শনিবার, ২২ জুলাই, ২০১৭ ০০:০০ টা

হুুমায়ূনের স্কুল

আলপনা বেগম, নেত্রকোনা প্রতিনিধি

হুুমায়ূনের স্কুল

হুমায়ূন আহমেদ প্রতিষ্ঠিত শহীদ স্মৃতি বিদ্যাপীঠ একটি স্বপ্নের নাম। চারপাশ খোলা মনোরম পরিবেশে তৈরি বিদ্যাপীঠটির অবকাঠামো সৌন্দর্যও যেন চোখে পড়ার মতোই। যে কেউ পরিদর্শনে এসে মুগ্ধ হয়ে পড়েন এর নান্দনিকতায়। চারদিকে বকুল, কৃষ্ণচূড়া আর তেঁতুল গাছ লাগানো। নির্মল বাতাসে ভরে থাকে বিদ্যালয় প্রাঙ্গণ। বিদ্যাপীঠের ঠিক উল্টো দিকেই প্রধান ফটকের সামনে লেখক বকুল গাছ লাগিয়ে তার নামকরণ করেছিলেন বকুলতলা। আর সেখানেই নির্মিত হয় ৪ শহীদের নাম লিখে ‘শহীদ স্মৃতি ফলক’। বিদ্যাপীঠে ঢুকতেই প্রথমে চোখে পড়বে স্মৃতি ফলকটি। নাম ফলকে লেখকের পিতা কুতুবপুর গ্রামের শহীদ ফয়জুর রহমান আহমেদসহ কেন্দুয়া উপজেলার কচন্দরা গ্রামের শহীদ মুখলেছুর রহমান খান, বালিজুরা গ্রামের মুকলেসুজ্জামান ও বারই কান্দা গ্রামের আবদুল লতিফ মাস্টারের নাম রয়েছে। বাবার নামে নামকরণ না করে তিনি দেশের সব শহীদের উৎসর্গ করেই বিদ্যাপীঠের নামকরণ করেন শহীদ স্মৃতি বিদ্যাপীঠ। কবি শামছুর রাহমান সেই স্মৃতি ফলকের উন্মোচন করেছিলেন। স্কুলে যাওয়ার সড়কের নাম করেছেন শহীদ ফয়জুর রহমান সড়ক।

বিদ্যাপীঠের শিক্ষাদান কর্মসূচিও গতানুগতিক থেকে ভিন্ন আঙ্গিকে। এ যেন সত্যি রূপ কথার গল্পের মতোই। মা আয়শা ফয়েজের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করাই ছিল যার প্রথম উদ্দেশ্য। শিক্ষার্থীরা যখন দূর-দূরান্ত থেকে সাইকেল চালিয়ে আসা-যাওয়া করে সেই দৃশ্য যেন দৃষ্টি কাড়ে। বিশেষ করে যেখানে নারীরা এখনো অবহেলিত সেখানে সাইকেলে চড়ে বিদ্যালয়ে আসা-যাওয়া সত্যিই বিরল।

হুমায়ূন আহমেদ পৈতৃক ভিটার অদূরেই ৩ একর জায়গা কেনেন স্কুলের জন্য। স্বপ্নের বিদ্যাপীঠকে বাস্তবে রূপ দিতে ১৯৯৬ সালের ১২ জানুয়ারি ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব আসাদুজ্জামান নূর। এরপর অবকাঠামো নির্মাণ শেষ হয় ২০০০ সালে। পরবর্তীতে সরকারিকরণ নিয়ে জটিলতা থাকায় ২০০৬ সালে সম্পূর্ণ নিজ উদ্যোগে প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তোলা হয়। ১১ বছরে হাঁটি হাঁটি পা পা করে বিদ্যাপীঠে বর্তমানে আছে ৩২৯জন শিক্ষার্থী। বিদ্যালয়টিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরের সুদূর প্রসারী ভাবনা নিয়েই হুমায়ূন আহমেদ বিদ্যাপীঠ নামকরণ করেছিলেন। কানাডার স্কুলগুলোর আদলে বিদ্যাপীঠের ডিজাইন তৈরি করেছিলেন লেখকের দ্বিতীয় স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওন। বিল্ডিংয়ের ১৪টি কক্ষে ৩০ জনের আসন বিন্যাসে এ ডিজাইন করা হয়। বিদ্যালয় থেকে ২০১০ সালে প্রথম জেএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে শতভাগ পাস করে। এতে কিছুটা আশার সঞ্চার হয় শিক্ষক এবং এলাকাবাসীর মাঝে। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৬ সালে ২৯ জন জিপিএ-৫সহ ৬৬ পরীক্ষার্থী জেএসসিতে উত্তীর্ণ হয়। এদিকে ২০১৭ সালে এসএসসি পরীক্ষায় ৬৫ জন অংশগ্রহণ করে ২৫ জন জিপিএ-৫সহ শতভাগ পাস করে। এ অর্জনে কাজ করে যাচ্ছে প্রতিটি শিক্ষকের আন্তরিকতা।

প্রত্যন্ত গ্রাম এলাকা হওয়ায় প্রথমে অনেকের তেমন আগ্রহ ছিল না ছেলে মেয়েদের পড়াশোনার ব্যাপারে। ধীরে ধীরে শুধু নেত্রকোনা নয় পার্শ্ববর্তী কিশোরগঞ্জ জেলার নান্দাইল, ঈশ্বরগঞ্জ, তাড়াইল এবং আঠারবাড়ী এলাকার ছেলেমেয়েরা এখানে পড়তে আসে। বর্তমানে নেত্রকোনার রোয়াইলবাড়ী ইউনিয়নের আশপাশ গ্রামসহ ৪টি উপজেলার ৫৬টি গ্রামের শিশুরা এই বিদ্যাপীঠের শিক্ষার্থী। এ এলাকার ছেলেদের পাশাপাশি মেয়েদের স্কুলে যাওয়ার সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে, যা ছিল অকল্পনীয়।

শিক্ষা কারিকুলামে ১৫ জন শিক্ষক শুধু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা দিয়েই ক্ষান্ত নন। তারা এলাকা ভিত্তিক বাড়ি বাড়ি গিয়ে হোম ভিজিট করে আসেন প্রতি নিয়ত। এতে দরিদ্র এলাকা এবং শিক্ষার হার কম থাকায় শিশুদের সমস্যাগুলো চিহ্নিত হয়। শিক্ষকরা বাড়িতে গিয়ে অনেক ছেলেমেয়েকে পড়ান। বাইরে পড়াশোনা করার সুযোগ না থাকায় এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে নারী শিক্ষার দ্বার উন্মোচন হয়। প্রতি ক্লাসে ষষ্ঠ থেকে ১০ম শ্রেণি পর্যন্ত ৭০ ভাগ মেয়েদের উপস্থিতি লক্ষণীয়। বর্তমানে শিক্ষার মান আরও উন্নত করতে বিদ্যাপীঠে আবাসিক শিক্ষা দেওয়ার প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। কম বেতনে শিক্ষকরা শুধু হুমায়ূন আহমেদকে ভালোবেসে নিরলস সেবা দিয়ে যাচ্ছেন এই প্রতিষ্ঠানটিতে। শিক্ষার্থীরাও কথাসাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদের প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানে পড়ে গর্ববোধ করছে।

প্রতিষ্ঠানটিতে ১২টি কম্পিউটারের একটি ল্যাব রয়েছে। আর্থিক অসঙ্গতি থাকলে শিক্ষার্থীদের ফ্রিতে পড়ার সুযোগ রয়েছে। বৃত্তি, উপবৃত্তি, দরিদ্রতা মিলিয়ে ১৭০ জন রয়েছে, যাদের শিক্ষা খরচ একেবারে ফ্রি। এসব খরচ এবং শিক্ষকদের বেতন-ভাতা বহন করে আসছে হুমায়ূন আহমেদ প্রতিষ্ঠিত নুহাশ পল্লীর আয় থেকে এবং স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওন।

সরকারি সহায়তা না থাকায় কোনো রকমে চলে যাচ্ছে প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম। অথচ নেত্রকোনা জেলার মধ্যে শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানটি কোনো অংশে কম নয়। এমন প্রত্যন্ত অঞ্চলে শিক্ষা বিস্তারে নীরব ভূমিকা রেখে গেলেও আজও এমপিও ভুক্তি করছেন না কর্তৃপক্ষ। যে কারণে অভিজ্ঞ শিক্ষক নিয়োগ করা যাচ্ছে না।

বিদ্যাপীঠের সহকারী প্রধান শিক্ষক শরীফ আহমেদ আনিস বলেন, ‘এমপিওভুক্তি না হওয়ায় শিক্ষক নিয়োগ দিলেও বেশিদিন থাকেন না। অন্যত্র চাকরি নিয়ে চলে যান। স্থানীয় শিক্ষানুরাগী এবং হুমায়ূনভক্ত বলেই অর্ধাহারে-অনাহারে শিক্ষাদান করে যাচ্ছেন। এই অঞ্চলকে দেশবাসীর কাছে হুমায়ূন আহমেদের গ্রামকে শিক্ষিত গ্রাম হিসেবে পরিচিত করাই এখানকার শিক্ষকদের লক্ষ’।

এখন অপেক্ষা সাবির্ক সহযোগিতা পাওয়ার। নিরক্ষরমুক্ত এলাকা গড়তে হয়তো প্রতিষ্ঠানটিই হতে পারে অনন্য উদাহরণ।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর