শনিবার, ২২ এপ্রিল, ২০১৭ ০০:০০ টা
স্টিভেন স্পিলবার্গ

“তোমাকে দিয়ে আর যাই হোক সিনেমা হবে না

তানভীর আহমেদ

“তোমাকে দিয়ে আর যাই হোক সিনেমা হবে না

বিশ্বকাঁপানো সিনেমা পরিচালক স্টিভেন স্পিলবার্গ। এই জাদুকরী নির্মাতা শুরুর দিকে মোটেও পাত্তা পাননি কারও কাছে। ক্যালিফোর্নিয়ার সাউদার্ন ইউনিভার্সিটি অব সিনেমাটিক আর্টসে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে ফেল করেছেন। ‘সি গ্রেড’ থাকায় প্রথমবার সুযোগ না পেয়ে দ্বিতীয়বার আবার ভর্তির চেষ্টা করেন। সেবারও তিনি রিজেক্টেড হন—উল্টো তাকে বলে দেওয়া হয়, তোমাকে দিয়ে আর যাই হোক, সিনেমা হবে না। এর চেয়ে ভালো অন্য কিছু কর...। সেই মানুষটিই জ্যস, শিল্ডলার্স লিস্ট, সেভিং প্রাইভেট রায়ান,  জুরাসিক পার্ক, ক্যাচ মি ইফ ইউ ক্যান—এমন বহু বিখ্যাত চলচ্চিত্র তৈরি করে বিশ্ববাসীকে চমকে দিয়েছেন...

 

নিউ হলিউড যুগে সবচেয়ে প্রতিভাবান, খ্যাতিমান ও শক্তিমান সিনেমা পরিচালক স্টিভেন স্পিলবার্গ। তাকে হলিউডের ম্যাজিশিয়ানও বলা হয়। নয়তো আর কি! তার বানানো সিনেমাগুলো জাদুমন্ত্রের মতো যে দর্শকদের বুঁদ করে ফেলে। দর্শক সিনেমা হল থেকে বেরিয়ে এসে, সেই সিনেমাতেই মাতাল। স্পিলবার্গের ঘোর কাটাতে আরেকবার সিনেমা দেখাটাই স্বস্তি। ঠোঁটকাটা সমালোচকরাও মানেন, স্পিলবার্গের মাস্টারপিস বিশ্ব সিনেমায় গুপ্তধনতুল্য।

স্টিভেন স্পিলবার্গের জন্ম আমেরিকার নিউ জার্সি শহরের সিনসিনাটিতে। সালটা ১৯৪৬। শৈশব কেটেছে ফিনিক্স শহরের কাছে স্কটসডেলে। তার পরিবারের অবস্থাও খুব ভালো ছিল না। বাবা ছিলেন একজন ইলেকট্রিক ইঞ্জিনিয়ার। অবশ্য সংগীতপ্রেমী মায়ের পিয়ানো শুনে লোকে বাহবা দিত। ভিডিও ছবি নির্মাণে স্পিলবার্গের কৌতূহল বহু আগে থেকেই ছিল। তার প্রথম কাজ ছিল ‘এসকেপ টু নোহোয়ার’। ৪০ মিনিটের এই ছবি যখন তিনি বানান তখন তার বয়স ছিল মাত্র ১৩। ১৯৬৩ সালে মাত্র ১৬ বছর বয়সে স্পিলবার্গ ‘ফায়ারলাইট’ নামে একটি ছবি প্রযোজনা করেন। যে ছবি থেকে উদ্বুদ্ধ হয়ে পরবর্তীতে তিনি ‘ক্লোজ এনকাউন্টার’ ছবিটি নির্মাণ করেন। জেনে অবাক হতে হয়, তার প্রথম প্রযোজিত ছবিটি স্থানীয় মুভি থিয়েটার থেকে প্রায় ১০০ ডলার লাভ করে। সিনেমা নিয়ে এত মাতামাতি থাকলেও পড়াশোনায় সুবিধা করতে পারেননি তিনি। তিনি সিনেমা নিয়ে পড়তে গেলেন ক্যালিফোর্নিয়ায়। সেখানে ইউনিভার্সিটি অব সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়া সিনেমাটিক আর্টসে ভর্তি হতে চাইলেন। কিন্তু তার রেজাল্ট খারাপ ছিল। সি গ্রেড থাকায় তাকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। দ্বিতীয়বার আবার ভর্তি পরীক্ষা দিলেও কাজ হয়নি। উল্টো তাকে শুনিয়ে দেওয়া হলো— এই রেজাল্ট নিয়ে সিনেমা নিয়ে পড়াশোনা হবে না। বরং সিনেমা বানানোর মাথা থেকে ভূত ঝেড়ে ফেলে অন্য কিছু কর!

ইইউসিএসে ভর্তি হতে চেয়েও পারেননি। এত বাজে রেজাল্ট দেখে কেউই ভর্তি করতে চাইলেন না তাকে। ইইউসিএস থেকে তিনবার ‘রিজেক্টেড’ হয়েছেন তিনি। শেষ পর্যন্ত বাবার কথায় সিনেমা নিয়ে পড়াশোনার কথা বাদ দিয়ে ভর্তি হলেন ক্যালিফোর্নিয়ার স্টেট ইউনিভার্সিটিতে। ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করলেও সিনেমা বানানোর অদম্য ইচ্ছা তার ছিল। তাই পড়াশোনা ছেড়ে সিনেমা বানানোর দিকেই ঝুঁকলেন। এজন্য কম কথা শুনতে হয়নি তাকে।

 

তার প্রথম স্টুডিওটিকে স্টুডিও না বলে একটা খুপড়ি ঘর বলাই ভালো। তিনি প্রতিদিন অফিসের গেটের দারোয়ানের সঙ্গে সুট-টাই পরে অফিসে ঢুকতেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী থাকা অবস্থাতেই ইউনিভার্সাল স্টুডিওতে ইন্টার্ন কাজের সুযোগ পেয়ে যান। বিনা বেতনে কাজ করতেই হাসিমুখে রাজি হয়ে যান তিনি। ২৪ মিনিটের ছবির কাজ এমব্লিন নিয়ে যাত্রা শুরু করলেন। এর জন্য এক বন্ধুর কাছ থেকে ধার করলেন ১৫ হাজার ডলার। এরপর তাকে পিছে ফিরে তাকাতে হয়নি। স্থানীয় একটি টিভি চ্যানেলের সঙ্গে সাত বছরের চুক্তিতে তৈরি করলেন কিছু টিভি ড্রামা, ফিচার ফিল্ম। যেমন, ‘দ্য নাইট গ্যালারি’, ‘মারকাস ওয়েলবি এমডি’, ‘দ্য নেম অব দ্য গেম’, ‘ডুয়েল’। তবে ইউনিভার্সেল স্টুডিওতে কাজ করার সুযোগ স্পিলবার্গের ক্যারিয়ারে নতুন দিগন্তের উন্মোচন করে দেয়। ইউনিভার্সেল থেকে স্পিলবার্গ প্রথম ফিচার ফিল্ম তৈরি করেন ১৯৭৪ সালে। নাটকীয় কমেডিভিত্তিক ছবিটির নাম ‘সুগারল্যান্ড এক্সপ্রেস’। সে বছর ছবিটি মুক্তি পাওয়ার পর চারদিকে আলোড়ন পড়ে যায় এবং ছবিটি কান

চলচ্চিত্রের উৎসবে শ্রেষ্ঠ ছবির পুরস্কার জিতে নেয়। তারপরের বছরই, ১৯৭৫ সালে স্পিলবার্গ নির্মাণ করেন আরও একটি অসাধারণ ছবি

জ্যস’। ‘জ্যস’ স্পিলবার্গকে আন্তর্জাতিক খ্যাতি ও সম্মান এনে দেয়। ব্যাপক সফলতার সঙ্গে ছবিটি বিভিন্ন দেশে সুপারহিট হওয়ার পর ১৯৭৬ সালে এটি একাডেমি অ্যাওয়ার্ডের জন্য মনোনীত হয় এবং সবাইকে অবাক করে দিয়ে প্রথমবারের মতো স্পিলবার্গের কোনো ছবি এডিটিং, সাউন্ড ও অরজিনাল স্কোর এ তিনটি শাখায় অস্কার জিতে নেয়। ছবিটি পরবর্তীতে ১০০টি শ্রেষ্ঠ আমেরিকান ছবির অন্তর্ভুক্ত হয়। সবচেয়ে বড় কথা এ ছবির মধ্য দিয়ে স্পিলবার্গ সর্ব সাধারণের ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে আসেন।

স্পিলবার্গের পরিচয় যে কেবল পরিচালক হিসেবেই সীমাবদ্ধ থেকেছে তা নয়। প্রযোজক হিসেবেও তিনি উজ্জ্বল হয়ে আছেন। তার পরিচালিত ছবি মাত্র ৪৮টি। কিন্তু প্রযোজিত ছবির সংখ্যা ১০৭টি। তিনি একজন অভিনেতাও বটে। ‘অস্টিন পাওয়ারস ইন গোল্ডমেম্বার’, ‘ভেনিলা স্কাই’, ‘দ্য লস্ট ওয়ার্ল্ড’, ‘জুরাসিক পার্ক’, ‘ইউওর স্টুডিও অ্যান্ড ইউ’, ‘গ্রিমলাইন’, ‘ইন্ডিয়ানা জোন্স’, ‘দ্য টেম্পেল অফ ডুম’, ‘দ্য ব্লস ব্রাদার্স’, ‘জ্যস’, ‘সামথিং এভিল’ ছবিতে অভিনয় করেছেন তিনি। ১৯৯৮ সালে স্পিলবার্গ তার ধারার সম্পূর্ণ বিপরীত রকমের একটি ছবি নির্মাণ করলেন ‘সেভিং প্রাইভেট রায়ান’। এ ছবিটিকে বলা হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সবচেয়ে বাস্তবসম্মত শ্রেষ্ঠ একটি ছবি। নব্বইয়ের দশকে স্পিলবার্গ ঝড়ের মতো একের পর এক কাজ করে গেছেন।

এ সময়েই মুক্তি পায় তার জীবনের সবচেয়ে ব্যবসা সফল ও জনপ্রিয় দুটি ছবি ‘জুরাসিক পার্ক ও ‘শিন্ডলার’স লিস্ট’— এমন ছবির কথা বলে শেষ করা যাবে না। স্পিলবার্গ  ক্যামেরায় মানুষের গল্প যেভাবে বলেছেন তার অতুলনীয়।

আজ বলাই যায়, নানা ব্যর্থতা পেরিয়ে জীবন জয়ের এক সোনালি গল্পে শিরোনাম ‘স্পিলবার্গ’।

সর্বশেষ খবর