শনিবার, ২৫ মার্চ, ২০১৭ ০০:০০ টা
বৈমানিক সাদিয়া আহমেদ

আকাশে উড়ছেন বাংলার নারী

আকাশে উড়ছেন বাংলার নারী

সাফল্যের গল্পগাথা বাঙালির ইতিহাস। সেখানে সদর্প অবস্থান নারীর। তারা পেরিয়েছেন সব বাধা। এমনকি জয় করেছেন আকাশ। কঠিন মনোবল আর স্থির লক্ষ্য তাদের পৌঁছে দিয়েছে সাফল্যের শিখরে। তারই দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন বৈমানিক সাদিয়া আহমেদ। লিখেছেন— তানিয়া তুষ্টি

 

প্রতিটি ফ্লাইটের আগে একগাদা পড়াশোনা। যে দেশগুলো পাড়ি দেব, তার রুট সম্পর্কে জানা, প্রত্যেকটি দেশের আবহাওয়াকে আলাদা করে খোঁজ নেওয়া, সেসব দেশের ‘এয়ার ল’ জানা— সবই সেরে নিতে হয়। নিজের শরীরের প্রয়োজনীয় বিশ্রাম ও ফিটনেস রাখাও ফ্লাই করার অন্যতম শর্ত। প্রতিটি মুহূর্তকে যেন চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিতে যাচ্ছি। এক সেকেন্ডের জন্যও মনোযোগ হারানো চলবে না। কারণ আমার হাতের ওপর নির্ভর করছে বিমানের সব যাত্রীর জীবন। আমরা যারা বৈমানিক তারাও এই ঝুঁকির বাইরে থাকি না। টানটান উত্তেজনা নিয়ে প্রতিদিনের রুটিন গড়গড় করে বলে চললেন বৈমানিক সাদিয়া আহমেদ। তার ব্যাখ্যায় উঠে আসে বৈমানিকদের অ্যাডভেঞ্চারধর্মী জীবনের প্রতিচ্ছবি। পরক্ষণে মুখে একটু লাজুক হাসি নিয়ে বলেই ফেললেন, আমরা আসলে পুরুষদের মতো শুধু শেভ করে ইউনিফর্ম পরেই অফিসে দৌড় দিতে পারি না।

কমপ্লিট গ্রুমিং অর্থাৎ গোজগাজটা নিখুঁতভাবে করে তবেই বের হতে হয়। তাই সময়ের দিকে একটু বেশিই নজর দিতে হয়। সাদিয়ার মুখে শোনা গেল, মেইন্টেনেন্স ডিপার্টমেন্ট থাকলেও আগে তাদের বিমানের কন্ডিশন দেখে নিতে হয়। বিমানে থাকা দুজন বৈমানিক একই কাজ করে দুজনের রিপোর্ট মিলিয়ে দেখেন, কোনো ত্রুটি ধরা পড়ল কিনা। ত্রুটি থাকলে দ্রুত সংশোধন করে তবেই ফ্লাই। এটা প্রতিটি ফ্লাইটের আগের কাজ। এই কাজে একদম অবহেলা চলে না। তারা নাকি অভ্যস্তই হয়ে গেছেন এই কাজে। সাদিয়া বললেন, একটু অসচেতন হলে বড় ধরনের বিপদের ঝুঁকি। তাই প্রত্যেকের জীবনের নিরাপত্তার জন্য বিমানের অবস্থা নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ জরুরি হয়।

 

 

গ্রামের বাড়ি সিলেটে। বাবা বন বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ছিলেন। মা গৃহিণী। যৌথ পরিবারে দুই ভাইবোনের মাঝে বেড়ে ওঠা সাদিয়া আহমেদের। ছোটবেলায় আমি সব সময় ব্যাংকার হতে চাইতাম দুই ব্যাংকার চাচাকে দেখে। দাদা নানা দুজনেই পুলিশ। নাইন টেনে পড়ার সময় আবার ভাবতাম পুলিশ অফিসার হব। আসলে ছোট থেকেই কেন জানি ইউনিফর্ম লাইফস্টাইলটা খুব পছন্দের। তখন থেকে মনে হতো যে চাকরিই করব তাতে যেন ইউনিফর্ম থাকে। আমি সবসময় চাইতাম একটি রুটিন লাইফ। এর মধ্যে আমি খুব দ্রুত প্রতিষ্ঠিতও হতে চাইতাম। আর্থিক প্রয়োজন না থাকলেও ক্যারিয়ারের ব্যাপারে উদগ্রীব থাকতাম। বাবা আমাকে সব সময় বলতেন, তুমি মেয়ে বা ছেলে হও, ধনী অথবা গরিব যে পরিবার থেকেই আসো একটা সময়ে তোমাকে দিয়েই তোমার বিচার করা হবে। তখন দেখা হবে না তুমি কতটা সুন্দর, তুমি কতটা লেখাপড়া জান, কেমন পরিবার থেকে এসেছো, জীবন তোমাকেই মোকাবিলা করতে হবে। আর তাই যত দ্রুত সম্ভব নিজেকে গুছিয়ে নিতে হবে। বাবা সব সময় একটি করে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিতেন। সেটা শেষ করে বাবাকে বলতাম তুমি তো বলেছিলে পারব না, এই যে পেরেছি। তখন বলতেন এটা না বললে তোমার মাঝে চেষ্টার অভাব থাকত।

এমন বন্ধুপ্রতিম বাবাকে পাওয়া আসলে ভাগ্যের ব্যাপার বললেন সাদিয়া।

শহীদ আনোয়ার স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে ১৯৯৯ সালে এসএসসি ও ২০০১ সালে এইচএসসি পাস করেন সাদিয়া। এরপর তিনি জিএমজি এয়ারলাইন্সে যোগ দেন এক্সিকিউটিভ হিসেবে। তখন তার মনে হয়, আমি তো ছোট থেকে অন্যকিছু ধারণ করে এসেছি। অফিস টু বাসা ছকবাঁধা জীবন আমার জন্য না। তখন বাবাকে রাজি করিয়ে কানাডার একটি স্কুল থেকে বিমানে প্রশিক্ষণ নিই। এরপর দেশে ফিরে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন। তারপর ২০০৭ সালে জিএমজি এয়ারে বৈমানিক হিসেবে যোগ দিলাম।

বৈমানিক সাদিয়া বিমান চালানোয় যেমন তুখোড়, স্বামী ও এক সন্তানকে নিয়ে সংসার সামাল দিতেও তেমনি পটু। জানালেন, আমি খুব সাজগোজ পছন্দ করি, আবার সংসার করতেও পছন্দ করি। নিজ হাতে রান্না করা ভীষণ উপভোগ করি। যতক্ষণ বাসায় থাকি বাচ্চাকে পুরো সময়টি দিই। এক কথায় খুব করে গুছিয়ে থাকাটা আমার খুব পছন্দের। এমন একটি দায়িত্বশীল পেশায় থেকে সাদিয়া সময় সংকটে ভোগেন না। অথচ তাকে প্রায়ই একদিন দুদিন পরে বাসায় ফিরতে হয়। কখনো এর থেকেও চাপ থাকে। বললেন, আমার স্বামীও বৈমানিক। তিনি আমার টাইম সিডিউল খুব ভালো মতো বোঝেন।

আমাদের দেশে একজন গর্ভবতী নারীকে বোঝানো হয় সে অসুস্থ। অথচ এটি জীবনের একটি অংশ। আমাকে বাচ্চা প্রসবের মাত্র তিনদিন পরেই হাসপাতাল থেকে আমাকে রিলিজ দেয়। বারো দিনের মাথায় আমেরিকা থেকে ফ্লাই করে দেশে ফিরে আসি।

২০০৭ সাল থেকে তিন বছর জিএমজি এয়ার লাইন্স, এরপর পাঁচবছর রিজেন্ট এয়ারওয়েজে কাজ করেছেন। বর্তমানে সাদিয়া আছেন ইউএস বাংলা এয়ারলাইন্সে। প্রতি ছয় মাসে তাদের ট্রেনিং থাকে। যাতে হঠাৎ বিপদে পড়লে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে পারি। আমাদের পুরো কাজটিই রুটিন ওয়ার্ক। এমনকি আমরা যখন বাসায় থাকছি, খাচ্ছি, বিশ্রাম নিচ্ছি পুরোটাই রুটিন মেনে। বেশি খেয়ে বা বিশ্রাম নিয়ে মুটিয়ে যাওয়া ও অসুস্থ হওয়াটা এই পেশায় একদম অনুচিত।

যেসব মেয়ে এই পেশায় আসতে আগ্রহী প্রথমেই তাদের দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হতে হবে। সাদিয়ার অভিজ্ঞতা বলে, এই পেশায় যোগদানের সময় একটি মেয়েকে নানা সমস্যায় পড়তে হয়। প্রথমে ধরে নেওয়া হয় সে চ্যালেঞ্জ নিতে পারবে না। অথচ নিয়োগ পাওয়ার পর সেই মেয়েটিকে নিজের যোগ্যতা প্রদর্শনে অধিক প্রমাণ দিতে হয়।

কিছু ক্ষেত্রে বেশি যোগ্যতা দেখাতে হয়। বৈমানিক হতে সৌন্দর্যের খুব বেশি দরকার নেই। তবে শারীরিক সুস্থতা, মানসিক দৃঢ়তা ও সাহস দরকার। 

ইউনিফর্মের সঙ্গে পুরো গ্রুমিং শেষ করতে একটি মেয়েকে কমপক্ষে ১ ঘণ্টা সময় বেশি হাতে রাখতে হয়। এদিকে আবার তাকে বাসার কাজ করা, বাচ্চা থাকলে তাকেও নিরাপদে রাখার ব্যবস্থা করে তবে বের হতে হয়। ফ্লাই শেষে বাসায় গিয়ে আগে তাকেই সংসার, বাচ্চা, পরিবারের অন্যান্য সদস্যের প্রতি খেয়াল রাখতে হয়। অপরদিকে পুরুষ বৈমনিকটি বাসায় ফিরেই বিশ্রাম নিতে পারে। পুরুষের তুলনায় একজন নারীর এতকিছু করার ক্ষমতা থাকে। এজন্য নারী হিসেবে তিনি যথেষ্ট গর্ব অনুভব করেন। তবে এটিও স্বীকার করেন, সুখের সংসার গড়তে স্বামী-স্ত্রীর উভয়ের সমান অংশীদারিত্ব থাকা দরকার। নইলে তা সম্ভব না।

বৈমানিকদের এমনিতেই একটি সন্তোষজনক বেতন কাঠামো থাকে। তার ওপর আবার পদোন্নতি আছে। বছরজুড়ে ফ্লাই করার ওপর বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট থাকে। তা ছাড়া সুশৃঙ্খল ও উন্নত জীবন ব্যবস্থা পাওয়ার সুযোগ থাকায় বৈমানিকের চাকরিটি সবার কাছে লোভনীয়। নিজের অবস্থান নিয়ে তিনি খুব গর্বিত। আমি সেই জায়গাতে এসেছি যেখানে খুব সহজেই যে কেউ আসতে পারে না। দশটা ছেলের মাঝে আজ কোনো মেয়েকে আলাদা করে দেখার সুযোগ নেই। আমি একটি মেয়ে হলেও আমাকে দায়িত্ব দিন। আমি তা ঠিকঠিক পালন করব। এই বিশ্বাস রেখে সমান করে দেখা শুরু করুন। আমাদের যেন নারী দিবসে অধিকার নিয়ে চিল্লাতে না হয়। আবার পরক্ষণেই তাদের অবস্থান আগের জায়গায় চলে না যায়। তাই মেয়েদের উচিত চ্যালেঞ্জ নিতে শেখা।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর