শনিবার, ৩ জুন, ২০১৭ ০০:০০ টা
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট

ধানে প্রথম নারী ডিজি

শেখ সফিউদ্দিন জিন্নাহ্

ধানে প্রথম নারী ডিজি

বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) প্রথম নারী ডিজি ড. ভাগ্যরানী বণিক ইতিমধ্যে ভুট্টাবিজ্ঞানী হিসেবে দেশ-বিদেশে ব্যাপক খ্যাতি অর্জন করেছেন

বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) প্রথম নারী মহাপরিচালক (ডিজি) হলেন ড. ভাগ্যরানী বণিক। ইতিমধ্যে তিনি ভুট্টাবিজ্ঞানী হিসেবে দেশ-বিদেশে ব্যাপক খ্যাতি অর্জন করেছেন। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের জার্নালে তার ৩৭টি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে...

 

দেশের গণমানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। এ দেশকে চাল উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ করা এমনকি বিদেশে চাল রফতানির সক্ষমতা অর্জনের নেপথ্যে এর অবদান সর্বজনস্বীকৃত। আর এরই মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ঈর্ষণীয় সুনাম কুড়িয়েছে। আর এবারই প্রথম প্রতিষ্ঠানটির সর্বোচ্চ আসন মহাপরিচালক (ডিজি) পদে একজন নারীকে অধিষ্ঠিত করা হয়েছে। আর এতে প্রতিষ্ঠানটিতে নতুন মাত্রা যুক্ত হলো। দেশের খাদ্য নিরাপত্তা এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার গুরুত্ব অনুধাবন করে ১৯৭০ সালের ১ অক্টোবর রাজধানী ঢাকার অদূরে গাজীপুরে ৭৬.৮২ হেক্টর জমি নিয়ে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রথমদিকে এর নাম ছিল পূর্ব পাকিস্তান ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট। পরবর্তীতে দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭১ নামে পরিবর্তন আসে। নাম হয় বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট। আর এরপর থেকেই মূলত প্রতিষ্ঠানটি দেশের ধান নিয়ে নানা গবেষণা চালিয়ে যান। আর এই গবেষণায় এসেছে আমূল পরিবর্তন। দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে চাষাবাদের জমি কমে গেলেও ধানের উৎপাদন দিন দিন বেড়েই চলেছে। যার পুরোটাই বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের অবদান। আর এই প্রতিষ্ঠানে পুরুষদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নারীরাও এগিয়ে রয়েছেন। তারই প্রমাণ মহাপরিচালক (ডিজি) নারী। আর এই ভাগ্যবতী নারী ডিজির নামও ভাগ্য দিয়ে লেখা। নাম ড. ভাগ্য রানী বণিক। তিনি গত বছরের ৩০ জুন বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) সাবেক মহাপরিচালক ড. জীবনকৃষ্ণ বিশ্বাসের স্থলাভিষিক্ত হন। তবে তিনি ইতিমধ্যে ভুট্টা বিজ্ঞানী হিসেবে দেশ-বিদেশে ব্যাপক খ্যাতিও অর্জন করেছেন।

ড. ভাগ্য রানী বণিকের জন্ম কুমিল্লা জেলার সদর দক্ষিণ উপজেলার বাগমারা রাজার গ্রামে ১৯৫৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর। তার শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ওই গ্রামেই। গ্রামের বাগমারা হাই স্কুল থেকে ১৯৭৪ সালে এসএসসি এবং লালমাই কলেজ থেকে ১৯৭৬ সালে এইচএসসি পাস করেন। পরে ভর্তি হন শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে (সাবেক বাংলাদেশ কৃষি ইনস্টিটিউট)। এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৮২ সালে বিএসসি এজি অনার্স ডিগ্রি লাভ করেন। এরপরের বছরই তিনি ১৯৮৩ সালের ৫ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটে বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা হিসেবে যোগদান করেন। কর্মজীবনের পাশাপাশি পড়াশোনাও চালিয়ে যান। ১৯৮৭ সালে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বাকৃবি) থেকে কৌলিতত্ত্ব ও উদ্ভিদ প্রজনন বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৯১ সালের এপ্রিল মাসে ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা হিসেবে পদোন্নতি পান।

এর পাশাপাশি পিএইচডিতে ভর্তি হন। ২০০৩ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ওই বিষয়ে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। কর্মজীবনে বিশিষ্ট ভুট্টা বিজ্ঞানী ড. ভাগ্য রানী বণিক বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। এরপর তিনি ২০০৪ সালের মে মাসে প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, ২০১০ সালের মার্চ মাসে মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, ২০১৩ সালের এপ্রিল মাসে পরিচালক (পরিকল্পনা ও মূল্যায়ন), ২০১৪ সালের আগস্ট মাসে পরিচালক (তৈলবীজ গবেষণা কেন্দ্র), ২০১৪ সালের ডিসেম্বর মাসে পরিচালক (প্রশিক্ষণ ও যোগাযোগ), ২০১৫ সালে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক (প্রশিক্ষণ ও যোগাযোগ) পদে পদোন্নতি লাভ করেন। কর্মজীবনের সব ক্ষেত্রে তিনি অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন।

এছাড়া তিনি রিসার্চ প্ল্যানিং অ্যান্ড ইভাল্যুয়েশন, মুগবীন স্প্রাউটিং অ্যান্ড ইটস ইউসেজ, বার্লি ও ভুট্টার প্রজনন কৃষিতত্ত্ব, বায়োমেট্রিক সংক্রান্ত প্রশিক্ষণ, প্রজেক্ট ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট, অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ অ্যান্ড ফিনান্সিয়াল ম্যানেজমেন্ট, রিসার্চ প্ল্যানিং অ্যান্ড ইভাল্যুয়েশন ইত্যাদি বিষয়ে বিভিন্ন মেয়াদে দেশ-বিদেশে প্রশিক্ষণে অংশ নেন।

ড. ভাগ্য রানী বণিক সরল ভাষায় বলেন, মহাপরিচালক (ডিজি) হিসেবে দায়িত্ব পালনের সুযোগ পেয়ে আমি গর্বিত ও অনুপ্রাণিত। একই সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তন, জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও কৃষি জমি কমে যাওয়ার মতো নানা প্রতিকূলতার মুখে এখানে আরও ভালোভাবে দায়িত্ব পালনের চ্যালেঞ্জ সম্পর্কেও আমি সমান সচেতন, বলেন ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রথম নারী মহাপরিচালক ড. ভাগ্য রানী বণিক।

ভুট্টার ওপর ড. ভাগ্য রানী বণিকের অনেক গবেষণা রয়েছে। ভুট্টা বিজ্ঞানী হিসেবে দেশ-বিদেশে তার সুখ্যাতিও কম নয়।

এই পথচলা সম্পর্কে ড. ভাগ্য রানী বণিক বলেন, ‘আমার কাজের প্রেরণা বাবা-মা, স্বামী-সন্তান। এছাড়া সমাজের জন্য সাধ্য অনুযায়ী ভালো কিছু করার তাগিদই আমার অনুপ্রেরণার উৎস।’

কৃষি নিয়ে পড়াশোনায় আগ্রহ সম্পর্কে ড. ভাগ্য রানী বণিক জানান, ‘এর মাধ্যমে দেশের মানুষের কল্যাণে কাজ করা যায় বলেই এ বিষয়ে পড়াশোনা করেছেন।’

ভবিষ্যতে কোন বিষয়ে গবেষণা এবং কাজ করতে আগ্রহী জানতে চাইলে ড. ভাগ্য রানী বণিক বলেন, ‘বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটে বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেছি। ভুট্টা ফসলের উন্নয়নের জন্য কাজ করেছি। এখন সারা জীবনের কর্ম অভিজ্ঞতার আলোকে এ দেশের প্রধান খাদ্যশস্য ধান গবেষণা কাজের মানোনয়ন কিভাবে করা যায় এর ওপর কাজ করার চেষ্টা করছি।’

এছাড়া রিসার্চ ম্যানেজম্যান্ট ও হিউম্যান ক্যাপাসিটি বিল্ডিংয়ের ওপর প্রশিক্ষণ ও কাজ করতে আগ্রহী। ধান গবেষণাা ইনস্টিটিউটের সার্বিক উন্নয়নে নিজের সর্বোচ্চ মেধা দিয়ে কাজ করব। এ প্রতিষ্ঠানকে দেশের মানুষের সেবায় এগিয়ে নেওয়ার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করব।

ড. ভাগ্য রানী বণিকের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের জার্নালে লেখালেখির সংখ্যা অনেক। তার প্রকাশিত গবেষণা নিবন্ধের সংখ্যা ৩৭টি। পেশাগত জীবনে তিনি চীন, জাপান, জার্মানি, মেক্সিকো, থাইল্যান্ড, ভারত ও নেপালসহ বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেছেন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি দুই সন্তানের মা। ছেলে বিশ্বজিৎ বণিক পথিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং এক মেয়ে প্রতীতি বণিক তুলি চিকিৎসাবিজ্ঞানে পড়ছেন। তার স্বামী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক হিসেবে অবসর নেন।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর