শনিবার, ২৫ মার্চ, ২০১৭ ০০:০০ টা
অন্যরকম

পুরান ঢাকার খাবারের ঐতিহ্য

মাহবুব মমতাজী

পুরান ঢাকার খাবারের ঐতিহ্য

ভোজনরসিকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে বাহারি সব খাবার। তার প্রাপ্তিস্থান সম্পর্কেও জ্ঞানের ব্যাপ্তি কম থাকে না। কোনো ভোজনরসিকের কাছে মজার খাবারের প্রাপ্তিস্থান সম্পর্কে জানতে চাইলে এককথায় উত্তর আসবে পুরান ঢাকার নাম। আচ্ছা, এখানেই এতসব খাবারের ছড়াছড়ি কেন? সব ভোজনরসিক কি পুরান ঢাকায় থাকে, নাকি পুরান ঢাকার খাবারপ্রেমিকরা দোকান খুলে বসেছে? উত্তর যেটাই হোক, চলুন আজ জেনে নেওয়া যাক পুরান ঢাকার খাবারের ঐতিহ্য সম্পর্কে।

 

কয়েক শ বছরেও কদর হারিয়ে যায়নি পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী মুখরোচক খাবারের। মুঘল আমলের এই প্রিয় খাবারগুলো পাওয়া যায় নির্দিষ্ট কিছু স্থানে। তবে বাকরখানির বিস্তার ঘটেছে প্রায় সবখানে। কারণ এখানকার খানদানি বাসিন্দাদের সকালের ঘুম ভাঙে এক পিস বাকরখানি আর এক মগ দুধের চায়ে। ভাজাপোড়ার তৈলাক্ত খাবারের আধিক্য রয়েছে চকবাজার, চানখাঁরপুল ও নাজিমুদ্দিন রোডের দিকে। এসব আমিষ খাবারের ভিড়ে তাঁতীবাজার ও ইসলামপুরে একটুখানি জায়গা পেলে খুশি হন সেখানকার মানুষ। তবে এই ভোজন রসিকের সংখ্যা সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে বেশি।

বাকরখানি : শুধু ঢাকাতেই নয়, চট্টগ্রাম অঞ্চলের বাকরখানিও প্রসিদ্ধ। আগা বাকের খাঁ ও খনি বেগমের নামযোগে হয়েছে বাকরখানি। পুরান ঢাকাবাসীর সকালের নাস্তায় এটি অতি প্রিয় খাবার। বাকরখানি ময়দার খামির থেকে ছোট রুটি আকারে বানিয়ে আগুনের তাপে মচমচে বা খাস্তা করে তৈরি করা হয়। ছোট-বড় বিভিন্ন আকারের বাকরখানি পাওয়া যায় পুরান ঢাকায়। তৈরির পেছনে বাকরখানির আছে এক দীর্ঘ ইতিহাস। জনশ্রুতি থেকে জানা, জমিদার আগা বাকের খাঁ তথা আগা বাকির খাঁর নামানুসারে এ রুটির নাম রাখা হয়েছিল। বাংলার তৎকালীন রাজধানী মুর্শিদাবাদের নর্তকী খনি বেগম ও আগা বাকেরের মধ্যে ছিল মধুর প্রেম। আবার বাকের খাঁর নামানুসারেই বাকলা-চন্দ্রদ্ব্বীপ (পটুয়াখালী-বরিশাল) অঞ্চলের নাম হয়েছে বাকেরগঞ্জ। বাকরখানির সৃষ্টি হয়েছে আঠারো শতকের মাঝামাঝিতে। ঐতিহ্যবাহী এ খাবারকে রক্ষার জন্য এখনো কয়েক প্রজন্ম এর ব্যবসা ধরে রেখেছে। সেই স্বাদের ও আসল বাকরখানি না থাকলেও এর জনপ্রিয়তা এখনো কমেনি।

বাকরখানির কারিগররা জানান, লালবাগ কেল্লার কাছেই প্রথম বাকরখানির দোকান গড়ে উঠেছিল। তা থেকেই ধীরে ধীরে বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। চানখাঁরপুল, নাজিরাবাজার ও বংশাল এলাকায় রাস্তার দুই পাশে চোখে পড়বে পরপর অসংখ্য দোকান। যারা বিভিন্ন আকৃতি ও স্বাদের বাকরখানি বানান। এগুলোর ধরনের মধ্যে আছে কাবাব বাকরখানি, চিনি বাকরখানি, ছানা বাকরখানি, খাস্তা বাকরখানি, নোনতা বাকরখানি, পনির বাকরখানি, নারিকেল বাকরখানি, ঘিয়ের বাকরখানি, মাংসের বাকরখানি ইত্যাদি। সাধারণ বাকরখানির দাম প্রতি পিস ২-৪ টাকা। কোথাও কেজি দরে বিক্রি হয়। কাবাব, পনির বা মাংসের বানানো বাকরখানি প্রতি কেজির মূল্য ১১০-১৩০ টাকা। চকবাজার, আমলীগোলা, নাজিরাবাজার, বংশাল, ইসলামবাগ, হাজারীবাগ, আবুল হাসনাত রোড, সিদ্দিকবাজার, বনগ্রাম, লক্ষ্মীবাজার, সূত্রাপুর, একরামপুর, গেন্ডারিয়া, নারিন্দা, দয়াগঞ্জ, কাগজীটোলাসহ পুরান ঢাকার প্রায় সব এলাকায় রয়েছে বাকরখানির ছোট-বড় দোকান।

নয়াবাজারের শমসের নামের এক কারিগর জানান, পুরান ঢাকায় হাজারো পরিবার খুঁজে পাওয়া যায় যারা বংশপরম্পরায় বাকরখানি তৈরি ও বিক্রির সঙ্গে জড়িত। পুরান ঢাকার বনেদি পরিবারগুলো তাদের বিয়ে বা বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে মালাই-মাখনের বাকরখানির অর্ডার এখনো দিয়ে থাকে।

সূত্রাপুর কলতাবাজারের শামীম নামের এক বাসিন্দা জানান, ‘আমাদের বেশির ভাগ সদস্যই গরম দুধ চায়ে বাকরখানি চুবিয়ে সকালের নাস্তা করেন। বলতে গেলে এটি এক অন্যরকম ঐতিহ্য।’

 

চকের বাহারি ইফতার

চকবাজারের খানদানি ইফতারসামগ্রীর সুনাম বেশ পুরনো। এটি শুধু দেশেই নয়, এর সুনাম রয়েছে দেশের বাইরেও। রমজান এলে চকের শাহি মসজিদের সামনের অংশে উর্দু রোর্ডের দুই পাশ ধরে বসানো হয় হরেক রকমের নবাবি ইফতারসামগ্রীর দোকানের পসরা। নবাবি খাবারের মধ্যে আছে সুতি কাবাব, জালি কাবাব, শাকপুলি, টিকা কাবাব, আস্ত মুরগির কাবাব, মোরগ মুসলম, বঁটিকাবাব, কোফতা, চিকেন কাঠি, শামি কাবাব, শিকের ভারী কাবাব, ডিম চপ, কাচ্চি, তেহারি, মোরগ পোলাও, কবুতর ও কোয়েলের রোস্ট, খাসির রানের রোস্ট, দইবড়া, মোলার হালিম, নুরানি লাচ্ছি, পনির এবং ‘বড় বাপের পোলায় খায়, ঠোঙা ভইরা লইয়া যায়।’ বড় বাপের পোলায় খায়, ঠোঙা ভইরা লইয়া যায় ছাড়া বাকি সব খাবার একই এলাকায় বছরজুড়ে পাওয়া যায়। সৈয়দ আলী নামের এক দোকানদার জানান, ‘কাবাবসহ বিভিন্ন ভাজাপোড়া খাবারের ব্যবসা আমাদের এখানে সারা বছরই চলে। দেখা গেছে বেশির ভাগ ব্যবসায়ী দুপুরের খাবার এবং বিকালের নাস্তা এসব দিয়েই সারেন।

 

নিরামিষ খাবার

পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী খাবারের মধ্যে আরও আছে মুরগির চাপ, খাসির চাপ, বিরিয়ানি, তেহারি, শাহি মোরগ পোলাও, নান্না বিরিয়ানি, হাজী বিরিয়ানি, পরোটা মগজ, কাচ্চি ও নানা ধরনের কাবাব। ভোজনবিলাসী নগরবাসীর এসব মুখরোচক খাবার। তৈলাক্ত আমিষ খাবারের ভিড়ে প্রত্যুষে বিভিন্ন পার্কে স্বাস্থ্যসচেতন নগরবাসীর শুরু হয় নিয়মিত শরীরযোগ। আমিষের ভিড়ে একটুখানি মাথা তুলে ঠাঁই নিয়েছে নিরামিষ খাবার। নিরামিষ খাবারের হোটেল শুরুতে একটি থাকলেও পুরান ঢাকার ইসলামপুর ও তাঁতীবাজারে গড়ে উঠেছে বিষ্ণুপ্রিয়া, আদি গোবিন্দ, জগন্নাথ ভোজনালয়, গোপীনাথ— এ চারটি হোটেল। যে হোটেলগুলোয় আমিষের কোনো বালাই নেই। এমনকি কারিগররাও নিরামিষভোজী। শুধু পুরান ঢাকাবাসীই নন; গুলশান, চকবাজার, নিউমার্কেট, রামপুরা, মিরপুর, যাত্রাবাড়ীর বাসিন্দা খেতে আসেন এ হোটেলগুলোয়। আসেন ব্যবসায়ী এমনকি বিদেশিরাও। নিরামিষের মধ্যে বিষ্ণুপ্রিয়া হোটেলে পাওয়া যায় রসুন-পিঁয়াজমুক্ত কাশ্মীরী পনির, ছানারসা তরকারি, ফুলকপি, পটোল ভাপা, মুগ ডাল, বুট ডাল, কচু শাক, টক ডাল, লাউয়ের ডগা, বাঁধাকপি, জলপাইর চাটনি, মিষ্টান্ন, বেগুনি, সাম্বার, ম্যাকারনি, শিমের বিচি, ডালের বড়া, সয়াবিন সবজি, পাতলা ডাল, কচুর লতি ও করলা ভাজা। এ ছাড়া জগন্নাথ ভোজনালয়ে কলা ভর্তা, লাউ ভাজি, পুঁই শাক, লাল শাক, কোমর শাক, পেঁপে ভর্তা, কচু ভর্তা, আলু ভর্তা, ভেণ্ডি, বেগুন ভর্তা, শাক ভর্তাসহ বিভিন্ন ভর্তা পাওয়া যায়। তবে আদি গোবিন্দ ও গোপীনাথে খাবারের ধরনের সংখ্যা সাত-আটটি। জগন্নাথ ভোজনালয়ের মালিক শ্যামলচন্দ্র পাল এই প্রতিবেদককে জানান, ২০০৮ সালে ধর্মীয় বিবেচনা ‘আমিষ ছাড়ো ও নেশা ছাড়ো আন্দোলন’ থেকে শুরু হয় তার নিরামিষ রেস্টুরেন্টের যাত্রা। সারা দেশের স্বর্ণ, লোহার টুকরা, শুকনা ভোজ্যপণ্যের ব্যবসায়ী-মারোয়ারি এবং সলিমুল্লাহ ও ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজের ভারত-নেপালের ছাত্রদের কাছেও এ নিরামিষ খাবার প্রিয়।

সর্বশেষ খবর