শনিবার, ২০ মে, ২০১৭ ০০:০০ টা
ইবি শিক্ষার্থীর উদ্ভাবন

স্মার্ট ইন্টেলিজেন্ট হোম সিকিউরিটি সিস্টেম

ইকবাল হোসাইন রুদ্র, ইবি

স্মার্ট ইন্টেলিজেন্ট হোম সিকিউরিটি সিস্টেম

এটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাসা-বাড়ি, ব্যাংক ও অফিসের নিরাপত্তা বজায় রাখতে সক্ষম। এ ছাড়া বার্তার মাধ্যমে বাসা-বাড়ি ও অফিসের দরজা, লাইট, ফ্যান, এসি, হিটার, কম্পিউটার অন-অফ করতে সক্ষম এই সিস্টেম। এই সিস্টেম অগ্নিসংযোগ, বৃষ্টিপাত, ভূমিকম্পসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় অডিও কল, খুদে বার্তা, ফেসবুক পোস্ট দিয়ে মালিকের কাছে বার্তা পৌঁছ দিতে পারবে...

 

প্রযুক্তির উৎকর্ষ সাধনের সঙ্গে সঙ্গে মানুষ অতিমাত্রায় প্রযুক্তিনির্ভর হয়ে পড়েছে। তাই বাসা-বাড়ি কিংবা অফিসের নিরাপত্তা ব্যবস্থায়ও মানুষ প্রযুক্তির ব্যবহার দিন দিন বাড়িয়ে দিচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত পদার্থ বিজ্ঞান, ইলেকট্রনিক্স অ্যান্ড কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের মাস্টার্সের ছাত্র নিয়াজ মোস্তাকিম ‘স্মার্ট ইন্টেলিজেন্ট অ্যান্ড ভারসেটাইল হোম সিকিউরিটি সিস্টেম’ উদ্ভাবন করেছেন। এটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাসা-বাড়ি, ব্যাংক ও অফিসের  নিরাপত্তা বজায় রাখতে সক্ষম। এ ছাড়া বার্তার মাধ্যমে বাসা-বাড়ি ও অফিসের দরজা, লাইট, ফ্যান, এসি, হিটার, কম্পিউটার অন-অফ করতে সক্ষম এই সিস্টেম। এই সিস্টেম অগ্নিসংযোগ, বৃষ্টিপাত, ভূমিকম্পসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় অডিও কল, খুদে বার্তা, ফেসবুক পোস্ট দিয়ে মালিকের কাছে বার্তা পৌঁছাতে সক্ষম।

নিয়াজ মোস্তাকিম দীর্ঘ দুই বছর বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক খালিদ হোসেন জুয়েল ও অধ্যাপক খলিলুর রহমানের তত্ত্বাবধানে গবেষণার পর এই সিস্টেম উদ্ভাবন করেন। গত রবিবার দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয় প্রেস কর্নারে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে এই সিস্টেমের ব্যবহার পদ্ধতি ও সুবিধাবলি উপস্থাপন করেন নিয়াজ মোস্তাকিম।

তিনি সাংবাদিকদের জানান, আধুনিক সিকিউরিটি ও সব সুযোগ-সুবিধার সমন্বয়ে ‘স্মার্ট ইন্টেলিজেন্ট হোম’-এর বাউন্ডারি লাইনে একটা কী-প্যাড আনলকড সিকিউরিটি গেট সিস্টেম আছে। কী-প্যাড এর মাধ্যমে পাসওয়ার্ড দিয়ে খুলতে হবে। এর সামনে একটা ডিসপ্লে আছে এবং ইনডিকেটর লাইট আছে। যদি গেটটি আনলকড হয় তবে ডিসপ্লে ও লাইট এ সংকেত দেবে। বাউন্ডারি লাইনে একটি কলিং বেল আছে, যা প্রেস করা মাত্রই ক্যামেরা চালু হবে এবং ভিডিও রেকর্ডিং শুরু হবে, এটি বাড়ির মনিটরে দেখা যাবে। যদি পরিচিত কেউ হয় তবে বাড়ির মালিক এনড্রয়েট অ্যাপ্লিকেশনের মাধ্যমে ভিতর থেকে বাড়ির দরজা খুলে দিতে পারবে। বাউন্ডারি লাইনের সামনে কেউ ঘোরাফিরা করলেও সেন্সর তা শনাক্ত করে অন্য একটি ক্যামেরা চালু করে দেবে, যা অটোমেটিক ভিডিও রেকর্ড করবে। সন্ধ্যায় বাড়িটির বাউন্ডারি লাইট অটোমেটিক চালু হবে এবং সকালে তা বন্ধ হবে। এটি নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে একটা ডিজিটাল ঘড়ির সময় অনুযায়ী। বাড়ির মেইন গেটে সিকিউরিটি হিসেবে ফিঙ্গার প্রিন্ট সেন্সর লাগানো আছে। এটি বিশটি ফিঙ্গার প্রিন্ট নমুনা মেমোরিতে জমা রাখতে পারে। শুধু ফিঙ্গার প্রিন্ট মিললেই গেট খুলবে এবং কিছু সময় পর তা বন্ধ হয়ে যাবে। বাড়ির এই গেটে হিউম্যান কাউন্টার আছে, যা ডিসপ্লেতে দেখাবে কতজন ভিতরে আছে। কেউ ভিতরে প্রবেশ করলেই ওই কক্ষের লাইট অটোমেটিক অন হবে এবং ভিতরে কে আছে তা পরিষ্কার দেখা যাবে। এখানে দুটি পিআইআর মোশন সেন্সর ব্যবহার করা হয়েছে, যা সম্পূর্ণ জায়গার মনিটর করবে। এই সেন্সর কিছু শনাক্ত করলে বাড়ির মালিকের স্কাইপি অ্যাকাউন্টে ভিডিও কলিং শুরু হবে।

মোস্তাকিম আরও জানান, রান্নাঘরের সিকিউরিটি হিসেবে শিখা সেন্সর, গ্যাস সেন্সর এবং স্মোক সেন্সর ব্যবহার করা হয়েছে। কখনো ফ্লেম সেন্সর বাড়িতে আগুন লাগা শনাক্ত করলে ফায়ার সার্ভিসকে মেসেজ দিয়ে বাড়ির ঠিকানা জানাবে। গ্যাস সেন্সর গ্যাস বিস্ফোরণ শনাক্ত করলে বাড়ির মালিককে অডিও কলের মাধ্যমে জানাবে, স্মোক সেন্সর স্মোক শনাক্ত করলে বাড়ির মালিককে মেসেজ দিয়ে জানাবে। এখানে তাপমাত্রা মাপার জন্য একটা সেন্সর ব্যবহার করা হয়েছে, যার তাপমাত্রা ৫০ ডিগ্রির উপরে গেলে মালিকের ফেসবুকে অটোমেটিক ডিভাইসটি পোস্ট দিয়ে জানাবে। ভূমিকম্পের সংকেত বোঝার জন্য একটা সেন্সর ব্যবহার করা আছে, যা ভাইব্রেশন হলেই ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে জানাবে।

বাড়ির ছাদে ওয়াটার সেন্সর লাগানো আছে। বৃষ্টির পানি হলে তা বাড়ির জানালাগুলো অটোমেটিক বন্ধ করে দেবে। বাড়ির ভিতর কেউ বিপদে পড়লে ইমারজেন্সি বেল আছে, যা দিয়ে প্রতিবেশীকে ডাকা যাবে। এখানে প্রতিবন্ধীদের জন্য একটা সাউন্ড সেন্সর ব্যবহার করা হয়েছে যেখানে যে কোনো সাউন্ড এর মাধ্যমে কাউকে ডাকতে পারবে। দূর থেকে বাড়ির মধ্যে কোনো ডিভাইস কন্ট্রোল করার জন্য জিএসএম মডিউল ব্যবহার করা হয়েছে, যার মাধ্যমে যে কোনো জায়গা থেকে বাড়ির মালিক বাড়ির হিটার, ফ্যান, এয়ার কন্ডিশনার অফ বা অন করতে পারবেন। অন বা অফ হওয়ার পর তা মেসেজ দিয়ে মালিককে জানাবে। বাড়ির স্টোর রুমে একটা মেসেজ কন্ট্রোলড লকার আছে, যা মেসেজ দিয়ে অন অফ করা যাবে। এই স্টোর রুমের সিকিউরিটি হিসেবে এর সামনে আইআর সেন্সর ব্যবহার করা হয়েছে। এর সামনে কেউ এলে সঙ্গে সঙ্গে তার ছবি তুলে ফেসবুকে পোস্ট করবে, যা থেকে মালিক তাকে শনাক্ত করতে পারবেন। দূরে থেকেও মালিক তার বাড়িটি রক্ষা করতে পারবেন তার প্রতিবেশীকে জানানোর মাধ্যমে।

ব্লুুটুথ ও এন্ড্রোয়েট অ্যাপসের মাধ্যমে বেডরুম লাইট, বাথরুম লাইট, কম্পিউটার অন অফ করা যাবে। টেম্পারেচার বেড়ে গেলে তা কমানোর জন্য ফ্যান, লাইট অটোমেটিক অন হবে। এ ছাড়া ব্লুটুথ ও এন্ড্রোয়েট অ্যাপসের মাধ্যমে বাড়ির ভিতর থেকে বাইরে কত দূরে কেউ আছে তাও দেখা যাবে এই সিস্টেম ব্যবহার করে। নিয়াজ মোস্তাকিমের উদ্ভাবিত স্মার্ট ইন্টেলিজেন্ট হোম সিকিউরিটি সিস্টেমের নমুনা বাড়িটি তৈরিতে খরচ হয়েছে প্রায় ৩৫ হাজার টাকা। তবে বাসা-বাড়ি কিংবা অফিসের সিকিউরিটি সিস্টেম স্থাপনে খরচ হবে ৫০ হাজার টাকা (তার বাদে)। এই গবেষণাটির তত্ত্বাবধায়ক বিভাগীয় সহযোগী অধ্যাপক খালিদ হোসেন জুয়েল ও অধ্যাপক খলিলুর রহমান আশা প্রকাশ করেছেন যে ডিজিটাল বাংলাদেশ এর সফল রূপায়ণের জন্য এই সিস্টেমটি একটি মাইলফলক হতে পারে। এ বিষয়ে নিয়াজ মোস্তাকিম জানান, ‘আমার দীর্ঘ দুই বছরের গবেষণার ফসল এটি। এটি আরও দ্রুত করা সম্ভব ছিল। কিন্তু নিজের খরচে তৈরি করতে সময় বেশি লেগেছে। তবে সরকার কিংবা অন্য কোনো বেসরকারি প্রতিষ্ঠান যদি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয় তাহলে সে এই পদ্ধতির মাধ্যমে অতিদ্রুত ডিজিটাল বাংলাদেশের বাস্তবায়নের স্বপ্ন দেখেন। এ ছাড়া তাকে যদি আর্থিক বিষয়ে সাপোর্ট দেওয়া হয় তাহলে সে আরও ভালো কিছু উদ্ভাবন করার আশা ব্যক্ত করেন।’ ফলিত পদার্থ বিজ্ঞান, ইলেকট্রনিক্স অ্যান্ড কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সভাপতি ড. মানজারুল আলম বলেন, সরকার ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে সার্বিক সহযোগিতা পেলে আমাদের শিক্ষার্থীরা নতুন নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবনের মাধ্যমে দেশ ও জাতির কল্যাণে অবদান রাখতে পারবে বলে আশা করছি। নিয়াজ মোস্তাকিম নওগাঁ জেলার ধামইরহাট উপজেলার জাহানপুর গ্রামের নজরুল ইসলামের ছেলে।

সে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত পদার্থ বিজ্ঞান, ইলেকট্রনিক্স অ্যান্ড কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী। অনার্স প্রথম শ্রেণিতে প্রথম এবং মাস্টার্সেও একই ফলাফলের আশাবাদী মোস্তাকিম।

সর্বশেষ খবর