শনিবার, ৬ মে, ২০১৭ ০০:০০ টা

অনুপ্রেরণীয় রানী হামিদ

অনুপ্রেরণীয় রানী হামিদ

নিজের বাসায় পুরস্কার আর ক্রেস্টের সামনে হাস্যোজ্জ্বল রানী হামিদ - ছবি: বাংলাদেশ প্রতিদিন

তিনি একজনই। রানী হামিদ। সবাই এক নামে চেনে। আমাদের দেশে যে কজন মানুষ সাফল্যের শীর্ষে উঠে নিজেকে অনুুপ্রেরণীয় ব্যক্তিত্বে পরিণত করেছেন রানী হামিদ তাদের অন্যতম। কেবল দাবা খেলেই অর্জন করেছেন বিশ্বজোড়া খ্যাতি। দাবার জন্যই যেন তার জন্ম। তিনি বাংলাদেশের প্রথম মহিলা আন্তর্জাতিক দাবা মাস্টার। এ দেশের নারীরা যখন ঘরের বাইরে পা ফেলার কথাই ভাবতে পারতেন না, তখনই দাবায় আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের বিজ্ঞাপন হয়ে ওঠেন রানী হামিদ। শনিবারের সকালের সঙ্গে আড্ডায় তিনি অনেক স্মৃতিচারণ করেন। জানা যায় অনেক তথ্যও। বিস্তারিত লিখেছেন— অপূর্বা কাজী

 

তার পুরো নাম সৈয়দ জসিমুন্নেসা খাতুন। ডাক নাম রানী। বিয়ের পর স্বামীর নাম যুক্ত করে রানী হামিদ হন। তবে ক্রীড়াঙ্গনে তিনি রানী হামিদ নামেই পরিচিত। ১৯৮৫ সালে তিনি ফিদে আন্তর্জাতিক মহিলা মাস্টার খেতাব পান। তিনবার ব্রিটিশ মহিলা দাবা প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন রানী হামিদ নিজের পুরনো দিনগুলোর কথা মনে করে রোমাঞ্চিত হন। ব্রিটিশ মহিলা দাবায় চ্যাম্পিয়ন হওয়ার স্মৃতি রোমনন্থন করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘সেটা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। অনেক বেশি খুশি লেগেছিল সেদিন। ব্রিটিশরা আমাদের অনেকদিন শাসন করেছে। সেই ব্রিটিশদের হারিয়েই আমি চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলাম। তারপর আরও দুবার ব্রিটিশ মহিলা ওপেনে চ্যাম্পিয়ন হয়েছি। আর আন্তর্জাতিক মাস্টারের প্রথম নর্ম পাওয়ার মুহূর্তটি আমার কাছে ছিল বিশেষ আনন্দের। আমার জানাই ছিল না, আমি নর্ম পেয়েছি।’ 

তিনি জাতীয় মহিলা দাবায় ১৮ বার চ্যাম্পিয়ন হন। যদিও ১৯৭৭, ১৯৭৮ ও ১৯৭৯ সালে আরও তিনবার জাতীয় মহিলা দাবায় জিতেন তিনি, কিন্তু তখন রেকর্ড রাখা হতো না। ক্রীড়াক্ষেত্রে নিজের সফল অগ্রযাত্রা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘বাবা ও স্বামী—উভয়ের সংসারই ছিল ক্রীড়াবান্ধব। সেখান থেকেই এসেছে আমার মূল অনুপ্রেরণা। পরবর্তী প্রজন্মেও ক্রীড়াবান্ধব এই পরিবেশ অব্যাহত রয়েছে। স্বামী লে. কর্নেল (অব.) আবদুল হামিদ ছিলেন এ দেশের হ্যান্ডবলের পথিকৃৎ। বড় ছেলে কায়সার হামিদ জাতীয় ফুটবল দলে খেলেছে। মেজ ছেলে সোহেল হামিদ স্কোয়াশ, হ্যান্ডবল, ক্রিকেট ও ফুটবল খেলেছে। এখন সে স্কোয়াশ অ্যান্ড র‌্যাকেটস ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক। ছোট ছেলে শাহজাহান হামিদ ববি জাতীয় হ্যান্ডবল দলের সাবেক খেলোয়াড়। মেয়ে জেবিন হামিদ টুকটাক দাবা খেলেছে। ববি হামিদের মেয়ে সামাহা হামিদ স্কলাস্টিকার হয়ে হ্যান্ডবল খেলে। কায়সার হামিদের ছোট ছেলে সাদাত হামিদ জুনিয়র পর্যায়ে ফুটবল খেলছে।’

মজার ব্যাপার হচ্ছে তিনি নিজে, তার স্বামী এবং ছেলে প্রত্যেকেই জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত ক্রীড়াবিদ। এই বয়সে এসে চাওয়া-পাওয়ার কিছু আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘না। তেমন কিছু চাইবার নেই। ক’দিন আগে প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে পুরস্কার পাওয়া ১৫৩ ক্রীড়াবিদের মধ্যে আমি ছিলাম। এই স্বীকৃতি আনন্দের। আমি আমার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে এতটুকু অসুখী নই। এর পরও কোথায় যেন একটা কথা থেকেই যায়। এ সময়ে এসে ক্রীড়াক্ষেত্রে সাফল্য পেলে সরকারের তরফ থেকে অনেক পুরস্কার মিলে যায়। কিন্তু আমি মনে করি শেষ বয়স পর্যন্ত সফল ক্রীড়াবিদদের জন্য কোনো না কোনো ভাতার ব্যবস্থা থাকা উচিত। এতে করে খেলা থেকে অবসর নিলেও কেউ আর সামাজিক নিরাপত্তা বা আর্থিক নিরাপত্তাহীনতায় ভুগবে না।’

অসাধারণ এই প্রতিভাবান নারীর জন্ম ১৯৪৪ সালে সিলেট জেলার সৈয়দ পরিবারে। সিলেটের রাখাইলের সবুজে ঘেরা প্রকৃতির মধ্যে কেটেছে তার শৈশব। শৈশব থেকে দাবার বোর্ডের দিকে দারুণ ঝোঁক ছিল রানী হামিদের। ঝোঁকটা আরও বেড়ে গেল যখন দেখলেন, বাবা মমতাজ আলী প্রতি সন্ধ্যায় বন্ধুদের নিয়ে দাবা খেলতেন। স্কুল জীবনে ভালো ব্যাডমিন্টন খেলোয়াড় ও অ্যাথলিট হওয়া সত্ত্বেও দাবাই ছিল রানীর প্রধান ভালোবাসা। ১৯৫৯ সালে তিনি সেনাবাহিনীর তৎকালীন বিশিষ্ট ক্রীড়াবিদ ক্যাপ্টেন আবদুল হামিদের সঙ্গে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন। স্বামী ক্রীড়াবিদ হওয়ায় দাবা খেলার ব্যাপারে সব ধরনের সহযোগিতা পান। ১৯৭৭ সাল থেকে এই পর্যন্ত সব ধরনের প্রতিযোগিতামূলক আসরে অংশ নিয়ে আসছেন রানী হামিদ। শুরুতে তিনি খুব অ্যাটাকিং খেলোয়াড় ছিলেন। পরে পজিশনাল খেলার দিকে নজর দেন।

রানী হামিদ একাধিকবার বিশ্ব দাবা অলিম্পিয়াডে শুধু মহিলা দল নয়, জাতীয় দলের হয়ে অংশ নেওয়ার যোগ্যতা লাভ করেছেন। যে কৃতিত্ব বিশ্বের খুব কম মহিলা দাবাড়ুরই রয়েছে। স্বীয় অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি ‘মজার খেলা দাবা’ ও ‘দাবা খেলার আইন কানুন’ নামে দুটি বই লিখেছেন।

তিনি যখন ফিদে আন্তর্জাতিক মহিলা মাস্টার হন, তখন আমাদের অনেকের জন্মই হয়নি। স্বভাবতই বোঝা যাচ্ছে রানী হামিদ একজন প্রবীণ ক্রীড়াবিদ। কিন্তু তার চাল-চলন আর জীবনযাত্রা যেন বয়সকে হার মানায় অবিরত। এই বয়সেও দুর্দান্ত স্মার্ট রানী হামিদ। তবে তার কাছে ফ্যাশনের নির্দিষ্ট কোনো সংজ্ঞা নেই। অনেকেই তার রূপের রহস্য নিয়ে নানা সময় নানা প্রশ্ন করেছেন। কিন্তু তার কাছে স্বাচ্ছন্দ্যে পরিপাটি চলাচল করাই ফ্যাশন। এখন প্রশ্ন হলো, কে কতটা পরিপাটি থাকার চেষ্টা করেন বা পরিপাটি থাকতে পারেন। এ ক্ষেত্রে একটা ব্যাপারে তিনি খুবই সচেতন।

আর সেটা হলো শাড়ির সঙ্গে ব্যাগ ও জুতা সব সময় ম্যাচিং করে পরা। শাড়ি খুবই প্রিয় পোশাক। সুযোগ পেলেই শাড়ি কিনেন। তাই বিশাল শাড়ির সংগ্রহ তার। আর হালকা ধরনের গয়না তার বরাবরের মতো পছন্দ। জুতার ক্ষেত্রে আরামদায়ক জুতা পরতেই পছন্দ করেন। অল্প বয়সের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বললেন, অল্প বয়সে চুলে দুই বেণি করতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন। বিয়ের পর নায়িকা শবনমের একটা খোঁপার স্টাইল খুব ভালো লেগেছিল তার, তখন ওই খোঁপাটাই করতেন চুলে। তবে স্বামী প্রয়াত কর্নেল এম এ হামিদের পছন্দ ছিল খোলা চুল। তাই তার সঙ্গে বের হলে চুল খোলা রাখার চেষ্টাই করতেন সবসময়। মজার ব্যাপার হচ্ছে, রানী হামিদের লাইফ স্টাইলে তার স্বামীর ভূমিকা অনেক বেশি। তিনি নিজেও স্বামীর পছন্দ-অপছন্দকে বেশ প্রাধান্য দিতেন।

 

খেলা ও সংসার দুটি স্বতন্ত্র কর্মক্ষেত্রে তিনি একজন সফল নারী। তিন ছেলে ও এক মেয়ের মা রানী হামিদ সন্তানদের সুশিক্ষা দিয়েছেন। বড় ছেলে কায়সার হামিদ বাংলাদেশের ফুটবল প্রেমীদের কাছে একটি অতিপরিচিত নাম। মেজো ছেলে ক্রিকেট খেলে আর ছোট ছেলে ফুটবল। তিনি বলেন, সন্তানরা তার পেশা গ্রহণ করেনি বলে তার কোনো দুঃখবোধ নেই। বরং যার যার পছন্দ অনুযায়ী নিজেদেরটা বেছে নেওয়াতেই তিনি বেশি খুশি। মেয়েদের পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে সেকালের চেয়ে একালকে ভালো মনে করেন রানী হামিদ। কারণ, এখন সন্তানদের ব্যাপারে বাবার চেয়ে মা বেশি সচেতন। যে বিষয়ে সন্তানদের আগ্রহ তাকে প্রধান্য দিয়ে তাদের উৎসাহিত করেন মা। সেকালে মায়েরা সন্তানের প্রতি খেয়াল রাখতে পারতেন না। সাংসারিক পরিবেশ এমন ছিল, মতামত ব্যক্ত করার ক্ষমতাও তাদের ছিল না। গৃহকর্তা যা বলতেন তা-ই মানতে বাধ্য তারা। তবে আমাদের দেশে আজো নারীরা বৈষম্যের শিকার। রানী হামিদ মনে করেন, এ বৈষম্য বেশি দিন থাকবে না। দরকার কেবল মানসিকতার পরিবর্তন।

 

রানী হামিদ যে উদ্যম নিয়ে ও সামাজিক বাধা-বিঘ্ন অতিক্রম করে খেলার পথ প্রশস্ত করে নতুন প্রজন্মের মধ্যে আগ্রহ সৃষ্টি করেছেন তা স্বাভাবিকভাবেই এ দেশের ভবিষ্যৎ মহিলাদের অনুপ্রাণিত করবে।

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর