শনিবার, ২২ এপ্রিল, ২০১৭ ০০:০০ টা
অনুপ্রেরণীয়

লাঠি-বল্লমের বিরুদ্ধে লড়ছেন এসপি আমেনা

লাঠি-বল্লমের বিরুদ্ধে  লড়ছেন এসপি আমেনা

নারীর অগ্রযাত্রা থেমে নেই। নারীরা তার যোগ্যতার ছাপ রেখে চলেছে নিজ নিজ ক্ষেত্রে। তাদেরই একজন এসপি আমেনা বেগম। বর্তমানে নরসিংদীর পুলিশ সুপার হিসেবে কাজ করছেন। ইতিমধ্যে সন্ত্রাস ও মাদক নিয়ন্ত্রণে কার্যকরী ভূমিকা রাখায় সর্বত্র প্রশংসিত হয়েছেন। নিজ কার্যালয়ে নারী ও শিশু সহায়তা কেন্দ্র খুলে নরসিংদীবাসীর কাছে আস্থাভাজন হয়ে উঠেছেন তিনি। শুধু শহর নয়, অপেক্ষাকৃত গ্রামাঞ্চলে আইনশৃঙ্খলার উন্নয়নে তার পদক্ষেপ স্বস্তি এনেছে। কমিউনিটি পুলিশিংকে জনপ্রিয় করে তুলতেও সচেষ্ট তিনি। প্রশাসন ও স্থানীয় জনগণকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করছেন। এই সাফল্যের প্রাপ্তি হিসেবে পুলিশ সপ্তাহ-২০১৫-তে বাংলাদেশ পুলিশ পদক (বিপিএম) পেয়েছেন তিনি। এসপি আমেনা বেগম বলেন, বিপিএম লাভ অত্যন্ত সম্মানের। কাজের স্বীকৃতি সব সময়ই  আরও ভালো করে কাজ করার প্রেরণা যোগায়।

 

আমেনা বেগমের শৈশব কেটেছে চট্টগ্রামে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এমএ পাস করেন। ১৯৯৯ সালে ১৮তম বিসিএস থেকে তিনি বাংলাদেশ পুলিশ সার্ভিসে যোগদান করেন। তিনি বলেন, ‘চ্যালেঞ্জিং কিছু করার ইচ্ছা থেকেই পুলিশ পেশায় আসি। বহুদিন বিসিএস থেকে পুলিশ বাহিনীতে নারী সদস্যের নিয়োগ ছিল না। ১৯৯৭-এ বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পুলিশ বাহিনীতে নারী সদস্য নিয়োগের সুযোগ করে দেন তখন আমি আবেদন করি। ভাইভাতে আমাকে দেখে বেশ অবাকই হন সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী কর্মকর্তা। তারা জানতে চান মেয়েদের এএসপি পদে চাওয়া হয়েছে কিনা। তারা এক রকম আমাকে ফিরিয়ে দিচ্ছিলেন। পরবর্তীতে বিষয়টি নিশ্চিত করায় ভাইভা বোর্ড আমার সাক্ষাৎকার নেন। পরীক্ষার পর বার বার আমার কাছে জানতে চাওয়া হয়, আপনি পুলিশের কাজ পারবেন তো?’

পুলিশিংয়ের মতো চ্যালেঞ্জিং পেশায় তার ক্যারিয়ারের দিকে তাকালে অর্জনের গ্রাফটাই উঁচু। তিনি বলেন, ‘নারী পুলিশদের জন্য ট্রেনিংটা সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জিং বিষয়। তারপর ফিল্ডে কাজ করাটাও চ্যালেঞ্জিং। পুলিশিং কার্যক্রমই মেল ডমিনেটিং ওয়ার্ক। নারী বলেই, আরও বেশি পরিশ্রম করি। কাজ করতে গিয়ে মোটাদাগে প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হয়নি। এখন যে পর্যায়ে কাজ করছি, এটি কমান্ডিং লেভেল। এখানে সবার সহযোগিতা পাচ্ছি।’

১৯৯৯ সালে আমেনা বেগম কুমিল্লার সহকারী পুলিশ সুপার (শিক্ষানবিস) হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। পরে ২০০৫ সালে পদোন্নতি পেয়ে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন ও পরে র‌্যাব সদর দফতরে যোগ দেন। তিনি জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে কাজ করেছেন। ২০০৬ সালে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে পূর্ব তিমুরে বাংলাদেশ আর্মড পুলিশ ইউনিটের ডেপুটি কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন তিনি।

সে অভিজ্ঞতা নিয়ে বলেন, ‘এ ধরনের মিশনে নারীর অশংগ্রহণ মূলক আইকোনিক। নারীর ক্ষমতায়ন ও অগ্রগতির প্রতিচ্ছবি এটি। তবে মিশনে একটানা দীর্ঘ সময় নারী পুলিশ সদস্য থাকা নিয়ে নতুন করে ভেবে দেখা দরকার।’

আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে পেশাগত অর্জন কম নয় তার। এসপি আমেনা বেগম ২০০৯ সালে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে আন্তর্জাতিক নারী পুলিশ সংস্থার এশিয়া অঞ্চলের সমন্বয়ক পদে নির্বাচিত হন। দ্বিতীয় মেয়াদেও এ দায়িত্ব পালন করেন। ২০১২ সালে বাংলাদেশের ‘প্রথম এশিয়ান উইমেন পুলিশ কনফারেন্স’-এ সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করেন। শুধু বিদেশ নয়, দেশেও তিনি নারী পুলিশিংয়ে অগ্রগণ্য ভূমিকা রেখেছেন।  তিনি বাংলাদেশ পুলিশ উইমেন নেটওয়ার্কে প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য। সুনাম ও সাহসিকতার সঙ্গে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-পুলিশ কমিশনার (এসপি), এআইজি (হাইওয়ে পুলিশ) এবং পার্বত্য রাঙামাটি জেলার পুলিশ সুপারের দায়িত্ব পালন করেন। ২০১২ সালে ‘আইজেন হওয়ায় ফেলোশিপ’-এর জন্য মনোনীত হন। যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়া অঙ্গরাজ্যসহ ১৬টি অঙ্গরাজ্যে, যুক্তরাষ্ট্রের পুলিশ বিভাগ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পুলিশিংয়ের ওপর অভিজ্ঞতা অর্জন করেন তিনি। এ ছাড়া মেক্সিকো, ইউএসএ, জার্মানি, দক্ষিণ আফ্রিকাসহ ইউরোপে পুলিশের বিভিন্ন সেমিনারে অংশ নিয়ে বিশ্বে নারী পুলিশ হিসেবে প্রশংসা কুড়াচ্ছেন তিনি।

পরিবারের সহযোগিতার কথাও বলেন তিনি। এসপি আমেনা বেগম বলেন, বিসিএস পরীক্ষার জন্য বাবা, মা, ভাই ও বোন সবাই উৎসাহ দিয়েছেন বলেই আজকের এই অবস্থানে আসতে পেরেছি।

 

পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে তিনি নারী ও শিশু সহায়তা কেন্দ্র খুলেছেন। বিভিন্ন পারিবারিক কলহ, নির্যাতন ও বিবাদের মীমাংসার চেষ্টা করা হয় এখানে। প্রয়োজনীয় আইনি পরামর্শ ও পুলিশি সহায়তা প্রদান করা হয় দ্রুত। এসপি আমেনা বেগম বলেন, ‘এই সহায়তা কেন্দ্রে সাধারণ পারিবারিক  কলহ ও নির্যাতনের অভিযোগ আসে। আমরা বিবদমান দুই পক্ষের পরিবারের সঙ্গে কথা বলে বিবাদ মিটিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করি। দরকার হলে পুলিশি সহায়তা দেই। নারীদের অভিযোগ শোনার জন্য নারী পুলিশ রয়েছে। তাই নারীরা নির্ভয়ে তাদের অভিযোগ উত্থাপন করতে পারে।’

নারী উন্নয়ন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘নারীরা এগিয়ে আসছে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের সাফল্যের খবর প্রেরণা যোগায়। আমি মনে করি না, সমাজে বা পরিবারে নারী-পুরুষের বিভেদ বা দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য নারীর অগ্রযাত্রায় বাধা। এ ধরনের চ্যালেঞ্জ সব কিছুতেই আছে। বাইরে তাকালে দেখবেন, পোশাক শ্রমিক থেকে শুরু করে উঁচু পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তা— সব ধরনের পেশাতেই নারীরা এসেছে।’

 

নরসিংদীর আইনশৃঙ্খলার উন্নয়ন ঘটাতে তিনি সচেষ্ট রয়েছেন। আমেনা বেগম বলেন, সন্ত্রাস, মাদক, জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে আমরা লড়াই করে যাচ্ছি। নারীর নিরাপত্তা প্রদানেও আমরা সচেষ্ট। নারী নির্যাতনের অভিযোগগুলো গুরুত্বের সঙ্গে  দেখা হয়। এ ছাড়া কমিউনিটিং পুলিশকে আরও কার্যকরী করে তুলতে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। সাধারণ মানুষকে পুলিশিংয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে পারলে কাজটা সহজ হয়ে যায়। এই এলাকার মাদক নিয়ন্ত্রণেও পূর্ণোদ্যমে কাজ করছি।’

 

কর্মব্যস্ত মানুষটির অবসর নেই বললেই চলে। অবসরে গান শোনেন, বই পড়েন। ইংরেজি সাহিত্যে পড়াশোনা করেন বলে বই পড়াতেই তার আনন্দ। তবে সে ফুরসত এখন মেলা ভার। ব্যক্তি জীবনে বিবাহিত আমেনা বেগমের অবসর এখন পরিবার ও সন্তানকে নিয়েই কাটে।

 

তার কাছে সাফল্যের মূলমন্ত্রই হচ্ছে, নিয়ম মেনে চলা। চৌকস ও সাহসী এই নারী এসপি বলেন, চাকরি জীবনে বারবার প্রমাণ করতে হয়েছে একজন নারী হয়েও তিনি নিয়মিত পুলিশিং দায়িত্ব পালন করতে পারেন।

সে কাজটাই তিনি করে যাচ্ছেন।

সর্বশেষ খবর