শনিবার, ৭ জানুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা
বেড়ানো

এই শীতে কুয়াকাটা

সাইফ ইমন

এই শীতে কুয়াকাটা

একপাশে সাগরের নীল জলরাশি, অন্যপাশে ইতিহাসঘেরা কুয়াকাটা প্রান্তর; যা বাংলাদেশে তো বটেই, গোটা বিশ্বে ‘সাগরকন্যা’ নামে পরিচিত। এই শীতে পরিবার-পরিজন নিয়ে ঘুরে আসতে পারেন সাগরকন্যা কুয়াকাটা থেকে।

 

ইতিহাস বলছে, অষ্টাদশ শতকে মোগল শাসকরা বার্মায় (মিয়ানমার) বসবাসরত আরাকানিদের সেখান থেকে বিতাড়িত করেন। পরে আরাকানিরা বর্তমান বাংলাদেশের একেবারে দক্ষিণে সাগর পারে বসতি স্থাপন করেন। তখন এখানে তারা সুপেয় পানির অভাব পূরণ করতে প্রচুর কুয়া বা কূপ খনন করেন। সেই থেকেই এ অঞ্চলের নাম ‘কুয়াকাটা’। পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার লতাচাপলী ইউনিয়নে অবস্থিত কুয়াকাটা বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের একটি সমুদ্রসৈকত ও পর্যটন কেন্দ্র। ভ্রমণপিয়াসুদের কাছে কুয়াকাটা সাগরকন্যা হিসেবে পরিচিত। এ সৈকতে একই জায়গা থেকে সূর্যাস্ত ও সূর্যোদয় দেখার বিরল অভিজ্ঞতা সত্যিই বিমোহিত করে। সবচেয়ে ভালোভাবে সূর্যোদয় দেখা যায় সৈকতের গঙ্গামতীর বাঁক থেকে আর সূর্যাস্ত দেখা যায় পশ্চিম সৈকত থেকে। আরও আছে সৈকত-লাগোয়া নারিকেল গাছের দীর্ঘ সারি; যা অত্যন্ত মনোমুগ্ধকর। সেই সঙ্গে দূর সাগরে মন কেড়ে নেওয়া জেলেদের মাছ ধরার দৃশ্য দেখতে দেখতে কোথায় হারিয়ে যাবেন নিজেই। বাংলাদেশের অন্যতম নৈসর্গিক এ সমুদ্রসৈকত ১৮ কিলোমিটার দীর্ঘ। এখানে এলে দেখতে পাবেন আরও কিছু দর্শনীয় স্থান। আসুন জেনে নিই এসব স্থান সম্পর্কে।

ইকো পার্ক

সমুদ্রসৈকত কুয়াকাটার জিরো পয়েন্ট থেকে মাত্র দেড় কিলোমিটার পুব দিকে ৭০০ একর জায়গাজুড়ে তৈরি হয়েছে পরিকল্পিত ইকো পার্ক। এ পার্কের বাগানে বিভিন্ন প্রজাতির ফলদ, বনজ ও শোভাবর্ধক ৪২ হাজার গাছ রয়েছে। আছে পার্কের লেকে প্যাডল বোট নিয়ে ঘুরে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অবলোকনের অফুরন্ত সুযোগ। ১ হাজার ফুট দীর্ঘ এ লেক যে কাউকে আকৃষ্ট করে। জনপ্রতি মাত্র ২০ টাকা ভাড়ায় মোটরসাইকেলে ঘুরে আসতে পারেন ইকো পার্কটি।

 

শত বছরের পুরনো নৌকা

পর্যটন কেন্দ্র কুয়াকাটার সৈকতে বালুর বুক চিরে জেগে ওঠে শত বছরের পুরনো নৌকা। ২০১২ সালের জুলাইয়ে সৈকতের বালুর মধ্যে জেগে ওঠা এ নৌকাটির অংশবিশেষ প্রথম দেখতে পান স্থানীয়রা। পরে দেশি ও আন্তর্জাতিক নৌকা বিশেষজ্ঞের তত্ত্বাবধানে এটি উত্তোলন করা হয়। প্রাচীন নিদর্শনের চিহ্ন হিসেবে বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতর নৌকাটি কুয়াকাটার শ্রীমঙ্গল বৌদ্ধ মন্দিরসংলগ্ন একটি বেষ্টনীর ভিতর সংরক্ষণ করে। নৌকাটির দৈর্ঘ্য ৭২ ফুট, প্রস্থ ২২ ফুট, ওজন প্রায় ৯০ টন।

শুঁটকিপল্লী

কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকতের পশ্চিম প্রান্তে আছে জেলেপল্লী। এখানে প্রচুর জেলের বাস। নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত এখানে চলে মূলত শুঁটকি তৈরির কাজ। সমুদ্র থেকে মাছ ধরে এনে সৈকতেই শুঁটকি তৈরি করেন জেলেরা।

গঙ্গামতীর জঙ্গল

কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকত শেষ হয়েছে পুব দিকে গঙ্গামতীর খালে। এখান থেকেই শুরু গঙ্গামতীর জঙ্গল। অনেকে একে গজমতীর জঙ্গলও বলেন। এখানেও ঘুরে বেড়াতে ভালোবাসেন পর্যটকরা।

কাঁকড়ার দ্বীপ

গঙ্গামতীর জঙ্গল ছাড়িয়ে আরও সামনে কাঁকড়ার দ্বীপ। এখানে লাল কাঁকড়ার বাস। নির্জনতা পেলেই সৈকত লাল করে চষে বেড়ায় কাঁকড়ার দল। অক্টোবর থেকে মার্চ পর্যন্ত সমুদ্রসৈকত থেকে স্পিডবোটে যাওয়া যায় কাঁকড়ার দ্বীপে।

