শনিবার, ৩ জুন, ২০১৭ ০০:০০ টা
চ্যালেঞ্জিং

তায়কোয়ান্দো শিখছেন রাবির মেয়েরা

কাজী শাহেদ, রাজশাহী

তায়কোয়ান্দো শিখছেন রাবির মেয়েরা

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও আশপাশের মেয়েরা আত্মবিশ্বাস বাড়াতে নিয়ম করে তায়কোয়ান্দো শিখছেন। সকাল-বিকাল দুই ব্যাচে শতাধিক মেয়ে তায়কোয়ান্দো প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। নিজের আত্মরক্ষার কৌশল যেমন আয়ত্ত করছেন, তেমনি দেশ-বিদেশের বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে তারা দেশের মুখ উজ্জ্বল করছেন...

 

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষার্থী মারলিন আক্তার। সাত মাস ধরে তিনি তায়কোয়ান্দো প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। তিনি বলেন, ‘একজন মেয়েকে সমাজের সর্বস্তরে শারীরিকভাবে দুর্বল ভাবা হয়। নানা রকমভাবে যৌন হয়রানির শিকার হতে হয়। তায়কোয়ান্দো শিক্ষার মাধ্যমে আমি নিজেকে রক্ষা করার কৌশল আয়ত্ত করছি। ৭ মাস আগে রাস্তায় একা চলতে খুব অসহায় লাগত। কিন্তু এখন আমি খুব আত্মবিশ্বাসী। অতি সহজে কেউ আমার ওপর হামলা করতে পারবে না।’ 

শুধু এক মারলিন নন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও আশপাশের এলাকার মেয়েরা আত্মবিশ্বাস বাড়াতে নিয়ম করে তায়কোয়ান্দো শিখছেন। সকাল-বিকাল দুই ব্যাচে শতাধিক মেয়ে তায়কোয়ান্দো প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। নিজের আত্মরক্ষার কৌশল যেমন তারা আয়ত্ত করছেন, তেমনি দেশ-বিদেশের বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে তারা দেশের মুখ উজ্জ্বল করছেন। শুরুটা হয়েছিল ১৯৯৮ সালে। সেবার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষার্থী ফজলে রাব্বি চৌধুরী, সাইকোলজি বিভাগের কামরুজ্জামান চঞ্চল ও আইন বিভাগের নাজমুর রহমান অংশ নিয়েছিলেন জাতীয় তায়কোয়ান্দো প্রতিযোগিতায়। প্রথমবারেই সাফল্যের দেখা পান এই তিন তরুণ। তিনজনই অর্জন করেন স্বর্ণপদক। একই বছরে নেপালে অনুষ্ঠিত সাফ গেমসে অংশ নেওয়ার সুযোগ হয় নাজমুর রহমানের। বাংলাদেশের হয়ে ব্রোঞ্জপদক লাভ করেন তিনি। এরপর ২০০৩ সাল। কামরুজ্জামান চঞ্চল কোরিয়া গিয়েছিলেন তায়কোয়ান্দো প্রশিক্ষণ নিতে। প্রথমবার কোরিয়ায় গিয়ে দেখেন তায়কোয়ান্দো নিয়ে কোরীয়দের উন্মাদনা। কোরিয়ার খিয়ংহি বিশ্ববিদ্যালয়ে তো তায়কোয়ান্দোতে রীতিমতো অনার্স ডিগ্রি দেওয়া হয়। এসব দেখে বাংলাদেশেও তায়কোয়ান্দোকে ছড়িয়ে দিতে উদ্বুদ্ধ হন কামরুজ্জামান।

২০১২ সাল। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শরীরচর্চা বিভাগে সহকারী পরিচালক হিসেবে যোগদান করেন কামরুজ্জামান চঞ্চল। যোগদান করেই কোরীয় উন্নয়ন সংস্থা ‘কৈকা’র সহযোগিতায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্মাণ করেন তায়কোয়ান্দো জিম। তখন থেকেই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা শুরু করেন তায়কোয়ান্দো প্রশিক্ষণ। সময় যত গড়াতে থাকে ছেলেদের পাশাপাশি মেয়েদের অংশগ্রহণও তত বৃদ্ধি পেতে থাকে। প্রতি বছর অন্তত ৫০ জন ছাত্রীর তায়কোয়ান্দো প্রশিক্ষণ নেওয়া শুরু হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের জিম থেকে। আত্মরক্ষা, আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি, শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ থাকা ও নিজেকে বিশ্বমানের খেলোয়াড় হিসেবে তৈরি করতেই তায়কোয়ান্দো প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন তারা। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক তায়কোয়ান্দো প্রতিযোগিতায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আছে গৌরবময় ইতিহাস। প্রতি বছরই জাতীয় তায়কোয়ান্দো প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে স্বর্ণসহ নানা পদক অর্জন করছেন রাবির শিক্ষার্থীরা। ২০১৩ সালে বাংলাদেশ গেমসে অংশ নিয়ে রাবির তায়কোয়ান্দো প্রতিযোগীরা স্বর্ণসহ ৬টি পদক জিতে নেন। গত ২৫ ও ২৬ মার্চ থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককে অনুষ্ঠিত ১৩তম আসাম্পশন ইউনিভার্সিটি আন্তর্জাতিক তায়কোয়ান্দো চ্যাম্পিয়নশিপের ‘প্রিন্সেস কাপ’ প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে রাবির প্রতিযোগী বাংলা বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী আলী মোহাম্মদ নাইম স্বর্ণ ও রৌপ্য পদক অর্জন করেন। নাইমের কোচ হিসেবে সঙ্গে ছিলেন মো. কামরুজ্জামান চঞ্চল। কামরুজ্জামান চঞ্চল জানান, রাবিতে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ২০১২ সালে তায়কোয়ান্দো প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু হয়। শুরুতে ছেলেরা বেশি আগ্রহ দেখালেও বর্তমানে মেয়েদের অংশগ্রহণ বাড়ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে এটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। বাংলাদেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েই তায়কোয়ান্দোর জনপ্রিয়তা বেশি। আমরা চাই এই জনপ্রিয়তা পুরো দেশে ছড়িয়ে দিতে। সে অনুযায়ী আমরা কাজও করছি। তিনি আরও জানান, প্রথম পর্যায়ে আমরা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তবিভাগ তায়কোয়ান্দো প্রতিযোগিতা-২০১৭ আয়োজন করেছি। গত মঙ্গল ও বুধবার দুই দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত হয় এই প্রতিযোগিতা। বিশ্ববিদ্যালয়ের ১২টি বিভাগের ৬১ জন শিক্ষার্থী অংশগ্রহণ করেন। যার মধ্যে ছাত্রী অংশগ্রহণ করেছেন ১৯ জন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে এই খেলাটি নিয়ে ব্যাপক উৎসাহ দেখা গেছে। প্রতিযোগিতায় অংশ নেন চারুকলা অনুষদের কারুশিল্প বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী ফারজানা তাসনিম রিতু। তিনি জানান, গত ১ বছরের বেশি সময় ধরে তিনি তায়কোয়ান্দো প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। তিনি বলেন, ‘জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই প্রয়োজন আত্মবিশ্বাস। তায়কোয়ান্দো সেই আত্মবিশ্বাসটা এনে দেয়। তা ছাড়া তায়কোয়ান্দোতে আত্মরক্ষার কলাকৌশলও শেখানো হয়। মেয়ে হিসেবে প্রতিনিয়তই আমাকে সমাজের নানা প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে আত্মরক্ষা করে চলতে হয়।’ প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়া ইংরেজি বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী ঈশিতা বলেন, ‘শুধু আত্মবিশ্বাস নয়, মেয়েদের শারীরিক গঠন ঠিক রাখতে তায়কোয়ান্দো প্রশিক্ষণের বিকল্প নেই। তায়কোয়ান্দো প্রশিক্ষণের মাধ্যমে একজন মেয়ে তার শারীরিক গঠন ইচ্ছামতো রাখতে পারে। আত্মবিশ্বাস, আত্মরক্ষা ও শারীরিক গঠন ঠিক রাখার জন্য প্রতিটি মেয়ের তায়কোয়ান্দো প্রশিক্ষণ নেওয়া উচিত।’ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী বিশ্ব তায়কোয়ান্দো প্রতিযোগিতায় আগামী ৬-৭ বছর পর চ্যাম্পিয়ন হবে বলে মনে করছেন নেপালি তায়কোয়ান্দো প্রশিক্ষক অশোক খড়কা। তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছেন তায়কোয়ান্দো প্রশিক্ষণ দিতে। গত ১৯ থেকে ২২ মে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের তায়কোয়ান্দো খেলোয়াড়দের প্রশিক্ষণ প্রদান করেন। তিনি বলেন, ‘তায়কোয়ান্দো শেখার বিষয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েদের প্রচণ্ড আগ্রহ রয়েছে। তারা অনেক বুদ্ধিমান। তায়কোয়ান্দো একটি বুদ্ধিমত্তার খেলা। শারীরিক শক্তির চেয়ে এ খেলায় বেশি বুদ্ধির প্রয়োজন রয়েছে। এখানে যারা তায়কোয়ান্দো প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন তারা যদি তাদের প্রশিক্ষণ চালিয়ে যান, তবে আগামী কয়েক বছর পরই তারা বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হবে।’

সর্বশেষ খবর