মাটি শুকাইয়া কাঠ হইয়া গেছে। আবার কাঠ পচিয়া মাটি হইয়া ওঠে। মাটি ফুঁড়িয়া গাছ জন্মাইয়া যায়, আকাশে কোনো গাছ হয় না। কোথায় কী হয়, না হয় আমার অতশত ভাবিয়া কোনো ফল আসে না। ২৫০০ বর্গফুটের ফ্ল্যাটে চার বেড, পাঁচ বাথ, পাঁচ বারান্দা, ড্রয়িং, ডাইনিং, কিচেন আমাদের প্রয়োজন নাই। প্রয়োজন নাই বলিয়া যে একেবারেই ঘর থাকিবে না তা কী করে হয়। মাটি শুকাইয়া যায়, দলা পাকানো মাটি ভাঙিবার ফুরসত কই।
পাঁচ ক্লাসের গবেষক কন্যার জন্য এক ব্যাগ মাটি ভরিয়া আনিয়াছি আমাদের শহুরে বাসায়। কন্যা গাছ লাগাইবে, তাহার জেদ সে গাছ লাগাইবেই। নয়নতারা। যাহার শাখায় শাদা ফুল ফোটে। প্রায় সারা বছর শুভ্র মাথা লইয়া হেলদোল করে। কন্যা মাটির দলা গুঁড়ো করিতে থাকে। আমি একটা কাচের বোতলে পানি ভরিয়া মানিপ্লান্ট গুঁজিয়া রাখি ঘরের কালো টেবিলে।
পাশের বাড়ির বারান্দায় একটা হাত ফুটিয়া থাকে। মসৃণ দুধের মতো হাতটির ছবি তুলিয়া রাখি। ছবি দেখিয়াই আমার সময় পার হইয়া যায়। দেশে কী ঘটিতেছে তা আমার জানা হয় না। বেগুনের দাম কমিয়া গেছে বইলা শুনিয়াছি। এখন না কি তা গরুতেও খাইতেছে না। কৃষকের বেদনা মাঠেই দাফন হইয়া যাইতেছে। এ বিষয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী কিংবা দেশীয় বুদ্ধিজীবীরা কোনো বাতচিত করিতেছে কি না আমার জানা নাই।
ফুটিয়া থাকা হাতটি মোবাইলের গ্যালারি থাইকা বাহির কইরা খাইতে থাকি। সেই হাত থাইকা দামি ক্রিমের গন্ধ বাহির হয়। জিহ্বার আগায় আরবের খেজুরের মতো স্বাদ লাইগা থাকে।
কন্যার মায়ের কোনো শখ নাই। সে সারা দিন সেলাই মেশিন চালাইতে থাকে। মোবাইলে মান্না দে’র গান ছাইড়া দেয়। মেশিনের শব্দ ও গানের কথা মিলেমিইশা এক অদ্ভুত দ্যোতনা তৈরি করে। সে মেশিন চালাইতে থাকে, ঘড়ঘড় ঘড়ঘড়... কফি হাউজ কফি হাউজ...। আমার কানে কী শব্দ ভাইসা আসে তা বুঝিতে পারি না। কন্যা মা-বাবার ছবি আঁইকা ড্রেসিং টেবিলের কাচে লাগাইয়া দেয়। তারপর আমারে ঘুম থাইকা ডাইকা তোলে। ওর মায়েরেও মেশিন থাইকা তুইলা আনে। আমাদের দুজনরে সেই ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড় করাইয়া বলে, ‘তোমরা দুজনেই আয়নায় ঢুইকা গেছ। এখন বাহির হইয়া দেখাও।’ আমরা দুজনে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করি। তারপর তার পিঠে থাবা দিয়া বলি, ‘আয়নায় না, আমরা তো তোমার মইধ্যে ঢুইকা আছি মা।’ আমাদের কথা শুইনা কন্যা আনন্দ পাইয়া বারান্দায় যায়। ফের মাটি গুঁড়ো করিতে মনোযোগ দেয়।
মোবাইলের গ্যালারি থাইকা আবার সেই হাতের ছবিডারে বাহির করি। খুব ভালো কইরা চোখ ফুটাইয়া জুম কইরা দেখতে থাকি। এমন সুন্দর হাত ফেসবুকে ছাইড়া দিলে তো ভাইরাল হইয়া যাইব। কতজন মুগ্ধ হইয়া তাকাইয়া থাকবো, কে জানে। হাতের আঙুলগুলা একটা শিল্প হওয়ার আওয়াজ তোলে, তা আমি বুঝিতে পারি। মধ্যমা ও অনামিকা বারান্দার গ্রিল ছুঁইয়া আছে। বৃদ্ধাঙুলি একটু বাঁকা হইয়া বামে ঝুঁইকা গেছে। কনিষ্ঠা হালকা ডানে ঝুঁইকা খাড়া হইয়া কারে যে ডাকতেছে তা সেই হাতের মালকিনই বলিতে পারিবে। পাঁচ নখে হালকা খয়েরি নেইলপালিশ জীবন্ত হইয়া আমারে খরগোশের পশমের মতো অনুভূতি দিয়া যাইতেছে। অনামিকা ও কবজিতে দামি সোনার রিং আর মোটা চেইন হাতের সৌন্দর্য আরও বাড়াইয়া দিছে। এমন দামি জিনিস খুইলা বেইচা দিলে তো আমি দুই মাস পোলাও-মাংস খাইয়া বাঁইচা বাঁইচা ঘুমাইতে পারি।
কন্যার লক্কড়ঝক্কড় মার্কা গাড়িগুলা ঘরের ভিতর ছড়াইয়া থাকে। দিনের বেলায় আমি ঘুমাইয়া থাকিলে সে সবচেয়ে বড় গাড়িটা আমার মাথার ওপর তুইলা দেয় এবং আমারে ঝাঁকি দিয়া বলে, ‘বাবা, তুমি কি বাঁইচা আছো?’ আমি ধড়ফড়াইয়া বিছানা ছাইড়া উইঠা বসি এবং তারে বলি, ‘আছি, আছি।’ বালিশের পাশে দেখি গাড়িটা পইড়া আছে। দুপুরবেলায় টেলিভিশন খুইলা আমার চোখ কপালে ওঠে। দাদনের টাকা না দিতে পারায় ইন্দাচুল্লি গ্রামের মোছা. বিলকিসরে ঘর থাইকা ধইরা আইনা রাস্তায় পিটাইতে পিটাইতে মাইরা ফেলছে দাদনচক্রীরা। সে ইটভাটায় শ্রমিক হিসেবে কাজ করিত। ইটের চুল্লিতে দিয়াশলাইয়ের নীল-বারুদ মাথাওয়ালা কাঠি আর সে জ্বালাইয়া দেবে না। অভাবের আগুনে সে নিজেই পুইড়া গেল। আর পুড়াইয়া গেল রাষ্ট্রযন্ত্রের বাম কোনা।
আমরা কী কইরা বাঁইচা আছি আর কী কইরা মইরা যাইব, কেউ জানি না। নাকি কেউ কেউ জানে? যাহারা জানে তারা তুরস্ক থাইকা, ইতালি থাইকা, লন্ডন থাইকা হরেক কিসিমের লাইট আইনা শহর সাজায়া তোলে। আমাদের শহরে রাতেও রাত নামে না। আমাদের চব্বিশ ঘণ্টা দিন। চাঁদের কোনো প্রয়োজন পড়ে না। আমরা তাই আলো-দিনেই হাগি মুতি শুই আর কাজকর্ম সারি। আমাদের আনন্দের সীমা থাকে না। অসীম আনন্দে ভাসতে ভাসতে দীর্ঘ লোডশেডিং হইলে গ্রীষ্মের তাপে মিষ্টি আলুর মতো ধীরে ধীরে সিদ্ধ হইতে থাকি।