ফাতরার বন

কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকতের পশ্চিম পাশে নদী পার হলেই সুন্দরবনের শ্বাসমূলীয় বনাঞ্চল দেখতে পাবেন। এর নাম ফাতরার বন। সুন্দরবনের সব বৈশিষ্ট্য রয়েছে এখানে। তাই সমুদ্রকন্যা দেখার পাশাপাশি এখানে এলে পাবেন সুন্দরবনের স্বাদও। তবে এ বনে নেই কোনো হিংস্র জানোয়ার। বনমোরগ, বানর আর নানান পাখি দেখা যায় এ বনে। কদাচিৎ বুনো শূকরের দেখাও মেলে। কুয়াকাটা থেকে ফাতরার বনে যেতে হবে ইঞ্জিনচালিত নৌকায় চড়ে।

 

 

কুয়াকাটার কুয়া

কুয়াকাটা নামকরণের পেছনে যেসব কুয়া, তার একটি এখনো টিকে আছে। কয়েক বছর আগে এটি সংস্কার করা হয়। সমুদ্রসৈকতের কাছে রাখাইনদের বাসস্থল কেরানিপাড়ার শুরুতেই প্রাচীন এ কুয়ার অবস্থান, যা সবার দৃষ্টি কাড়বে।

সীমা বৌদ্ধ মন্দির

কুয়াকাটার প্রাচীন কুয়ার সামনেই রয়েছে সীমা বৌদ্ধ মন্দির। কাঠের তৈরি এ মন্দির কয়েক বছর আগে ভেঙে পাকা দালান করা হয়েছে। মন্দিরের মধ্যে আছে প্রায় ৩৭ মণ ওজনের প্রাচীন অষ্টধাতুর তৈরি বুদ্ধমূর্তি।

কেরানিপাড়া সীমা বৌদ্ধ মন্দির থেকে সামনেই ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী রাখাইনদের আবাসস্থল। তাদের তৈরি শীতের চাদর বেশ আকর্ষণীয়।

হতে যাচ্ছে ‘বিচ কার্নিভাল’

যারা কাছাকাছি সময়ে কুয়াকাটা যাওয়ার প্ল্যান করেছেন তাদের জন্য এ মুহূর্তে রয়েছে বাড়তি পাওনা। ১২, ১৩ ও ১৪ জানুয়ারি কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকতে হতে যাচ্ছে ‘বিচ কার্নিভাল’।

এতে থাকছে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের জন্য নানা আয়োজন। এ সমুদ্রসৈকতকে বিশ্বের কাছে তুলে ধরতে এ আয়োজন বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের। সমুদ্রসৈকতে ঘুড়ি ওড়ানো থেকে শুরু করে বালু ভাস্কর্য প্রদর্শনী দেখার অভিজ্ঞতা, বলী খেলা, সার্ফিং, প্যারাসেইলিং, ফানুস ওড়ানো, ডিজে শোসহ নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে চমৎকার সময় উপভোগের সুযোগ পাবেন পর্যটকরা। তাই এখনই ব্যাগ গুছিয়ে ব্যস্ত নগরীকে কিছু সময়ের জন্য বিদায় জানিয়ে ঘুরে আসতে পারেন প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যের এ বেলাভূমি থেকে।

 

 

কীভাবে যাবেন

ঢাকা থেকে বেশ কয়েকটি বাস এখন সরাসরি কুয়াকাটা যায়। বিআরটিসি, দ্রুতি, সাকুরা পরিবহনসহ একাধিক পরিবহনের গাড়িতে গাবতলী কিংবা সায়েদাবাদ বাসস্ট্যান্ড থেকে কুয়াকাটা যেতে পারেন। তবে বাসে গেলে কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকত থেকে ২০০ মিটার দূরে নামিয়ে দেবে। আর ঢাকা থেকে বাসে যেতে লাগে ১২-১৩ ঘণ্টা। নৌপথে কুয়াকাটায় যেতে চাইলে ঢাকা সদরঘাট থেকে বিলাসবহুল ডাবল ডেকার এম ভি পারাবত, এম ভি সৈকত, এম ভি সুন্দরবন, এম ভি সম্পদ, এম ভি প্রিন্স অব বরিশাল, এম ভি পাতারহাট, এম ভি উপকূল লঞ্চের যে কোনোটিতে উঠে চলে যেতে পারেন পটুয়াখালী কিংবা কলাপাড়া। এখান থেকে রেন্ট-এ-কার ও পটুয়াখালী-কুয়াকাটা রুটের বাসে পর্যটন কেন্দ্র কুয়াকাটা পৌঁছাতে পারেন।

আবাসন

কুয়াকাটায় আবাসনের জন্য রয়েছে দুটি ডাকবাংলো ও কুয়াকাটা সাগরকন্যা পর্যটন হলিডে হোমস। রেস্ট হাউস রয়েছে এলজিইডির দুটি, সড়ক ও জনপথের একটি, জেলা পরিষদের দুটি এবং রাখাইন কালচার একাডেমির একটি। এসব জায়গায় থাকতে হলে সংশ্লিষ্ট দফতরের পূর্বানুমতি নিতে হয়। এ ছাড়া ব্যক্তিগত উদ্যোগে এখানে গড়ে উঠেছে ছোট-বড় অর্ধশতাধিক আবাসিক হোটেল ও মোটেল।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর