শনিবার, ২১ জানুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা
অনুপ্রেরণীয়

বিশ্বসেরা শিক্ষক বগুড়ার শাহনাজ

বিশ্বসেরা শিক্ষক বগুড়ার শাহনাজ

লেখা : সাইফ ইমন ছবি : আবদুর রহমান টুলু

২০১৫ সাল থেকে মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক ভারকি ফাউন্ডেশন ‘গ্লোবাল টিচারস’ পুরস্কার প্রবর্তন করছে। এ বছর এই পুরস্কারের জন্য বিশ্বের ১৭৯টি দেশের প্রায় ২০ হাজার শিক্ষক-শিক্ষিকা আবেদন করেন। এদের মধ্যে থেকে শীর্ষ ৫০ শিক্ষককে বাছাই করা হয়েছে। এই ৫০ জনের মধ্য থেকে এ বছরের ১৯ মার্চ দুবাইয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে বিজয়ীর নাম ঘোষণা করা হবে। বিজয়ীকে অর্থ পুরস্কার দেওয়া হবে ১০ লাখ মার্কিন ডলার। মনোনয়নের তালিকায় আছেন ১৬ জন শিক্ষিকা। যাদেরই একজন বাংলাদেশের শাহনাজ পারভীন। বগুড়ার শেরপুর মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষিকা শাহনাজ পারভীনের নাম এখন সবার জানা। প্রথম কীভাবে খবরটি পেলেন এবং অনুভূতি কেমন ছিল জানতে চাইলে শাহনাজ পারভীন বলেন, ‘আমি প্রথম খবরটি জানতে পারি ই-মেইলের মাধ্যমে। তখন আমি ঢাকা থেকে বাড়ি ফিরছি। সবার আগে আম্মাকে জানাই, তারপর স্বামী, ছোট বোন এবং অন্য আত্মীয়স্বজনকে জানাই। এই অনুভূতি এক কথায় সত্যিই অনেক অনেক আনন্দের। এটাই প্রমাণ করে পরিশ্রম কখনো বৃথা যায় না। মহান আল্লাহ তা’আলার কাছে অশেষ কৃতজ্ঞতা। শেষ পর্যন্ত গ্লোবাল টিচার পুরস্কার জিতলে আরও ভালো লাগবে।’ এরপর নিজের সাফল্যের পেছনের পরিশ্রমের কথা বলতে থাকেন শাহনাজ পারভীন, ‘আমার ভিতরে সব সময়ই সবার সামনে দৃষ্টান্ত স্থাপন করার মনোবল ছিল। অনেক শিক্ষক প্রাইভেট ও কোচিংকে গুরুত্ব দিয়ে অর্থ উপার্জন করছেন। আমি সে পথে হাঁটিনি। এখনো টিনশেডে থাকি। আমার লক্ষ্য ছিল সমাজ ও দেশের জন্য কিছু করা। আমার চাওয়া আমার ছাত্ররা জীবনে সফলতা অর্জন কারার পাশাপাশি ভালো মানুষ যেন হতে পারে। আমি প্রকৃতির আলো-বাতাস গ্রহণ করছি, বিনিময়ে কিছু ফিরিয়ে দেওয়া আমার কর্তব্য। আমি সেই চেষ্টায় সব কাজ করে থাকি। যে কোনো সাফল্যে কিছু মানুষের ভূমিকা অনস্বীকার্য। আমি বাংলাদেশ সরকার ও শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ স্যার-এর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই। আরও কৃতজ্ঞতা জানাই বাংলাদেশ ইউনেস্কো জাতীয় কমিশনের প্রতি। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী, সচিব মহোদ্বয়ের প্রতি ও প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের সর্বস্তরের কর্মকর্তা ও শিক্ষকবৃন্দের প্রতি।’

 

পরিবার

স্বামী মোহাম্মদ আলী ও দুই মেয়ে নিয়ে শাহনাজ পারভীনের ছোট্ট সংসার। বড় মেয়ে মাসুমা মরিয়ম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিষয়ে স্নাতক এবং ছোট মেয়ে আমেনা মুমতারিন বগুড়া ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ছে।

 

বিয়ে ও পড়াশোনা

দশম শ্রেণিতে পড়ার সময় শাহনাজের বাবা অসুস্থ হয়ে পড়েন। তারপর খুব বেশি দিন যায়নি, কলেজে ওঠার পরই বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয় তাকে। মোটকথা যৌথ পরিবারের বাড়ির বড় বউ হিসেবে কম বয়সেই সব দায়িত্ব এসে চাপে। সংসারের রান্না, শ্বশুর-শাশুড়ির সেবা, ননদ-দেবরের আদর-যত্ন থেকে সবকিছুই সামলাতে হিমশিত খেতে হয় শাহনাজকে। তবুও পিছপা হননি তিনি। পড়াশোনা চালিয়ে নিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘সবার রান্নাবান্না শেষ করেই ক্লাসে যেতাম। বিকালে ক্লাস থেকে ফিরে সংসারের কাজে লেগে যেতাম। আর রাতে খাওয়া-দাওয়া শেষে সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়লে রাত জেগে পড়তাম।’ ১৯৯২ সালে মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড থেকে আলিম পরীক্ষায় মেধা তালিকায় সারা দেশে মেয়েদের মধ্যে দ্বিতীয় হন তিনি। পরবর্তীতে নানা সাংসারিক প্রতিবন্ধকতায় বগুড়ার সরকারি আজিজুল হক কলেজে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিষয়ে স্নাতক (সম্মান) শ্রেণিতে ভর্তি হন।

 

শিক্ষকতার শুরু

স্নাতকে পড়ার সময় বেসরকারি বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করেন শাহনাজ। ২০০৩ সালে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগে উত্তীর্ণ হন। শিক্ষকতাকেই পেশা হিসেবে বেছে নেন। বিএড, এমএডসহ বিভিন্ন ডিগ্রি অর্জন করেন এবং প্রশিক্ষণ নেন। তিনি বলেন, ‘বাবা-মায়ের ইচ্ছা ছিল ডাক্তার বানাবেন। যদিও তারা দুজনই ছিলেন শিক্ষক। অল্প বয়সে বিয়ে হলো আরেক শিক্ষকের সঙ্গে। মূলত এটাই ছিল শাহনাজের আপাদমস্তক শিক্ষক হিসেবে গড়ে ওঠার রহস্য।’ জ্ঞানের ধারক-বাহক এই শিক্ষিকা শেরপুর মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যোগদান করেন। ২০০৯-১০ সালে উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ শিক্ষক নির্বাচিত হয়েছেন। ২০১৩ সালে জাতীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ নারী শিক্ষক নির্বাচিত হন।

 

শেরপুর শিশুকল্যাণ প্রাথমিক বিদ্যালয়

সুবিধাবঞ্চিত পথশিশু ও প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য ব্যক্তিগত উদ্যোগে নিজের বাসায় শেরপুর শিশুকল্যাণ প্রাথমিক বিদ্যালয় নামের একটি প্রতিষ্ঠান চালান শাহনাজ। এখানে সুবিধাবঞ্চিত শিশুরা পড়াশোনার পাশাপাশি বই-খাতা-কলম, স্কুলের পোশাক, ব্যাগ, টিফিন সবই পাচ্ছে বিনামূল্যে। শাহনাজ জানান, ‘প্রতিদিন ভোরে দুই মেয়েকে স্কুলবাসে তুলে দিতে শেরপুর বাসস্ট্যান্ডে আসতাম। তখন বিভিন্ন জায়গায় কাজ করা ছোট ছোট বাচ্চাদের দেখতাম। তারা ফ্যালফ্যাল করে আমার মেয়ের স্কুলব্যাগের দিকে চেয়ে থাকত। একদিন আমি এরকম দু’একজনের কাছে জানতে চাইলাম তারা লেখাপড়া করতে চায় কিনা। তারা সঙ্গে সঙ্গে রাজি হলো। এরপর দু-তিনজন শিশুকে বাড়িতে এনে পড়ানো শুরু করলাম।’ ২০০৩ সাল থেকেই তিনি পথশিশু ও প্রতিবন্ধী শিশুদের নিয়ে কাজ করছেন। স্বামী মোহাম্মদ আলীর সহযোগিতায় এক সময় ঘর ভাড়া করে গড়ে তোলেন শেরপুর শিশুকল্যাণ প্রাথমিক বিদ্যালয়। প্রতিদিন বিকাল ৩টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা চলে পাঠদান। বর্তমানে এ স্কুলের শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৫০।

 

দিন শুরু করেন যেভাবে

ভোরে নামাজ পড়েই মেডিটেশনে বসেন শাহনাজ। মেডিটেশন শেষে অনাথ শিশুদের জন্য মাটির ব্যাংকে টাকা জমান প্রতিদিন। মেডিটেশন সম্পর্কে শাহনাজ বলেন, ‘আমার পরিবারের সবাই মেডিটেশন করে। এতে করে নিজের মধ্যে একাগ্রতা তৈরি হয় এবং লক্ষ স্থির করে সামনে এগুনো যায়।’ শাহনাজ সব সময় স্কুলের সময়ের আগেই স্কুলে পৌঁছান। তিনি প্রতিদিনই ছাত্রদের নতুন কিছু না কিছু পাঠদানের চেষ্টা করেন। তিনি বলেন, ‘বাচ্চাদের যদি শেখাতে না পারি তবে হীনম্মন্যতা এসে যায়। স্কুল শেষ হয় সাড়ে ৪টায়। কখনো এর আগে স্কুল থেকে বের হই না।’

 

অনুপ্রেরণা

শাহনাজ পারভীনের অনুপ্রেরণা হলো তার মা। তিনি বলেন, আমার আম্মা আমার কাছে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তিনি মাইলের পর মাইল হেঁটে নিজে নৌকা বেয়ে স্কুলে পড়াশোনা করেছেন। কলেজে গেছেন। আম্মা কলেজে পড়ার সময়ই আমার জন্ম হয়। আমাকে কোলে নিয়ে কলেজের ক্লাস করতেন। সারা জীবন শিক্ষকতা করেছেন। ২০১১ সালে সহকারী শিক্ষক হিসেবে আম্মা রিটায়ার্ড করেন। আম্মাকে দেখেই শিক্ষকতা পেশার প্রতি ভালোবাসা ভালোলাগা তৈরি হয়। আমি ক্লাস সেভেন এ পড়ার সময় আমি একটা বই পুরস্কার পাই। বইটি ছিল বেগম রোকেয়ার ওপর লেখা একটি বই। বইটি আমার জীবন বদলে দিয়েছে। ওই বই থেকেই জানতে পেরেছি বেগম রোকেয়া নারীদের শিক্ষার জন্য কী পরিমাণ সংগ্রাম করে গেছেন। বাড়ি বাড়ি ঘুরে তিনি মেয়েদের পাঠদান করতেন। উনার প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতার শেষ নেই।

সর্বশেষ খবর