শনিবার, ২২ জুলাই, ২০১৭ ০০:০০ টা

পড়ন্ত বিকালে ধুনটের ঘোড়দৌড়

মোহাম্মদ সুজন

পড়ন্ত বিকালে ধুনটের ঘোড়দৌড়

গ্রামের ধানখেতই যেন বিশাল খেলার মাঠ। মাঠের মধ্যে কলাগাছ পুঁতে পাটের রশি ও বিভিন্ন রঙ্গিন কাগজ কেটে রশির সঙ্গে লাগিয়ে গোলাকার একটি জায়গা চিহ্নিত করা। মানুষজনও গোল হয়ে বসা, কেউবা দাঁড়িয়ে। দৃষ্টি সবার একদিকেই। মাঠের মাঝখান দিয়ে চলছে ঘোড়া। চলা নয়, এ তো প্রাণপণ ছোটা। পিঠে সওয়ারি, থামলেই চাবুকের ঘা। ছুটছে ঘোড়া। ধিরে ধিরে বাড়তে থাকে গতি। এরই নাম ঘোড়দৌড়। শীতের মাঝামাঝি মৌসুমে গ্রাম এলাকার আকর্ষণীয় গ্রাম্য বিনোদন। এই সময় গ্রামের চাষ করা খালি ধানখেতে বসে ঘোড়দৌড়ের আসর। এলাকার নারী-পুরুষ সব বয়সী দর্শক হাজির হয় মেলা মাঠে। খেলা শুধু ঘোড়াকে নিয়ে। সঙ্গে মেলাও জমে ওঠে। দিনে পড়ন্ত বিকালে ঘোড়দৌড়। আর শেষ দিনে চলে বাউল গান, জারি গান, ভাটিয়ালী গান, যেমন খুসি তেমন সাজো, কৌতুক ও গ্রামীণ যাত্রাপালা। গ্রামাঞ্চলে ঘোড়দৌড়ের এমন আয়োজন কমে গেলেও বগুড়া ধুনট উপজেলার নয়া উল্লাপাড়া গ্রামের উদ্যোগে প্রতিবছর শীত মৌসুমে ঘোড়দৌড় মেলার আয়োজন করা হয়। ২০১২ সাল থেকে হচ্ছে ঘোড়দৌড় মেলা। প্রতিবছর পৌষ মাস থেকে মাঘ মাসের যে কোনো সময়ে আয়োজন করা হয় ঘোড়দৌড়ের মেলা। আয়োজক বলতে গ্রামের সাধারণ কৃষক। তাদের মিলিত চেষ্টায় সম্পন্ন হয় ঘোড়দৌড় মেলা। প্রায় এক মাস আগেই শুরু হয় প্রচারণা। ঘোড়া, ঘোড়সওয়ার আর ঘোড়া পালকদের অতিথি হিসেবে বরণ করে নেয় গ্রামের মানুষ। মেলা চলাকালে গ্রামে অতিথির সমাদরে থাকেন ঘোড়দৌড়ে অংশ নেওয়া লোকজন।

মেলা আয়োজনে সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন মোস্তাফিজুর রহমান মন্টু। তিনি জানালেন, গ্রামের ঘর প্রতি সাধ্যমতো অর্থসহায়তা নেওয়া হয়। এ থেকেই প্রতিযোগিতার তিন দিনের খরচ মেটানো হয়। খরচ বলতে ঘোড়ার মালিকদের তিন দিনের বাসস্থান ও খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা করা। রাতে ঘোড়দৌড় উপলক্ষে মেলার আয়োজন হলে সেখানে কেনাবেচা থেকে আয়োজকদের বাড়তি আয় হয়।

 

দৌড়ে আসে সাদা, কালো, লাল, হলুদ, চিত্রা হরেক রঙের ছোট বড় ঘোড়া। এসব ঘোড়াকে কেউ ‘ঘোড়া’ বলে ডাকে না। স্বভাব আর চরিত্র ভেদে নাম থাকে নানা রকম। পাল্লে ঠেকাও, পঙ্খিরাজ, সবুজ বাংলা, বাংলার বাঘ, টাইটানিক, বাহাদুর,  রংবাজ, কালিয়া, দুরন্ত, কালাচানসহ নানা নামে তাদের পরিচিতি। ঘোড়দৌড় উপভোগ করতে হাজার হাজার মানুষ ছুটে আসে মাঠে। মাঠে স্থান সংকুলান না হওয়ায় কেউ কেউ গাছের ডালে উঠে উপভোগ করেন এ আয়োজন। প্রথম গ্রুপ ও দ্বিতীয় গ্রুপ এই দুই ধরনের দৌড়ে অংশ নেয় গাইবান্ধা,  গোবিন্দগঞ্জ, রংপুর, বগুড়া, ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, জামালপুর, শেরপুর, গাজীপুর ধুনটের নয়াউল্লাপাড়াসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার ঘোড়সওয়াররা। নিজেকে শ্রেষ্ঠ ও জয়ের লক্ষ্য নিয়ে প্রতিযোগিতায় নামে ছোট বড় প্রায় ৫০টি ঘোড়া। দুরন্ত গতিতে ঘোড়া সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার যেন যুদ্ধে নামেন এসব ঘোড়সওয়ার। প্রতিযোগিতার শুরুতে মাইকে যখন ঘোষণা আসে— ‘আপনারা যারা প্রথম গ্রুপে দৌড়ে অংশ নেবেন তারা ঘোড়া নিয়ে লাইনে এসে দাঁড়ান’। সঙ্গে সঙ্গে দর্শকদের কাছ থেকে ভেসে আছে উল্লাস ও উচ্ছ্বাস। শুরু হয় প্রথম গ্রুপ দৌড় প্রতিযোগিতা। এ সময় আবারও মঞ্চ থেকে মাইকে উপস্থাপক বাদশা মণ্ডল বলেন, প্রথম দৌড়ে নিয়ম ভাঙলে সে ঘোড়া বাতিল, পুরস্কার দেওয়া হবে না। প্রথম গ্রুপে ছয়টি করে ঘোড়া দৌড়ে ৪টি চক্কর হবে। মেলা পরিচালনার কমিটির সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান মন্টু বাঁশিতে ফুঁ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দুরন্ত গতিতে ছুটে চলে ঘোড়ার ঘোড়সওয়াররা। আবারও তখন উপস্থাপকের কণ্ঠে ভেসে আসছে— মাঠের চারদিকে যারা আছেন, তারা নিরাপদ দূরত্বে থাকেন। সর্বোচ্চ গতিতে ঘোড়াগুলো দৌড়াবে। আপনারা চিন্তাও করতে পারবেন না! এসব শুনে আবারও উল্লাসে ফেটে পড়ে  নয়াউল্লাপাড়া মেলা মাঠের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তের হাজারও দর্শক। দাপট আর দৌড়ে দাপট ও চমক নিয়ে উপস্থিত হয় ১৩ থেকে ১৫ বছরের শিশু ঘোড়সওয়াররাও। তাদের কৌশলে ঘোড়ার ক্ষিপ্ত গতি নজরকাড়ে মেলায় আগত অতিথি ও দর্শকদের। প্রথম দাপট দৌড়ে প্রথম হয় একটি তারাকান্দি গ্রামের জামাল মেম্বারের পাল্লে ঠেকাও ঘোড়া। প্রশংসায় ভাসাতে থাকেন অতিথি ও উপস্থিত হাজার হাজার দশর্ক। কয়েকজন তাত্ক্ষণিক অর্থ পুরস্কারও প্রদান করে মো. রাশেদ মণ্ডল নামে ঘোড়সওয়ারকে। তিন দিন পালাক্রমে চলে এই প্রতিযোগিতা।

শেষ দিনে প্রথম গ্রুপ ও দ্বিতীয় গ্রুপ এই দুই ধরনের দৌড়ে জয়ীদের হাতে রঙ্গিন টেলিভিশনসহ আকর্ষণীয় পুরস্কার তুলে দেন মেলার প্রধান অতিথি বীর মুক্তিযোদ্ধা আলহাজ হাবিবর রহমান। উপস্থিত দর্শকদের উদ্দেশে বলেন, গ্রামীণ জনপদের ঐতিহ্য ঘোড়ার দৌড় মেলা শুরু হলো। নানা কারণে ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতা কমে গেছে। তবে এ ধরনের আয়োজন গ্রামীণ জনপদের মানুষকে আনন্দিত করে। প্রথম রাউন্ড দৌড় প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছেন মো. রাশেদের ঘোড়া পাল্লে ঠেকাও, দ্বিতীয় রাউন্ডে আতিকুর রহমানের ঘোড়া পঙ্খিরাজ, তৃতীয় রাউন্ডে আজিজ উদ্দিনের ঘোড়া বাহাদুর। এ ছাড়া মেলায় অংশ গ্রহণকারী সব প্রতিযোগীকে সৌজন্য পুরস্কার দেওয়া হয়। এদিকে মেলার শেষ দিনে ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতা দেখার জন্য ধুনট উপজেলাসহ পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন জেলা থেকে লাখো মানুষের সমাগম ঘটে। নয়াউল্লাপাড়া গ্রামের বাসিন্দা মুসলিম মণ্ডল জানান, মেলাকে ঘিরে প্রতিটি বাড়িতে ১০-৩০ জন পর্যন্ত আত্মীয়স্বজনের আগমন ঘটেছে। এই মেলাকে ঘিরে ঈদের মতোই অত্র অঞ্চলে আনন্দ-উৎসব বিরাজ করে। মেলা কমিটির অর্থবিষয়ক সম্পাদক মো. বেলাল মণ্ডল জানান, আমরা কৃষক আমাদের গ্রামের প্রায় সবাই কৃষক হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে ফসল ফলাই। আমাদের  বিনোদনের জন্যই ঐতিহ্যবাহী এই মেলার আয়োজন। মেলায় কসমেটিকসের দোকান, মিষ্টির দোকান, বেত, বাঁশ, কাঠ ও কুঠির শিল্পসহ সব দোকানপাট বসে। ঘোড়দৌড়ের পাশাপাশি রাতব্যাপী দর্শক শ্রোতাদের মাতিয়ে রাখেন স্থায়ীয় বাউল শিল্পীরা।

সর্বশেষ খবর