শনিবার, ২২ এপ্রিল, ২০১৭ ০০:০০ টা

জামদানির আঁতুড়ঘর রূপগঞ্জ

জামদানির আঁতুড়ঘর  রূপগঞ্জ

শীতলক্ষ্যার তীরে ভেড়ানো ময়ূরপঙ্খী। নদীর বুকে তপ্ত রোদে খেলা করছে মৃদু বাতাস। পাশেই টিনের দোচালা ঘরে নিঃশব্দে জামদানির জমিনে নকশা ফুটিয়ে চলেছেন কারিগররা। মনের হাজারো আঁকিবুঁকিকে রং নকশায় ফুটিয়ে তুললেও বর্ণহীন থেকে যাচ্ছে তাঁতিপল্লীর জীবন। শীতলক্ষ্যার ঢেউয়ের মতোই দিন দিন ক্ষীণ হয়ে আসছে রূপগঞ্জের জামদানি পল্লীর কারিগরদের জীবনযাত্রা। জামদানির প্রতিটি পরতে জড়িয়ে আছে হাজারো গল্পের সূচনা ও শেষ। এক সময় বজরা, পানসী নৌকা করে দেশের বিভিন্ন জেলা এবং পাশের দেশ থেকে রূপগঞ্জে জামদানি কিনতে আসার গল্প এখন ইতিহাস। রূপগঞ্জের জামদানি পল্লী ঘুরে এসে এসব অজানা গল্প তুলে ধরছেন— জয়শ্রী ভাদুড়ী , ছবি তুলেছেন— গোলাম মোস্তফা তুহিন

 

রূপগঞ্জের জামদানি তাঁতিদের সকাল-সন্ধ্যা

জামদানি শব্দের উৎপত্তি নিয়ে নানা মতভেদ থাকলেও এক পক্ষের মতে, শব্দটি ফার্সি ভাষা থেকে এসেছে। ফার্সি জামা অর্থ কাপড় এবং দানা অর্থ বুটি। এ ক্ষেত্রে জামদানির অর্থ আসে বুটিদার কাপড়। ধারণা করা হয় মুসলমানরাই ভারতীয় মহাদেশে প্রথম জামদানির প্রচলন করেছিলেন। আরেক দলের মতে, ফারসিতে জাম অর্থ এক ধরনের উত্কৃষ্ট মদ এবং দানি অর্থ পেয়ালা। জাম পরিবেশনকারী ইরানি সাকীর পরনের মসলিন থেকে জামদানি নামের উৎপত্তি ঘটেছে।

চতুর্দশ শতাব্দীতে ভারতীয় উপমহাদেশ ভ্রমণের সময় ইবনে বতুতা সোনারগাঁও এলাকার সুতি বস্ত্রের প্রশংসা করেন। মোগল আমলকে বলা হয় বাংলাদেশের জামদানির স্বর্ণযুগ। এ সময় ঢাকা থেকে এক লাখ টাকা মূল্যমানের কাপড় রাজ দরবারে রপ্তানি করা হয়। তখন শীতলক্ষ্যার বাতাস আর পানির স্পর্শে রূপগঞ্জ ও এর আশপাশের গ্রামে গড়ে ওঠে জামদানি সাম্রাজ্য।

রূপগঞ্জের জামদানির ইতিহাস বলতে গিয়ে চোখ বন্ধ করে মনে করার চেষ্টা করছিলেন ৮৫ বছরের বৃদ্ধ তাঁতি আবদুল গফুর। ‘ছোটবেলায় দাদা-দাদির মুখে শুনেছিলাম ব্রিটিশ আমলে আমাদের এলাকার জামদানি খুব চলত। সাহেব-মেমরা আসত জামদানি কিনতে। তারা জোড়ায় জোড়ায় শাড়ি কিনে নিয়ে যেত ইংল্যান্ডে। কিন্তু এর মধ্যে শুরু হলো ষড়যন্ত্র। এখান থেকে কারিগরদের ধরে নিয়ে গিয়ে বিদেশে শাড়ি তৈরি করে কম দামে বিক্রির পাঁয়তারা করল ব্রিটিশরা। কিন্তু বেঁকে বসল কারিগররা। তারা বুদ্ধি করে প্রতিদিন কেজি কেজি তেল মাখতে শুরু করল তাঁত বসানোর কাঠে। মধ্যে থেকে ইচ্ছা করে সুতা কেটে দিতে শুরু করল। এতে করে দেখা গেল জামদানির খরচ পড়লো তিনগুণ বেশি। জামদানি বেচে লাভ তো নয় বরং গাঁট থেকে পয়সা খরচ হচ্ছে দেখে কারিগরদের দেশে পাঠিয়ে দিল ব্রিটিশরা।’ গল্প শেষ করে হাঁফাচ্ছিলেন তিনি। ‘আসলে এটা আমাদের কত পুরুষের ব্যবসা তা আমরা জানি না। জন্মের পর থেকে তাঁত, মাকু আর সুতার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছি আমরা।’ বলতে গিয়ে চোখের কোণে পানি ছলকে ওঠে বৃদ্ধ এই জামদানি শিল্পীর।

নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলা। নোয়াপাড়া গ্রামকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে জামদানি পল্লী। আগে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে কাজ করতেন কারিগররা। কোনো ধরনের সুযোগ-সুবিধা ছিল না তাদের। তাই জামদানি শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে সরকারি সাহায্যে ১৯৯১ সালে নোয়াপাড়াতে তৈরি হয় জামদানি পল্লী। এখন জামদানি পল্লীতে রয়েছে প্রায় ৪০০ তাঁত। সেখানে তাঁতি পল্লীর বাসিন্দার পাশাপাশি কুমিল্লা, কিশোরগঞ্জ, ময়মনসিংহ, জামালপুর, ফরিদপুর, নোয়াখালী, পাবনাসহ দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে কাজ শিখতে আসেন বেকার যুবকরা। জামদানি তৈরি শিখে নিজেদের এলাকায় অনেকেই গড়ে তুলেছেন নিজের তাঁতের কারখানা। অনেককেই নাম লিখিয়েছেন সেরা কারিগরের তালিকায়। শুধু জামদানি পল্লীতে আটকে নেই কারখানা। নোয়াপাড়ার পাশের মৈকুলী, মগরাকল, কাহিনা,

গন্ধবপুর, সোনারগাঁও, খিদিরপুর, ভারগাঁও, কাজীপাড়া, বড়গাঁও, আমগাঁও, ট্যাংগর, আন্ধারমানিক, দেওভোগ, নানাখি, নোয়াপুর, গঙ্গাপুরসহ আশপাশের আরও অনেক গ্রামে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে প্রায় এক দেড় হাজার তাঁত।

এই তাঁত শিল্পের সঙ্গে জড়িয়ে আছে প্রায় পাঁচ হাজার মানুষের পরিবার। জেলা জামদানি শ্রমিক ইউনিয়ন সূত্রে জানা যায়, ১৯৭৫ সালেও এই এলাকাতে এক লাখ ৩০ হাজারের মতো জামদানি কারিগর ছিলেন। কিন্তু দিনের পর দিন অভাব অনটনে পেশা পরিবর্তন করছেন জামদানি কারিগররা। আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন এই নিপুণ শিল্পীরা। ১৯৯৭ সাল থেকে শুরু হয় জামদানি শিল্পের সংকট। নানা অনিয়মের কারণে ওই বছরই বন্ধ হয়ে যায় জামদানি রপ্তানি। ফলে ধ্বংসের মুখে এসে দাঁড়ায় শিল্পটি। পরে সরকারি চেষ্টায় আস্তে আস্তে ঘুরে দাঁড়ায় শিল্পটি। কিন্তু বড় বড় শপিংমল আর মধ্যস্বত্ব ভোগীদের আনাগোনায় লাভের মুখ দেখছে না তাঁতিরা। আর এর পাশাপাশি ভারতীয় এবং দেশীয় মানহীন কমদামি জামদানির সঙ্গেও প্রতিনিয়ত পাল্লা দিয়ে চলতে হচ্ছে তাদের।

 

গুরুর রক্ত ঝরিয়ে শেখে সাগরেদ

তাঁতে সুতা বসিয়ে তৈরি করা হয় শাড়ির জমিন। আর হাতে লোহার তৈরি মাথা চোখা পেট ফাঁকা করা মাকুতে জড়ানো থাকে নকশা তোলার সুতা। একপাশে নকশা তুলে শাড়ির দুইপর্দা জমিনের মধ্য দিয়ে বিদ্যুৎ গতিতে মাকু ওই প্রান্তে ছুড়ে দেয় কারিগর। তা ধরে নিয়ে অপরপ্রান্তে ওই নকশার অনুকরণে নকশা তোলে সাগরেদ। কিন্তু প্রথম দিকে মাকু ছুড়ে দিলে অভ্যাস না থাকায় ধরতে পারে না সাগরেদ। ফলে সুতার ফাঁক দিয়ে তাঁতের নিচে কারিগরের পায়ে বিঁধে মাকুর ধারালো মাথা। এভাবে যতদিনে সাগরেদ মাকু ধরা না শেখে ততদিন গভীর হতে থাকে কারিগরের পায়ে আঘাতের চিহ্ন।

হরেক পাড়ের বাহারি নাম

জামদানি শাড়ির মূল আকর্ষণ থাকে পাড়ে। আর এই পাড়ের সঙ্গে মিলিয়ে শাড়ির শরীরজুড়ে ফুটিয়ে তোলা হয় আকর্ষণীয় অনবদ্য নকশা। নকশার নাম জিজ্ঞেস করতে কলকলিয়ে ওঠে আকরাম খানের তাঁত ঘর। সবার রুটি-রুজি আর ভালোবাসার জায়গায় যেন দোলা দিয়ে যায় প্রশ্নটি। করোলা, আঙ্গুর লতা, পুঁইডগা, পান, চালতা, ইঞ্চি, মদন, কাওয়ার টেংরি, খাণ্ডা, আলগা, উড়া, ফুল, সুপারি পাড়। আর শাড়ির মাঝের নকশার মধ্যে আছে তারা ফুল, শাপলা, গোলাপ, হাঁসফুল, বিলায় আড়া, ইচার টেংরি, বাঘের পাড়া, চেনকেচি, শিকড় কেচি, আম পাড়াসহ হাজারো নাম। আসলে জামদানির নকশার কোনো ধরাবাঁধা নিয়ম নেই। কারিগরের দক্ষতা আর নকশা তোলার ওপর তৈরি হয় শাড়ির কারুকাজ।

 

শুকতারার আলোয় জামদানি হাট

বৃহস্পতিবার ভোর রাত ৪টা। হাঁক-ডাকে উত্তাপ বাড়ছে রূপগঞ্জের জামদানি পল্লীতে। পূর্ণিমা হোক আর অমাবস্যা শুকতারার আলোয় জমে ওঠে রূপগঞ্জের জামদানি পল্লীর হাট। আর সকাল ৭টা পার হতেই শেষ বেচা-কেনা। হাটের টিনের চালা দেওয়া ঘরে নিজেদের তৈরি জামদানি নিয়ে পসরা সাজান তাঁতিরা। আর ব্যাপারীর চোখ খোঁজে ফেরে নতুন নকশা আর নিখুঁত জমিন। হাতের ভাঁজে নিখুঁত জামদানি পড়লেই ছোঁ মেরে তুলে নেন ব্যাপারীরা। দাম দর সেরে বগলদাবা করেন কোম্পানি বা শো-রুমের জন্য। আর অর্ডার দেওয়ার থাকলে নমুনা শাড়ি দেখে দাম ঠিক করে অর্ডার দিয়ে যান কারখানা মালিকদের। অর্ডারে টাকার সঙ্গে চুক্তি থাকে সময়ের। রূপগঞ্জের এই জামদানি হাট ধরতে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসেন কাপড় ব্যবসায়ীরা। জামদানি পল্লীর কারখানা মালিকরা বলেন, জামদানি পল্লীর প্রতি হাটে আনুমানিক ২ কোটি টাকার বেচাবিক্রি হয়। তবে উৎসব বা কোনো অনুষ্ঠান থাকলে অনেক সময় এর চেয়ে বিক্রি বাড়ে আবার অনেক সময় ব্যবসায় ভাটাও পড়ে।

 

আঙ্গুলের জাদুতে জামদানি বুনন

জামদানি পল্লীর তাঁতিদের মধ্যে এখন গড়ে উঠেছে দুই শ্রেণি। কেউ ছেলেমেয়েকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে অন্য পেশায় নিতে চাইছে। কেউ আবার নিজের শিল্পীসত্তার বীজ সন্তানদের মধ্যে বপন করে পড়াশোনা নয় বরং তৈরি করতে চাইছেন সেরা কারিগর। কোনো ধরনের লোহালক্কড়, বিদ্যুৎ বা গ্যাস ছাড়া শুধু কাঠের তাঁত আর বাঁশের খোঁটায় তৈরি হয় স্বপ্নের জামদানি। এই অবিশ্বাস্য ভেলকি ঘটে যায় চোখের সামনে জাদু আঙ্গুলের ছোঁয়ায়। কারিগর মনে ভাবে, চোখে দেখে আর আঙ্গুল সেই চিত্র ফুটিয়ে তোলে জামদানির জমিনে। সুতা-জরির আনাগোনায় কারিগরের সেই কাজ শোভা পায় নববধূর গায়ে। একটি শাড়ি গড়ে দিয়ে যায় সম্পর্কের সূচনা, কিছু স্বপ্নের জায়গা।

 

ব্র্যান্ডিং হয়নি রূপগঞ্জের জামদানি

রূপগঞ্জের এই জামদানি রপ্তানি হচ্ছে বিশ্বব্যাপী। বাংলাদেশের এক নিভৃত পল্লী থেকে ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, সৌদি আরব, লন্ডনের আলো ঝলমলে শপিং মলে জায়গা করে নিয়েছে জামদানি শাড়ি। এই কাপড়ের শাড়ির পাশাপাশি তৈরি হয় সালোয়ার-কামিজ, কুর্ত্তা, পাঞ্জাবি, ওড়নাসহ রকমারি পোশাক। প্রতি বছর ৫০-৬০ কোটি টাকার জামদানি শাড়ি রপ্তানি হয়। কিন্তু এর লভ্যাংশ ওঠে না জামদানি শিল্পীর হাতে। লাভের অংশ যায় ব্যবসায়ী, মহাজন আর মধ্যস্বত্ব ভোগীদের হাতে।

লাভ তো নয়ই রূপগঞ্জের জামদানি শিল্পীরা পায়নি তাদের প্রাপ্য সম্মানটুকুও।

জামদানির আদিভূমি হিসেবে বাংলাদেশ পেয়েছে আন্তর্জাতিক মেধাস্বত্ব্ব বিষয়ক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল প্রোপার্টি রাইটস অর্গানাইজেশনের স্বীকৃতি। তারা জামদানিকে বাংলাদেশের জিওগ্রাফিক্যাল ইনডিকেশনের ধাপ অনুযায়ী জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। কিন্তু জামদানির আদিভূমি রূপগঞ্জ এখনো লোকচক্ষুর অন্তরালে। মানুষ ঢাকায় জামদানি খোঁজে কিন্তু কারখানা হলো রূপগঞ্জে। তাই আজও উপেক্ষিত রূপগঞ্জের জামদানি পল্লীর নীরব শিল্পীরা। তাদের দাবি সম্মান বা অর্থ নয় জামদানির সঙ্গে এই শিল্পের জন্মস্থান রূপগঞ্জের নামটির প্রসার। তাই নিজেদের অস্তিত্ব এবং ভালোবাসার জায়গা জামদানি শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে সরকারের সদিচ্ছা এবং সহযোগিতা চান জামদানি শিল্পীরা।

সর্বশেষ খবর