সকাল হইতে হইতেই কন্যার মা সেলাই মেশিনের চেয়ারে বইসা পড়ে। আবার ঘড়ঘড় ঘড়ঘড়...কফি হাউজ কফি হাউজ... চলতেই থাকে। সে যেন পোশাক নয় মানুষের শরীর সেলাই করে। কাপড়ের কোথাও যেন একটুও ব্যথা না লাগে সেদিকে খেয়াল রাখে। এলাকার সকল মেয়ের বুকের মাপ তার নখদর্পণে থাকে। কন্যার মাটি গুঁড়ো করা শেষ হইলে আমি তারে একটি নয়নতারার চারা উপহার দিই। সে চারাটি যত্ন কইরা বারান্দায় রাইখা আইসা আমার পিঠে হেলান দিয়া তেৎসুকো কুরোয়ানাগির ‘তোত্তোচান’ বইটি পড়তে থাকে।
ময়লা-আবর্জনার জলস্তূপের মধ্যে তিনটি রাজহাঁস ঠোঁট ডুবায়া খাবার খুঁজতে থাকে। খানিক দূরেই আরেকটা রাজহাঁস শহরের ড্রেনের ওপর গলাটা টান টান কইরা উদাসীনভাবে তাকায়া থাকে। যেন পৃথিবীতে তাহার কেউ নাই। একা একা ড্রেনের ওপর বিষাদ ডাইকা আনে। সেই সময় রাজহাঁসের মতোই একটা বিষাদগ্রস্ত মেয়ের কথা আমার মনে পইড়া যায়। লালশাড়ি পরা মেয়েটি চুল ছড়াইয়া মায়াময় করুণ দৃষ্টিতে মেঘের দিকে তাকায়া থাকিত। চেহারায় দুখী দুখী ভাব লইয়া শহরে শাড়ির আঁচল উড়াইয়া কই কই ঘুইরা বেড়াইত কেবল সে-ই বলিতে পারে। সে যখন কোথাও দাঁড়াইয়া শহরের লাইটগুলানের দিকে তাকাইয়া থাকিত, তখন তার গলার রগগুলা সাপের ফণার মতো ফুলিয়া উঠিত।
নয়নতারার চারাটি টবের মাটিতে পুঁতিয়া দিয়াছে কন্যা। হালকা পানি ঢালিয়া সে চুল আঁচড়াইতেছে। স্কুলের ব্যাগপত্র গুছাইয়া ডোরেমন দেখিতেছে। আমি বাজার থাইকা একটা তরমুজ চড়া দামে কিইনা আনছি। কন্যার মা বঁটিতে তরমুজ দুফালা করিয়া আমারে ডাকিতেছে। সামনে খাড়াইতেই সে বলিল, ‘এইটা কী আনিয়াছ?’ আমি অন্যদিকে চোখ করিয়া বলিলাম, ‘ক্যান তুমি চেনো না?’ তার দুই গাল লাল কইরা আমারে বলিল, ‘এ তো পুরাই শাদা, লাল পাও নাই।’ আমি হেবলার মতো কিছুক্ষণ দাঁড়াইয়া উত্তর করিলাম, ‘তরমুজের লাল তো তুমি গালে মাখিয়াছ।’ এ কথা শোনামাত্রই একফালি তরমুজ আমার মুখের দিকে ছুড়িয়া মারিয়া সে মেশিনের চেয়ারে গিয়া বসিল।
যেহেতু আমাদের শহরে রাত নামে না। আমাদের ঘরে-বাহিরে হরেক রাজসিক বাত্তি, আমরা তাপানুকূল নগরের বাসিন্দা, আমাদের টয়লেটেও ঝাড়বাত্তি আর টনকে টন এসি, তাই আমাদের গরম লাগে না। রাজাদের কোনো গরম নাই, শরমের বালাই তো পাওয়াই যাইব না। আমাদের নদী থাইকা ট্রাক ট্রাক উইঠা যায় বালি। আমরা সোনার ডিম খাইয়া স্বাস্থ্যবান থাকি। আমাদের কর্ম লাগে না, আমরা অসুস্থ হই না। শুধু কখনো কখনো আমরা দীর্ঘ ঘুমের মতো লোডশেডিংয়ে থাকি। তাই ভাড়া বাড়ির ট্যাংকিতে পানি থাকে না।
মাঝে মাঝে ভাবি শহর ছাইড়া দেব। টাকার জোগান হইলে শহর থাইকা দূরে ছোটখাটো একটা বাড়ি বানাইয়া তাতে হাঁস-মুরগি, কবুতর ও ময়না পাখি পুষিব। বাড়িজুড়ে লাগাইব নানা কিসিমের গাছপালা। তবে ময়নারে কথা শিখাইব না। কথার বদলে তারে শিখাইব চুপ থাকার ভাষা। ঘরের চার দেয়াল জুইড়া থাকবে থরে থরে অন্ধকারের বই। ঘরে থাকিবে একটা স্বচ্ছ কাচের জানালা। জানালার ওপাশে দেখা যাইব সবুজ ধানখেত, সোনালি গমের মৌসুম, গাছে গাছে কাঠবেড়ালির নড়াচড়া, চলাফেরা। জানালা বরাবর ভিড়াইয়া দেব ছোট্ট একটা টেবিল আর হাতলওয়ালা একটা চেয়ার। আলোর শহর ছাইড়া অন্ধকারের বই পড়তে পড়তেই কাইটা যাইব সামান্য জীবন। ‘তুমি এত অন্ধকারের বই পড়ো ক্যান?’ ভাবনার চরকির মধ্যে এমন প্রশ্নে চমকাইয়া উঠিলাম। আশপাশে তাকাইয়া তো কারও শরীর পাইলাম না। ‘আরে এদিকে, তোমার চেয়ারে বইসা গমখেত দেখতাছি আর অন্ধকারের বই পড়তাছি।’ আমি জানালার দিকে লক্ষ্য কইরা তারে জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘কে আপনি, আমার ঘরে আইলেন কীভাবে?’ তিনি ঘাড় ঘুরায়া বলিলেন, ‘আমি কাফকা, ১৯২৪ থাইকা আইছি। তোমার বইয়ের তাক থাইকা নাইমা এখানে বসছি। কন্যার নয়নতারা গাছটা দেইখাই ফিইরা যাইব।’
আমি তড়িঘড়ি কইরা বারান্দায় গেলাম। দেখি নয়নতারার মাটি শুকাইয়া কাঠ হইয়া গেছে। ঘরে তো কোথাও পানি নাই, বেসিনের ট্যাপ ঘুরাইয়াও পানি বাহির হয় না। গাছটা নেতাইয়া গেছে। নদীর পাশেই আমাদের বাড়ি। একটা পাত্র লইয়া নদীর দিকে দৌড়াইলাম। যাইয়া দেখি নদীও শুকায়া গেছে। শুধু চর আর চর। আরও কিছুদূর আগাইয়া দেখি কারা যেন গরুর ধড় কাইটা মাথাটা বালিতে ফেইলা গেছে। মাথাটাও শুকাইয়া শুধু শিং দুইটা উজায়া আছে। এই দৃশ্য দেইখা আরেক ঘটনা ভাইসা উঠিল মনের ভিতর। কয়েক বছর আগে আমার কন্যার বয়সি এক শিশুরে হাত-পা বাইন্ধা, মাথা থেকে গলা পর্যন্ত পলিথিন ব্যাগ প্যাঁচাইয়া শ্বাস আটকাইয়া কারা যেন মাইরা ফেলছিল। গরুর মাথার মতো এই চরেই শিশুটারে কারা যে ফেইলা গেছিল তা আজও জানা যায় নাই।
আমার শরীরে ভয় ধইরা গেল। পানিহীন দৌড়াইতে দৌড়াইতে ঘরে ফিরিলাম। দেখিলাম চেয়ারটা ফাঁকা। টেবিলে রাইখা গেছে ‘এ হ্যাঙ্গার আর্টিস্ট’ বইটা। ঘরের কোথাও কাউরে দেখা গেল না।
বারান্দায় গিয়া দেখি কন্যা নয়নতারার গোড়ায় পানি ঢালতাছে।