শনিবার, ২২ জুলাই, ২০১৭ ০০:০০ টা

বস্তি থেকে ফুটবলের সম্রাট

সাইফ ইমন

বস্তি থেকে ফুটবলের সম্রাট

১৯৯৯ সালে বার্তা সংস্থা রয়টার্স পেলেকে নির্বাচিত করে গত শতকের সেরা ক্রীড়াব্যক্তিত্ব হিসেবে। আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটির বিবেচনায়ও তিনিই গত শতকের সেরা ক্রীড়াব্যক্তিত্ব। ফ্রান্সের বিখ্যাত ফুটবল সাময়িকী ফ্রান্স ফুটবলের গোল্ডেন বলজয়ী ফুটবলারদের ভোটেও পেলেই গত শতকের সেরা ফুটবলার, ইউনিসেফ আর বিবিসির জরিপেও তাই বলছে।

 

কালো মানিকখ্যাত ব্রাজিলের পেলেকে বলা হয় ফুটবলের সম্রাট। ১৯৪০ সালের ২৩ অক্টোবর ব্রাজিলের ত্রেস কোরাকোয়েস শহরের এক বস্তিতে জন্মগ্রহণ করেন পেলে। পেলের পুরো নাম ‘এডসন অ্যারানটিস দো নাসিমেন্ট’। বস্তিতে পেলের বন্ধুরা ডাকত ‘ডিকো’ নামে। ছেলেবেলা থেকেই ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন ছিল পেলের। একদিন সেই স্বপ্ন সত্যি হয়। বস্তির ছেলে হয়েও শতাব্দীর সেরা ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব হিসেবে নিজেকে নিয়ে যান অনন্য উচ্চতায়। গোটাবিশ্ব যাকে নিয়ে উন্মাদনায় মত্ত সেখানে পেলের নিজ দেশ ব্রাজিলে কিন্তু সর্বকালের সেরা খেলোয়াড় নন। বিরল এই সম্মানটি দেওয়া হয় তিনবার ফর্মুলা ওয়ানজয়ী ‘আয়ারটন সেনা’কে।

জুতা পরিষ্কারের কাজ করতেন : দরিদ্র কৃষ্ণাঙ্গ পরিবারে জন্ম নেওয়ায় ছেলেবেলাতেই পেলেকে চায়ের দোকানে কাজ করতে হয়েছিল। এ ছাড়া রেলস্টেশন ঝাড়ু দেওয়ার পাশাপাশি কিছুদিন জুতা পরিষ্কারের কাজও করেছিলেন বিশ্বনন্দিত এই ফুটবলার। ফুটবলে সহজাত প্রতিভা প্রকাশ পায় ছোটবেলা থেকেই ব্রাজিলের আর ১০টা সাধারণ ছেলের মতো বস্তির অলিগলিতে ফুটবল খেলতেন পেলে। কিন্তু ছিল না ফুটবল কেনার টাকা। তাই মোজার ভিতর খবরের কাগজ ভরে বানানো হতো ফুটবল সেই ফুটবল দিয়েই অনুশীলন করতেন তিনি।

দৃষ্টি কাড়েন ওয়ালডেমার ডি ব্রিটোর : গলিতে ফুটবল খেলতে খেলতেই পেলের প্রতিভা একদিন চোখে পড়ে স্যান্টোসের গ্রেট ওয়ালডেমার ডি ব্রিটোর। জীবনের পরিবর্তন শুরু হয় সেখান থেকেই। তখন পেলের বয়স মাত্র ১৫ বছর। ব্রিটোর মাধ্যমে পেলে যোগ দেন স্যান্টোস ক্লাবে। অন্তর্ভুক্ত হন স্যান্টোসের ‘বি’ টিমে। প্রতিভার স্বাক্ষর রাখেন এখানেও। এক বছরের মাথায় স্যান্টোসের মূল দলে সুযোগ পেয়ে যান পেলে। ব্রাজিলের পেশাদার ফুটবল লিগে স্যান্টোসের হয়ে সেবার লিগের সর্বোচ্চ গোলদাতার পুরস্কারটি অর্জন করেন তিনি। এরপরই বিশ্বের বড় বড় ফুটবল ক্লাবগুলোর চোখ পড়ে পেলের ওপর। তাকে নিয়ে রীতিমতো কাড়াকাড়ি পড়ে যায় উইরোপের রিয়াল মাদ্রিদ, জুভেন্টাসের মতো ফুটবল ক্লাবগুলোর মধ্যে। কিন্তু ইউরোপিয়ান ক্লাবগুলোতে পেলের কখনই খেলা হয়নি। এর কারণ হলো ব্রাজিলিয়ান লিগে পেলের পারফরম্যান্স এতটাই নজরকাড়া ছিল যে স্বয়ং ব্রাজিল সরকার আইন করে পেলেকে ব্রাজিলের জাতীয় সম্পদ হিসেবে ঘোষণা করে। এই কারণেই ইউরোপিয়ান লিগে পেলের কোনোদিন খেলা হয়নি।

প্রথম বিশ্বরেকর্ড : ১৯৫৭ সালের ৭ জুলাই পেলে প্রথম দেশের হয়ে আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলার সুযোগ পান। খেলাটি হয় আর্জেন্টিনার বিপক্ষে। কিন্তু সেই ম্যাচে ব্রাজিল আর্জেন্টিনার কাছে ২-১ গোলের ব্যবধানে হেরে যায়। আর ব্রাজিলের পক্ষে একমাত্র গোলটি করেন পেলে। তখন পেলের বয়স মাত্র ১৬ বছর ৯ মাস। সেইসঙ্গে অর্জন করেন আন্তর্জাতিক অঙ্গনের সর্বকনিষ্ঠ গোলদাতার রেকর্ড। এটাই ছিল পেলের প্রথম বিশ্বরেকর্ড। 

পেলের বিশ্বকাপ ফুটবল : ১৯৫৮ সালের বিশ্বকাপে পেলে প্রথম সুযোগ পায় নিজ দেশ ব্রাজিলের হয়ে। তার প্রথম ম্যাচটি ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপক্ষে। কোয়ার্টার ফাইনালে ব্রাজিল মুখোমুখি হয় ওয়েলসের বিপক্ষে। ওই ম্যাচে পেলের করা গোলে ব্রাজিল সেমিফাইনালের টিকিট নিশ্চিত করে। এই গোলটিও ছিল বিশ্বকাপের ইতিহাসে সর্বকনিষ্ঠ খেলোয়াড়ের গোল। পরবর্তীতে ব্রাজিল স্বাদ পায় প্রথম বিশ্বকাপ জয়ের। ১৯৫৮ সালের বিশ্বকাপে ফাইনালে পেলে জোড়া গোল করে ব্রাজিলকে প্রথম বিশ্বকাপ জয়ের স্বাদ দেন। তখন পেলের বয়স মাত্র ১৭। এরপর আরও তিনটি বিশ্বকাপ ফুটবল খেলার সুযোগ পান পেলে। ১৯৫৮ সালে বিশ্বকাপের পর ১৯৬২, ১৯৬৬ ও ১৯৭০-এর বিশ্বকাপে খেলেন পেলে। মোট তিনবার (১৯৫৮, ১৯৬২ ও ১৯৭০) বিশ্বকাপ জয়ের গৌরব অর্জন করেন। তবে ১৯৬২ সালের বিশ্বকাপে ২য় ম্যাচে গুরুতর আঘাত পান তিনি। এই আঘাতই সেবারের বিশ্বকাপ খেলা থেকে ছিটকে পড়েন। কিন্তু সেবার ব্রাজিল ঠিকই বিশ্বকাপ জয় করে। তবে চোটের কারণে দল থেকে ছিটকে পড়ায় পেলে সেই দলের সদস্য কিনা তা নিয়েই বিতর্ক ছিল ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত। ফুটবলের বিশ্ব সংস্থা ফিফা বিশেষ ব্যবস্থায় তাকে ১৯৬২-এর বিশ্বকাপজয়ী দলের সদস্য  ঘোষণা করে। এর মাধ্যমে কোনো দেশের হয়ে পেলে ৩টি বিশ্বকাপ জয়ের কৃতিত্ব অর্জন করে। এরই মাঝে শুধু ১৯৬৬ সালের যে বিশ্বকাপটা ব্রাজিল জিততে পারেনি। তবে সেবার বিশ্বকাপের ১ম ম্যাচেই বুলগেরিয়ার বিপক্ষে গুরুতর আঘাত পেয়ে আহত হন। ১৯৭০ সালের বিশ্বকাপের দলটিকে ব্রাজিলের সর্বকালের সেরা দল হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এই দলটির অন্যতম সদস্য হিসেবে পেলে জিতেন তৃতীয় বিশ্বকাপ শিরোপা। পেলে ছাড়া বিশ্বের আর কোনো ফুটবলারেরই নেই তিনটি বিশ্বকাপ জয়ের সাফল্য।

সংসার জীবন : সংসার জীবনে থিতু হতে পারেননি পেলে। ১৯৬৬ সালে রোজমেরিকে বিয়ে করেন। ১৬ বছর সংসার করেন রোজমেরির সঙ্গে। এরপর ১৯৮২ সালে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায় তাদের। সেই ঘরে এক ছেলে এডসন এবং দুই মেয়ে ক্রিস্টিনা এবং জেনিফারের জন্ম হয়। ১৯৮১ থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত ব্রাজিলিয়ান সুন্দরী মডেল জুজার সঙ্গে চুটিয়ে প্রেম করেন এই কিংবদন্তি। এর দীর্ঘদিন পর ১৯৯৪ সালে পেলে দ্বিতীয় বিয়ে করেন সাইকোলজিস্ট অ্যাসারিয়া লেমসকে। অবশ্য এ ঘরও টিকেনি তার। ২০০৮ সালে তাদের ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। পরে তৃতীয় বিয়ে করেন মার্শিয়া আওকিকে। পেলে তিন ছেলে এবং তিন কন্যা সন্তানের জনক।

১২৮৩ গোল! : পুরো ক্যারিয়ারে পেলে মোট গোল করেছেন ১২৮৩টি। এর জন্য তিনি ম্যাচ খেলেছেন ১৩৬৩টি। গোল করেছেন ১২৮৩টি। তার পা থেকে হাজারতম গোলটি আসে ১৯৬৯ সালের নভেম্বরে। ভাস্কো-দা-গামা ক্লাবের বিপক্ষে ব্রাজিলিয়ান লিগের এক ম্যাচে হাজারতম গোলটি করেন তিনি। সেদিন পুরো বিশ্ব নতুন করে আবিষ্কার করে এই ফুটবল বিশ্বকে। কোনো একক খেলোয়াড় হিসেবে পেলেই একমাত্র হাজার গোল করে বিশ্বরেকর্ড করার গৌরব অর্জন করেন।

সান্তোস : ক্লাব ফুটবলে পেলের শুরু হয়েছিল সান্তোসের বি টিম থেকে এবং তিনি ক্লাব ফুটবলের ক্যারিয়ার শেষ করেন স্যান্টোসের হয়েই। ১৯৫৬ সাল থেকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ১৮ বছরে জিতেছেন ব্রাজিলিয়ান লিগ, কাপ আর আন্তর্জাতিক ক্লাব টুর্নামেন্টের ২৭টি ট্রফি।

নাইজেরিয়ার গৃহযুদ্ধ বিরতি : একটি দেশের গৃহযুদ্ধ বিরতির কারণ ছিলেন পেলে। তাও পেলেকে এক নজর দেখার জন্য! পেলে একবার নাইজেরিয়ায় গিয়েছিলেন।

সে সময় দেশটিতে গৃহযুদ্ধ চলছিল। শুধু পেলেকে দেখার জন্য নাইজেরিয়ার গৃহযুদ্ধে বিবদমান দলগুলো যুদ্ধ বিরতি ঘোষণা করেছিল।

ব্যক্তিত্ব : দেশপ্রেমিক হিসেবে পেলের যথেষ্ট সুনাম রয়েছে। তার প্রমাণ সরকারি নিষেধাজ্ঞার কারণে ইউরোপের লিগে খেলেননি। অথচ অনেক টাকা আয়ের হাতছানি ছিল ইউরোপে। কিন্তু তিনি হাসিমুখেই মেনে নিয়েছেন সরকারি সিদ্ধান্ত। এমনকি ভুলে যাননি শৈশবের দরিদ্রতাও। ব্রাজিলের দরিদ্র শিশুদের সাহায্য করতে খেলোয়াড়ি জীবনেই গড়ে তোলেন বিশেষ ফাউন্ডেশন। আর খেলা থেকে অবসর নেওয়ার পর কখনো ইউনিসেফের বিশেষ দূত, কখনো জাতিসংঘের জলবায়ুবিষয়ক বিশেষ দূত হিসেবে কাজ করেছেন। আবার ব্রাজিলের বিশেষ ক্রীড়ামন্ত্রী হিসেবে সাধ্যমতো চেষ্টা করেছেন গরিব শিশুদের সাহায্যে।

সর্বশেষ খবর