শনিবার, ২২ এপ্রিল, ২০১৭ ০০:০০ টা
জীবনযুদ্ধে জয়ে স্বপ্ন পূরণে এগিয়ে যাচ্ছে শারীরিক প্রতিবন্ধী রীতা

অদম্য ইচ্ছাশক্তির কাছে হার মেনেছে দারিদ্র্য

রিয়াজুল ইসলাম, দিনাজপুর

অদম্য ইচ্ছাশক্তির কাছে হার মেনেছে দারিদ্র্য

খুব ভোরে ঘুম থেকে ওঠে প্রতিবন্ধী রীতা। নিজের বই পড়া শেষ করে সংসারের কাজে মা-কে সাহায্য করে। এরপর কলেজ না থাকলে হাজিরা অনুযায়ী কাজে যায় মাঠে। তবে সবাই তাকে কাজে নেয় না। এ সময় মা ভিক্ষা করতে যায়। এভাবে চলে তাদের মা-মেয়ের সংসার। আর এ জীবন যুদ্ধে জয় করেই ভবিষ্যৎ স্বপ্নপূরণে এগিয়ে যাচ্ছে শারীরিক প্রতিবন্ধী রীতা। শারীরিক প্রতিবন্ধী আর দরিদ্রতার কশাঘাতে জর্জরিত মাকে নিয়ে ভিক্ষাবৃত্তি করে এ স্বপ্ন দেখছেন সর্বোচ্চ ডিগ্রি অর্জনে রীতা। পিতৃহারা এ মেয়েটি এখন বীরগঞ্জ ডিগ্রি কলেজের মানবিক বিভাগে স্নাতক ১ম বর্ষের ছাত্রী। অভাব আর দরিদ্রতাকে জয় করে মেধাবী এ মেয়েটি চালিয়ে যাচ্ছে তার শিক্ষাজীবন। পিতৃহারা শারীরিক প্রতিবন্ধী রীতার অদম্য ইচ্ছা শক্তির কাছে হার মেনেছে দরিদ্রতা। দিনাজপুরের বীরগঞ্জের শিবরামপুর ইউপির গোবিন্দপাড়া গ্রামের মৃত যদু বর্মণের মেয়ে রীতা রানী। বাবা গোবিন্দ বর্মণ যদু মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত দি রওশন সার্কাসে কাজ করেছে।

শারীরিক প্রতিবন্ধী রীতার অসুস্থ মাকে নিয়ে বাঁশের তৈরি জীর্ণ খুপরি ঘরে বসবাস করতেন। মা জ্যোত্স্না কাজ ও ভিক্ষাবৃত্তি করে সংসার চালান। পিতার অবর্তমানে সংসারে মাকে নিয়ে ভিক্ষাবৃত্তি করে সর্বোচ্চ ডিগ্রি অর্জনের স্বপ্ন তার। তার এ অবস্থা দেখে দিনাজপুর প্রেস ক্লাব ও ঢাকার বীরগঞ্জ সমিতি ইতিমধ্যে একটি দোচালা টিনের ঘর করে দিয়েছে। তাদেরকে আর্থিকভাবে কিছু সাহায্য করে থাকেন বীরগঞ্জের সোহেল আহমদ নামের এক ব্যক্তি। সোহেল আহমদ মাঝে মাঝে খোঁজখবর নেয় তাদের। প্রয়োজনে আর্থিকভাবেও সহযোগিতা করে।

