শনিবার, ৮ জুলাই, ২০১৭ ০০:০০ টা

শঙ্খ নদের বাঁকে বাঁকে...

বর্ষা মৌসুমে বান্দরবান মেঘের রাজ্যে রূপ নেয়। স্থানীয় শঙ্খ নদ ফিরে পায় বাঙালির নদীমাতৃক ঐতিহ্য। শঙ্খ নদের অথৈ জলের সাগর আর স্থানীয় অসংখ্য ছোট-বড় ঝরনার বৃষ্টি ও ঝরনাধারা নিয়ে যায় অন্য এক জগতে।

মনির হোসেন

শঙ্খ নদের বাঁকে বাঁকে...

একটি বাঁক পেরিয়ে আরেকটি বাঁক মানেই নতুন সৌন্দর্যের সংজ্ঞা খোঁজা। যেন নদীর গতিপথ এখানেই শেষ, তবে সেটি নিছক মরীচিকা। আরেকটি বাঁক নিয়ে যাবে নিরুদ্দেশের দিকে। এটিই ‘শঙ্খ’ নদ। স্থানীয়রা একে ‘রিগ্রাই খিয়াং’ বা ‘স্বচ্ছ নদী’ নামে ডাকে। বাংলাদেশের বেশির ভাগ নদ-নদী উত্তর থেকে দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে মিশেছে। কিন্তু শঙ্খ বান্দরবানের দক্ষিণাঞ্চলে সৃষ্টি হয়ে উত্তর দিকে প্রবাহিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে শেষ হয়েছে। মিয়ানমার সীমান্তবর্তী বাংলাদেশের বান্দরবানের মদক এলাকার পাহাড়ে এ নদের জন্ম। উত্পত্তিস্থল থেকে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত নদীটির দৈর্ঘ্য প্রায় ১৭০ কিলোমিটার। এটি চট্টগ্রাম বিভাগের দ্বিতীয় বৃহত্তম নদ। নদের দুই পাড়ে বসবাসকারী প্রায় ৯০ শতাংশই মারমা নৃ-গোষ্ঠী। তাদের জীবন-জীবিকার সঙ্গে শঙ্খ নদ ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আর তাদের পানির উৎস বলতে যা বুঝায় তাও এ পাথুরে নদকে ঘিরে। নৌকা চলছে ধীরে ধীরে। নদীতে পানি কম। নদীর দুই পাড়ে জুম চাষে ব্যস্ত চাষিরা। জুম চাষের কারণে নদীর পাড় দুটো সবুজে মোড়ানো কার্পেটের মতোই মনে হবে। যেতে যেতে দেখা মিলবে বেতছড়া বাজারের। বাজারটির পাশেই সেনাবাহিনীর একটি চেকপোস্ট। নৌপথে বান্দরবান থেকে রুমা যেতে এ চেকপোস্টে নাম নিবন্ধন করতে হয়। তার একটু দূরেই একটি ছড়া। নাম কেউচ্যারাং ছড়া। ছড়াটির কোনো কোনো অংশে পানির গভীরতা ১০-১২ ফুট। অসংখ্য ছোট-বড় ঝরনা থেকে সৃষ্টি হওয়া পাহাড়ি নদী বা ছড়া মিশেছে শঙ্খ নদে। এগুলোর মধ্যে পাইন ছড়া, সুয়ালক ছড়া এবং বান্দরবান-চন্দনাইশ সীমান্তের দুপাছড়ি ছড়া, রোয়াংছড়ি উপজেলার ঘেরাও ছড়া, পালং ছড়া, বেতছড়া, তারাছা ছড়া, কেউচ্যারাং ছড়া, চেমাছড়া, পানতলা ছড়া, রুমা খাল, পর্দাখাল, রেমাক্রী খাল, ক্যারাং ছড়া, খুনিম ছড়া অন্যতম। রিজুক জলপ্রপাত বান্দরবানের অপরূপ সৃষ্টি। ইঞ্জিনচালিত নৌকায় চড়ে শঙ্খ নদের দুই পাড়ের নয়নাভিরাম দৃশ্য দেখে যে কেউ মুগ্ধ হতে বাধ্য। ৩০-৪০ মিনিট নৌকা চলার পর হঠাৎ কানে আসবে শোঁ শোঁ শব্দ। দূর থেকে জলপ্রপাতের পানি নীল মনে হবে। জলপ্রপাতটির জলের ঝাপটা ২০০ ফুট এলাকা পর্যন্ত এদিক-ওদিক বিস্তৃত। মনে হবে ঝিরিঝিরি বৃষ্টির মধ্যে মন মাতোয়ারা। প্রায় ৩০০ ফুট উঁচু থেকে ঝরে পড়া জলপ্রপাতের রিমঝিম সুরের মূর্ছনা আপনাকে নিয়ে যাবে অন্য এক জগতে। এর আশপাশের জায়গাগুলো মনকাড়া প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর। রিজুকের আশপাশে মারমা ও বম উপজাতিদের গ্রাম রয়েছে। রিজুক দেখতে গিয়ে নৌকা ভ্রমণের আনন্দ আর ঝরনার অপরূপ সৌন্দর্য দুটোই উপভোগ করা যায়। বর্ষা মৌসুমে আরও মোহনীয় হয়ে উঠে রিজুকের ধারা। বৃষ্টি আর ঝরনাধারা উপভোগ করতে করতে আপনি হারাবেন এক অন্য রাজ্যে। এবার রেমাক্রী, নদীর দুই পাড়ে বড় বড় পাহাড়। একটার পর একটা পাহাড় উঁকি দিচ্ছে। এক পাহাড় ডিঙিয়ে আরেক পাহাড়ে। নদের তীরে পাতার ছাউনির নিচে আম, কাঁঠাল, কলা আর আনারসের স্তূপ। জুম চাষিদের মুখে তৃপ্তির হাসি। নৌকা চলবে আঁকাবাঁকা শঙ্খ নদের বুক চীরে। সামনে বিশাল এলাকা জুড়ে বিছানার মতো ছড়িয়ে আছে ছোট ছোট পাথর। এলাকার নাম ছোট পাথর। রেমাক্রী খালের দুই পাশের সবুজ বন-বনানী; শুভ্রনীল আকাশ আর পাহাড় ছুঁয়ে ওড়াউড়ি করে মেঘবালিকারা। আবার যখন তখন বৃষ্টি হয়ে নিচেও নেমে আসে। এ যেন এক স্বর্গীয় অনুভূতি। তাছাড়া বান্দরবানের স্থানীয় ঐতিহ্য সংস্কৃতি পর্যটকদের বিমোহিত করে। পাহাড়ি ঐতিহ্যের বিভিন্ন নৃত্যের তালে শুধু মুগ্ধ নয়, বুঁদ হয়ে থাকাই যেন প্রশান্তি।

 

শঙ্খ ভ্রমণে টুকটাক

যেভাবে যাবেন

ফকিরাপুল বা আরামবাগ থেকে সেন্টমার্টিন, সৌদিয়া, শ্যামলী ও হানিফ পরিবহনে বান্দরবান। বাসস্ট্যান্ড থেকে অটোতে ক্যাচিংঘাটা ট্রলার ঘাট। সেখান থেকে ট্রলারে বান্দরবান থেকে রুমা, রুমা থেকে থানচি আবার থানচি হয়ে রেমাক্রী, নাফাকুমও যেতে পারেন।

ভ্রমণ টিপস

ভ্রমণের সর্বক্ষেত্রে পরিবেশ ও প্রকৃতি সচেতনতার কথা মাথায় রাখবেন। স্থানীয় আচার ও সংস্কৃতিকে সম্মান করবেন। অনুমতি ছাড়া কারও ছবি তোলার চেষ্টা করবেন না। ক্যাপ, সানগ্লাস, গামছা এবং মশা থেকে রক্ষার জন্য অডোমস, প্রয়োজনীয় সব ওষুধ সঙ্গে রাখবেন।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর