শনিবার, ২২ এপ্রিল, ২০১৭ ০০:০০ টা
স্বপ্ন পূরণে এগিয়ে যাচ্ছেন মৃদুলা

এভারেস্টের পথে আবারও বাংলাদেশ

এভারেস্টের পথে আবারও বাংলাদেশ

সব ঠিক থাকলে আবারও এভারেস্টের চূড়ায় উড়বে বাংলাদেশের পতাকা। নিশাত মজুমদার এবং ওয়াসফিয়া নাজরীনের পর এবার হিমালয়ের রানী হতে যাচ্ছেন মৃদুলা আমাতুন নূর। ১৯ এপ্রিল এভারেস্টের বেসক্যাম্প ছেড়ে এগিয়ে যাচ্ছেন শীর্ষের দিকে। বেসক্যাম্পে সর্বশেষ কথা হয় তার সঙ্গে। লিখেছেন— শামছুল হক রাসেল

 

সবকিছু ঠিক থাকলে শিগগিরই এভারেস্টের চূড়ায় বাংলাদেশের পতাকা উড়তে যাচ্ছে আরও একবার। আর যার হাত দিয়ে এ চ্যালেঞ্জিং কাজটি সম্পন্ন হতে যাচ্ছে, তিনি মৃদুলা। পুরো নাম মৃদুলা আমাতুন নূর। গত ১৫ এপ্রিল শনিবার বাংলাদেশ সময় বেলা ১১টায় হিমালয়ের বহু কাঙ্ক্ষিত বেসক্যাম্পে পৌঁছান তিনি। ভূমি থেকে ৫ হাজার ৩৬৪ মিটার, অর্থাৎ ১৭ হাজার ৫৯৮ ফুট ওপরে অবস্থান করেন বাংলাদেশের এই তরুণী। ওয়্যারলেসে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে এ কথা তখনই নিশ্চিত করেন মৃদুলা নিজেই। এর আগে ১৪ এপ্রিল ৫ হাজার ১৮০ মিটার উঁচু বরফে ঢাকা গোরাকশিপে পৌঁছান মৃদুলা। এর মধ্যেই ১৯ এপ্রিল বেসক্যাম্প ত্যাগ করে চূড়া অভিমুখে যাত্রা শুরু করেছেন মৃদুলা।

বেসক্যাম্পে পৌঁছানোর সময় থেকেই ভীষণ ঠাণ্ডা ও তীব্র বাতাসের সঙ্গে লড়াই হয়েছে তার। কিন্তু সেসব তার কাছে কিছুই নয়। এতটা পথ পাড়ি দিয়েছেন এ বিষয়টিই তার কাছে অবিশ্বাস্য লাগছে। ফোনেও অনেকটা উত্ফুল্ল মনে হচ্ছিল তাকে।

এর আগে এভারেস্টের পথে প্রায় চার দিন বেসক্যাম্পে ছিলেন মৃদুলা। সে সময় বেশ কয়েকবার ওপরে ওঠার চেষ্টা চালানো হয়। কিন্তু আবহাওয়া পুরোপুরি প্রতিকূলে থাকায় বেসক্যাম্পে ফেরত আসতে বাধ্য হন তিনি। ১৮ এপ্রিল মঙ্গলবার বেসক্যাম্পে ব্ল্যাক ডে পালন করেন মৃদুলা। মাউন্ট এভারেস্টের সাড়ে ১৭ হাজার ফুট ওপরের বেসক্যাম্প থেকে ওয়্যারলেস ফোনে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে এ তথ্য জানান মৃদুলা। ২০১৫ সালের এই দিনে এভারেস্টে ভূমিকম্প ও তুষারধসে ১৮ জন শেরপা প্রাণ হারান। নিখোঁজ হন আরও বেশ কয়েকজন। তাদের স্মরণে নেপালে পালন করা হয় ব্ল্যাক ডে। তাই হিমালয় যাত্রীরাও আজ তাদের স্মরণ করছেন বেসক্যাম্প থেকে।

ঢাকা কমিউনিটি মেডিকেল কলেজের দ্ব্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী মৃদুলা আমাতুন নূর। জন্ম ঢাকায় হলেও শেকড় ফেনীর পরশুরাম উপজেলার গুথুমা গ্রামে। বাবা মো. আবু হেনা ও মা ফরিদা আক্তারের এক ছেলে এক মেয়ের মধ্যে মৃদুলাই বড়। বাবা-মা অবশ্য শুরুতে মেয়ের এই ডানপিটেপনা আবদার মেনে নিতে পারেননি। কিন্তু মেয়ের আগ্রহ আর অদম্য বাসনার কাছে হার মেনেছেন শেষ পর্যন্ত। এখন তারাও অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় আছেন মেয়ের চূড়ান্ত সাফল্যের খবরে। ছোটবেলা থেকেই ডানপিটে ছিলেন মৃদুলা। একটু বড় হওয়ার পর নেপাল ও ভারতের বেশ কিছু পর্বতারোহী বন্ধুর কাছে পর্বতারোহণের অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন। গত বছর অক্টোবরে হিমালয়ের শীতিধার চূড়ায় আরোহণের পর থেকেই মৃদুলার স্বপ্ন মাউন্ট এভারেস্ট জয় করা। এখন তিনি তার স্বপ্নের কাছাকাছি। সবকিছু ঠিক থাকলে মে মাসের প্রথমার্ধে মাউন্ট এভারেস্ট জয়ের ব্যাজটাও পরতে সক্ষম হবেন তিনি। মৃদুলা মাউন্ট এভারেস্ট জয় করতে সক্ষম হলে তিনি হবেন তৃতীয় বাংলাদেশি নারী। এর আগে নিশাত মজুমদার ও ওয়াসফিয়া নাজরীন বাংলাদেশের হয়ে এভারেস্ট জয় করেন।

সামান্য একটি ঘটনাই বদলে দিয়েছে মৃদুলার জীবনের বাঁক। উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়ে রাঙামাটিতে ঘুরতে গিয়েছিলেন তিনি। হঠাৎ একটি পাহাড় দেখে চূড়ায় উঠতে ইচ্ছে করল মৃদুলার। আসলে যার অদৃষ্টে লেখা আছে হিমালয় জয়ের স্বপ্ন, সেই মেয়েকে আটকাবে কে। অথচ ট্র্যাকিংয়ের সামান্য জ্ঞানটুকুও ছিল না তার। কাউকে কিছু না বলেই ধীরে ধীরে উঠতে লাগলেন পাহাড়ের গা বেয়ে কোনো রকম সেফটি বেল্ট ছাড়াই। কখনো পড়ে যাচ্ছিলেন, কখনো হাত ছেড়ে যাচ্ছিল, কখনো পিছলে নেমে আসছিলেন কিছুটা। কিন্তু থেমে থাকেননি। এগিয়ে গেছেন অবিচল লক্ষ্যে। এভাবে একসময় একেবারে দুই হাজার ফুট ওপরে উঠেছিলেন তিনি। যে কোনো মেয়ের তো বটেই, সবার জন্যই প্রথমবারেই ২ হাজার ফুট অতিক্রম করা রীতিমতো ঈর্ষণীয় ব্যাপার। সেই থেকেই পাহাড় জয়ের নেশা পেয়ে বসে মৃদুলাকে। মনে মনে সুযোগ খুঁজতে থাকে আবারও পাহাড় জয়ের। এরই মাঝে পরীক্ষার রেজাল্ট হওয়ার পর ব্যস্ত হয়ে পড়েন ভর্তিযুদ্ধ নিয়ে। ডাক্তার হওয়ার উদ্দেশ্যে ভর্তি হন কমিউনিটি মেডিকেল কলেজে। পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেও মনের ভিতর ওত পেতে থাকা পাহাড় জয়ের সুপ্ত বাসনাটা মুছে যায়নি কখনই। দেরি না করে ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে হিমাচল প্রদেশের মানালির অটল বিহারি বাজপেয়ি ইনস্টিটিউট অব মাউন্টেনিয়ারিংয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করেন মৃদুলা। প্রতিষ্ঠানটি তাকে প্রশিক্ষণের জন্য নির্বাচন করে। বাংলাদেশ থেকে একাই ছিলেন তিনি। ছিলেন ৮০ জনের গ্রুপে সবচেয়ে কম বয়সী। ১ অক্টোবর থেকে শুরু হলো তার টানা ২৬ দিনের বেসিক মাউন্টেনিয়ারিং কোর্স। হিমালয়ের শীতিধার চূড়া জয়ের জন্য মৃদুলা রওনা দিয়েছিলেন ৭ অক্টোবর। ১৬ অক্টোবর সেখানে তিনি বাংলাদেশের পতাকা ওড়ান। পৃথিবীতে এই শৃঙ্গ জয় করা তিনিই সবচেয়ে কম বয়সী মেয়ে। ২৫ অক্টোবর ইনস্টিটিউটের ডিরেক্টর ক্যাপ্টেন রণধীর সিং তাকে ওই চূড়া জয়ের ব্যাজ পরান।

নিজের অভিযান প্রসঙ্গে বেসক্যাম্প থেকে দেশবাসীর কাছে দোয়া চেয়েছেন মৃদুলা। তিনি বলেন, ‘সবকিছু ঠিক থাকলে মে মাসের প্রথম সপ্তাহে চূড়ায় উঠতে পারব। এখানে মূল সমস্যা আবহাওয়ার খামখেয়ালি ও প্রতিকূলতা। আশা করছি, সব বাধা অতিক্রম করতে পারব। সবাই আমার জন্য দোয়া করবেন।’

সর্বশেষ খবর