বীরগঞ্জের গোবিন্দপাড়া গ্রামের পিতৃহীন শারীরিক প্রতিবন্ধী রিতা রায় ১১ মাস বয়স থেকেই কঠিন দরিদ্রতার সঙ্গে যুদ্ধ করে শিক্ষাগ্রহণ করে আসছে। গ্রামের গোবিন্দপাড়া সোহাগ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় হতে ২০০৮ সালে ৫ম শ্রেণি পাস করে পার্শ্বের গ্রামের পাবলিক দ্বিমুখী উচ্চবিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। লেখাপড়া করার প্রবল ইচ্ছে প্রকাশ করায় তার বিধবা মা জ্যোত্স্না মানুষের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ এবং দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা করে লেখাপড়ার খরচ জোগান দিয়ে আসছে। খেয়ে না খেয়ে রীতা রায় মায়ের জোগান দেওয়া সামান্য অর্থের ওপর ভর করেই তার লেখাপড়া চালিয়েছে। কোনো রকম প্রাইভেট পড়া ছাড়াই সে ২০১৪ সালের এসএসসি পরীক্ষায় ৩ দশমিক ৬৩ মার্কস পেয়ে মানবিক বিভাগে বি গ্রেডে পাস করে। এসএসসি পাস করার পরেও রীতা রায় লেখাপড়া চালিয়ে যেতে চায়, তাই তার মা এবং বীরগঞ্জ ডিগ্রি কলেজের শিক্ষকদের সহযোগিতায় এইচএসসিতে মানবিক বিভাগে আবারও ভর্তি হয়। এইচএসসিতে ভর্তির পর তার কষ্ট আরও বেড়ে যায়। গ্রামের বাড়ি থেকে কলেজের দূরত্ব ২২ কি.মি. পথ। যাতায়াতের এই দীর্ঘ পথ হেঁটে এবং ভিক্ষে করে বাসের ভাড়া এবং নিজেদের খাওয়ার পয়সা উঠাতে হয় তাকে। শত কষ্টের মাঝে হার মানেনি রীতা রায়। প্রায় প্রতিদিন সে কলেজে যায়। এরপরে এইচএসসি পাস করে এখন বীরগঞ্জ ডিগ্রি কলেজের মানবিক বিভাগে স্নাতক ১ম বর্ষের ছাত্রী। সে পড়ালেখার মাঝে বিভিন্ন কাজও করে থাকে দিন হাজিরায়। তাদের এ দুরবস্থার সময়ে বীরগঞ্জের এক তরুণ ব্যবসায়ী সোহেল আহমদ মাঝে মাঝে খোঁজখবর নেয় তাদের। প্রয়োজনে আর্থিকভাবে সহযোগিতাও করে। শারীরিক প্রতিবন্ধী রীতা রায় জানান, আজ যতটুকু শিক্ষার আলো সে পেয়েছে সমস্তটাই তার মায়ের অবদান। মানুষের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ এবং ভিক্ষাবৃত্তি করে যে আয় হতো সেখান থেকেই তার মা তাকে লেখাপড়া করার জোগান দিয়েছে এবং তিন বেলার জায়গায় এক বেলা অন্ন জুগিয়েছে। পৈতৃক সহায় সম্পত্তি না থাকায় বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে তাদের সংসারে অভাব অনটন লেগেই রয়েছে। উপায়ন্তর না পেয়ে তখন থেকে সংসার চালাতে মা জ্যোত্স্নাকে ঝিয়ের কাজ ও ভিক্ষাবৃত্তিতে জড়িয়ে পড়তে হয়। সে আরও জানায়, প্রতিবন্ধী দুই বোনের মধ্যে সে ছোট, বড় বোন প্রমিলাও প্রতিবন্ধী। এত কষ্টের মাঝেও তাকে গ্রামেই কৃষিকাজ করা এক যুবকের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছে তার মা। তাদের সংসারে একটি কন্যা শিশু রয়েছে। রীতা  রায় তার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণের প্রবল ইচ্ছা রয়েছে তার। শিক্ষক হয়ে সমাজের অবহেলিত জনগোষ্ঠীর হয়ে কাজ করতে চায় সে। যারা লেখাপড়া বঞ্চিত তাদের পাশে আমিও যেন দাঁড়াতে পারি। শিবরামপুর ইউপি চেয়ারম্যান চনক চন্দু অধিকারী জানান, রীতার শিক্ষার জন্য তার মা প্রতিদিন এক রকম যুদ্ধ করে চলেছে। মানুষের দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা ও ঝিয়ের কাজ করে মেয়েকে লেখাপড়া করাচ্ছে। বীরগঞ্জ ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ খায়রুল ইসলাম জানান, গোবিন্ধপাড়া গ্রামের শারীরিক প্রতিবন্ধী রীতা রায় বীরগঞ্জ ডিগ্রি কলেজের মানবিক বিভাগে স্নাতক ১ম বর্ষের ছাত্রী। তার লেখাপড়া করার অদ্যম ইচ্ছা রয়েছে বলেই আমরা সবাই মিলে সহযোগিতা করেছি। আমাদের বিশ্বাস রীতা আগামীতে ভালো ফলাফল করবে এবং তার সাফল্য কামনা করছি।

সর্বশেষ খবর