শিরোনাম
শনিবার, ২০ মে, ২০১৭ ০০:০০ টা

জুয়েলের ফ্রেন্ডশিপ স্কুল

জুয়েলের ফ্রেন্ডশিপ স্কুল

সমাজে কিছু মানুষ থাকে যারা স্রোতের বিপরীতে চলেন। শুধু বলেই থেমে না থেকে এগিয়ে চলেন সামনের দিকে। নিজের পথ নিজেই তৈরি করেন। এমনই এক তরুণ জুয়েল আহমেদ। সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের শিক্ষার আলোয় আলোকিত করতে টাঙ্গাইলে ৪টি অবৈতনিক ফ্রেন্ডশিপ স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছেন। এই তরুণ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। ২০১২ সালে জুয়েল আহমেদ একাদশ শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় নিজ বাড়ি আদি টাঙ্গাইলে ফ্রেন্ডশিপ স্কুলের প্রথম শাখাটি চালু করেন। সেই সময় জুয়েল আহমেদ তার নিজের ও আশপাশের এলাকার প্রায় ২৯ জন ঝরে পড়া ও সুবিধাবঞ্চিত শিশুকে খুঁজে বের করে তার স্কুলে পড়ালেখা করার সুযোগ করে দেন। আত্মপ্রত্যয়ী এই তরুণকে নিয়ে লিখেছেন— সাইফ ইমন

 

২০১২ সালে জুয়েল আহমেদ নিজ বাড়ি টাঙ্গাইলে ফ্রেন্ডশিপ স্কুলের প্রথম শাখাটি চালু করেন। তখন তিনি একাদশ শ্রেণির ছাত্র। জুয়েল আহমেদ তার নিজের ও আশপাশের এলাকার প্রায় ২৯ জন ঝরেপড়া ও সুবিধাবঞ্চিত শিশুকে খুঁজে বের করে তার এ স্কুলে ভর্তি করান ও পড়ালেখা করার সুযোগ করে দেন। তার সাধ্য অনুযায়ীই এই শিশুদের শিক্ষা উপকরণ দিতে থাকেন। তখন এই স্কুলে ৩ জন শিক্ষক ও শিক্ষিকা পাঠদান করাতেন। স্বপ্নবাজ মেধাবী তরুণ জুয়েল আহমেদ ইংরেজি মাধ্যমের কয়েকজন ছাত্র পড়িয়ে যে সামান্য সম্মানী পেতেন, তা দিয়েই স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকাদের অল্প কিছু সম্মানী তথা কোনোরকমে স্কুলটি চালাতেন। বর্তমানে ফ্রেন্ডশিপ স্কুলের ৪টি শাখায় প্রায় ৪০০ সুবিধাবঞ্চিত শিশু বিনাবেতনে পড়ালেখা করার সুযোগ পাচ্ছে। এ বিষয়ে টাঙ্গাইল পৌরসভার মেয়র মো. জামিলুর রহমান মিরন বলেন, সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের নিয়ে জুয়েলের এ উদ্যোগ নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার। আমি ফ্রেন্ডশিপ স্কুলের বিষয়ে খুবই আন্তরিক। তবে শুধু আমি একা নই সমাজের সবাই এগিয়ে এলে এই স্কুলগুলোকে টিকিয়ে রাখা তথা সর্বত্র ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব। টাঙ্গাইলের জেলা প্রশাসক মো. মাহবুব হোসেন বলেন, এই তরুণ যে কাজ করছে, সত্যিই আমি তা দেখে বিস্মিত হয়েছি। আশা করি, জুয়েল সবাইকে নিয়ে একদিন সমগ্র বিশ্বে এই কার্যক্রম ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হবে।

 

স্কুলের নামকরণ 

শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মাঝে পাঠদানের সময় সবসময় বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকবে। শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পাঠ্য বিষয়গুলো এমনভাবে পরিবেশন করবেন যাতে শিক্ষার্থীরা খুব সহজেই পাঠ্য বিষয়গুলো বুঝতে পারে। সবার মাঝেই বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকবে। ফলে শিশু ও শিক্ষার্থীরা খুব সহজেই সব কিছু আয়ত্ত করতে পারবে। এ কথা চিন্তা করেই স্কুলের নামকরণ করা হয়েছে ফ্রেন্ডশিপ স্কুল।

 

উদ্যোগের শুরু

প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়া অবস্থাতেই স্বপ্ন দেখতেন জুয়েল, সমাজের অবহেলিত শিশুদের জন্য ভালো কিছু করতে হবে। ২০০৮ সাল থেকেই শিশুদের শিক্ষা প্রদানমূলক কাজের সঙ্গেই সম্পৃক্ত হন তিনি ও বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চলে শিশুদের সচেতনতামূলক বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা শুরু করেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ২০১২ সালে একাদশ শ্রেণিতে পড়া অবস্থায়ই ফ্রেন্ডশিপ স্কুলের প্রথম শাখা প্রতিষ্ঠা করি। শুরুতে ২৯ জন সুবিধাবঞ্চিত শিশুকে পাঠদানের সঙ্গে সম্পৃক্ত করি। পড়ালেখার ক্ষতি হচ্ছে কি না জানতে চাইলে জুয়েল বলেন, পড়ালেখার পাশাপাশি স্কুলগুলো চালানো হচ্ছে। এ জন্য পড়ালেখার কোনো ক্ষতি হচ্ছে না।

 

অর্থায়ন

বর্তমানে ফ্রেন্ডশিপ স্কুলের ৪টি শাখায় ১৫ জন শিক্ষক-শিক্ষিকা রয়েছেন। জুয়েল আহমেদ আউটসোর্সিং, সাংবাদিকতাসহ বিভিন্ন বিষয়ের ওপর রিসার্চ করে যে সম্মানী পান, তা দিয়েই তার এ স্কুলগুলো কোনো রকমে চালান। এত অল্প বয়সের তরুণ এ ধরনের শান্তিপূর্ণ কাজ করছে যা সত্যিই বিস্ময়কর। বিশ্ব শান্তি স্থাপনে এই তরুণের এমন উদ্যোগকে একটি রোল মডেল হিসেবে বিবেচনা করা যেতেই পারে। এই তরুণের স্বপ্ন পর্যায়ক্রমে একদিন সমগ্র বাংলাদেশ ও বিশ্বের সব সুবিধাবঞ্চিত শিশু মানসম্মত শিক্ষায় শিক্ষিত হবে। এই মেধাবী তরুণের স্বপ্নকে এগিয়ে নিতে আমরা সবাই এগিয়ে আসতে পারি। জুয়েল আহমেদ বলেন, বিষয়টি সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নজরে এলে এই সমাজ খুব দ্রুত এগিয়ে যাবে। এ প্রসঙ্গে জুয়েল আহমেদ আরও বলেন, গবেষণামূলক কাজ, আউটসোর্সিং, সাংবাদিকতা থেকে যে সম্মানী পাওয়া যায়, তা দিয়েই প্রধানত স্কুলগুলো কোনোরকমে চলছে। ফ্রেন্ডশিপ স্কুলের কার্যক্রম টাঙ্গাইল পৌরসভার মেয়র মো. জামিলুর রহমান মিরনের পছন্দ হওয়ায় তিনি নির্বাচিত হওয়ার পর ২০১৬ সাল থেকে শিশুদের পোশাক ও বই সরবরাহ করে থাকেন। সবসময়ই পাশে থাকার চেষ্টা করেন।

 

পরিবার ও বেড়ে ওঠা

জুয়েল আহমেদের বাবা আবদুল কাদের মিয়া সেনাবাহিনীতে কর্মরত ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত জুনিয়র কমিশন্ড অফিসার হিসেবে। আর মা নিলুফা বেগম গৃহিণী। বড় ভাই মর্তুজা আল মামুন সিঙ্গাপুরে কর্মরত আছেন। টাঙ্গাইলের বিন্দুবাসিনী সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি ও টাঙ্গাইলের মেজর জেনারেল (অব) মাহমুদুল হাসান আদর্শ মহাবিদ্যালয় থেকে এইচ এস সি পাস করেছেন। বর্তমানে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে দ্বিতীয় বর্ষে অধ্যয়ন করছেন তিনি।

 

ভবিষ্যতের স্বপ্ন

ভবিষ্যতের স্বপ্ন সম্পর্কে জানতে চাইলে জুয়েল আহমেদ জানান, যত যাই করি না কেন, পর্যায়ক্রমে বিশ্বের সব শিশু যাতে শিক্ষার আলোয় আলোকিত হতে পারে ও একটি শান্তিপূর্ণ দেশ ও বিশ্ব গড়তে পারে, এজন্য ফ্রেন্ডশিপ স্কুলের কার্যক্রম সমগ্র দেশ ও বিশ্বের প্রতিটা অঞ্চলে ছড়িয়ে দেওয়া। শুধু একা এত বড় স্বপ্ন বাস্তবায়ন অনেক কঠিন। এক্ষেত্রে সবার সহযোগিতা পেলে খুব দ্রুত একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে এ শান্তিপূর্ণ কার্যক্রম সর্বত্র ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব।

‘দশে মিলে করি কাজ হারি জিতি নাহি লাজ’ এ ধারণায় বিশ্বাসী জুয়েল জানান, সবার সহযোগিতায় অবশ্যই ভালো কিছু সম্ভব।

 

স্কুল পরিচালনা 

ফ্রেন্ডশিপ স্কুলের ৪টি শাখায় ১৫ জন শিক্ষক-শিক্ষিকা প্রায় ৪ শতাধিক সুবিধাবঞ্চিত শিশুকে পাঠদানের সঙ্গে সম্পৃক্ত আছেন। এ ছাড়াও ৭ জন দফতরি স্কুলে কর্মরত রয়েছেন। স্কুলের ২টি শাখা ভাড়া নেওয়া, ১টি খাসজমিতে ও জায়গা সংকট থাকায় আরেকটি শাখা ১টি বাড়ির উঠানে কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। স্কুল পরিচালনা করার ক্ষেত্রে শত শত মানুষ সহযোগিতার আশ্বাস দিয়ে থাকলেও ২-৪ জন মানুষ ছাড়া কারও সহযোগিতাই পাওয়া যায়নি। এমনকি প্রকৃতপক্ষে উৎসাহমূলক সহযোগিতাও কারও কাছ থেকেও পাওয়া যায়নি বলে জানান জুয়েল আহমেদ। তবুও কঠোর পরিশ্রম ও দৃঢ় মনোবল এবং কঠোর পরিশ্রম করার কারণে সব বাধাকে অতিক্রম করে সবার দেওয়া চ্যালেঞ্জকে জয় করে ২৯ জন ঝরেপড়া, সুবিধাবঞ্চিত শিশু থেকে ৪ শতাধিক সুবিধাবঞ্চিত শিশুকে মানসম্মত শিক্ষার আওতায় আনা হয়েছে। যার ফলে সমাজের প্রায় ৪ শতাধিক শিশু আজ শিক্ষার আলোয় আলোকিত হচ্ছে। সমগ্র বিশ্বে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের মাঝে মানসম্মত শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে চান জুয়েল আহমেদ। শিক্ষার মধ্য দিয়ে সমগ্র দেশ ও বিশ্বকে আলোকিত করার স্বপ্ন দেখেন এই তরুণ।

সর্বশেষ খবর