শনিবার, ২২ জুলাই, ২০১৭ ০০:০০ টা
নাজমুন আরা সুলতানা

বিচারালয়ে ৪২ বছর

বিচারালয়ে ৪২ বছর

বাংলাদেশের ইতিহাসে তিনি প্রথম নারী বিচারপতি। সফলতার সঙ্গে শেষ করেছেন দীর্ঘ ৪২ বছরের বিচারিক অধ্যায়। সদ্য অবসরে গিয়ে প্রথম সাক্ষাৎকার দেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে। কথায় কথায় উঠে আসে স্মৃতিবিজড়িত নানা ঘটনা। বিস্তারিত জানাচ্ছেন—  আহমেদ আল আমীন ও তানিয়া তুষ্টি ছবি—রাফিয়া আহমেদ

 

বাবার স্বপ্ন ছিল ব্যারিস্টার হবে সন্তানদের কেউ। আদালতে লড়বে ন্যায়বিচারের জন্য। ব্যারিস্টারি পড়ার সামর্থ্য না থাকায় আইনজীবী হয়ে আদালত অঙ্গনে প্রবেশ করলেন মেয়ে। এরপর একের পর এক ইতিহাস। দিনে দিনে সেই মেয়েটি পরিণত হলেন এক লিজেন্ডে। তিনি বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা। বাংলাদেশের বিচার বিভাগে প্রথম নারী বিচারক। সুপ্রিম কোর্টের হাই কোর্ট ও আপিল বিভাগেও প্রথম নারী বিচারপতি তিনি। ৪২ বছরের বিচারিক জীবনের সমাপ্তি ঘটেছে ৭ জুলাই। বর্তমানে তিনি অবসরে।     

নাজমুন আরা সুলতানা একজন সফল নারীর নাম। আলোকিত এই কীর্তিমান মানুষটি স্বমহিমায় ভাস্বর। চলন ও কথনে বিনয়ী। মেধা ও মননে সাধারণের চেয়ে একটু আলাদা। বিশেষভাবে এদেশের বহু নারীর জন্যই অনুপ্রেরণার উৎস। আলোর দিশারী।   

জন্ম ১৯৫০ সালের ৮ জুলাই। চৌধুরী আবুল কাশেম মঈনুদ্দীন ও বেগম রশীদা সুলতানা দীনের পাঁচ সন্তানের মধ্যে তিনি তৃতীয়। ব্যবসায়ী বাবার হঠাৎ মৃত্যু। পৈতৃক নিবাস মৌলভীবাজার ছেড়ে সপরিবারে চলে আসেন ময়মনসিংহ নানাবাড়িতে। সন্তানদের লালন-পালন করতে মা একটি স্কুলে শিক্ষিকার চাকরি নেন। স্বাভাবিক পড়াশোনা শেষে বাবার স্বপ্নপূরণে আইন শাস্ত্র অধ্যয়ন। মায়ের উৎসাহে ১৯৬৯ সালে ময়মনসিংহ ল কলেজে ভর্তি। মফস্বল শহরে ল-এর ক্লাস হতো সন্ধ্যায়। বাসায় ফিরতে রাত ৯টা বেজে যেত। মায়ের উৎসাহ আর অনুপ্রেরণায় তিনি পড়ালেখা চালিয়ে যান। বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা বলছেন, ‘বিধবা মায়ের পক্ষে বিদেশে পাঠিয়ে কোনো সন্তানকে ব্যারিস্টারি পড়ানো সম্ভব ছিল না। সে জন্য দেশে আইন বিষয়ে পড়াশোনা করি।’

‘মেয়েরা আবার উকিল হয় নাকি! এই মেয়ে ওকালতি করবে?’ মানুষের এমন কথাও শুনতে হয়েছে তাকে। আবার নারী আইনজীবী হিসেবে আদালতের কাছ থেকে বিশেষ সুবিধা পাবেন, এমন বিশ্বাসেও অনেকের মামলা আসত তার কাছে। আগে না গেলেও আইনজীবী হিসেবে ১৯৭২ সালের জুলাইয়ে আদালতপাড়ায় প্রথম পা রাখা। বিচারকাজ শুরু হলে আদালতে তিনি মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনতে থাকেন। নাজমুন আরা সুলতানার মনে সেদিনই জজ হওয়ার স্বপ্ন উঁকি দেয়। তবে মেয়েদের জজ হওয়ার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা থাকায় কিছুটা আশাহতই হয়েছিলেন। পরে সে নিষেধাজ্ঞা উঠে যায়। তিনি জজ হিসেবে নিয়োগ পেতে আবেদন করেন। বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমে ১৯৭৫ সালের ২০ ডিসেম্বর দেশের প্রথম নারী মুনসেফ (সহকারী জজ) হিসেবে যোগ দেন। প্রথম নারী জজ হিসেবে তাকে দেখতে আদালতে হুমড়ি খেয়ে পড়ত মানুষ। ‘আমার বিচারক হওয়াটা অনেকটাই কাকতালীয়। শ্বশুরবাড়ি খুলনায় ছিলাম। একদিন মায়ের অসুস্থতার খবরে ময়মনসিংহ যাই। সেখানে বাসার চিঠির বাক্স খুলে দেখি জজ নিয়োগ পরীক্ষার প্রবেশপত্র! পাঁচ থেকে ছয় দিন পরেই ১২০০ নম্বরের পরীক্ষা। তখন একদিকে যেমন পুলকিত হন অপরদিকে চিন্তায় পড়ে গেলেন এত অল্প সময়ে কীভাবে প্রস্তুতি সম্পন্ন করবেন। কিন্তু জজ হওয়া তো তার অনেক বড় স্বপ্ন। সময় কম পেলেও ঠিকই পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হলেন। ‘তখন মনে হয়েছিল ওই সময় ময়মনসিংহ না গেলে হয় তো আমার বিচারক হওয়াই হতো না। আল্লাহ আমাকে খুলনা থেকে টেনে এনে বিচারকের চেয়ারে বসিয়েছেন।’ মৃদু হাসির সঙ্গে কথাগুলো এভাবেই বলছিলেন বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা।

আইনজীবী হিসেবে পেশাজীবন শুরুর পর অধিকাংশ মানুষ বিষয়টি ভালোভাবে নিতে পারেনি। এমনকি বাড়িতে এসেও অনেকে কথা শুনিয়েছে। জজ হওয়ার পরও একই পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছে। সহকর্মীদের মধ্য থেকেও নানা কথা এসেছে। তবে অধিকাংশই সহযোগীর ভূমিকা রেখেছেন। এমন আচরণে সাময়িক ব্যথিত করলেও কোনো সমালোচনাই নাজমুন আরা সুলতানার গতিরোধ করতে পারেনি। তার ভাষ্য, ‘বিচারক হিসেবে আইন পেশায় আমার আসার অনুভূতি ছিল অসাধারণ। চাপ ছিল, চ্যালেঞ্জ ছিল। অনুভব করতাম, আমি ব্যর্থ হলে এর ‘দায়ে’ বিচার বিভাগে নারীর অগ্রযাত্রা বাধাগ্রস্ত হবে। আজ ৪০০ নারী বিচারক দেখে আমি তৃপ্ত হই।’

জজ হিসেবে যোগদান করার পর মানসিক চাপ বেড়ে যায়। আবার প্রথম সন্তান ছিল ছোট। বদলির চাকরিতে সাহায্য করার তেমন কেউ ছিল না। সবকিছু সামলাতে বেশ বেগ পেতে হয়েছে তাকে। তবু দায়িত্ব থেকে সরে আসেননি, কাজ করেছেন সঠিকভাবে।

বিচারিক জীবনের একটি ঘটনা নাজমুন আরা সুলতানাকে এখনো নাড়া দেয়। তখন তিনি কুমিল্লা জেলা জজ। বিকালে বেড়াতে নিয়ে প্রথম স্ত্রীকে রড দিয়ে পিটিয়ে হত্যা। সন্তানসহ লাশ রাস্তার ধারে জঙ্গলে রেখে দ্বিতীয় স্ত্রীর সঙ্গে রাতযাপন। ঝড়ের রাত পেরিয়ে পরদিন সকালে মৃত সেই মায়ের বুকের দুধ খাচ্ছে অবুজ শিশু। পথচারীর চোখে পড়ে এমন দৃশ্য। আদালতে সাক্ষ্য দিতে গিয়ে উদ্ধারকারী সেই পথচারীর যে কী কান্না! এমন আরও ঘটনা আছে বিচারক নাজমুন আরা সুলতানার অভিজ্ঞতার ঝুলিতে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় প্রতিবেশীকে ফাঁসাতে নিজের ছেলে হত্যার বিচারও হয়েছে তার আদালতে।

বিচারের সময় নারী হিসেবে কখনো তার মাতৃহৃদয় কেঁপে বা কেঁদে উঠেছে কিনা, এমন প্রশ্নে বিচারক নাজমুন আরা সুলতানার স্বাভাবিক জবাব, ‘আমি নারী বা পুরুষ নই। বিচারকের আসনে শুধুই বিচারক। আইন ও প্রমাণ অনুযায়ী রায় হয়েছে। জেনেবুঝে কখনো ভুল বিচার করিনি।’ বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানার অর্জনের ঝুলিতে আছে ফতোয়া, বেগম খালেদা জিয়ার বাড়ি, ষোড়শ সংশোধনী, ১০ বিচারপতির নিয়োগ ও মানবতাবিরোধী অপরাধ সংক্রান্ত মামলা। এর মধ্যে হাই কোর্টে ফতোয়া বাতিলের রায়টি বেশি আলোচিত।

একজন সচেতন ও জ্যেষ্ঠ নাগরিক হিসেবে দেশ নিয়েও তিনি ভাবেন। দেশের রাজনীতিটা যদি আরও সহিষ্ণু ও উদার হতো। আর দেশে কোনো দুর্নীতি ও অনিয়ম যদি না থাকত। দেশে আইনের শাসনের ভবিষ্যৎ চিত্র আরও সমুজ্জ্বল হবে বলেও তিনি আশা প্রকাশ করেন। বিচারক নিয়োগে আইনের পক্ষেই তার অবস্থান। তার মতে, দলীয় প্রভাবের বাইরে বিচারক নিয়োগ দিতে হবে। আর বিচারককে সৎ, সাহসী ও সুবিবেচক হতে হবে। কোনো নারী এই পেশায় আসতে চাইলে অবশ্যই ত্যাগের মানসিকতাসম্পন্ন হতে হবে।

অনেক বেশি দায়িত্ববোধ আর চাকরির সুবাদে সামাজিক অনুষ্ঠানাদিতে যোগ দেওয়ার কথা ভাবতেও পারতেন না। খুব কাছের মানুষজন এবং ঘরোয়া আয়োজনে গিয়েছেন। আর দশজন সাধারণ নারীর মতো সামাজিক আচার পালন ও উৎসব আনন্দ থেকে নিজেকে দূরে রেখেছেন পুরোটা জীবন। আর সবই করতে হয়েছে চাকরির স্বার্থে।

অফিসের দায়িত্ব পালন শেষে বাসায় ফিরে অল্প সময় বিশ্রাম। তারপর সন্ধ্যা থেকে বসে যেতেন নথিপত্র নিয়ে। হাজারো কাগজপত্রের কাজ আর আইন বিষয়ে পড়াশোনা থাকত। তাই নিজের জন্য সময় পেতেন খুবই অল্প। কিন্তু ব্যস্ততায় নিজের মাতৃত্বরূপকেও দিয়েছেন পূর্ণতা। কাজী নূরুল হক ও নাজমুন আরা সুলতানা দম্পতির দুই ছেলে কাজী সানাউল হক উপল ও কাজী এহসানুল হক সূর্য। দুজনেই ইঞ্জিনিয়ার। বড় ছেলে উপল অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী আর মায়ের কাছেই থাকেন ছোট ছেলে সূর্য।

বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানার শখ বাগান করা। বাসার ছাদের ওপরে আছে রকমারি সবজি বাগান। বাসার সামনে ও নিচে আছে নানা রকম ফুলের গাছের সমাহার। অবসরে এদের সান্নিধ্যেও সময় কাটে তার। আর মেতে ওঠেন নাতনি আনিয়ার সঙ্গে খুনসুটিতে। প্রকৃতি তাকে খুব টানে। সময় পেলেই ছুটে যান সাগর কিংবা পাহাড়ে। এখন ভাবছেন বই বা আত্মজীবনী লেখার কথাও।

তিনি বলেন, ‘কর্মজীবনে কাজের মধ্যেই থেকেছি। অফিসে, বাসায় সব জায়গায়। তাই সময়টাও দ্রুত কেটেছে। তবে শেষ পর্যায়ে এসে বিধিনিষেধের বেড়াজাল থেকে বের হওয়ার বাসনায় অবসরের দিন গুনতাম। কিন্তু শেষ দিন সবাইকে ছেড়ে আসতে খুব খারাপ লেগেছে। খানিকটা ইমোশনাল হয়ে পড়েছিলাম।’

বাবার স্বপ্নের সঙ্গে মিলে তার এইম ইন লাইফ একাকার হয়ে গেছে। একটাই আক্ষেপ, বাবাটা যদি আজ বেঁচে থাকত! তিনি যে দেখে যেতে পারলেন না!

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর