শনিবার, ৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা
ভ্রমণ

অবিশ্বাস্য নাফাখুম

অবিশ্বাস্য নাফাখুম

বাংলাদেশের অন্যতম দর্শনীয় স্থানের একটি হলো বান্দরবানের নাফাখুম। তাই এখানে পর্যটকদের ভিড়ও থাকে সবসময়। ঋতুভেদে প্রকৃতির অপূর্ব লীলাখেলা রচিত হয় এখানে।

 

বাংলাদেশের দুর্গম ঝরনাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে দুর্গম ঝরনা হচ্ছে নাফাখুম। নাফাখুম ঝরনার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এক অপার আশ্চর্যের নাম। এটি বান্দবান জেলায় অবস্থিত। চট্টগ্রাম থেকে ৭৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে পাহাড়ি শহর বান্দরবানের অবস্থান। পর্যটকদের পছন্দের শীর্ষে অবস্থানকারী জেলাগুলোর মধ্যে বান্দরবান অন্যতম। আয়তনে ৪৪৭৯ বর্গকিলোমিটার। বান্দরবান জেলার থানচি একটি উপজেলার নাম। এই উপজেলার মারমা অধ্যুষিত একটি এলাকার নাম রেমাক্রী। বান্দরবান জেলার যে স্থানগুলোর কারণে এই জেলাটি পর্যটকদের পছন্দের শীর্ষে তার একটি হলো নাফাখুম ঝরনা। আর এই রেমাক্রী গ্রামটিকে কেন্দ্র করেই এই নাফাখুম ঝরনাটি অবস্থিত। রেমাক্রী থেকে প্রায় ২-৩ ঘণ্টার হাঁটা দূরত্বে এর অবস্থান। রেমাক্রী খালের পানি প্রবাহ এই স্থানে এসে বাঁক খেয়ে প্রায় ৩০ ফুট নিচে পতিত হয়ে অসাধারণ এই ঝরনাটির সৃষ্টি করেছে। প্রকৃতির ছোঁয়ায় যেন ভিন্ন এক আবেদন।

 

স্থানীয় ভাষায় খুম শব্দের অর্থ ঝরনা। এ ছাড়া রেমাক্রী নদীতে এক ধরনের মাছ পাওয়া যায়, যার নাম নাফা মাছ। এই মাছের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এই মাছ সবসময় স্রোতের ঠিক বিপরীত দিকে চলে। বিপরীত দিকে চলতে চলতে মাছগুলো একসময় লাফিয়ে ঝরনা পার হতে যায় ঠিক তখনই উপজাতীয়রা লাফিয়ে ওঠা মাছগুলোকে জাল বা কাপড় দিয়ে ধরে ফেলে। এ থেকে এই ঝরনার নাম দেওয়া হয়েছে নাফাখুম ঝরনা।

ঢাকা থেকে বান্দরবান যেতে ট্রেনে, বাসে বা প্লেনে প্রথমে চট্টগ্রাম তারপর সেখান থেকে বান্দরবান যেতে হবে। বান্দরবান হতে ৭৯ কিমি. দূরে অবস্থিত থানচি। বান্দরবান হতে পাবলিক বাস অথবা জিপ অথবা চান্দের গাড়িতে করে থানচি যেতে হবে। পথে সুন্দর সুন্দর দৃশ্য উপভোগ করতে করতে আপনি যেতে পারবেন। থানচি থেকে যেতে হবে রেমাক্রী বাজার। রেমাক্রী বাজার হতে নাফাখুম ঝরনার কাছে যাওয়ার একমাত্র অবলম্বন সাঙ্গু নদীর নৌকা। এখানে আপ-ডাউন ইঞ্জিনচালিত নৌকা পাওয়া যায়। এই নৌকা ভাড়া করার জন্য পর্যটকদের থানচি ঘাটে অবস্থিত নৌকাচালক সমিতির সঙ্গে কথা বলতে হয় এবং সেখান থেকে বিজিবির তালিকাভুক্ত একজন গাইড নিতে হয়। এই পথে ভ্রমণে গাইড নেওয়া বাধ্যতামূলক।

 

বর্ষাকালে ঝরনা দিয়ে তীব্র গতিতে পানি নিচে পড়ে এ সময় উপর থেকে আছড়ে পড়া পানির প্রচণ্ড আঘাতে ঝরনার চারপাশে অনেকটা স্থান জুড়ে সৃষ্টি হয় ঘন কুয়াশার। নাফাখুম ঝরনার সঙ্গে আকাশে রৌদ্র-মেঘের লুকোচুরি আর নিচে খরস্রোতা নদীর ধেয়ে আসা ছল ছল শব্দ। সব মিলিয়ে এক অপরূপ সৃষ্টি। ঝরনার চারপাশে পাহাড়-পর্বত, নদী, পাথরের স্তূপ ও খাল আপনাকে প্রতিটি মুহূর্ত আনন্দ দিবে। এখানকার কিছু কিছু পাহাড় অনেক উঁচু। সেই পাহাড়গুলোর চূড়া মেঘের আবরণে ঢাকা পড়ে। সেই সঙ্গে ঝরনার সুমধুর গান তো রয়েছেই। পাশাপাশি বাতাসের সঙ্গে পানির বিন্দু দেহ মন সব আনন্দে ভিজিয়ে দেয়। বান্দরবান থেকে নাফাখুম যাওয়ার পথে পর্যটকদের তিন্দু ও বড় পাথর নামক দুটি স্থান পাড়ি দিতে হয়। অসাধারণ সুন্দর এই তিন্দুতে একটি বিজিবি ক্যাম্প রয়েছে। তিন্দুতে পর্যটকদের জন্য রাতে থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। তিন্দু ও বড় পাথর স্থান দুটি পাড়ি দেওয়ার অভিজ্ঞতা অসাধারণ। তিন্দু থেকে কিছুটা পথ সামনে এগোলেই বড় পাথর। এই পাথর নিয়ে রয়েছে স্থানীয়দের বিশ্বাস। তাদের দাবি চলতি পথে এই পাথরকে সম্মান প্রদর্শন করতে হয় নতুবা যেকোনো ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। লোকজন এই পাথরকে রাজা পাথর বলে সম্বোধন করেন। বড়টি একটি বিশাল আকারের পাথর এবং এর আশপাশে আরও বেশ কিছু ছোট ছোট পাথর নদীর প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করছে। এই স্থানে এলে নৌকা থেকে নেমে হেঁটে পাড়ি দিতে হয়। বহু বছর আগে ভূকম্পের ফলে পাশের পাহাড় থেকে বিশাল বিশাল আকারের এই পাথরগুলো নদীতে এসে পড়েছে।

 

বড় পাথর থেকে ঘণ্টা খানেকের পথ সামনে এগোলে রেমাক্রী বাজারে পৌঁছাবেন। বাজারের পাশেই পর্যটকদের জন্য একটি রেস্ট হাউস রয়েছে। রেমাক্রী বাজার হতে আড়াই ঘণ্টার মতো হাঁটা দূরত্বে নাফাখুম ঝরনা অবস্থিত। বাজারের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীর কিনারা ধরে হেঁটে নাফাখুম ঝরনায় যেতে হয়। এই পথের দুই পাশের মনোরম দৃশ্যের কারণে আপনি হারিয়ে যাবেন অন্য কোনো ভুবনে। যেন এর সৃষ্টি পৃথিবীতে নয় পৃথিবীর বাইরে কোথাও। এই পথে নাফাখুম ঝরনার কাছে যেতে বেশ কয়েক কোমর থেকে বুক সমান পানি পাড়ি দিতে হয়। তাই অতিরিক্ত সাবধান থাকতে হয়। আবার অনেক ক্ষেত্রে পথে যেতে যেতে টারজানের মতো গাছের লতা-পাতায় ঝুলেও পথ পাড়ি দিতে হয়। এভাবে একের পর এক রোমাঞ্চকর বাধা পেরিয়ে অবশেষে দেখা মিলবে নাফাখুম ঝরনার। অবশ্যই মনে রাখবেন এই পথে ভ্রমণে গাইড নেওয়া বাধ্যতামূলক। শুধু তাই নয় নৌকাচালক সমিতির অফিসে পর্যটকদের নাম, ঠিকানা, মোবাইল নম্বর, নৌকার মাঝির নাম রেজিস্টার করে ভ্রমণের অনুমতি নিতে হয়।

 

খরচের হিসাব

ঢাকা হতে বান্দরবান নন-এসি বাসে খরচ হবে ৩৫০ টাকা হতে ৪০০ টাকা। বান্দরবান হতে থানচি পাবলিক বাস ২০০ টাকা; বান্দরবান হতে থানচি জিপ/চান্দের গাড়ি ৪,০০০/৫,০০০ টাকা; থানচি হতে রেমাক্রী নৌকা ভাড়া ৪,৫০০ টাকা; রেমাক্রীতে পর্যটক যতদিন থাকবেন তার প্রতি রাতের জন্য নৌকা ভাড়া বাবদ ১,৫০০ টাকা করে অতিরিক্ত গুনতে হয়।

গাইড থানচি হতে রেমাক্রী পর্যন্ত নিবে ৫০০ টাকা; রেমাক্রী হতে নাফাখুম পর্যন্ত ৬৫০ টাকা। খাবার খরচ মোটামুটি ১০০/১২০ টাকার মধ্যে হরেক রকমের খাবার খাওয়া যায়। থাকার খরচ থানচিতে জনপ্রতি ৬০/৭০ টাকা আর রেমাক্রীতে জনপ্রতি ৬০/৭০ টাকা। এ ছাড়া যাত্রা শুরু করার আগে পর্যটকদের নিজ নিজ নাম, ঠিকানা, পিতার নাম, মোবাইল নম্বর প্রভৃতি একটি কাগজে লিখে সেই কাগজটি ১০/১২টি ফটোকপি করে সঙ্গে নিতে হবে। পথিমধ্যে বিভিন্ন স্থানে এই কাগজ জমা দিতে হয়।

 

আবাসন ও খাওয়া

পর্যটকদের থাকার জন্য থানচিতে একটি রাষ্ট্রীয় রেস্ট হাউস রয়েছে। আপনি এখানে থাকতে চাইলে আগে থেকে প্রশাসনের অনুমতি নিতে হবে। এ ছাড়া থানচি নৌকা ঘাটে পর্যটকদের থাকার জন্য স্থানীয় লোকজন কিছু ঘর বানিয়ে রেখেছে। মজার ব্যাপার এসব ঘরে থাকার জন্য অতিরিক্ত কোনো টাকা দিতে হয় না। ওই ঘরের মালিকের দোকানে তিন বেলা খাওয়া-দাওয়া করলেই থাকা ফ্রি। তাই থানচিতে থাকা এবং খাওয়ার জন্য এটাই হতে পারে আপনার জন্য আদর্শ জায়গা। বান্দরবান থেকে নাফাখুম যাওয়ার পথে পর্যটকদের তিন্দু ও বড় পাথর নামক দুটি স্থান পাড়ি দিতে হয়। তিন্দুতে পর্যটকদের থাকার জন্য উপজাতীয়দের ঘর রয়েছে। নির্ধারিত ভাড়ার বিনিময়ে উপজাতীয়রা এসব ঘর পর্যটকদের কাছে ভাড়া দিয়ে থাকে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর