শনিবার, ৩ জুন, ২০১৭ ০০:০০ টা

বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ ফলদ গবেষণা কেন্দ্র

সৈয়দ নোমান, ময়মনসিংহ

বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ ফলদ গবেষণা কেন্দ্র

মাঘ-ফাল্গুনে গাছ ফুলে ফুলে ভরে যায়, বেড়ে যায় মৌমাছির গুঞ্জন। বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে আমের মধুমাখা সুঘ্রাণ। এ ছাড়া নানা প্রজাতির বারোমাসি ফলের সমাহার  প্রতি বছর উপহার দিচ্ছে এশিয়া মহাদেশের সর্ববৃহৎ তথা গোটা পৃথিবীতে দ্বিতীয় ফলদ বৃক্ষের জীবাত্মা সংগ্রহশালা ‘জার্মপ্লাজম সেন্টার’। ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তে ৩২ একর জায়গাজুড়ে গড়ে উঠেছে এ প্রকল্প।

 

ময়মনসিংহ শহরের দক্ষিণে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে গড়ে ওঠা গোটা পৃথিবীতে দ্বিতীয় ফলদ বৃক্ষের জীবাত্মা সংগ্রহশালার নাম ‘জার্মপ্লাজম সেন্টার’। ১৯৯১ সালে মাত্র এক একর জায়গা নিয়ে গড়ে উঠেছিল ‘ফ্রুট ট্রি স্টাডিজ’ নামক একটি প্রকল্প। পরবর্তীতে নাম পরিবর্তন করে হয় ‘ফল গাছ উন্নয়ন প্রকল্প’। আর এখন এটিই ৩২ একর জায়গার ওপর দাঁড়িয়ে বিশ্বের সবার কাছে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেছে ‘জার্মপ্লাজম সেন্টার’ হিসেবে। সেন্টারটিতে রয়েছে অসংখ্য বিলুপ্তপ্রায় ও বিরল প্রজাতির দেশীয় ফল আর ঔষধি গাছের সমাহার। ইতিমধ্যে বৃক্ষপ্রেমিক মানুষের কাছেও দর্শনীয় স্থান হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। সজীব ফলের এমন উদ্যানে সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, সেখানে রয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির লেবু-পেয়ারা ও বারোমাসি আমড়া। বাউকুল, আপেল কুলসহ বহু কুলের গাছ। রয়েছে বিলুপ্তপ্রায় সফেদা, কালোপাতি সফেদা, বাদামি সফেদা, লাল টকটকে আপেল জামরুল, গোলাপি রঙের নাশপাতি জামরুল, সবুজ জামরুল, বামন জলপাই, মিষ্টি ও হাইব্রিড কামরাঙা, বৈচি, লুকলুকি, পানিয়ালা, খিরনি, হরীতকী, বহেড়া, বন কাঁঠাল, ডেওয়া, ফলসা, স্টার আপেল, লোকাট, চেরি, করমচা, অরবরই, মহুয়া, আমলকি, বেল, আঁশ ফলসহ নানা প্রজাতির ফল গাছ। বছরে দুই থেকে চারবার ফল দিতে সক্ষম দোফলা, ত্রিফলা ও চৌফলাও রয়েছে এ উদ্যানে। জীবন্ত ফলের এ জাদুঘরটি এ পর্যন্ত গবেষণার স্বীকৃতিস্বরূপ জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে পেয়েছে অসংখ্য সরকারি ও বেসরকারি পুরস্কার। যার মধ্যে ২০০৩ ও ২০১২ সালে বৃক্ষরোপণে বিশেষ অবদানের জন্য প্রধানমন্ত্রীর জাতীয় প্রথম পুরস্কার। ২০১৪ সালে বঙ্গবন্ধু কৃষি পুরস্কারসহ বিভিন্ন সরকারি এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে সংবর্ধনায় ভূষিত হয়েছে ৪৮ বারেরও বেশি। আর এতসব সাফল্যের মূল কারিগর সেন্টারের পরিচালক প্রফেসর ড. এম এ রহিম কৃষিতে বিশেষ অবদানের জন্য পেয়েছেন সুদূর আমেরিকার নিউইয়র্ক প্রবাসী বাঙালিদের বিশেষ সম্মাননাসহ ‘নরমেন আরনক বোরলক’ আন্তর্জাতিক পুরস্কার।

দেশের মাটিতে বিদেশি ফল

জার্মপ্লাজম সেন্টারের মাধ্যমে বিদেশ থেকে অনেক ফলই বাংলাদেশে এসেছে। এর মধ্যে পার্সিমন, রাম্বুটান, এভোকেডো, জাবাটিকাবা, ড্রাগন উল্লেখযোগ্য।

 

পার্সিমন : এ ফলটি ১৯৯৮ সালের অক্টোবর মাসে জাপান থেকে এনে জার্মপ্লাজম সেন্টারে বীজ রোপণ করা হয়। প্রায় ৮ বছর পর বামন প্রকৃতির এ গাছটি থেকে প্রথম ফল আসে। তখন ২০৭টি ফল এসেছিল গাছটিতে। ফলটির গবেষক ড. এম এ রহিম জানান, ‘ফলটি পাকলে সবুজাভাব হলুদ রং ধারণ করে’।

রাম্বুটান : এ ফলটির জন্মস্থান মালদ্বীপ অথবা থাইল্যান্ডে বলে জার্মপ্লাজম সেন্টার থেকে জানা গেছে। ১৯৯৯ সালে রাম্বুটান এই ফলদ বাগানে আসে। লিচুর মতো এ ফলটির খোসার ওপর খয়েরি রঙের লম্বা লোম থাকে। সুস্বাদু ও মুখরোচক এ ফলটি পূর্ব এশিয়ার থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, বার্মা, ফিলিপাইন ও ভিয়েতনামসহ বিভিন্ন দেশে চাষ হয়ে থাকে।

এভোকেডো : এভোকেডোর আদি জন্মস্থান মধ্য আমেরিকা। বাংলাদেশে আসে ১৯৯৭ সালে। চট্টগ্রামের হাটহাজারী ও অন্যান্য পার্বত্য এলাকায় সীমিত আকারে বর্তমানে এর চাষ হচ্ছে।

জাবাটিকাবা : সিন্ধু প্রদেশের রসালো ফল জাবাটিকাবা। বৈজ্ঞানিক নাম Myrciaria cauliflora স্বাদে টক-মিষ্টি। সেই সঙ্গে প্রচুর পুষ্টি। প্রতিটি ফলে রয়েছে একটি করে বীজ। খর্বাকৃতির জাবাটিকা গাছের একেবারে নিচে ফলন ধরে। ২০০৫ সালে দেশের মাটিতে প্রবর্তন করা হয় ফলটিকে।

ড্রাগন ফল : ২০০৭ সালে প্রথম প্রবর্তন করেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) বাউ জার্মপ্লাজম সেন্টারের পরিচালক প্রফেসর ড. এম এ রহিম। এ ফলের জাত থাইল্যান্ড, ফ্লোরিডা ও ভিয়েতনাম থেকে নিয়ে আসেন।

 

ফলের গবেষণায় সাফল্য বাংলাদেশের

বর্তমানে জার্মপ্লাজম জাদুঘরের প্রকল্প পরিচালক ‘বাউকুল’ জন্মদাতা কৃষি বিজ্ঞানী ড. আবদুর রহিম। সঙ্গে রয়েছেন একজন সিনিয়র রিসার্চ এসোসিয়েট, দুজন রিসার্চ এসোসিয়েট। এসব গবেষকের পাশাপাশি ৩৬ জন শ্রমিকও কাজ করেন এ ফলদ জাদুঘরে। জানা যায়, প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় উদ্ভাবন হয়েছে প্রায় ৮৭টি বিভিন্ন প্রজাতির ফলের জাত। এ জাতগুলোর মধ্যে আমের ২৫, পেয়ারার ১০, কুলের ৩, লেবুর ৪, জাম্বুরার ৫, লিচুর ৪, তেঁতুল ২, লংগান ২, ড্রাগন ৪, কামরাঙা ৩, জলপাই, লটকন, আমলকি, ডুমুর, মালটা ২, অরবরই, স্ট্রবেরি, কদবেল, কাঁঠাল, রাম্বুুটান, আমড়া ও কাজুবাদাম-এর একটি করে জাত, লিচু ৪, গাব ২, জামরুল ও সফেদার ৪টি করে জাত। এ ছাড়াও বাউ ড্রাগন ফল-১ (সাদা), বাউ ড্রাগন ফল-২ (লাল), বাউ ড্রাগন ফল-৩, বাউ লঙ্গা-১ (বোগর), বাউ তেঁতুল-১ (মিষ্টি), বাউ তেঁতুল-২ (টক), বাউ কদবেল-১ (বনলতা), বাউ পেয়ারা-৭ (বীজশূন্য গোল), বাউ পেয়ারা-৮ (বীজশূন্য ডিম্বাকার) উল্লেখযোগ্য।

প্রকল্প পরিচালক ড. আবদুর রহিম জানান, এখানে রয়েছে ১৮১ প্রজাতির প্রায় ১১,৬৪২টি দেশি-বিদেশি মাতৃগাছ। এগুলোর মধ্যে রয়েছে ৩০৫ রকমের আম, ৫৭ প্রকারের পেয়ারা, ২৩ রকমের লিচু, ৪৭ রকমের লেবু, ৯৪ রকমের কাঁঠাল, ৬৭ প্রজাতির বিলুপ্তপ্রায় অপ্রধান ফল, ৬৮ প্রজাতির ফলদ ঔষধি গাছ, ২৭ প্রজাতির ভেষজ গাছ ও ৪২টি দেশ থেকে সংগ্রহকৃত ৫৮ প্রজাতির বিদেশি ফল। এ ছাড়াও পাহাড়ি এলাকার ১৬ রকমের ফল রয়েছে। ওই ফলগুলোর ওপর নিবিড় গবেষণা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে এ সেন্টারটি। আমের সিডলেস, ডায়াবেটিক ও নাবীজাত শ্রাবণীর মতো জাত নিবন্ধন নিয়েছে।

 

সব ধরনের ডায়েটের জন্য এ ফলটি উপযুক্ত। খাবারের পর ডেজার্ট হিসেবে পূর্ব ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে এ ফল খাওয়ার রেওয়াজ রয়েছে। এ ফলটি প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি, মিনারেল এবং উচ্চ ফাইবারযুক্ত। সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা প্রকৃতি কন্যার অলংকার এ জার্মপ্লাজম সেন্টার। সজীব ফলের এ জীবাত্মা জাদুঘরটিকে দেখতে প্রতিদিনই ভিড় জমাচ্ছেন দেশ-বিদেশের অসংখ্য প্রকৃতিপ্রেমিক। শুধু ভিড় জমিয়েই শান্ত নন প্রকৃতিপ্রেমীরা, তারা চারা সংগ্রহ করে নিয়েও যাচ্ছেন দেশের বিভিন্ন স্থানে।

সর্বশেষ খবর