শনিবার, ২১ জানুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা
ভ্রমণ

কামরূপ কামাখ্যার পথে পথে

কামরূপ কামাখ্যার পথে পথে

তীর্থস্থান হলেও কামাখ্যা মন্দির আসামের অন্যতম দর্শনীয় স্থানের একটি। তাই পুণ্যার্থীর পাশাপাশি এখানে পর্যটকের ভিড় থাকে সবসময়। তন্ত্রসাধকদের কাছেও এই কামাখ্যা মন্দিরটি  বিশেষ তীর্থস্থান। ঘুরে এসে লিখেছেন—গাজী মুনছুর আজিজ

 

পাথর খোদাই করে তৈরি মূর্তিগুলো। খোদাই চিত্রও বলা যায়। এ খোদাইচিত্র রয়েছে কামাখ্যা মন্দিরের দেয়ালজুড়ে। ছোট-বড় এসব খোদাইচিত্র বা মূর্তির পাশাপাশি নানা কারুকার্য রয়েছে। এ খোদাইচিত্র ও কারুকাজ দেখেই বলা যায় মন্দিরটি অনেক প্রাচীন। আর এ প্রাচীন মন্দিরে হাজির হই আসাম ভ্রমণের এক দুপুরে। মন্দিরটি আসামের রাজধানী গুয়াহাটি শহরের পশ্চিমে কামরূপ জেলার নীলাচল পর্বতের চূড়ায় অবস্থিত।

 

এখানে মূলত ১০ মহাবিদ্যা অর্থাৎ ভুবনেশ্বরী, বগলামুখী, ছিন্নমস্তা, ত্রিপুরাসুন্দরী, তারা, কালী, ভৈরবী, ধূমাবতী, মাতঙ্গী ও কমলা দেবীর মন্দির আছে। এর মধ্যে ত্রিপুরাসুন্দরী, মাতঙ্গী ও কমলা প্রধান মন্দিরে পূজিত হন। অন্য দেবীদের জন্য পৃথক মন্দির আছে। কামাখ্যা দেবীর এ মন্দির ৫১ সতীপীঠেরও অন্যতম।

 

তন্ত্রসাধকদের কাছে এ মন্দির বিশেষ তীর্থস্থান। এ ছাড়া পুণ্যার্থীদের কাছেও এ মন্দিরের গুরুত্ব অনেক। তবে তীর্থস্থান হলেও এ মন্দির আসামের অন্যতম দর্শনীয় স্থানের একটি। তাই পুণ্যার্থীদের পাশাপাশি এখানে পর্যটকদের ভিড়ও দেখি বেশ।

ঘুরে ঘুরে মন্দিরটি দেখি। বিশাল জায়গা জুড়ে মন্দিরটির অবস্থান। সর্বত্রই পূজায় ব্যস্ত পুণ্যার্থীরা। মন্দিরদের অনেক স্থানেই দেখি নানা ধরনের ফুল নিয়ে বসে আছেন বিক্রেতারা। যারা পূজা দিতে আসেন তারা এসব ফুল কিনেন। পুণ্যের আসায় অনেকে নানা ধরনের মানত নিয়ে আসেন এখানে। কেউ মোম জ্বালান, আবার কেউ দেন পশু বলিদান।

 

মন্দির প্রাঙ্গণজুড়ে অনেক আলোকচিত্রী ঘুরেন কামাখ্যা মন্দিরের নানা অ্যাঙ্গেলের ছবি নিয়ে। মূলত এসব আলোকচিত্রী মন্দিরে আসা পুণ্যার্থী ও পর্যটকদের ছবি তুলে দেন টাকার বিনিময়ে।

এ মন্দিরে মোট চারটি কক্ষ আছে। একটি গর্ভগৃহ ও তিনটি মণ্ডপ। যেগুলোর স্থানীয় নাম— চলন্ত, পঞ্চরত্ন ও নাটমন্দির। গর্ভগৃহটি পঞ্চরথ স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত। অন্যগুলোর স্থাপত্য তেজপুরের সূর্যমন্দিরের সমতুল্য। এগুলোতে খাজুরাহো বা অন্যান্য মধ্যভারতীয় মন্দিরের আদলে নির্মিত খোদাইচিত্রও রয়েছে। আর মন্দিরের চূড়াগুলো উল্টো মৌচাকের মতো। গর্ভগৃহটি মূলত ভূগর্ভস্থ একটি গুহা। এখানে কোনো মূর্তি নেই। শুধু একটি পাথরের সরু গর্ত আছে। এ গর্ভগৃহটি ছোট ও অন্ধকারাচ্ছন্ন। সরু খাড়া সিঁড়ি পেরিয়ে এখানে পৌঁছাতে হয়।

 ইতিহাস থেকে জানা যায়, বর্তমানের এ মন্দির ভবনটি অহোম রাজাদের রাজত্বকালে নির্মিত। এর মধ্যে প্রাচীন কোচ স্থাপত্যটি সযত্নে রক্ষিত আছে। খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় সহস্রাব্দের মাঝামাঝি সময় মন্দিরটি ধ্বংসপ্রাপ্ত হলে ১৫৬৫ সাল নাগাদ কোচ রাজা চিলরায় মধ্যযুগীয় মন্দিরের স্থাপত্যশৈলী অনুসারে মন্দিরটি পুনরায় সংস্কার ও নির্মাণ করে দেন। এখন যে মৌচাক-আকারের চূড়া দেখা যায় তা নিম্ন আসামের মন্দির স্থাপত্যের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য। মন্দিরের বাইরেও গণেশ ও অন্যান্য হিন্দু দেবদেবীর খোদিত মূর্তির দেখা মেলে।

 

মন্দির প্রাঙ্গণে কামাখ্যা নাট্য সমিতি, কামাখ্যা পুরোহিত (পাণ্ডা) সমাজ, কামাখ্যা সংগীত বিকাশ কেন্দ্র, কামাখ্যা বালক প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রমও চলে।

 

কলকাতা থেকে এ মন্দিরে পূজা দিতে আসা দম্পতি অশোক দত্ত ও সীমা দত্ত বলেন, পুণ্যের আশায় আমাদের বাপ-দাদাদের অনেকেই এখানে পূজা দিয়েছেন। সে ধারাবাহিকতায় আমরাও আসছি। আসলে পুণ্যার্থীদের কাছে এ মন্দির অনেক গুরুত্বের। এখানে বার্ষিক অম্বুবাচী মেলাসহ সারা বছরই পূজা-পার্বণের আয়োজন হয়ে থাকে। বেশ কিছুক্ষণ ঘুরে বের হই মন্দির থেকে। তারপর আসাম শহরের বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান ঘুরে বিকালে উঠি শিলংয়ের গাড়িতে।

 

যাওয়ার আগে জেনে নিন

কীভাবে যাবেন

আসাম যাওয়ার জন্য মেঘালয়ের ডাউকি বর্ডার সহজ মাধ্যম। কলকাতা থেকে গুয়াহাটি বিমানেও যাওয়া যায়। তবে খরচ বেশি। সিলেটের তামাবিল বর্ডার পার হলেই ডাউকি বর্ডার। ডাউকি থেকে ট্যাক্সি পাবেন শিলংয়ের। ১ হাজার ৫০০ থেকে ২ হাজার ৫০০ রুপিতে এ ট্যাক্সিতে ৪ জন শিলং যেতে পারবেন। শিলংয়ের পুলিশ বাজার থেকে ট্যাক্সি বা সুমো জিপ পাবেন গুয়াহাটির। ভাড়া ট্যাক্সিতে ১৫০ রুপি আর সুমো বা জিপে ৮০ রুপি প্রতিজন। গুয়াহাটির পল্টনবাজার বা রেলস্টশন থেকে কামাখ্যা মন্দির যাওয়ার জন্য লোকাল বাস পাবেন।

ঢাকা থেকে রাতের বাসে বা ট্রেনে সিলেট গিয়ে সেখান থেকে অটোরিকশায় তামাবিল বর্ডার। এ ছাড়া কমলাপুর থেকে শিলংয়ের উদ্দেশে বিআরটিসি-শ্যামলী বাস ছাড়ে। এ বাসে যেতে যোগাযোগ করতে পারেন কমলাপুরের বিআরটিসি-শ্যামলী বাস কাউন্টারে।

 

আবাসন ও রেস্তোরাঁ

থাকার জন্য গুয়াহাটির পল্টনবাজার ও রেলস্টশনের আশপাশে অনেক হোটেল আছে। ভাড়া সিঙ্গেল রুম ৭০০ থেকে ২ হাজার রুপি। খাওয়া-দাওয়ার জন্য পল্টনবাজার ও রেলস্টেশন এলাকায় অনেক হোটেল পাবেন। ১০০ থেকে ৩০০ রুপিতে ভাত-মাছ-মাংস বা রুটি পাবেন।

 

কেনাকাটা

পল্টনবাজার, পানবাজার বা স্টেশনরোড গুয়াহাটির বাণিজ্যিক প্রাণকেন্দ্র বলা চলে। পোশাক-প্রসাধনী বা গিফট সবই পাবেন এসব বাজারে। আর আসামের চা কেনার জন্য স্টেশন রোডে রয়েছে অনেকগুলো দোকান।

 

মনে রাখুন

গুয়াহাটির একস্থান থেকে অন্যস্থান যাওয়ার জন্য লোকাল বাস পাবেন। ভাড়া ১০ থেকে ২০ রুপি। এ ছাড়া ট্যাক্সি রিজার্ভ করে ঘুরতে পারেন। পাসপোর্ট, জাতীয় পরিচয়পত্র, প্রতিষ্ঠানের পরিচয়পত্র, এনওসিসহ প্রয়োজনীয় কাগজপত্রের একাধিক ফটোকপি রাখুন। হোটেল ভাড়া, ডলার ভাঙানো বা বর্ডার পার হওয়ার জন্য দরকার হবে।

সর্বশেষ খবর