শনিবার, ২১ জানুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা
অন্যরকম

ব্যতিক্রমী জামাইদের মাছমেলা

► কে কত বড় মাছ নিয়ে যেতে পারেন শ্বশুরবাড়ি এমন প্রতিযোগিতা হয়ে থাকে এখানকার জামাইদের মাঝে ► আড়াইশ বছরের ঐতিহ্যবাহী এ জামাই মেলা ► মূলত ১০-১২টি গ্রামের জামাইদের মাঝে হয় নীরব এই প্রতিযোগিতা

শেখ সফিউদ্দিন জিন্নাহ্

ব্যতিক্রমী জামাইদের মাছমেলা

আড়াইশ’ বছর পুরনো জামাই মেলা এখন মাছ মেলায় রূপ নিয়েছে। মেলার আশপাশের ১০-১২ গ্রামের মেয়ের জামাইদের মধ্যে মাছ কেনা নিয়ে এক ধরনের নীরব প্রতিযোগিতা হয়। কে কত বড় মাছ কিনে শ্বশুরবাড়ি নিয়ে যাবেন। আর এই মাছ কেনার প্রতিযোগিতা এক সময় রূপ নিয়েছে জামাইদের মাছ মেলা। আড়াইশ’ বছর আগে হিন্দু ধর্মের এক পূজাকে কেন্দ্র করে বসছে জামাইদের মাছ মেলা। প্রতি বছর মাঘ মাসের প্রথম দিন কালীগঞ্জ ও কাপাসিয়া উপজেলার ১০-১২টি গ্রামের মেয়ের জামাইরা শ্বশুরবাড়ি আসেন বেড়াতে। আর বেড়াতে এসে শ্বশুরবাড়িতে কে কত বড় মাছ কিনে নিয়ে যাবেন সেই প্রতিযোগিতা শুরু হয় জামাইদের মাঝে। মূলত এই মাছ কেনাকে কেন্দ্র করেই গাজীপুরের কালীগঞ্জের বিনিরাইল গ্রামে বসছে জামাইদের মাছ মেলা। প্রথম দিকে এখানে শুধু মাছই বিক্রি হতো। দিন যত গড়াতে থাকে এই মাছ মেলার পরিধিও বেড়ে যায়। বর্তমানে এখানে শুধু মাছ-ই বিক্রি হয় না, মাছের পাশাপাশি নানা ধরনের সামগ্রী বিক্রি হয়। আর এই মেলায় প্রতি বছর এ একদিনেই কয়েক কোটি টাকার মাছ বিক্রি হয় বলে জানান মাছ বিক্রেতারা। এ দিনটিকে ঘিরেই এখানে দিনব্যাপী চলে আনন্দ-উৎসব। দিনটির জন্য সারা বছর অপেক্ষায় থাকেন উত্সুক সাধারণ মানুষ। বিনিরাইল এবং এর আশপাশের গ্রামে যারা বিয়ে করেছেন, সেসব জামারাই হচ্ছেন এই মেলার মূল ক্রেতা ও দর্শনার্থী।

ব্যতিক্রমী এই মেলায় আছে একের ভিতর দুই। অনেকটা এক টিকিটে দুটি ছবি দেখার মতো। কারণ এটা জামাই মেলা হলেও, এখানে বসে মাছের বিশাল মেলা। তা ছাড়া এই মেলাকে ঘিরে এলাকার জামাইদের মধ্যে চলে এক নীরব প্রতিযোগিতা। আর এই প্রতিযোগিতাটি হচ্ছে কোন জামাই সবচেয়ে বড় মাছটি কিনে শ্বশুরবাড়ি নিয়ে যাবেন। এ ছাড়াও বাংলাদেশের অনেক জেলা থেকে ক্রেতারা মাছ কিনতে আসেন এ মেলায়। এই মেলাকে কেন্দ্র করে হাজার হাজার মানুষের সমাগম ঘটে কালীগঞ্জের বিনিরাইল গ্রামের এই মেলায়। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি।

আগতরা জানান, এটা আসলে মূলত জামাই মেলা। কিন্তু সবাই এটাকে এখন বলে মাছের মেলা। কালীগঞ্জ ও কাপাসিয়ার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লোকজন তো আসছেন-ই। এর বাইরে থেকেও অনেকে এসেছেন গাজীপুরের এই ব্যতিক্রমী মেলায়। রাজধানী ঢাকা, গাজীপুর, টাঙ্গাইল, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী, ভৈরব, কিশোরগঞ্জ, ময়মনসিংহসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে হাজারো মানুষ কেবল এই মেলা উপলক্ষেই কালীগঞ্জ ও কাপাসিয়ায় আসেন। প্রতি বছর পৌষ-সংক্রান্তিতে অনুষ্ঠিত হয় এ মেলা। এবারের মেলায় অন্তত ৩ শতাধিক মাছ ব্যবসায়ী বাহারি মাছের পসরা সাজিয়ে বসেছেন বলে আয়োজক সূত্রে জানা গেছে। মেলায় মাছ ছাড়াও আসবাবপত্র, খেলনা, মিষ্টি ইত্যাদির পসরাও বসেছে। মাছের মেলায় সামুদ্রিক চিতল, বাঘাইড়, আইড়, বোয়াল, কালী বাউশ, পাবদা, গুলসা, গলদা চিংড়ি, বাইম, কাইকলা, রূপচাঁদা, পাখি মাছ, রাক্ষস মাছের পাশাপাশি স্থান পেয়েছে নানা রকমের দেশীয় মাছ।

এ বছরের মেলায় ৪০ কেজি ওজনের একটি মাছ ঘিরে ক্রেতা জামাইদের প্রতিযোগিতা শুরু হয়। মাছটির নাম কাতল। বিক্রেতা দাম হেঁকেছেন ৯০ হাজার টাকা। ক্রেতাদের মধ্যে স্থানীয় রামচন্দ্রপুর এলাকার জামাই রফিক মাছটির দাম সর্বোচ্চ ৬০ হাজার টাকা বলছেন। কিন্তু বিক্রেতা আরও বেশি দাম পাবার আশায় মাছটি ছাড়ছেন না। ক্রেতার চেয়ে উত্সুক জনতার ভিড়ই বেশি। আর চলে দর কষাকষি। পৌষ মাসের শেষে মাঘ মাসের প্রথম দিন শনিবার সকাল থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত চলে এই মাছ মেলা। মাঘের প্রথমদিন শনিবার সরেজমিন বিনিরাইল গ্রামে ঐতিহ্যবাহী মাছের মেলায় গিয়ে দেখা যায় এ দৃশ্য।

গাজীপুর ও আশপাশের বিভিন্ন এলাকা থেকে লোকজন এ বাজারে মাছ কেনতে এসেছেন। জেলার বাইরে থেকেও অনেকে এসেছেন সর্ববৃহৎ এ মাছ মেলায়। মেলাকে ঘিরে পুলিশ প্রশাসন থেকে দেওয়া হয়েছে নিরাপত্তা। মেলায় কিশোরগঞ্জের ভৈরব থেকে আসা মাছ ব্যবসায়ী নয়ন কুমার দাস জানান, তিনি ২০ বছর ধরে এ মেলায় দোকান করেন। শুরুতে বেচাকেনা ভালো হলেও বর্তমানে তেমন হয় না। তবে কেনার চেয়ে দেখতে আসা মানুষের ভিড় এখন বেশি। পাশাপাশি স্থানীয় মানুষের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক স্থাপন হওয়ায় প্রতি বছর এ মেলায় যোগ দেন তিনি। কাপাসিয়ার সাফাইশ্রী গ্রামের মাছ ব্যবাসয়ী ধীরেন বর্মণ জানান, প্রতি বছর এই জামাই মেলায় মাছ বিক্রি করতে মহাজনের কাছ থেকে আগে-ভাগেই টাকা নিয়ে মাছ কিনি। বিক্রি মোটামুটি হলেও আনন্দটা বেশি হয়।

মেলায় মাছ কিনতে আসা এক জামাই বলেন, শ্বশুরবাড়ি মাছ নিয়ে যাওয়া বলে কথা। তাই এলাকার সব জামাইর নজর বিনিরাইলের মাছের মেলার বড় মাছটার দিকে। স্থানীয় বড় মাছ ব্যবসায়ীরা সপ্তাহখানেক ধরে বড় বড় মাছ সংগ্রহ করেন। সেই অনুযায়ী মাছের দামও হাঁকানো হয়।

ব্যতিক্রমী এই মেলা নিয়ে আরেকজন বলেন, এবার সাড়ে ১৫ হাজার টাকার চিতল, বোয়াল, আইড়সহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ কিনেছেন বাড়িতে নেওয়ার জন্য।

স্থানীয় সাংবাদিকরা জানান, মাছের মেলাটি এ অঞ্চলের ঐতিহ্যের ধারক। মেলায় বেচাকেনা যা-ই হোক। এ মেলা আমাদের ঐতিহ্য আর সংস্কৃতিকে বহন করছে—এটাই সবচেয়ে বড় কথা। মেলার আয়োজক কমিটির সভাপতি নুরুল ইসলাম নুরু জানান, মেলাটি প্রথম অনুষ্ঠিত হতো খুবই ক্ষুদ্র পরিসরে। এটি অগ্রহায়ণের ধান কাটা শেষে পৌষ-সংক্রান্তি ও নবান্ন উৎসবে আয়োজন করা হতো। প্রায় ২৫০ বছর ধরে মেলার আয়োজন করে আসছে স্থানীয়রা। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এ মেলাটি একটি সার্বজনীন উৎসবে রূপ নিয়েছে। সাধারণ সম্পাদক মনির হোসেন শেখ বলেন, ব্রিটিশ     শাসনামল থেকে শুরু হওয়া জামাইদের মাছ মেলা এখন ঐতিহ্যে রূপ নিয়েছে। এ মেলা গাজীপুরের সবচেয়ে বড় মাছ মেলা হিসেবে গণ্য হয়।

কালীগঞ্জের জামালপুর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মাহবুবুর রহমান ফারুক মাস্টার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আড়াইশ বছরের ঐতিহ্যের এই ব্যতিক্রমী মেলা দেখতে দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে আসেন শত শত সাধারণ মানুষ। এক সময় এটি জামাইদের মেলা থাকলেও এখন এটি সবার মেলায় রূপ নিয়েছে। এখানে আসা দর্শনার্থীরা জানিয়েছেন, এই মেলায় এসে তারা অনেক আনন্দ উল্লাস করেন। এখানে অনেক বড় বড় মাছ দেখে তাদের প্রাণ জুড়িয়ে যায়। এত বড় বড় মাছ আগে কখনো কোথাও দেখেনি। মূলত মাছ দেখার জন্যই এই মেলায় আসেন দর্শনার্থীরা।

সর্বশেষ খবর