শনিবার, ৭ জানুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

বিদ্যানন্দের এক টাকায় আহার

তানিয়া জামান

বিদ্যানন্দের এক টাকায় আহার

বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন গরিব অসহায় শিশুদের মাঝে খাবার বিতরণের পাশাপাশি শিক্ষাদানও করে। খোলা রাস্তাতেই চলছে তাদের পাঠদান ও খাবার বিতরণ

সুদীর্ঘ কোনো পরিকল্পনা থেকে নয়, ক্ষুধার্তকে এক বেলা খাওয়ানোর আনন্দ থেকে বিদ্যানন্দের যাত্রা শুরু। আর্থিক অসংগতি থাকা মানুষের জন্য এক বেলা খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে। মাত্র এক টাকার বিনিময়ে এক বেলার সুস্বাদু খাবার তাদের পরিতৃপ্তি জোগাতে অনেকটাই সক্ষম। এক বেলার এই খাবার যেন অসহায় মানুষগুলোকে ভিক্ষাবৃত্তি বলে মনে না করায় সেজন্য প্রত্যেকের কাছ থেকে ন্যূনতম একটি মূল্য রাখা হয়। আর সেই ন্যূনতম মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে এক টাকা। অপরের দেওয়া খাবার খেতে যেন অসহায় মানুষগুলোকে ভাবতে না হয় তারা সত্যিকার অর্থেই খাবারের মূল্য পরিশোধে অপারগ— এমনটিই বললেন প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠাতা কিশোর কুমার দাশ।

 

বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের যাত্রা শুরু হয়েছে ২০১৩ এর ডিসেম্বর থেকে। ঘরোয়া পরিবেশে রান্না খাবার বিলিয়ে দেওয়া হতো গরিব অসহায়দের মাঝে। কিশোর কুমার দাশের উদ্যোগে কল্যাণমূলক এই কাজে যারা এগিয়ে এসেছেন তাদের প্রত্যেকেই কোনো রকম ব্যবসায়িক মনোভাবকে উহ্য রেখেই এসেছেন। নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী অর্থ ও সময় দিয়ে প্রতিষ্ঠানটিকে এগিয়ে নিয়ে চলেছেন। এভাবে প্রায় তিন বছর চলার পর ২০১৬ সালের নভেম্বর থেকে কিছু দাতা ফাউন্ডেশনটিতে অর্থ দান শুরু করেছে। প্রাপ্ত এ অর্থ সত্যিকার অর্থে কোন কাজে লাগছে তা পর্যবেক্ষণের জন্য অডিট কমিটি রয়েছে। এ ছাড়াও ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে অর্থ দানের আগে দাতাদের ফাউন্ডেশনের কাজকে স্বচক্ষে পরিদর্শন করার আবেদন থাকে। এভাবে এগিয়ে চলা ফাউন্ডেশনটি দৈনিক মোট পাঁচটি ব্রাঞ্চে ৭০০ এর বেশি প্যাকেট বিতরণ করছে।

 

আগে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে খাবার বিতরণ হলেও বর্তমানে ‘এক টাকায় আহার’ প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে খাবার বিতরণ করা হচ্ছে। এই পরিকল্পনার আওতায় গত চার মাসে ১ লাখ ২০ হাজার পথশিশুকে খাবার দেওয়া হয়েছে। সুস্বাদু এই খাবারের বিনিময়ে কেন এই এক টাকা করে নেওয়া হচ্ছে, এমন প্রশ্নের উত্তরে প্রতিষ্ঠানটির ভাইস প্রেসিডেন্ট জানান, ‘বিদ্যানন্দের প্রতিষ্ঠাতা কিশোর কুমারের উদ্যোগে মূলত এই আয়োজন। এক টাকার বিনিময়ে পথশিশু ভিক্ষুক বাচ্চাদের মাঝে খাবার তুলে দেওয়া হয়। অন্তত এক টাকা হলেও যেন তারা ভাবতে পারে আমরা খাবার কিনে খাচ্ছি। এতে চেয়ে খাওয়ার মতো হীনম্মন্যতা তৈরি হবে না।’

 

খাবার কিনে খাওয়ার মতো নিজেদের সামর্থ্যবান ভাবতে পারার আনন্দকে উপহার দিতেই মূলত এই আয়োজন। এই পরিকল্পনার আওতায় খাবার পেয়ে থাকেন ১২ বছরের নিচে অসহায় শিশুরা আর ৬০ বছরের ঊর্ধ্বে বৃদ্ধরা। কিশোর কুমার জানান, আমরা পথে বের হলে অনেক ক্ষুধার্ত শিশুকে দেখি। এক বেলা খাবারের জন্য সবার কাছে হাত পাতে। তখন নিজের চিন্তাকে প্রসারিত করলাম। ভাবলাম অচিরেই তাদের জন্য কিছু করা দরকার। তখন থেকে ঢাকার গাবতলী ও বিমানবন্দর রেল স্টেশনে এসব খাবার বিতরণ করা হয়। প্রতিষ্ঠানটির এক ঝাঁক স্বেচ্ছাসেবক এসব খাবার বিতরণ করে। এত কম দামে খাবার পেয়ে খুশি শিশুরাও। এ ছাড়াও নারায়ণগঞ্জ, রাজবাড়ী, কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের বেশকিছু স্থানে প্রতিদিন খাবার বিতরণ হয়।

 

কিশোর কুমার জানান, আগে ইচ্ছা না থাকলেও বর্তমানে একটি স্পেশালাইজ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে চাই। সেখানে সামর্থ্যহীনদের মধ্য থেকে মেধাবীদের এনে কর্মমুখী প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। এক বেলা খাবার বিতরণ করে এসব অসহায়কে হয়তো সাময়িক উপকার করছি। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি উপকারে কোনো অবদান রাখতে পারছি না। বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করতে পারলে স্থায়ী ব্যবস্থা করা যাবে।

 

কিশোর কুমার দাশ মনে করেন, সমাজের চোখে যারা অসহায়, নিম্ন কাজে লিপ্ত, চুরি, ছিনতাইয়ে লিপ্ত তাদের সুপথে আনার দায়িত্ব সমাজের সবার। আমি একা বিরাট এই সংখ্যাকে কিছুই করতে পারব না। তবে সবাই একটু একটু করে এগিয়ে এলে বড় ধরনের কাজ করা সম্ভব। আমাদের দেশকে বদলে স্বাবলম্বী করা সম্ভব। তাই সামর্থ্যবানদেরই এগিয়ে আসতে হবে। আমি আমার কাজ দিয়ে অন্যদের উৎসাহ দিতে পারি। বিরাট এই কাজের ছোট্ট অংশীদার হতে পারি। তাদের পরিচালনায় দুটি এতিমখানা আছে। সেখানে এতিম বাচ্চাদের ভরণপোষণের দায়িত্ব পালন করে আসছেন। এ ধরনের কাজ সুন্দরভাবে পরিচালনার জন্য কিশোর কুমার কৃতজ্ঞ উদ্যোগী স্বেচ্ছাসেবীদের কাছে। তিনি বলেন, এমন একটি অলাভজনক কাজেও যে এত মানুষ যুক্ত হতে আগ্রহী তা আমার জানা ছিল না। অসংখ্য ছেলেমেয়ে নিজেদের কাজের পাশাপাশি সময় দিচ্ছেন। বাজার করা থেকে শুরু করে রান্নাবান্না, বিতরণ সবই ধৈর্যসহকারে পরিচালনা করছেন। তাই নিঃসন্দেহে বলা যায় আমাদের তরুণদের মধ্যে দেশপ্রেম অটুট। তারাও ভালো কাজের সঙ্গে যুক্ত হতে আগ্রহী। আর তা সম্ভব হলে আমাদের দেশকে এগিয়ে নেওয়া সম্ভব। বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের জন্য প্রতিদিন এত সময় দিতে গিয়ে স্বেচ্ছাসেবীদের ব্যক্তিজীবনে আয় উপার্জনে বিরূপ প্রভাব পড়ছে কিনা জানতে চাইলে ফাউন্ডেশনটির প্রতিষ্ঠাতা জানান, এখানে যারা কাজ করছেন, তাদের যোগ্যতা হিসেবে দেখা হয় নিজ নিজ অঙ্গনে প্রতিষ্ঠিত কিনা। এই কাজের জন্য দেওয়া সময় যেন তাদের ব্যক্তিগত কাজে ব্যাঘাত না ঘটায় সেদিকে খেয়াল রাখা হয়। তিনি আরও জানান, বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের কিছু বেতনভুক্ত কর্মী আছেন, তারাও অর্ধেক মূল্য গ্রহণ করেন। যারা বিভিন্ন কেন্দ্রের দায়িত্বে আছেন তাদের অধিকাংশই কর্মজীবনের শেষ পর্যায়ে।

 

 

বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা কিশোর কুমার দাশ

বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা কিশোর কুমার দাশের জন্ম নারায়ণগঞ্জে। বাবার চাকরি সূত্রে ছেলেবেলা কাটে চট্টগ্রামের কালুরঘাটে। বাবা-মা ও পাঁচ ভাইবোনের দারুণ একটি পারিবারিক বলয়ে বড় হয়েছেন কিশোর কুমার দাশ। ভাইবোনরা প্রত্যেকেই উচ্চ শিক্ষা লাভ করে কর্মক্ষেত্রে সফলতার স্বাক্ষর রাখছেন। তিনি নিজে পড়াশোনা করেছেন চুয়েটে। বর্তমানে কিশোর কুমার দাশ পেরুর রাজধানী লিমায় একটি বড় কোম্পানিতে চাকরি করছেন। চট্টগ্রামে বড় হওয়ার সুবাদে ছোটবেলায় দেখেছেন হাজারো মানুষের জন্য মেজবানের আয়োজন। ধর্মীয় উপাসনালয়ে দেখেছেন ভেদাভেদ ভুলে এক লাইনে দাঁড়িয়ে অন্ন গ্রহণের আত্মিক প্রশান্তি। তখনই মনে বাসনা জাগে, সুযোগ এলে ক্ষুধার্ত মানুষকে পেটপুরে খাবার খাওয়ার আনন্দ দানের। কিশোর কুমার দাশের এই পরিকল্পনার প্রাতিষ্ঠানিক রূপ আজকের বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন। পড়াশোনা শেষে চাকরি শুরু করার পর একটু একটু করে স্বপ্ন পূরণের পথে হাঁটতে শুরু করেন তিনি। প্রথমে নিজের উদ্যোগে, পরবর্তীতে ভাইবোন, বন্ধু-বান্ধব ও স্বেচ্ছাসেবকরা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন।

সর্বশেষ খবর