না। উল্টো যুক্তি দেখাই, এই গরমে চা খেতে যাবেন?
নয়তো কী! এই ঠান্ডা ঘরে বসে আপনাকে এরা চা খাওয়াবে?
না, মানে, এই এলাকায় ধারে-কাছে তেমন চায়ের দোকানও পাবেন না।
[চলবে]