শনিবার, ৮ জুলাই, ২০১৭ ০০:০০ টা

তরিকুলের বিশ্বজয়

আন্তর্জাতিক কোরআন প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন তরিকুল

রোকন রাইয়ান

তরিকুলের বিশ্বজয়

সংযুক্ত আরব আমিরাতের রাজধানী দুবাইয়ে অনুষ্ঠিত হয় ‘হলি কোরআন অ্যাওয়ার্ড’

বয়স মাত্র ১৩। এই বয়সে খেলাধুলাতেই ব্যস্ত থাকে অধিকাংশরা। সেখানে একেবারেই অন্যরকম হাফেজ তরিকুল। তেরোর তরিকুল করেছেন বিশ্বজয়। হয়ে উঠেছেন তারুণ্যের তারকা। ১০৩টি দেশকে পেছনে ফেলে প্রথম হয়েছেন। পুরস্কার হিসেবে পেয়েছেন ৬০ লাখ টাকা। তার এ অবদানে বাংলাদেশের জয়গান আরেকবার দেখেছে বিশ্ব। বলছি দুবাই আন্তর্জাতিক কোরআন প্রতিযোগিতার কথা। গত ১৫ জুন অনুষ্ঠিত হয় এ প্রতিযোগিতার ফাইনাল রাউন্ড।    

প্রতিবছর মধ্যপ্রাচ্যের ধনী রাষ্ট্র সংযুক্ত আরব আমিরাতের রাজধানী দুবাইয়ে অনুষ্ঠিত হয় ‘হলি কোরআন অ্যাওয়ার্ড’। দেশটির ধর্ম ও আওকাফ মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে আয়োজিত হয় এ প্রতিযোগিতা। এবারের আসরটি ছিল ২১তম। এ প্রতিযোগিতায় সারা বিশ্ব থেকে বাছাই করা প্রতিনিধিরা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। প্রতিটি দেশ থেকে মাত্র একজন করে সুযোগ পান। এবার সে সুযোগটি পেয়েছিলেন হাফেজ তরিকুল ইসলাম। রাজধানীর মারকাজুত তাহফিজ ইন্টারন্যাশনাল মাদ্রাসার ছাত্র।

শুরুতে ভাবেননি দুবাই যাওয়ার ভাগ্য তরিকুলের মিলবে। মার্চে ইসলামিক ফাউন্ডেশন মিলনায়তনে আয়োজিত বাছাই পরীক্ষায় কয়েকশ হাফেজকে পেছনে ফেলে সে উত্তীর্ণ হয়।

তরিকুল ইসলাম জানান, সেদিন থেকেই স্বপ্নের শুরু। ভয়, আশঙ্কা, উল্লাস সবই ছিল ভিতরে। প্রথমবারের মতো বিশ্ব কোরআন প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়া। জুন মাসের ৩ তারিখ শুরু হয় প্রতিযোগিতার প্রাথমিক পর্ব। হাফেজ তরিকুলের সুর যেন আলাদা হয়, ভিন্ন কিছু থাকে সে জন্য আলাদা মেহনত করতে হয়েছে। সবারটা যাচাই করতে হতো। তারপর আলাদা সুর (লেহান) তৈরি করা। যা বিচারকদের মনকে নাড়িয়ে তুলত। শেষ দিকে এমন হয়েছে, অন্য প্রতিযোগীরা তরিকুলের পাশে এসে বসে থাকত সে কীভাবে কোন সুরে পড়ছে তা অনুসরণ করার জন্য।

১৫ জুন। পুরস্কার ঘোষণার তারিখ। দিনটি ছিল অন্য সব দিনের চেয়ে আলাদা। দীর্ঘ ১১ দিন যাচাই-বাছাইয়ের পর চূড়ান্ত হয়েছে সেরা ১০। এই ১০ জনই পরবে সেরার মুকুট। কিন্তু সেখানে কে হবে প্রথম বিজয়ী। কে হবে রানার্সআপ। ওস্তাদ কারী নেছার আহমদও উৎকণ্ঠায়। তরিকুল বলেন, প্রথমেই দশম বিজয়ীর নাম ঘোষণা হলো। তখন থেকেই স্থির থাকতে পারছিলাম না। আমার নামটি যেন প্রথমেই না আসে সে জন্য মনে মনে বার বার আল্লাহকে জপছিলাম। এভাবে দ্বিতীয় বিজয়ী পর্যন্ত যখন আমার নাম নেই তখন আর সন্দেহ ছিল না— আমিই প্রথম বিজয়ী। ভাবতেই বুকের ছাতি আসমান ছুঁতে চাইছিল বার বার। এত গর্ব যে জীবনে কখনো হয়নি।

হাফেজ নেছার আহমদ বলেন, আমি চেষ্টা করছিলাম পুরস্কার অনুষ্ঠান লাইভ দেখাতে। কিন্তু প্রথম স্থান অধিকারীর নাম যখন ঘোষণা হলো। বলা হলো ২১তম আন্তর্জাতিক হলি কোরআন অ্যাওয়ার্ড জিতেছে বাংলাদেশের প্রতিযোগী হাফেজ তরিকুল। কথাটা কান স্পর্শ করতেই হাত থেকে মোবাইলটা পড়ে গেল। জীবনে অনেক আনন্দের সম্মুখীন হয়েছি। কিন্তু এটি ছিল সবচেয়ে আলাদা। সবচেয়ে অন্যরকম। 

পুরস্কার অনুষ্ঠানের মঞ্চে আরব আমিরাত ও সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোর নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। আর বিজয়ীদের হাতে পুরস্কার তুলে দিয়েছেন আমিরাতের যুবরাজ আহমদ বিন মুহাম্মদ বিন আল মাকতুম।

‘হলি কোরআন অ্যাওয়ার্ড’ প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারী দেশ যেমন সর্বোচ্চ তেমনি পুরস্কারের দিক থেকেও সর্বোচ্চ। এখানে প্রথম পুরস্কারপ্রাপ্তের হাতে তুলে দেওয়া হয় ২ লাখ ৫০ হাজার দিরহাম। যা বাংলাদেশি টাকায় ৬০ লাখ টাকা। পুরস্কারের এ অর্থ পাঠিয়ে দেওয়া হয় দূতাবাসের মাধ্যমে। তরিকুল বলেন, পুরস্কারটা বড় অংকের। তবে গুরুত্বপূর্ণ হলো দেশের নাম উজ্জ্বল করতে পেরেছি এটাই বড় অর্জন।

তবুও পুরস্কারের বিশাল এ অর্থ কী করবেন বলে ভেবেছেন— জানতে চাইলে তরিকুল মুচকি হেসে বলেন, ঈদের ছুটি থাকায় দূতাবাস থেকে এখনো টাকাগুলো তুলতে পারিনি। পেলে তখনই দেখা যাবে। তবে তরিকুল জানান, এই অর্থ দিয়ে কিছু সেবামূলক কাজ ও আমার বাবা-মাকে হজ করানোর ইচ্ছা আছে। 

অন্য পুরস্কারপ্রাপ্তদের মধ্যে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিযোগী হুজাইফা সিদ্দিকী। তিনি পেয়েছেন ২ লাখ দিরহাম। তৃতীয় হয়েছেন যৌথভাবে গাম্বিয়ার মুহাম্মদ মোডাউ জুবে ও সৌদি আরবের প্রতিযোগী আবদুল আজিজ আল ওবায়দান। তারা দুজনে ১ লাখ ৫০ হাজার দিরহাম পুরস্কার পেয়েছেন।

দুবাই জয় করা হাফেজ তরিকুল ইসলাম কুমিল্লার ছেলে। জেলার দাউদকান্দি উপজেলার মালিগাঁও গ্রামে তার জন্ম। তার বাবার নাম মো. আবু বকর সিদ্দিক। তিনি অবসরপ্রাপ্ত হাইস্কুল শিক্ষক। সাত ভাইবোনের মধ্যে তরিকুল পঞ্চম।

হাফেজ তরিকুল বলেন, আমার আব্বার দাদা আলেম ছিলেন। এ কারণে পরিবারের সবাই আমাকে হাফেজ ও আলেম বানাবেন বলে নিয়ত করেন। পরিবারের অন্যরা স্কুলে পড়লেও আমাকে ভর্তি করিয়ে দেওয়া হয় মাদ্রাসায়। শুরুতে গ্রামের একটি মক্তবে ভর্তি করা হয়। সেখানেই কায়দার সবক শিখি। তারপর হিফজ পড়তে শুরু করি। মাত্র এক বছরেই তিনি হেফজ সম্পন্ন করেন। হিফজের পাশাপাশি তিনি আলিয়া মাদ্রাসা থেকে চলতি বছর জেএসসি পরীক্ষা দেবেন।

তরিকুল বড় হয়ে কোরআনের একজন দক্ষ বিশ্লেষক ও প্রচারক হতে চান। দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে বাইরেও পড়ার ইচ্ছা আছে তার। ভাগ্য সহায় হলে মিসরের আল আজহার বা মদিনা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বেন বলেও জানান তিনি।

২০১৪ সালে মাছরাঙা টেলিভিশনে ‘আল কোরআনের আলো’ প্রতিযোগিতায় তিনি দ্বিতীয় স্থান লাভ করেন। পুরস্কার হিসেবে পান দুই লাখ টাকা। ২০১৫ সালে বাংলাভিশনে ‘পবিত্র কোরআনের আলো’ প্রতিযোগিতায় তরিকুল ষষ্ঠ স্থান লাভ করেন, পান ৫০ হাজার টাকা পুরস্কার। ২০১৭ সালে এনটিভিতে ‘পিএইচপি কোরআনের আলো’ প্রতিযোগিতায় পঞ্চম স্থান লাভ করেন, পান ৫০ হাজার টাকা পুরস্কার।  ২০১৭ সালে হুফাজুল কোরআন ফাউন্ডেশনের ‘জাতীয় হিফজুল কোরআন প্রতিযোগিতায়’ দ্বিতীয় স্থান লাভ করেন, সেখানে পুরস্কার হিসেবে পান ২০ হাজার টাকা।

 

ছিল না ২০০ টাকাও

হাফেজ তরিকুলের পারিবারিক অবস্থাটা নাজুকই বলতে হয়। বাবা এক সময় গ্রামের স্কুলটিচার হলেও এখন কিছুই নেই। সামান্য পরিমাণ জমি চাষ করে সংসার চলে। তাই পড়ালেখার খরচও ঠিকমতো জোগাড় হতো না। তরিকুল ইসলামের পাশেই বসা তার ওস্তাদ হাফেজ কারী নেছার আহমদ আন নাছিরী জানালেন, তরিকুল অজপাড়াগাঁয়ের সন্তান। বাবার অর্থবিত্ত নেই। কিন্তু ঈর্ষণীয় একজন ছেলে আছে তার। সে বিশ্বজয় করেছে।

পারিবারিক অবস্থা বোঝাতে কারী নেছার আহমদ বললেন, ইসলামিক ফাউন্ডেশনে যখন প্রতিযোগিতার বাছাই পর্ব হয়। ফরম তুলতে ২০০ টাকার দরকার ছিল। সেই সময় তরিকুলের কাছে ফরমের এই সামান্য টাকাও ছিল না। আমার পকেট থেকেই দিয়েছিলাম। কিন্তু আজ সে বিশাল অর্থ জয় করেছে। এটি আল্লাহর কৃপাতেই সম্ভব হয়েছে।

তরিকুল অবশ্য এটির জন্য শিক্ষকদের প্রতি কৃতজ্ঞ। শুধু নিজের চেষ্টা মেহনতেই নয়, বিশাল এ অর্জনের পেছনে বড় হাত নিজের শিক্ষকদের। এটি সে সবসময় স্মরণ রাখে। তরিকুল বলেন, আমার পেছনে শিক্ষকরা যতটা কষ্ট করেছেন, সময় দিয়েছেন, অন্য কারও জন্যই দেননি।  এই ঋণ আমি শোধ করতে পারব না কিছুতেই।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর