শনিবার, ৬ মে, ২০১৭ ০০:০০ টা

মুক্তিযুদ্ধের সবচেয়ে বড় ই সংগ্রহশালা

সাইফ ইমন

মুক্তিযুদ্ধের সবচেয়ে বড় ই সংগ্রহশালা

এই সাইট থেকে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক ৪ হাজার বই অনলাইনে বিনামূল্যে পড়া যাবে। এর মধ্যে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের দুর্লভ অনেক দলিল, মুক্তিযুদ্ধ ও পরবর্তী সময়ের উল্লেখযোগ্য ঘটনার পত্রিকা (১৯৪৭ থেকে ২০০০ সাল), মুক্তিযোদ্ধাদের গেজেট এবং অসংখ্য প্রবন্ধ-নিবন্ধ। এসব ছাড়াও এই পাঠশালায় রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের ওপর বিভিন্ন সময়ের প্রামাণ্যচিত্র, ভিডিও ফুটেজ এবং প্রায় ৬ হাজার আলোকচিত্র। এরই মধ্যে এতে প্রায় ১০ লাখ পাঠক ভিজিট করেছেন...

 

 

বাংলাদেশ নামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে মহান মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখা হয়েছে হাজার হাজার কবিতা, গান। তৈরি হয়েছে চলচ্চিত্র। দেশে-বিদেশে রয়েছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ওপর লেখা প্রচুর গবেষণাধর্মী বই, ঐতিহাসিক রচনা, ছবি ও প্রতিবেদন। এসব নিয়ে ‘মুক্তিযুদ্ধ ই-আর্কাইভ’ নামের ডিজিটাল লাইব্রেরির আনুষ্ঠানিক পথচলা শুরু হয় গত বছর ১৪ নভেম্বর। শহীদ জায়া শিক্ষাবিদ শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী এই লাইব্রেরির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। এর প্রতিষ্ঠাতা সাব্বির হোসাইন এবং এর সভাপতি ও পৃষ্ঠপোষক শান্তা আনোয়ার। তারা জানান, এই সাইট থেকে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক চার হাজার বই অনলাইনে বিনা মূল্যে পড়া যাবে। এসবের মধ্যে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের দুর্লভ অনেক দলিল, মুক্তিযুদ্ধ ও পরবর্তী সময়ের উল্লেখযোগ্য ঘটনার পত্রিকা (১৯৪৭ থেকে ২০০০ সাল), মুক্তিযোদ্ধাদের গেজেট এবং অসংখ্য প্রবন্ধ-নিবন্ধ। এসব ছাড়াও এই পাঠশালায় রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের ওপর বিভিন্ন সময়ের প্রামাণ্যচিত্র, ভিডিও ফুটেজ এবং প্রায় ছয় হাজার আলোকচিত্র। মুক্তিযুদ্ধ ই-আর্কাইভ ট্রাস্টের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক সাব্বির হোসাইন বলেন, বাংলাদেশের প্রান্তিক এলাকাগুলোতে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পৌঁছে দেওয়ার উদ্দেশ্য থেকেই এই ডিজিটাল লাইব্রেরির যাত্রা হয়েছে। পাশাপাশি এটি ইতিহাস বিকৃতির হাত থেকে মুক্তিযুদ্ধকে রক্ষা করবে। এরই মধ্যে এতে প্রায় ১০ লাখ পাঠক ভিজিট করেছেন।

যুক্তরাজ্যের পাবলিক রিসার্চ বিশ্ববিদ্যালয় ‘ইউনিভার্সিটি অব ইক্সেটার’-এর হিউম্যানেটিস কলেজের ‘দ্য ইক্সেটার সাউথ এশিয়া সেন্টার’ তাদের একাডেমিক রিসোর্স ম্যাটারিয়াল সেকশনে ‘মুক্তিযুদ্ধ ই-আর্কাইভ ট্রাস্ট’কে অন্তর্ভুক্ত করেছে। মুক্তিযুদ্ধের ডিজিটাল লাইব্রেরি ও আর্কাইভের পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের ওপর মিউজিয়াম নির্মাণের লক্ষ্যে বর্তমানে কাজ করছে ‘মুক্তিযুদ্ধ ই-আর্কাইভ’। প্রাথমিকভাবে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন ও নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে মিউজিয়াম স্থাপনের কাজ চলছে।

২০০৭ সালে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ পাঠাগার ও গবেষণাকেন্দ্র নামে একটি আর্কাইভ তৈরির কাজ শুরু হয়। এরপর ‘মুক্তিযুদ্ধ ই-আর্কাইভ’ নামে ২০১৪ সালে এই লাইব্রেরির পরীক্ষামূলক যাত্রা শুরু হয়। এর প্রতিষ্ঠাতা সাব্বির হোসাইন বলেন, ’৭১-এর গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস আমরা এক দিনে বা একক প্রচেষ্টায় অর্জন করিনি। দীর্ঘ দুই দশকের অন্যায়-অবিচারের পরিপ্র্রেক্ষিতে বাঙালির মনে জন্মেছিল স্বাধীনতার স্বপ্ন। নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে শেষে দেয়ালে পিঠ ঠেকে যায় স্বাধীনতার স্বপ্নকামী বাঙালিন। তখনই বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৭ মার্চ মুক্তিযুদ্ধের ডাক দেন। শুরু হয় মহান মুক্তিযুদ্ধ। এরপর নয় মাসের প্রচেষ্টায় ৩০ লক্ষাধিক প্রাণ ও পাঁচ লাখ নারীর নির্মম নির্যাতনের বিনিময়ে অর্জিত হয় আমাদের স্বাধীনতা। কিন্তু এর মাঝে ঘটে যায় অনেক কিছু, অসংখ্য মানুষ ভিটেমাটি সহায়সম্বল হারিয়ে নিঃস্ব হয়, এক কোটি মানুষ গৃহহীন হয়ে যায়। অনেকে ফিরে আসেন মৃতপ্রায় জীবন নিয়ে, ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয় দেড় লাখ বর্গ কিলোমিটারের আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি। তারপরও বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে শত প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে যাত্রা শুরু করে স্বাধীন বাংলাদেশ। এসব বিষয় পুঙ্খানুপুঙ্খ রূপে রয়েছে এই মুক্তিযুদ্ধ ই-আর্কাইভে।’

তিনি আরও বলেন, ‘খুব ছোট থেকেই আমি পরিবারের কাছ থেকেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা শিক্ষা পেতে থাকি। আমার এক চাচা শহীদ হন মুক্তিযুদ্ধে। তাকে বিহারিরা তখন গলা কেটে হত্যা করে। তা ছাড়া সে সময় আমাদের পরিবারকে পালিয়ে বেড়াতে হয়েছিল। এসব বিষয় থেকেই আমার ভিতর এক ধরনের তারণা কাজ করে। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কিছু করার অনুপ্রেরণা তৈরি হয়। যার ফলে আজকের এই মুক্তিযুদ্ধ ই-আর্কাইভ।’ এই ই-সাইটটির প্রধান পৃষ্ঠপোষক শান্তা আনোয়ার। তিনি একজস নারী উদ্যোক্তা। তিনি বলেন, ‘আমি সৌদিতে ছিলাম স্বামী, সংসার নিয়ে। তখন আমার দুই মেয়ের জন্ম হয়। এরা বাংলা বলতে পারত না। বাংলাদেশের সংস্কৃতির সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই। তাই আমি আমার সন্তানদের আমার বাংলাদেশের সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে চেয়েছিলাম। তখন আমার সন্তানদের কথা ভেবে, সন্তানদের মুখে বাংলায় ‘মা’ ডাক শোনার জন্য দেশে চলে আসি ২০১৩ সালে। এরপর দেখা হয় সাব্বিরের সঙ্গে। সেই প্রথম এই মুক্তিযুদ্ধের ই-আর্কাইভের কথা জানায়। আমি শুরু থেকেই আগ্রহী ছিলাম। এরপর সবার সম্মিলিত চেষ্টায় এই সাইটটির কার্যক্রম শুরু করতে সক্ষম হই।’

সাব্বির বলেন, পঁচাত্তরে সপরিবারে নির্মমভাবে নিহত হন জাতির জনক। শুরু হয় আমাদের অর্জিত সব অর্জন ধূলিস্মাৎ করার অপচেষ্টা, বিতর্কিত করার চেষ্টা করা হয় এই রাষ্ট্রের জন্ম ইতিহাস। এক সময় দেখি দেশের নতুন প্রজন্ম যারা কিনা ঠিক ইতিহাস জানতে চায়, শিকড়ের সন্ধানে ছুটে চলে অনবরত, তাদের পড়তে হয় বিড়ম্বনায়। কেননা একেক জায়গায় একেক কথা শুনে তারা বিভ্রান্তিতে পড়ে। যদি তরুণরা হাতের কাছে সব তথ্য একসঙ্গে পেত, যখন যা দরকার, তাহলে এই বিড়ম্বনা লাঘব হতো অনেকাংশে। মুক্তিযুদ্ধ ই-আর্কাইভ ঠিক এই কাজটিই করতে বদ্ধপরিকর।

প্র্রযুক্তির উৎকর্ষতার ফলে ইন্টারনেটের মাধ্যমে তথ্য এখন সহজলভ্য হয়েছে ব্যক্তি মানুষের হাতের নাগালে। এই অনলাইন জগতেও একাত্তরের পরাজিত শক্তিরা হানা দিয়েছে, অপপ্রচারে নেমেছে একাত্তর, মুক্তিযুদ্ধ, শহীদদের সংখ্যা, গণহত্যা, বঙ্গবন্ধু নিয়ে। আর এসবে বিভ্রান্ত হচ্ছে তরুণ সমাজ। এই মুক্তিযুদ্ধ ই-আর্কাইভের ফলে বর্তমান সমাজের তরুণরা মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানতে পারছে। এর জন্য নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন এই মুক্তিযুদ্ধ আর্কাভের সঙ্গে জড়িতরা। প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক সাব্বির হোসাইন এবং প্রধান পৃষ্ঠপোষক ও সভাপতি শান্তা আনোয়ার বাদেও এই মুক্তিযুদ্ধ ই-আর্কাইভের সঙ্গে জড়িত আছেন শিহাব খান   (ট্রাস্টি), দেওয়ান মাবুদ (ট্রাস্টি), জাহিদ খান, (সহ-পরিচালক), সুমিত চৌধুরী (স্বেচ্ছাসেবী), মশিউর রহমান (স্বেচ্ছাসেবী), মৌশিক মিশু (সহযোগী), ডা. মাহফুজুর রহমান, মুক্তিযোদ্ধা ও গবেষক (উপদেষ্টা), শেখ মো. কাশেম, মুক্তিযোদ্ধা (উপদেষ্টা), আরিফ রহমান (গবেষণা সহকারী)

সর্বশেষ খবর