শনিবার, ৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

ঐতিহ্যের ভারতেশ্বরী হোমস

তানিয়া জামান

ঐতিহ্যের ভারতেশ্বরী হোমস

প্রশংসনীয় সব মানবীয় গুণাবলি নিয়ে বেড়ে উঠবে প্রতিটি মেয়ে। এই পৃথিবী যেন তার জন্য স্বাপদসংকুল না হয়। যেন জয় করতে পারে যে কোনো প্রতিকূল পরিস্থিতি। এমন মন্ত্রে দীক্ষিত ভারতেশ্বরী হোমসের ছাত্রীরা। রাজধানী ঢাকা নগরী থেকে মাত্র ৬৫ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে টাঙ্গাইল জেলার সদর থেকে ৩০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে মির্জাপুর থানা। এই সদর শহরে রণদা প্রসাদ সাহা নিজের প্রপিতামহী ভারতেশ্বরীর নামে ১৯৪৫ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ভারতেশ্বরী হোমস। তদানীন্তন কালে শ্রীমতি ভারতেশ্বরী দেবী সুশিক্ষিত ও বিচক্ষণ বুদ্ধিসম্পন্ন নারী হিসেবে খ্যাত ছিলেন। অনাথ রণদা প্রসাদ সাহাকে তিনিই একমাত্র স্নেহ দিয়ে ছেলেবেলায় শিক্ষা দেওয়ার আন্তরিক চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু দুরন্ত রণদাকে বিদ্যালয়মুখী করতে পারেননি। পরবর্তী সময়ে শ্রী রণদা প্রসাদ সাহা যখন জীবন সংগ্রামে জয়ী হলন তখন এই পুণ্যময়ীর কথা স্মরণ করেন। তার দেখানো পথ অনুসরণ করে বুঝতে পেরেছিলেন শিক্ষাই জাতির উন্নতির সোপান। শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত হয়ে যে সমাজে নারীরা পিছিয়ে রয়েছে, কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজে বাস করে নিজেকে তিলে তিলে হারিয়ে ফেলেছে, সেই সমাজ থেকে নারীকে তুলে নিয়ে আত্মনির্ভরশীল করা প্রয়োজন। সম্মানের সঙ্গে তাদের বেঁচে থাকার যোগ্যতা অর্জন করার মানসে নারী শিক্ষার প্রয়াস চালান আর পি সাহা। রণদা প্রসাদ সাহা তারই পরম আরাধ্য প্রপিতামহীর স্মৃতি চির অম্লান করে রাখার জন্য ভারতেশ্বরী হোমস নামে ছাত্রীদের আবাসিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন।

 

বাংলাদেশের কৃতী সন্তান শ্রী রণদা প্রসাদ সাহা ১৮৯৬ সালের নভেম্বর মাসের উত্থান একাদশী তিথিতে টাঙ্গাইল জেলার মির্জাপুর গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। বাবা দেবেন্দ্রনাথ পোদ্দার ও মা কুমুদিনী দেবীর সংসার ছিল অতি সাধারণ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির। বিনা চিকিৎসায় মাকে মারা যেতে দেখে প্রতিজ্ঞা করেন সামর্থ্য থাকলে গরিব দুঃখীদের বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা দেবেন। কৈশর বয়সে অনেক সংগ্রাম করেছেন। কঠোর সাধনা ও তিতিক্ষার ফলে তিনি বিপুল ঐশ্বর্যের অধিকারী হন। সেই সম্পদই দেশের মানুষের কল্যাণে ব্যয় করেন। স্থাপন করেন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। তার প্রতিষ্ঠিত কুমুদিনী কলেজ, কুমুদিনী হাসপাতাল, দেবেন্দ্র কলেজ ও ভারতেশ্বরী হোমস অক্ষয় কীর্তি হয়ে আছে এখনো। জনগণকে বহুমাত্রিক সেবা প্রদানে ১৯৪৭ সালে গঠন করেন কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট। এর অধীনে উইমেন মেডিকেল কলেজ, কুমুদিনী নার্সিং স্কুল, কলেজ, পানি শোধনাগার, নিজস্ব পাওয়ার প্লান্ট, সবজি চাষ, মাছ চাষ, ডেইরি ফার্মসহ শিক্ষক-ছাত্রীর আবাসিক ব্যবস্থা রয়েছে মির্জাপুরের একই চত্বরে।

 

উদ্দেশ্য

নারী উন্নয়ন কেন্দ্রিক এই প্রতিষ্ঠানের রয়েছে নানাবিধ নারীর কল্যাণকর উদ্দেশ্য। এখানে অধ্যয়নরত ৮০০ ছাত্রীর শিক্ষাগত যোগ্যতা, সহায়ক কর্মের দক্ষতা, চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে সমৃদ্ধ করতে যে উদ্দেশ্যগুলো হলো—

 

► নারীদের সৎ, সাহসী, সুশিক্ষিত ও সুশৃঙ্খল মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা।

► কর্মঠ, সামাজিক ও সহনশীল করা।

► যে কোনো বিরূপ সময়, প্রতিবেশ ও পরিবেশের সব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় মানবীয় গুণাবলিতে উদ্ভাসিত অবিচল ও আত্মপ্রত্যয়ী মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা।

►স্বতন্ত্র সত্তা হিসেবে পরিবারের ভিতর ও বাইরে স্বাবলম্বী হওয়া।

 

এসব উদ্দেশ্য অর্জনের মানসে ভারতেশ্বরী হোমসে  যোগ্য ও দক্ষ শিক্ষক-শিক্ষিকারা পঞ্চম শ্রেণি থেকে উচ্চমাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত শিক্ষা দিয়ে থাকেন। বিদ্যালয়টি ১৯৪৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হলেও ১৯৬২ সাল থেকে উচ্চমাধ্যমিক শ্রেণি খোলা হয়। স্বাধীনতার পরপরই উত্তপ্ত রাজনীতি ও উচ্ছৃঙ্খলতার কারণে ১৯৭৩ সালে উচ্চমাধ্যমিক শাখা বন্ধ করে দেওয়া হয়। এসএসসি পাসের পর অন্য কলেজে ভর্তি হওয়া, আবাসিক সমস্যা, সুন্দর পরিবেশের অভাব ইত্যাদি সমস্যার কথা বিবেচনা করে কর্তৃপক্ষ ১৯৮৩ সালে এই প্রতিষ্ঠান আবার উচ্চমাধ্যমিক শাখা খোলেন। উচ্চ মাধ্যমিকে বিজ্ঞান, মানবিক ও বাণিজ্য শাখা রয়েছে। শিক্ষার সুষ্ঠু, সুন্দর পরিবেশে ছাত্রীদের ফলাফল অত্যন্ত সন্তোষজনক। তারা আদর্শ ব্যক্তিত্বে গড়ে ওঠে। ভর্তি ব্যবস্থা প্রাইমারি শাখাটি একটি পরীক্ষামূলক প্রকল্প। কুমুদিনী কমপ্লেক্স ও পাশের এলাকার ছাত্র-ছাত্রীরা ভর্তি হতে পারে। এ শাখায় ছাত্রছাত্রী অনাবাসিক। স্কুল শাখায় ৫ম ও ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি করা হয়। ভর্তি সংক্রান্ত বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয় বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক পত্রিকায়। বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী নির্দিষ্ট দিনে ভর্তি পরীক্ষা, পরবর্তী দিনে নির্বাচিতদের ডাক্তারি ছাড়পত্র পাওয়া সাপেক্ষে ভর্তি করা হয়। এদিকে কলেজ শাখায় মন্ত্রণালয়, শিক্ষা অধিদফতর ও বোর্ডের জারিকৃত নিয়ম অনুযায়ী জাতীয় দৈনিকে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের মাধ্যমে ভর্তি করা হয়। এ ক্ষেত্রেও ডাক্তারি ছাড়পত্র আবশ্যক। ছাত্রীদের অত্যন্ত দায়িত্বশীল ও জিনিসপত্রের প্রতি যত্নশীল হওয়ার জন্য ১৯৯৩ সাল থেকে মাধ্যমিক শাখার পোশাক ব্যক্তিগতভাবে কিনতে হবে। তবে বিদ্যালয়ের সমতা ও শৃঙ্ক্ষলা রক্ষা করার জন্য কুমুদিনী চত্বরে ন্যায্যমূল্যে বিপণি থেকে কিনে ছাত্রীনিবাসে যেতে হবে। বাইরের পোশাক এখানে একদমই গ্রহণযোগ্য নয়। এ ছাড়া পড়াশোনার সরঞ্জামাদি, পোশাকের অন্যান্য অনুষঙ্গ বাইরে থেকে কেনা যাবে। কেউ চাইলে ন্যায্যমূল্য বিপণি থেকেও কিনতে পারবে।

 

ছাত্রীনিবাসের নিয়মাবলি

► প্রত্যেক ছাত্রীকে অবশ্যই ছাত্রীনিবাসে থাকতে হবে।

► কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া ছাত্রীরা হোমসের বাইরে যেতে পারে না।

► অসুস্থ হলে দ্রুত সিক রুম ইনচার্জকে জানাতে হবে।

► চিঠিপত্র পোস্টকার্ডের মাধ্যমে লিখতে হবে।

► ছাত্রীবাসে কর্মাধ্যক্ষার আদেশানুযায়ী ডিউটি করতে প্রত্যেক ছাত্রী বাধ্য থাকবে।

► অভিভাবক সাক্ষাৎ দিবস ব্যতীত অন্য দিনে দেখা করতে পারবে না।

► বৈধ অভিভাবক পরিচয়পত্রসহ সাক্ষাৎ করতে পারবে।

► বাইরের খাবার, নুডলস, পিঠা পায়েশ দেওয়া যাবে না।

► হোমসের আইনশৃঙ্ক্ষলা ভঙ্গকারীর বহিষ্কারের বিষয়ে কোনো আবেদন কার্যকর নয়।

►এখানে বাল্যবিবাহ নিষিদ্ধ। বিদ্যালয় ছাত্রীদের বয়ঃক্রম অনুযায়ী বিয়ের প্রশ্নই উঠে না। এখানে বিবাহিত ছাত্রী ভর্তিযোগ্য না। বিবাহিতা প্রমাণে ছাত্রীর ভর্তি বাতিল হবে।

► ছাত্রীদের মোবাইল ফোন ব্যবহার ও বহন নিষিদ্ধ।

 

ছাত্রীদের দৈনিক কর্মসূচি

এখানকার ছাত্রীরা প্রতিদিন সকাল ৫টায় ঘুম থেকে ওঠে। আধাঘণ্টার মধ্যে নিজেদের পরিচ্ছন্নতার কাজ করে নেয়। সাড়ে ৫টা থেকে সাড়ে ৬টার মধ্যে তাদের শরীরচর্চা ও প্রাতরাশ শেষ হয়। তারপর প্রাতকালীন পাঠ চলে ৭টা ২৫ মিনিট পর্যন্ত। পড়াশেষে সমাবেশ চলে ৭টা ৪০ মিনিট পর্যন্ত। জুনিয়র শাখার ক্লাসের সময় ৭টা ৪০ মিনিট থেকে ১টা ১০ মিনিট পর্যন্ত। সিনিয়র শাখার ক্লাস চলে ৭টা ৪০ মিনিট থেকে ২টা পর্যন্ত। দুপুরের খাবার সময় থাকে ১টা ১০ থেকে ২টার মধ্যে। বৈকালিক ও নৈশকালীন পাঠ হয় সাড়ে ৫টা থেকে সাড়ে ৭টা পর্যন্ত। তারপর আবার অনুশীলন এবং খাওয়া। এগুলো শেষ করতে আধা ঘণ্টা ব্যয় করে। সিনিয়র গ্রুপের দ্বিতীয় পাঠ থাকে রাত ৮টা থেকে ১০টা পর্যন্ত। তাদের বৈকালিক ও নৈশকালীন পাঠ সাড়ে ৫টা থেকে ৮টা পর্যন্ত। অনুশীলন ও খাবারের সময় আধা ঘণ্টা। জুনিয়র গ্রুপেরও দ্বিতীয় পাঠ সাড়ে ৮টা থেকে ১০টা পর্যন্ত। তারপর রাত ১১টায় ঘরের আলো নিভিয়ে দেওয়া হয়।

 

হোমসের বিশেষ বৈশিষ্ট্য

বাংলাদেশ জুড়ে এমন কী দেশের বাইরে ভারতেশ্বরী হোমস শিক্ষার পাশাপাশি সহপাঠ্য কার্যক্রমে সুপরিচিত বিদ্যালয়ের ছাত্রীরা নিজেদের কাজ নিজেরা করে অভ্যস্ত। নিজেদের থাকার ঘর, আঙিনার নর্দমা, নিজেদের ব্যবহূত বাথরুম নিজেরাই হোস্টেল কেয়ার টেকিং স্টাফের সহযোগিতায় পরিষ্কার করে থাকে। বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে রান্নার কাজে সহযোগিতা করে। খাওয়া-দাওয়া তত্ত্বাবধান করে এবং খাওয়ার পর পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার কাজ করে। এই প্রতিষ্ঠানের মহান প্রতিষ্ঠাতার আদর্শই এই প্রতিষ্ঠানের আলোকবর্তিকা। তার আদর্শকেই চিরঞ্জীব করতে সব অভিভাবকের সহযোগিতা একান্তভাবে কাম্য। কেননা মেয়েকে আদর্শ করে গড়ে তোলা শিক্ষক ও অভিভাবকের যৌথ দায়িত্ব।

সর্বশেষ খবর