শনিবার, ৮ জুলাই, ২০১৭ ০০:০০ টা
শ্রমজীবী মানুষের অ্যাপ

ডিজিটাল মানুষ

ডিজিটাল মানুষ

ডিজিটাল মানুষ অ্যাপ তৈরির কারিগররা

আমাদের ঘরে টুকিটাকি নানা ছোট সমস্যা হয়। যেমন বৈদ্যুতিক, তালা, গ্যাস, রং, গাড়ির মিস্ত্রি থেকে শুরু করে চর্মকার, স্যানিটারি সেবাদাতা, ইন্টারনেট সেবাদাতা, লন্ড্রি, সংবাদপত্রের হকার, ডেকোরেটর, তাঁতী, বাসা বদলের জন্য শ্রমজীবী মানুষের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করা যাবে স্মার্টফোন অ্যাপ্লিকেশন ‘ডিজিটাল মানুষ’-এর মাধ্যমে। গুগল অ্যাপ স্টোর থেকে নামিয়ে আপনার প্রয়োজনীয় মিস্ত্রির তথ্য লিখলেই পেয়ে যাবেন ফোন নম্বর। শুধু ফোন নম্বরই নয়, থাকবে তার পুরো ডাটা। লিখেছেন সাইফ ইমন—

 

‘তরুণদের স্বপ্নগুলোর বাস্তব রূপই ডিজিটাল মানুষ। এটি একটি গড়ে তোলা স্বপ্ন। এই স্বপ্নটি বাস্তবে রূপান্তর করা সরকার বা কোনো মুষ্টিমেয় ব্যক্তি বিশেষের দ্বারা কখনো সম্ভব হবে না, যদি আমরা সাধারণ নাগরিক এগিয়ে না আসি।’ —কথাগুলো বলছিলেন একজন উদ্যোক্তা, ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের পুরকৌশলের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র মো. খন্দকার আলিফ। তিনিই ‘ডিজিটাল মানুষ’ অ্যাপটির স্বপ্নদ্রষ্টা। সত্যি এক অসাধারণ কাজ করেছেন এই তরুণ ও তার সঙ্গীরা। বলা হচ্ছে শ্রমজীবী মানুষের অ্যাপ ‘ডিজিটাল মানুষ’ নিয়ে।

দেশকে ডিজিটাল করার লক্ষ্যে নিবেদিত এই তরুণরা। হাজারো উদ্যোক্তার মাঝে কিছু উচ্চাকাঙ্ক্ষী সাহসী তরুণের সমাজসেবামূলক উদ্যোগেই ডিজিটাল মানুষ অ্যাপটির  উদ্ভাবন হয়েছে। এই অ্যাপের বিশেষত্ব অন্য সবার থেকে একটু আলাদা। ধরুন, আপনি অফিস শেষে বাসায় যাচ্ছেন। বাইরে প্রচণ্ড গরমে ক্লান্ত। এমন সময় বাসা থেকে ফোন এলো বৈদ্যুতিক লাইনে সমস্যা হয়েছে। ফলে বাসায় বিদ্যুৎ নেই। কী করবেন তখন! শুধু আপনার হাতের স্মার্টফোনটি দিয়েই এর সমাধান সম্ভব। এর জন্য আপনাকে গুগল প্লে স্টোর থেকে ‘ডিজিটাল মানুষ’ অ্যাপটি ডাউনলোড করে ইনস্টল করতে হবে। যা সম্পূর্ণ ফ্রি। তারপর খুব সহজেই আপনার বাসস্থানের আশপাশের সবচেয়ে ভালো ইলেকট্রিশিয়ানের ডিটেইলস পেয়ে যাবেন আপনি। তার সঙ্গে কন্টাক্ট করে সহজে বাসায় পৌঁছানোর আগেই মুক্তি পেতে পারেন বৈদ্যুতিক সমস্যা থেকে। শুধু বৈদ্যুতিক সমস্যাই নয়, আপনার নিত্যপ্রয়োজনীয় হাজার শ্রমজীবী মানুষকে আপনি এই অ্যাপটিতে পাবেন।

সাধারণ মানুষও চাইলে এই অ্যাপের সাহায্যে তাদের সেবা প্রদান করতে পারবে। ইলেকট্রিশিয়ান, লন্ড্রি, স্যানিটারি মিস্ত্রি, অটো মেকানিক, মোবাইল ও কম্পিউটার সার্ভিস, ভ্যান সার্ভিস ইত্যাদি সব শ্রমজীবী মানুষকে খুঁজে পাবেন। আপনার আশপাশেই তারা অবস্থান করেন, কিন্তু প্রয়োজনে অনেক সময় তাদের পাওয়া যায় না। তারা সম্পূর্ণ নিজেদের হাত খরচ, টিউশন ও ফ্রিল্যান্স ইনকাম থেকে এসব মানুষকে একত্র করেছে। তাদের ডাটা সংগ্রহ করেছে। এই অ্যাপটি ঢাকা শহরের ৮৪টি এলাকার শ্রমজীবী মানুষ নিয়ে গঠিত। এই অ্যাপটি যদি সাধারণ মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়া যায় তাহলে যারা জায়গা বা টাকার অভাবে কাজ পাচ্ছিল না তাদের কর্মসংস্থান তো হবেই সেইসঙ্গে আমাদের অনেক সময় বাঁচবে। মানুষের দৈনন্দিন জীবনে তথ্যপ্রযুক্তির একটি ছোঁয়া আসবে। শ্রমবৈষম্যও কমে আসবে।

 

অ্যাপটিতে মোট ২২টি বিভাগ আছে। ঢাকা শহরের ৮৪টি এলাকার কর্মীদের খুঁজে পাওয়া যাবে। আপনি যে এলাকায় থাকেন সেই এলাকার ‘লোকেশন’ হিসেবে নির্বাচন করতে হবে। এরপর অ্যাপে চলে আসবে নির্দিষ্ট কাজের শ্রমজীবীদের তালিকা। সেখানে তাদের নাম, পরিচয়, তথ্য ও ফোন নম্বর পাবেন। ফোন করতে চাইলে বোতামে চাপ দিলেই তার কাছে ফোনকল চলে যাবে। আপনি তার সঙ্গে কথা বলে তাকে তিনটি বিষয় সম্পকে উভয়পক্ষ নিশ্চিত হয়ে নেবেন। প্রথমত আপনার সমস্যাটি সম্পূর্ণ তাকে বলবেন। তারপর এর জন্য কত পারিশ্রমিক দিতে হবে তা নিশ্চিত করবেন। সব শেষে আপনার বাসার ঠিকানাটি ঠিকভাবে বুঝিয়ে বলবেন। এরপর আপনার বাসায় এসে তিনি কাজটি করে দিয়ে যাবেন।

এরকম একটি উদ্যোগ সম্পূর্ণ ফ্রি হওয়ার কারণ কী জানতে চাইলে খন্দকার আলিফ বলেন, বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে ও মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হওয়ায় বাবার মুখে শোনা বাস্তব আত্মত্যাগের গল্পগুলো থেকে দেশ ও মানুষের জন্য কিছু করার স্বপ্ন কাজ করত। সেই স্বপ্ন থেকে আমাদের ডিজিটাল মানুষ অ্যাপ গড়ে তোলা। শ্রমজীবী বা পেশাজীবী মানুষের পরিশ্রমেই একটি দেশ গড়ে ওঠে। তাদের পরিশ্রমকে লাঘব করতে এবং তাদের উপযুক্ত সম্মান ও সুবিধা প্রদানই এই অ্যাপের লক্ষ্য।

 

বর্তমান অবস্থান

১ মে, ২০১৭ তথা শ্রমজীবী দিবসে এই অ্যাপটি প্রকাশ করা হয়। ২ মাসে ডিজিটাল মানুষ অ্যাপটির ডাউনলোড সংখ্যা ১০ হাজার ছাড়িয়েছে। ৫ হাজার শ্রমজীবী ও পেশাজীবী মানুষের মাঝে এই অ্যাপটি ৪৩৩২টি একক কাজের সন্ধান দিয়েছে।

এখন পর্যন্ত ডিজিটাল মানুষ অ্যাপের নির্মাণ ব্যয় বাবদ কোনো সাধারণ মানুষ ও শ্রমজীবী মানুষের কাছ থেকে কোনো অর্থ সংগ্রহ করা হয়নি। অ্যাপটির ফেসবুক পেজ—

https://www.facebook.com/DigitalManushApp/

পুরস্কার ও মনোনয়ন প্রাপ্তি

অ্যাপটি উদ্ভাবনের পর ১১ মে ২০১৭ তারিখে আন্তবিশ্ববিদ্যালয় সফটওয়্যার কম্পিটিশনে প্রথম স্থান অর্জন করেছে। এশিয়া প্যাসিফিক বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ারম্যান কাইয়ুম রেজা চৌধুরীর হাতে টিম ডিজিটাল মানুষকে পুরস্কার প্রদান করে। পুরস্কার প্রাপ্তির পর এর উদ্যোক্তা আলিফ ও তার সঙ্গীরা কিন্তু বসে থাকেনি। তারা সরেজমিন বিস্তার লাভের পাশাপাশি ডিজিটাল মানুষ অ্যাপটি সংস্করণে নিরলস কাজ করে যাচ্ছে।

সুখবর আরও আছে। ২০১৭ সালে দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম তথ্যপ্রযুক্তি উদ্যোক্তাদের প্রতিযোগিতায় ডিজিটাল মানুষসহ ২৯৪টি উদ্যোক্তা-দল অংশগ্রহণ করে। তার মধ্যে স্মার্ট স্যাটেলমেন্টস ও আরবানাইজেশন ক্যাটাগরিতে সেরা ৭-এ মনোনীত হয়েছে ডিজিটাল মানুষ।

 

শুরুতে প্রতিবন্ধকতা

অ্যাপটি এখন ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠলেও শুরুতে নানা প্রতিবন্ধকতার কথা জানালেন অ্যাপটির উদ্ভাবক আলিফ। তিনি জানান, ‘শুরুতে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে আমাদের। প্রতিটি এলাকায় গিয়ে শ্রমজীবী মানুষের তথ্য সংগ্রহ করা এবং তাদের বুঝানোটাই ছিল প্রথম চ্যালেঞ্জ। তারপর আছে প্রচারে প্রতিবন্ধকতা। সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিও

প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে। অপরিপক্ব নগর-ব্যবস্থাপনাও একটি মূল সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। আর্থিক জটিলতা তো রয়েছেই। অনেক টাকা খরচ হয়েছে এই অ্যাপটি তৈরি করতে। যেখানে এই সার্ভিসটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

ডিজিটাল মানুষ অ্যাপটি ব্যবহার করে অল্প কিছু ক্লিকের মাধ্যমেই অতি সহজে আপনি আপনার এলাকার কাঙ্ক্ষিত সেবাদানকারীর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারবেন। সেইসঙ্গে হটলাইন কল ব্যবস্থার মাধ্যমে ডিজিটাল মানুষ অ্যাপে শতভাগ নিশ্চয়তা সহকারে ডুর স্টেপ সার্ভিসের ব্যবস্থা আছে। তাদের বিশ্বস্ত সেবা ব্যবস্থায় নিরাপত্তার নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়।

তারা মানুষকে ভালো উদ্যোগমূলক কাজ করার অনুপ্রেরণা জোগায় (যেমন, নগর-পরিষ্কারকরণ, বৃক্ষরোপণ ও বাগান করা ইত্যাদি)। ঢাকা শহরজুড়ে প্রতিদিন গড়ে ৩০০-৪০০ জন সেবাদানকারী ডিজিটাল মানুষ-এর প্লাটফর্ম ব্যবহার করে কাজ পাচ্ছে। অন্যদিকে সাধারণ মানুষ বিনামূল্যে যথাযথ সেবা গ্রহণ করার মাধ্যমে অর্থ ও মূল্যবান সময় সঞ্চয় করতে পারছে। ৯ হাজারেরও বেশি পরিবার ডিজিটাল মানুষ অ্যাপ ব্যবহার করছে। আপনার এলাকায় আরও নতুন শ্রমজীবীর তথ্য সংগ্রহে এই অ্যাপ সংশ্লিষ্টরা কঠোর পরিশ্রম করে যাচ্ছে। যাতে আপনারা আরও অধিক সুবিধা ও সেবা পেতে পারেন। এর জন্য তারা অ্যাপটির ব্যবহারকারী ও সেবাদাতার কাছ থেকে কোনো অর্থ নিচ্ছে না। কারণ আপনাদের সন্তুষ্টিই তাদের অনুপ্রেরণা জোগায়।

ডাউনলোড লিংক: https://goo.gl/xiXZGR

 

 যেভাবে ব্যবহার করবেন অ্যাপটি

আপনার হাতের স্মার্টফোনটি দিয়ে খুব সহজেই ব্যবহার করতে পারবেন অ্যাপটি। শুরুতেই অ্যাপটি ডাউনলোড করে আপনার মোবাইলে ইনস্টল করুন। এরপর নিম্নের ধাপগুলো অনুসরণ করুন—

♦  অ্যাপের প্রথম পাতায় প্রবেশ করুন। স্টার্ট অপশন চাপুন

 

♦  দ্বিতীয় পাতায় সূচি থেকে আপনার কাঙ্ক্ষিত সেবাটি নির্বাচন করুন

 

♦  কাঙ্ক্ষিত সেবাতে প্রবেশ করার পর আপনার বাসস্থানের এলাকা নির্বাচন করুন

 

♦  এরপর সেই এলাকায় আপনার সেবা প্রদানকারী শ্রমজীবী মানুষ নির্বাচন করুন

 

♦  অবশেষে আপনার কাঙ্ক্ষিত শ্রমজীবী মানুষের সঙ্গে ফোন করে যোগাযোগ করুন

 

♦  কাজ শেষে রিভিউ দিতে পারেন

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর