১৩ বছর বয়সে ঘর ছাড়েন এবং স্কুল থেকে ঝরে পড়েন। পড়াশোনা ছেড়ে খামারে কাজ শুরু করেন। সেখান থেকে ইন্ডিয়ানা পুলিশ বাহিনীর ঘোড়ার গাড়ি রং করার চাকরি নেন। ১৪ বছর বয়স থেকে তিনি খামারে কৃষকের কাজ করেন
সাফল্যের কোনো বয়স লাগে না। কর্নেল হারল্যান্ড স্যান্ডার্স তার উদাহরণ। বিশ্ববাসী স্যান্ডার্সকে বিখ্যাত ফুড শপ কেএফসির মালিক হিসেবেই চেনেন। কর্নেল স্যান্ডার্সের হাতেই এসেছে মজাদার কেএফসির ফ্রাইড চিকেনের স্বাদ। বিখ্যাত এই ব্যক্তি সাফল্যের দেখা পান ৬০ বছর বয়সে।
দুনিয়া জোড়া যে কোম্পানিটির খ্যাতি, সেই কেএফসির মলিক স্যান্ডার্স জন্মগ্রহণ করেন ১৮৯০ সালের ৯ সেপ্টেম্বর ইন্ডিয়ানার হেনরিভ্যালিতে। বাবা উইলবার ডেভিড এবং মা মার্গারেট অ্যানে স্যান্ডার্স। তিন সন্তানের মধ্যে স্যান্ডার্স ছিলেন সবার বড়। বাবা ছিলেন নরম ও স্নেহপরায়ণ। তিনি ৮০ একরের একটি ফার্মে কাজ করতেন। ১৮৯৩ সালে এক দুর্ঘটনায় স্যান্ডার্সের বাবার পা ভেঙে যায়। তার দুই বছর পরে মাত্র ৫ বছর বয়সে স্যান্ডার্স বাবাকে হারান। বাবার মৃত্যুর পর মা মার্গারেট অ্যানে ১৯০২ সালে আবার বিয়ে করেন। সৎ বাবার পরিবার ভালো লাগেনি স্যান্ডার্সের। তখন তারা ইন্ডিয়ানার গ্রিনউডে চলে আসেন।
ছেলেবেলা থেকেই স্যান্ডার্স দরিদ্রতার মাঝে বড় হয়েছেন। মাত্র ১৩ বছর বয়সে ঘর ছাড়েন এবং স্কুল থেকে ঝরে পড়েন। পড়াশোনা ছেড়ে খামারে কাজ শুরু করেন। সেখান থেকে ইন্ডিয়ানা পুলিশ বাহিনীর ঘোড়ার গাড়ি রং করার চাকরি নেন। ১৪ বছর বয়স থেকে তিনি খামারে খেতমজুরের কাজ করেন। ১৯০৬ সালে ইন্ডিয়ানার নিউ আলবানিতে গাড়ির কন্ডাক্টরের চাকরি করেন। বছরখানেক চাকরি করে ছেড়ে দেন। এরপর কাজ নেন একটি কামারশালায়। সেখানে তিনি দুই মাসও টেকেননি। এরপর কয়লাচালিত ট্রেনের ছাইয়ের টাংকি পরিষ্কারের কাজ নেন। ১৬ বছর বয়সে কাজ পান ফায়ারম্যানের। এরপর নর্থফোক এবং ওয়েস্টার্ন রেলস্টেশনে দিনমজুরের কাজও করেন। স্যান্ডার্সের স্বভাবই হয়তো এমন ছিল যে, বেশি দিন এক জায়গায় কাজ করতে পারতেন না। দুই বছর পর আবার তিনি ফিরে যান ইলিনয় সেন্ট্রাল রেলরোডে। কাজ নেন ফায়ারম্যানের। ১৭ বছরের মাথায় মোট চারবার চাকরি হারিয়েছিলেন স্যান্ডার্স। এরপর স্যান্ডার্স এক্সটেনশন ইউনিভার্সিটিতে আইন বিষয় নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে লিটল রক নামের একটি প্রতিষ্ঠানে বছর তিনেক প্র্যাকটিস করে কিছু উপার্জন করেন। সেখানেও বাধা পান। এক ক্লায়েন্টের সঙ্গে আদালতে ঝগড়া করে আইন পেশার ইতি ঘটান। এরপর অর্থাভাবে আইন পেশাকেও বিদায় জানান। সেখান থেকে ফিরে পেনসিলভেনিয়ার রেলস্টেশনে চাকরি নেন। ১৯১৬ সালে স্যান্ডার্স ও পরিবার জেফারসনভাইলে চলে আসলে তিনি একটি বীমা কোম্পানিতে চাকরি নেন। সেই চাকরি হারিয়ে সেলসম্যানের কাজ করেন। ১৯১৮ সালে ১৮ বছর বয়সে বিয়ের পিঁড়িতে বসেন এবং ১৯ বছর বয়সেই বাবা হন স্যান্ডার্স। কিন্তু ২০ বছর বয়েসে তার স্ত্রী তাকে ফেলে রেখে চলে যায় আর কন্যা সন্তানটিকেও নিয়ে যায় সঙ্গে। ১৯২০ সালে তিনি নৌকার কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন। এই কোম্পানি থেকে তিনি নদীতে চলা ডিঙ্গি নৌকা বিক্রি করতেন। তার কোম্পানির নামে তিনি শেয়ারও চালু করেন। যার বেশিরভাগ মালিক ছিলেন তিনি নিজেই এবং কোম্পানির সচিব নির্বাচিত হন। এটাই ছিল তার ক্যারিয়ারের প্রথম এবং তাত্ক্ষণিক কোনো সাফল্য। ১৯২২ সালে ইন্ডিয়ানার কলম্বাসে চেম্বার অব কমার্স নামের একটি কোম্পানিতে সচিবের চাকরি নেন। সেই চাকরিটিও ভালো না লাগায় এক সময় চাকরি ছেড়ে দেন। শুধু তাই নয়, তার ডিঙ্গি নৌকার কোম্পানিটিও ৩২ হাজার ডলারে বিক্রি করে দেন। যার বর্তমান বাজার মূল্য ৩,০৯,০০০ ডলার। সেই অর্থ দিয়ে হাইড্রোকার্বন গ্যাসের বাতি উৎপাদনকারী কোম্পানি চালু করেন। তার বৈদ্যুতিক বাতির এই কোম্পানিটিও বেশিদিন টেকেনি। কলোনিল স্যান্ডার্স বৈদ্যুতিক বাতির ব্যবসায় ক্ষতির সম্মুখীন হন। এরপর পাড়ি জমান কেন্টাকির উইনচেস্টারে। সেখানে তিনি ম্যাচিলিন নামের একটি টায়ার কোম্পানিতে সেলসম্যানের চাকরি নেন। ১৯২৪ সালে কোম্পানিটি বন্ধ হলে নিকোলাসভ্যালির এক স্টেশনে চাকরি নেন এবং অদ্ভুত ব্যাপার হলো ১৯৩০ সালে স্টেশনটিও বন্ধ হয়ে যায়। একই বছরে ক্যান্টাকির নর্থ ক্যারোলাইনা এলাকায় শীল অয়েল কোম্পানি তাদের স্টেশনে খাবার সার্ভিসের প্রস্তাব করে। সেখানে তাকে কোনো জায়গা ভাড়া দিতে হতো না। বিনিময়ে তার বিক্রি করা খাবারের লভ্যাংশের কিছু অংশ দিতে হতো। সেখানে তিনি ফ্রাইড চিকেনসহ বিভিন্ন খাবার পরিবেশন করতেন। প্রাথমিকভাবে তিনি রেস্টুরেন্ট খোলার আগে বাসায় বাসায় মজাদার খাবার সরবরাহ করতেন। যেহেতু তার চকচকে দামি রেস্তোরাঁ ছিল না, তাই বাড়িতেই রান্না করে খাবার সরবরাহ করতেন। এক সময় তার তৈরি খাবারের জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে। ১৯৩৯ সালে নর্থ ক্যারোলাইনার অ্যাশেভ্যালিতে একটি মোটেল নেন স্যান্ডার্স। ওই বছরই নভেম্বর মাসে আগুন লেগে তার দোকানটি পুরোপুরি পুড়ে যায়। বারবার নানা বাধা থাকা সত্ত্বেও স্যান্ডার্স কখনো পিছপা হননি। জীবন সংগ্রামে দৃঢ় প্রত্যয়ে এগিয়ে গিয়েছিলেন। এবার তিনি ১৪০ আসনের একটি রেস্টুরেন্ট খোলেন। ১৯৪০ সালের জুলাইয়ে তিনি তার রেস্টুরেন্টে স্পেশ্যাল ফ্রাইড চিকেন বিক্রি শুরু করেন। তার বয়স যখন ৪০, তার ক্যান্টাকি সার্ভিস স্টেশনটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করে। তার এই জনপ্রিয়তায় ক্যান্টাকির গভর্নর তাকে ক্যান্টাকির কর্নেল মনোনীত করেন। সে সময় তিনি ফ্রাইড চিকেনের ব্যবসায়ে মনোনিবেশ শুরু করেন। ১৯৫২ সালে স্যান্ডার্স ‘চিকেন ফ্রাই’ ধারণাটিকে আয়ের উেস পরিণত করার উদ্দেশ্যে একটি উপযুক্ত রেস্তোরাঁ খুঁজতে শুরু করেন। না পেয়ে শেষমেশ সেলবাইভ্যালিতে রেস্তোরাঁ খুলে বসেন। নাম দেন ক্যান্টাকি ফ্রাইড চিকেন এবং সময় তালে তালে তার সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। তার তৈরি ‘ক্যান্টাকি ফ্রাইড চিকেন’ বিশ্বের প্রথম বড় ফ্রাইড চিকেন কোম্পানি হয়ে ওঠে। সেই প্রাচীন রেস্তোরাঁটিই আজকের ‘কেএফসি’। ১৯৫৫ সাল থেকে মাত্র দশ বছরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে কেএফসির এবং ৬০০টি শাখা প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৭০ সালে স্যান্ডার্স আমেরিকান কোম্পানির কাছে রেস্তোরাঁটি ২ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে বিক্রি করে দেন। ১৯৮০ সালে ৯০ বছর বয়সে বিখ্যাত এই ব্যবসায়ী পরলোক গমন করেন।