শনিবার, ২৫ মার্চ, ২০১৭ ০০:০০ টা
সাফল্য

মাছের জন্য নিরাপদ আশ্রয়

মুক্তার হাত ধরে রক্ষা পাচ্ছে বিলুপ্তপ্রায় মাছ

কাজী শাহেদ, রাজশাহী প্রতিনিধি

মাছের জন্য নিরাপদ আশ্রয়

শফিউল আলম মুক্তার ছোট একটি উদ্যোগ, কিন্তু ফলাফল অনেক বড়। দিনকে দিন দেশি প্রজাতির মাছের বিলুপ্তি দেখে যুবক মুক্তা পদ্মায় গড়েছিলেন ছোট আকারের এক মৎস্য অভয়াশ্রম। সেই অভয়াশ্রমই এখন স্বপ্ন দেখাচ্ছে মৎস্য অধিদফতরকে। মৎস্য বিভাগের কর্মকর্তারা দাবি করছেন, মুক্তার মাছের অভয়াশ্রম থেকে এখন ২৭ নদীতে যাচ্ছে বিলুপ্ত প্রায় মাছের পোনা।

 

রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার পিরিজপুর গ্রামে শফিউল আলম মুক্তার বাড়ি। বন্ধু শরৎ চন্দ্রকে সঙ্গে নিয়ে ২০১৪ সালে তিনি গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া পদ্মা নদীর কোলে আটকে থাকা জলাশয়ে গড়ে তুলেছিলেন একটি মৎস্য অভয়াশ্রম। ওই বছর তার সফলতা তাক লাগিয়ে দেয় মৎস্য বিভাগকে। তারপর মুক্তার পাশে দাঁড়ায় মৎস্য বিভাগ। এলাকার আরও ২০ যুবক সঙ্গী হয় তার। এখন সবার সহযোগিতায় মুক্তা বড় আকারে গড়ে তুলেছেন মৎস্য অভয়াশ্রম।

 

মুক্তা বলছিলেন, ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে পদ্মায় পানি কমে যায়। তখন নদীর কোলে জমে থাকা একটি জলাশয়ের মাত্র ১০০ মিটার এলাকায় তিনি ব্যক্তিগত উদ্যোগে প্রথম অভয়াশ্রম গড়ে তোলেন। ৮ মাস তিনি ওই জলাশয়ে সব ধরনের মাছ ধরা নিষিদ্ধ করেন। ওই সময় অভয়াশ্রমের আশপাশে প্রচুর পরিমাণে বিলুপ্ত প্রায় মাছ পেতে থাকেন জেলেরা। এ খবর পৌঁছে যায় স্থানীয় মৎস্য অফিসে। প্রশংসিত হয় তার উদ্যোগ। এরপর ২০১৫ সালে অভয়াশ্রম করতে মুক্তার পাশে দাঁড়ায় মৎস্য বিভাগ। পরিধি বাড়ে মুক্তার অভয়াশ্রমের। ওই বছর পদ্মার ৫০০ মিটার এলাকাজুড়ে গড়ে তোলা হয় অভয়াশ্রম। ওই বছর ফল ভালো হওয়ায় এ বছর পদ্মার এক কিলোমিটার এলাকাকে অভয়াশ্রম হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। এর মধ্যে আছে মাছের প্রজননক্ষেত্র ও চারণভূমি।

প্রথম বছর মুক্তা ব্যক্তিগত উদ্যোগে অভয়াশ্রম গড়ে তুললেও পরের দুই বছর তার পাশে দাঁড়িয়েছে স্থানীয় মৎস্য অধিদফতর। অভয়াশ্রম গড়ে তুলতে মৎস্য বিভাগ তাকে দিয়েছে প্রয়োজনীয় বাঁশ, খুঁটি, বেড়া ও মাছ থাকার বিশেষ খাঁচা (কালভার্ট)। আর পৃষ্ঠপোষকতা করছেন স্থানীয় সংসদ সদস্য ওমর ফারুক চৌধুরী।

 

শফিউল আলম মুক্তা জানান, অভয়াশ্রমের ভিতর জাল দিয়ে মাছ ধরা নিষিদ্ধ। তবে শুধু হুইল ও তাঘির মাধ্যমে বড়শিতে মাছ ধরার অনুমতি আছে। জেলার বিভিন্ন অঞ্চলের শৌখিন ব্যক্তিরা এখানে হুইল দিয়ে মাছ ধরতে আসছেন। তাদের বড়শিতে উঠে আসছে বড় বড় সব মাছ। তবে হুইলে বিলুপ্ত প্রায় ছোট মাছ ওঠে না। তাই এসব মাছ চলে যাচ্ছে পদ্মার বিভিন্ন শাখা-প্রশাখাতে।

 

তিনি আরও জানান, মুক্তার অভয়াশ্রমে এখন পর্যন্ত ৮৫ প্রজাতির মাছের দেখা মিলেছে।

বড় মাছের মধ্যে আছে—কালিবাউস, চিতল, ফলি, গুজি আইড়, বাসাড়, বাঘাড়, বোয়াল, রুই ও কাতলসহ বেশকিছু প্রজাতির মাছ। ছোট মাছের মধ্যে আছে—মাঘি পিয়ালি, পাত পিয়ালি, রানী, গুচি, তিন প্রজাতির বাইম, মলা, ঢেলা, চ্যালা, সরপুঁটি, খোলসা, ঘাইর‌্যা, বাচা, পুঁটি, বাতাসি, কাজলী, বেলে, পাবদা, টেংরা, পোয়া, মোয়া, কাঁকলে, চাঁন্দা, রিঠা, টাকি, চ্যাং, চাঁপিলা, তারা, খরকুটি, শিং, দেশি কৈ, মাগুর, শৈল, বজলমুড়ি, দারকিনা, পটকা, কাশ খয়রা, টাটকিনি ও উড়োল।

 আছে পর্যাপ্ত পরিমাণ ইলিশও। এ ছাড়া একেবারেই বিলুপ্ত প্রজাতির মাছ শিলং, সুনঘাঘু ও রাজপুঁটির দেখা মিলছে এই অভয়াশ্রমে।

 

শফিউল আলম মুক্তার ভাষায়, ‘আগে নদীতে এসব মাছ দেখা যেত না। এখন অভয়াশ্রমের আশপাশের এলাকায় ছোট মাছের পাশাপাশি ৬-৮ কেজি ওজনের বড় মাছও জেলেরা পাচ্ছেন। তারা বড় কোনো মাছ পেলেই মাছ নিয়ে আমার কাছে ছুটে আসেন। আমাকে মাছ দেখান। তখন খুব ভালো লাগে। আর এখানকার জেলেরা খুব সচেতন। কেউ অভয়াশ্রমের ভিতর জাল ফেলেন না।’

 

প্রথমে একজন, পরে আরও ২০ জন যুবককে নিয়ে অভয়াশ্রমে নিঃস্বার্থ শ্রম দিয়ে যাচ্ছিলেন মুক্তা। অভয়াশ্রম থেকে তাদের নিজেদের কোনো আয় ছিল না। তাদের কথা ভেবেছে মৎস্য অধিদফতর। মৎস্য অধিদফতর ‘ইউনিয়ন পর্যায়ে মৎস্য চাষ প্রযুক্তি সম্প্রসারণ’ প্রকল্পের আওতায় অভয়াশ্রমের ভিতর তাদের ভাসমান খাঁচায় মাছ চাষের সুযোগ করে দিয়েছে। গত বছরের ২৯ মে সেখানে ১০টি ভাসমান খাঁচার উদ্বোধন করেন স্থানীয় এমপি ওমর ফারুক চৌধুরী। পরে মৎস্য অধিদফতর তাদের আরও ১০টি ভাসমান খাঁচা দেয়। প্রতিটি খাঁচায় এক হাজার করে মনোসেক্স প্রজাতির তেলাপিয়া বেড়ে উঠছে। এসব মাছ বিক্রি করে লাভবান হবেন অভয়াশ্রমের উদ্যোক্তারা।

 

গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর অভয়াশ্রম ও ভাসমান খাঁচায় মাছ চাষ পরিদর্শন করে গেছেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র। এ ছাড়া অভয়াশ্রম পরিদর্শন করেছেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারি বিভাগের অধ্যাপক ড. রফিকুল ইসলাম সরকার, মৎস্য বিভাগের কর্মকর্তা পিএইচডি গবেষক আরিফ হোসেন এবং বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারি বিভাগের শিক্ষার্থী ও মৎস্য অধিদফতরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। উত্তরাঞ্চলের একমাত্র এই অভয়াশ্রম দেখে পরিদর্শন বইতে তারা লিখে রেখে গেছেন তাদের মুগ্ধতার কথা।

 

উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা শামসুল করিম জানান, পদ্মা তার উপনদী, শাখা ও প্রশাখা মিলিয়ে মোট ২৭টি নদীতে পানি দেয়।

গোদাগাড়ীতে পদ্মার এই অভয়াশ্রম থেকে বিলুপ্ত প্রায় অনেক প্রজাতির মাছ সেসব নদীতে যাচ্ছে। গত বছর পানি শুকিয়ে অভয়াশ্রমটি মূল নদী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লে শুধু ভরা মৌসুমে এখানকার মাছ নদীতে মিশেছে। তবে এবার অভয়াশ্রমের সঙ্গে মূল নদীর একটি চ্যানেল যুক্ত আছে। ফলে অভয়াশ্রমের মাছ নদীর মূল স্রোতে যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। আর পদ্মা যেসব নদীতে পানি দেয় সেসব নদীতে মাছ যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। অভয়াশ্রমটির ব্যাপারে স্থানীয় এমপি ওমর ফারুক চৌধুরী বলেন, বিলুপ্ত প্রায় মাছের সংরক্ষণে শফিউল আলম মুক্তা যে উদ্যোগ নিয়েছেন তা প্রশংসনীয়। তার অভয়াশ্রম দেশে বিলুপ্ত প্রায় দেশি প্রজাতির মাছের বিস্তারে খুবই ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে। এজন্যই মুক্তা ও তার সঙ্গীদের ভাসমান খাঁচা দেওয়া হয়েছে। এতে মাছ চাষ করে তারা নিজেরাও স্বাবলম্বী হতে পারবেন।

 

ব্যক্তিগত জীবনে তিন সন্তানের জনক মুক্তা। দুই ছেলে স্কুলে যায়। মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। স্ত্রী, দুই সন্তান, মা ও দুই ভাইয়ের সঙ্গে যৌথ পরিবারে বাস করেন। মুক্তা জানান, ছোট বেলা থেকেই তার পরিবারের সদস্যরা মাছ চাষের সঙ্গে জড়িত। তাদের নিজস্ব পুকুর আছে। পুকুরের মাছ চাষ করতে গিয়ে মাছের প্রতি তার ভালোবাসা জন্মে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর