শনিবার, ২৫ মার্চ, ২০১৭ ০০:০০ টা
ভ্রমণ

জাদুকাঁটার জাদু

সাইফ ইমন

জাদুকাঁটার জাদু

বাংলাদেশে যে সব দর্শনীয় নদী রয়েছে তার মধ্যে জাদুকাঁটা অন্যতম। প্রকৃতির অপূর্ব মায়া খেলা ঘটে এই মায়াবিনীর ধারে। মাথার ওপর নীল আকাশ। নিচ দিয়ে বয়ে চলেছে স্বচ্ছ সবুজরঙা জলধারা নিয়ে একটি নদী। নদীটির বুকে দৃষ্টি মেলে দিয়ে আপনি হারিয়ে যাবেন এক ভিন্ন সময়ে। নদীতে উথাল-পাথাল ঢেউ নেই তবে আছে নদীর বিশালতা। যেখানে তলিয়ে যাবেন অপার মুগ্ধতায়।

জাদুকাঁটা নদীর সৌন্দর্যে মুগ্ধ হতে হলে আপনাকে যেতে হবে হাওর অঞ্চল সুনামগঞ্জ। সুনামগঞ্জের উত্তর-পশ্চিমে এবং তাহিরপুর উপজেলা থেকে উত্তরে ভারত সীমান্তে নদীটির অবস্থান। নদীর উৎসমুখ থেকে শুরু করে সবুজ জলরাশির অবিরাম বয়ে চলার দৃশ্য অসম্ভব সুন্দর। যারা প্রকৃতি ভালোবাসেন তাদের জন্য জাদুকাঁটা হতে পারে এক অপার সৌন্দর্যের আধার।

 

সুনামগঞ্জ জেলা শহর থেকে জাদুকাঁটার দূরত্ব ২০ কিলোমিটার। কিন্তু ঠিক এ নদী পর্যন্ত ভালো কোনো রাস্তা নেই। যেতে হবে ভাড়া করা মোটরবাইকে। কিন্তু সব সমস্যা নিমেষেই ভুলে যাবেন জাদুকাটার দর্শনে। প্রথমেই সুরমা নদীর সাহেববাড়ীর ঘাটে। সেখান থেকে নৌকাযাত্রা। আধঘণ্টা পর দেখা পাবেন মণিপুরী ঘাটের। ঘাটে নেমেই মোটরবাইক ভাড়া পাবেন। এবার মোটরযাত্রা শুরু। পলাশ বাজার, ধলপুর বাজার পেছনে ফেলে, চিনাকান্দি বাজার ছাড়িয়ে বাইক আপনাকে একেবারে নিয়ে যাবে পাহাড়ের কাছে। এ সময় আপনাকে মোহাচ্ছন্ন করে রাখবে মেঘালয়। এরপর বিজিবি ক্যাম্পের পাশ দিয়ে নেমে যাবেন জাদুকাঁটার বালুচরে।

 

মেঘ আর পাহাড়ের সমন্বয়ে এখানে প্রকৃতি সাজিয়েছে তার অপার লীলাভূমি। মূল সড়ক থেকে পুরো রাস্তাটা আপনাকে আসতে হবে হেঁটে। তবে সব কষ্ট মাড়িয়ে যতক্ষণে পায়ের নিচে জাদুকাঁটার পরশ অনুভূত হবে তখন সব ভুলে যাবেন নিশ্চিত। আর মাথার ওপর পাহাড় এসে পড়বে, তখন অনুভূতি অন্য রকম। পাহাড় বেয়ে বের হয়ে বাংলাদেশে এসেছে জাদুকাঁটা নদী। দেখে মনে হবে, নদীর উৎসমুখে দুই পাশ থেকে পাহাড় ঝুলে আছে। পেছনে আরও একটি পাহাড়ের দেখা মিলবে সেখানে। এই নদী তীরেই রয়েছে হিন্দুধর্মাবলম্বীদের তীর্থস্থান। প্রতি বছর চৈত্র মাসে নদীতীরে পুণ্যস্নান হয়। হাজার হাজার মানুষের ঢল নামে এখানে। এখানে ঝকঝকে আকাশের সঙ্গে পুরো এলাকাটাই রঙিন ক্যানভাস। আপনাকে দিবে অসাধারণ স্বপ্নিল এক পরিবেশ। বিস্ময়ে অভিভূত হবেন প্রতিক্ষণ। জাদুকাঁটার জাদু আপনাকে জাদু করে ফেলেবে নিশ্চিত করেই। অসম্ভব রূপবতী এই নদীর রূপের জোয়ারে বেসে যাবেন আপনি। নদীর প্রতিটি বাঁকে যেন জাদুর পরশ আর মায়ার খেলা। অসম্ভব রূপবতী আর মায়াবতী জাদুকাঁটার প্রেমে পরে যেতে পারেন। এখানে রয়েছে একটি নামকড়া টিলা। যেখান থেকে মায়াবতী এই নদীর দৃশ্য অতি মনোরম। টিলার নাম বারিকটিলা। একটি গির্জা রয়েছে এখানে। চারদিকে সবুজ প্রকৃতি। পাশেই মেঘালয় পর্বতমালা আর চুনা পাথরের সৌন্দর্যের সঙ্গে আকাশে মেঘেদের লুকোচুরি আর বাতাসের দোল। বারিকটিলার ওপর দাঁড়িয়ে একদিকে চোখে পড়ে হাওর ও অন্যদিকে সারি সারি পাহাড়।

নীল-সবুজের নানা ছোঁয়া জাদুকাঁটার চারপাশে। ঝকঝকে আকাশে তুলোর মেঘ। পাশাপাশি হাত বাড়ানো দূরত্বে মেঘালয় পর্বতমালা আর জাদুকাঁটা নদী। বিশাল জলরাশি নিয়ে বয়ে চলা জাদুকাঁটায় মুগ্ধ দৃষ্টি মেলে দেখবেন শত শত মানুষ নদীতে। আর রয়েছে শত শত নৌকা। নদী থেকে পাথর তোলা হচ্ছে। এসব দেখে আপনার মন কেড়ে নিবে এই মায়াবিনী। এক অপরূপ স্বগীয় অনুভূতি এবং অদ্ভুত শূন্যতা তৈরি হবে মনে। এভাবে কত সময় পার হয়ে যাবে আপনি টেরই পাবেন না। হঠাৎ আবিষ্কার করবেন অনেক সময় পেরিয়ে গেছে বুঝতেই পারেননি। এরপর টিলার খাঁজ বেয়ে নেমে আসতে পারেন নদীতে। তারপর আর কী ঝাঁপিয়ে পড়া নদীর জলে। খেয়াল রাখতে হবে জলের নিচের পাথরের দিকে। এসব পাথরে ঘষা লেগে অনেকে আহত হলেও জাদুকাঁটার এমন ভালোলাগায় তাতে কেউই অবশ্য গুরুত্ব দেন না। যখন জাদুকাঁটার জল ছেড়ে উঠে আসবেন তখন গোধূলি। নীল আকাশ অন্ধকার হবে শুরু করেছে। নদীর বালিয়াড়িতে শেষ বেলার সূর্যের ঝিকিমিকি থাকতে থাকতেই বিদায় জানাতে হবে। ফিরে আসতে হবে জেলা শহরে।

 

এই নান্দনিক নৈসর্গিকতার পাশাপাশি এখানকার দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে রয়েছে জাদুকাঁটা ও বারিক টিলার পূর্ব প্রান্তে ৩৬০ আউলিয়ার অন্যতম সফর সঙ্গী শাহ আরফিনের মাজার। এ ছাড়াও জাদুকাঁটা নদীতীরে লাউর নবগ্রাম শ্রী-শ্রী অধৈত প্রভুর মন্দির ও পনতীর্থ ধাম, পশ্চিম তীরে ইস্কন মন্দির বোত্তাশাহর মাজার, বড়ছড়া কয়লা ও চুনাপাথর শুল্কস্টেশন, ট্যাকেরঘাট চুনাপাথর খনিজ প্রকল্প, আওলি জমিদার বাড়ি, রামসা প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত বিশাল টাক্সগুয়া হাওরের জলাভূমি এবং বনভূমি উল্লেখযোগ্য। 

 

কীভাবে যাবেন

আগেই বলেছি জাদুকাঁটা নদী সুনামগঞ্জ জেলার হাওর অঞ্চলে অবস্থিত। ঢাকা থেকে সুনামগঞ্জ যাওয়ার সরাসরি বাস রয়েছে। এনা, হানিফ, শ্যামলী, ইউনিকসহ অনেক বাস এই পথে চলে। সুনামগঞ্জ থেকে সরাসরি চলে যেতে পারেন জাদুকাঁটা নদীর তীরে। সুনামগঞ্জ শহর থেকে প্রথমে নৌকায় করে মণিপুরী ঘাটে। এর পর মোটরবাইকে চড়তে হবে। মোটরবাইকে ভাড়া নেবে ১৫০ থেকে ২০০ টাকা। আবার আপনি চাইলে সারা দিনের জন্যও মোটরবাইক ভাড়া করতে পারেন। যদি সারা দিনের জন্য ভাড়া নিতে চান তাহলে ভাড়া পড়বে ৮০০ থেকে ৯০০ টাকা।

 

জাদুকাঁটার তীরে পৌঁছে নৌকা ভাড়া করতে হবে। এক হাজার ৫০০ থেকে দুই হাজার টাকার মধ্যেই আপনি নৌকা পেয়ে যাবেন। আর সুনামগঞ্জে রাতে থাকার সুব্যবস্থা আছে। দলবেঁধে ঘুরতে গেলেই বেশি আনন্দ হবে। ইচ্ছে করলে ঘোরাফেরা শেষে দিনের আলোতেই আবার জেলা শহরে ফেরা যাবে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর